ডাক্তার ম্যাডাম পর্ব-০১

0
2900

#ডাক্তার_ম্যাডাম
#সূচনা_পর্ব
#মুমতাহিনা_জান্নাত_মৌ

❝ঘটক সাহেব আবার এসেছিলেন বাসায়।এবারের ছেলে একজন বড়সড় ডাক্তার।বিদেশ থেকে ডাক্তারি পাশ করে এসেছে। আমি তোর মতামত না জেনে কি করে হ্যাঁ করি,সেজন্য কিছুই বলি নি,এবার অন্তত রাজি হয়ে যা❞

তানিশা চেম্বারে যাবে বলে তাড়াতাড়ি করে রেডি হচ্ছিলো।তার মা মিসেস শিউলি বেগমের মুখে ডাক্তার ছেলের কথা শুনেও কোনো তোয়াক্কা না করে বাসা থেকে বের হয়ে গেলো তানিশা।
এদিকে তার মা চিৎকার করে বলছে তানিশা কিছু তো বল?উত্তর দিচ্ছিস না কেনো?তুই কি জীবনেও বিয়ে করবি না?এভাবে আর কতদিন?

তানিশা নিজেও জানে না এভাবে আর কতদিন?তবে তারও ইচ্ছা করে সুন্দরভাবে বেঁচে থাকতে।ভালোবাসার মানুষ টাকে সাথে নিয়ে জীবনটাকে সুন্দর করে সাজাতে।কিন্তু যখন সে ভালোবাসার মানুষ টাই নাই তার কাছে তাহলে কাকে নিয়ে সে এমন মধুর স্বপ্ন দেখবে?কার উষ্ণ ভালোবাসায় নিজের জীবন টা আরো রঙিন করবে?
তানিশা মনে করে কাউকে যদি একবার মন থেকে ভালোবাসা যায়,তাহলে তাকে শত চেষ্টা করেও ভোলা যায় না।আর যে চোখের আড়াল হওয়ার সাথে সাথে মন থেকে বের হয়ে যায়,তাকে আর যাই হোক ভালোবাসা বলা যায় না।সেজন্য তানিশা পুরনো ভালোবাসার স্মৃতি নিয়েই বেঁচে আছে এখনো।সেই প্রথম স্পর্শ, সেই প্রথম ভালোবাসার অনুভূতি এতো সহজ এ কি করে সে ভুলতে পারে।এখনো সেসব স্মৃতি চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে ভেসে ওঠে তার।

তানিশা নিজেও একজন এমবিবিএস ডাক্তার।সে বর্তমানে ঢাকা সরকারি হাসপাতালেই গাইনি বিভাগে আছে।তার অনেক বড় ইচ্ছা সে বিদেশ থেকে আরো অনেক বড় ডিগ্রি নিয়ে আসবে।দেশের নাম্বার ওয়ান গাইনিকোলজিষ্ট হবে সে।

চেম্বারে আজ অনেক রোগী এসেছে।কানায় কানায় পূর্ন চেম্বার।এই পরিস্থিতিতে দম ফেলার উপায় নেই তানিশার।ঠিক এই সময়ে ভয়ে ভয়ে এক বয়স্ক মহিলা (রোগীর লোক) তানিশার চেম্বারে ঢুকলো।আর বললো,

❝ডাক্তার ম্যাডাম❞একটা কথা বলতে পারি?

তানিশা আজ অনেক ব্যস্ত।তবুও সে ব্যস্ততার মধ্যেও চোখ তুলে তাকালো,
তানিশার তাকানো দেখে মহিলাটির চোখে মুখে ভয় আরো বেড়ে গেলো।মহিলাটি আমতা আমতা করছে।

তানিশা তখন বললো,জ্বি বলেন।

ম্যাডাম,আমার নাতনী জীবনেও এতো বড় ডাক্তার দেখেনি,তাই আপনাকে দেখতে চায়। সে এবার ক্লাসে এক রোল করেছে।পড়াশোনা করতে ভীষণ পছন্দ করে সে।সেও বড় হয়ে আপনার মত ডাক্তার হতে চায়। তাকে কি একটু আনবো ভেতরে?

তানিশা সাথে সাথে বললো,হ্যাঁ অবশ্যই।

বয়স্ক মহিলাটি কথাটা শোনামাত্র তার নাতনিকে নিয়ে আসলেন।মেয়েটি ভয়ে ভয়ে তানিশার কাছে এগিয়ে আসলো। তার চোখে অবাক বিস্ময় আর খানিকটা সংকোচ। কিন্তু চোখে মুখে শ্রদ্ধার অবয়ব।মনে হচ্ছে সে কোন মহামানব কে দেখছে!এমনভাবে হা করে তাকিয়ে আছে।

মেয়েটি দেখতে একদম পরীর মতো ছিলো। তানিশা দেখামাত্র মেয়েটিকে তার কাছে টেনে নিলো।আর বললো,কি মিষ্টি দেখতে তুমি!
তানিশা এবার মেয়েটির মাথায় হাত দিয়ে বললো, দুআ করে দিলাম। একদিন তুমিও অনেক বড় ডাক্তার হবে।

মেয়েটি সেই কথা শুনে মুচকি হেসে দিলো এক দৌঁড়।তানিশা মেয়েটির নাম জিজ্ঞেস করার ও সুযোগ পেলো না।তানিশা অবাক নয়নে তাকিয়ে রইলো মেয়েটির দিকে।ছোট বাচ্চাদের প্রতি ভীষণ দূর্বল সে।পরিনত বয়সে বিয়ে করলে আজ তারও এমন পরীর মতো মেয়ে থাকতো।

হঠাৎ তানিশার ফোনে রিং বেজে উঠলো। তানিশার মা ফোন দিয়েছে।তানিশা বুঝতে পারলো তার মা কেনো ফোন দিয়েছে।তার মা আবার তাকে সেই বিয়ের কথাই বলবে।সেজন্য তানিশা কল রিসিভ করলো না।তাছাড়া তার এখন এমারজেন্সি একটা সিজারের রোগী আছে।তানিশা সেজন্য তাড়াহুড়ো করে অপারেশন রুমে চলে গেলো।

রোগী কে ইতোমধ্যে অপারেশন বেডে নেওয়া হয়েছে।আইভি ফ্লুইড দেওয়া হয়েছে।এমনকি এনাসথেসিয়াও করা হয়েছে।
কিন্তু তানিশা বেডে শুয়ে থাকা রোগীকে দেখে একদম চমকে উঠলো।তার চোখ যেনো কপালে উঠে গেলো।কারণ এ আর অন্য কেউ নয়।তারই বেস্ট ফ্রেন্ড তন্নি।

তন্নি নিজেও জানতো না তার সিজার তানিশাই করবে।কারন তন্নির হাজব্যান্ড ইকবাল নিজে নিজেই ব্যবস্থা করেছে সব।আর তখনকার সেই মিষ্ট পরীটা হলো তন্নিরই মেয়ে।তানিশা সবচেয়ে বেশি অবাক হলো তন্নির হাজব্যান্ড কে দেখে।কারন তন্নির বিয়ে তো তানিশার প্রেমিকের সাথে হয়েছে।তাহলে এ ছেলের সাথে তন্নির কিভাবে বিয়ে হলো?তানিশার মাথা যেনো মুহুর্তের মধ্যে চক্কর দিয়ে উঠলো।সে এখন মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার মতো অবস্থায় আছে!তার এই বেস্ট ফ্রেন্ড তন্নির জন্যই আজ সে একাকি জীবনযাপন করছে।নিজের ভালোবাসার মানুষ কে ছেড়ে দিয়ে আজ সে এখন পর্যন্ত অবিবাহিতই রয়ে গেছে।

তন্নি ছোটো থেকে তার মামার বাসায় বড় হয়েছে।কারণ তন্নির বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করায় তন্নির মামা মিঃ তায়েব চৌধুরী তন্নি আর তার মাকে নিজের বাড়ি নিয়ে আসেন।আর যেতে দেন নি তন্নিদের।তন্নির দুইজন মামাতো ভাই ছিলো।একজনের নাম ছিলো আমান আর আরেকজনের নাম ছিলো নোমান।

তানিশা আর তন্নি ছিলো বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজের ছাত্রী।
আমান তখন অনার্স কম্পিলিট করে বিসিএসের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলো আর নোমান তখন ঢাকা সরকারি মেডিকেল কলেজের তৃতীয় বর্ষের স্টুডেন্ট ছিলো।আমান অনেক সহজ সরল আর মিশুকে স্বভাবের হলেও নোমান মোটেও তেমন ছিলো না।নোমানের ভীষণ অহংকার ছিলো।ঢাকা সরকারি মেডিকেল কলেজে পড়াশোনা করতো দেখে ভীষণ অহংকার ছিলো নোমানের।অহংকারে মাটিতে যেনো পা পড়ে না তার।

তন্নি ছিলো তানিশার কলেজের একমাত্র বেস্ট ফ্রেন্ড। সেই সুবাদে তানিশা অনেকবার গিয়েছে তার মামার বাসায়।কিন্তু একই বাসাতে থাকার পরও নোমান নিজের থেকে কোনোদিন তানিশার সাথে কথা বলে নি,সেজন্য তানিশাও কথা বলে নি।যদি নোমান আর তানিশা কোনোদিন মুখোমুখি হয়েছে যে যার মতো পাশ কেটে চলে গিয়েছে।তবে আমান সবসময় তানিশার সাথে কথা বলতো।তানিশার পড়াশোনার ব্যাপারে খোঁজখবর নিতো।দুই ভাই ছিলো সম্পূর্ণ দুই টাইপের।

ছোটবেলা থেকেই তানিশারও ভীষণ ইচ্ছা ছিলো সে মেডিকেলে পড়বে,ডাক্তার হবে।
আর হবেই না কেনো, সেই ছোটোকাল থেকে “এইম ইন লাইফ” রচনায় যে লিখে আসতেছে আমি একজন ডাক্তার হতে চাই।ক্লাস টিচার থেকে শুরু করে পাশের বাসার আন্টি যখন জিজ্ঞেস করতো, তানিশা! বড় হইয়া কি হবে?বুক ফুলিয়া তখন বলেছে ডাক্তার হবো।এলাকার সবাই ভালো স্টুডেন্ট বলে জানতো তানিশাকে।তাই সে বড় কোনো সাবজেক্ট এ পড়ালেখা করবে এ নিয়ে সবার বেশ আগ্রহ।

অবশেষে অনেক পড়ালেখা আর প্রতিযোগিতা করে তানিশা ও চান্স পেয়ে গেলো ঢাকা সরকারি মেডিকেল কলেজে।বাবা মা আর আশেপাশের মানুষ জন তো ইতোমধ্যে ❝ডাক্তার ম্যাডাম❞বলে ডাকা শুরু করে দিয়েছে।শুনতে কিন্তু সেইরকম লাগে তার।!খুশির ঠেলায় ডানা মেলে পাখির মতো উড়তে ইচ্ছা করে তার।এতো আনন্দ এখন সে কই রাখে!

আর সবচেয়ে বড় কথা ঢাকা সরকারি মেডিকেল কলেজ এ চান্স পেয়ে সে যে নোমানের সমস্ত অহংকার ধুলিৎসার করতে পেরেছে এর জন্যই সবচেয়ে বেশি আনন্দ হচ্ছে তানিশার।
নোমান নাকি সবসময় তন্নিকে বলে,তোদের মতো স্টুডেন্ট দের নিয়ে আমার ভীষণ টেনশন হয়।তোরা যেভাবে পড়াশোনা করিস আমার তো মনে হয় না ভালো কোনো ভার্সিটিতে তোরা চান্স পাবি।

তন্নি নোমানের এমন কথা শুনে তানিশার ডাক্তার হওয়ার কথা বলে দিয়েছে।নোমান তখন হেসে উড়িয়ে দিয়েছে কথাটা।
মেডিকেলে পড়বে!ডাক্তার হবে!হাসালি আমাকে।ভালো স্টুডেন্ট এর কোনো নমুনায় তো দেখি না ওর মধ্যে।সারাদিন এদিক ওদিক যেভাবে ছুটে বেড়ায় ডাক্তার হওয়া তো দূরের কথা নার্স ও হতে পারবে না।

#চলবে,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে