#ডাকপিয়নের_ছুটি_নেই
#লেখিকা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
#পর্ব____৩৬
সামনের সীটের দরজাটা খুলে ইশা বসতে নিলেই আকস্মাৎ বসে পড়লো মায়া। ইশা চকিতে তাকালো। প্রথমে বোঝার চেষ্টা চালালো কি হলো! যখন ব্যাপারটা উপলব্ধি হলো তখন স্বাভাবিক ভাবেই ভীষণ বিরক্ত হলো। মায়া ওর এই বিরক্তি প্রকাশের অপেক্ষা করছে হয়তো। তবে আশানুরূপ ইশা কিছুই বললোনা। তাই সে নিজেই আগ বাড়িয়ে বলল,
“পেছনের সীটে বসতে আমার একটু অসুবিধা হয়। আশাকরি তুমি কিছু মনে করোনি।;
ইশা স্বাভাবিক গলায় বলল,
“না আপু। কিছু মনে করিনি।;
বলেই দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে পেছনের সীটে গিয়ে বসলো। মায়ার অদ্ভুতুড়ে হাসি আর চোখে পরলো না ইশার। পেছনের সীটে আগে থেকেই তন্ময় বসে ছিলো। ইশাকে বসতে দেখে শুঁকনো হেঁসে বলল,
“পেছনের সীটে ওর একটু প্রবলেম হয়। আপনি কি মাইন্ড করলেন ভাবি?;
“না না ভাইয়া। মাইন্ড করিনি।;
“বাই দ্য ওয়ে আমি অনেক ভালো ড্রাইভ করি। আসার টাইমে কিন্তু আমিই ড্রাইভ করে নিয়ে এসেছি।;
ইশা ভাবান্তর দৃষ্টিতে তাকালো তন্ময়ের পানে। তন্ময় কিছু একটা ইঙ্গিত করেছে। তবে সেটা বুঝতে ইশার বেশি বেগ পেতে হয়নি। আসার সময়ে তন্ময় গাড়ি চালিয়েছে, শ্রাবণ নয়। অর্থাৎ প্রত্যাশিত হলেও শ্রাবণের পাশের সীট মায়ার জন্য বরাদ্দ ছিলোনা।
গাড়ির দরজার কাচে টোকা পড়লো। তন্ময় পেছন মুড়ে তাকালে তার সাথে সাথে ইশাও তাকায়। শ্রাবণ বাইরে দাঁড়িয়ে হাত নাড়ছে। তন্ময় তড়িঘড়ি গাড়ির দরজা খুলে দিলো। প্রশ্নবিদ্ধ মুখে শ্রাবণের পানে তাকালো।
“আরেকটা রাইড হয়ে যাক?;
তন্ময় প্রফুল্ল হয়ে উঠলো। চোখ ঝাপটে বলল,
“সেকেন্ড চান্সটা মিস করতে চাইনা!;
বলেই বেরিয়ে গেলো। তন্ময় বের হতেই শ্রাবণ বসে পড়লো ইশার পাশ ঘেঁষে। ঠিক তখনই সামনে থেকে মায়ার গলাটা ভেসে এলো,
“আবার তন্ময়! নো ওয়ে;
“কেন আপু, ভাইয়া কি ভালো ড্রাইভার নয়?;
“ওর সাথে রিস্ক মনে হয়।;
ইশা বিরক্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো। শ্রাবণ বিষয়টা লক্ষ্য করে মায়ার উদ্দেশ্যে বলল,
“দু’টো দিন বউকে ছাড়া থেকেছি! আর পারছিনা, সরি মায়া।;
মায়ার মুখটা নিভে গেলো। বিরস গলায় বলল,
“গাড়ি চালানোর সাথে বউকে ছেড়ে থাকার কি সম্পর্ক?;
“এই যে, লম্বা গ্যাব।;
হাত দিয়ে মেপে দেখালো শ্রাবণ। মায়ার ভেতরটা ঝলসে গেলো ঠিকই। ইশা হাসলো মনেমনে। শ্রাবণ মায়াকে দেখিয়েই ইশার কোমর জড়িয়ে কাছে টেনে আনলো। অতঃপর বাহু আগলে ইশার চোখে চোখ স্থীর করে বলল,
“দূরত্ব তখনই সহ্যের, যখন দীর্ঘ প্রতিক্ষার পরে এই মুখখানাই বারবার দেখতে পাই। প্রতিক্ষা তখনই আনন্দের, যখন কাঙ্ক্ষিত সুখগুলো তুমি হয়ে ধরা দাও।;
ইশার চোখেমুখে মুগ্ধতা খেলে গেলো। মৃদু হেসে নির্দ্বিধায়, নিঃসংকোচে লেপ্টে গেলো শ্রাবণের বুকে। মায়া দেখলো, পুড়লো, কয়লা হলো তাতে ইশার কিছুই যায় আসলোনা।;
চোখ বন্ধ করতেই ইশার চোখের তাঁরায় ধরা দেয় একটা ছোট্ট ঘটনা। ওদের রিসেপশনের দিনেও গুণে গুণে তিনখানা চিঠি এসেছিলো শ্রাবণের নামে। কুরিয়ার বয় দরজার সামনে এসে দাঁড়াতে আরবের সাথে দেখা হলো। আরব লোকটাকে দেখে ‘কাউকে খুঁজছেন?; প্রশ্ন করলে জবাব দেয় লোকটা,” শ্রাবণ খান আছেন? উনার নামে চিঠি আছে” আরব ভাবুক গলায় জবাব দিলো, “আছে, আজকে তার বউভাত, আমি তার ভাই! আপনি এগুলো আমাকে দিন”
লোকটার থেকে চিঠি নিয়ে আরব চলে যায় ভেতরে। বরাবরের মতোই আজও চিঠি দিতে শ্রাবণকে পেলোনা আরব। যার দরুণ বরাবরের মতোই সোজা চলে যায় শ্রাবণের ঘরে। আলমারিটা খুলে চিঠি দু’টো রেখে দেয় আগের জায়গায়। চিঠি রেখে যাওয়ার সময় ঘরের সামনে থেকেই দেখা হয়ে যায় ইশার সাথে।
“কাউকে খুঁজছো ভাইয়া?;
“ভাইয়ার নামে চিঠি এসেছে। ওকে না পেয়ে আজও আমিই রেখে গেলাম!;
চিঠির কথা শুনতেই ভেতরটা মুচড়ে উঠলো ইশার। পরক্ষণেই কপাল কুঁচকে তাকালো ইশা। শুধালো,
“মানে?;
“হ্যাঁ, আগেও তো অনেক চিঠি পেয়েছি! তবে ভাইয়াকে পাইনি। তাই ভাইয়াকে না জানিয়েই রেখে যেতে হলো।;
এই বলে আরব চলে যেতে নিলে পিছু ডাকে ইশা। কৌতুহল নিয়ে জানতে চায়,
“শ্রাবণ ভাই কখনোও দেখেছে এই চিঠিগুলো?;
আরব ভাবুক গলায় বলল,
“মনে তো হয়না!;
“তুমি বলোনি দেখতে?;
“একবার বলেছিলাম, ভাইয়া বলল জমিয়ে রাখ, একদিন সব একসাথে পোড়াবো!;
চলে যায় আরব! ইশাও চলে আসে রুমের ভেতরে। শ্রাবণকে জানায়না। নিজেই আলমারি খুলে বের করে আনে একগাদা চিঠি। আর কিছু না ভেবে সবগুলো চিঠিই পুড়িয়ে ফেলে নিজের হাতে।
“ভাই, এমারজেন্সি বিয়ে করতে চাচ্ছি।;
ইশার ধ্যান ভাঙে। সামনে থেকে ভেসে আসে তন্ময়ের গলা। শ্রাবণ সন্দিহান গলাতে বলল,
“বিয়ে আর তুই! আমি কি ঠিক শুনেছি।;
“ঠিকই শুনেছিস, তোদের এমন সফ্টি সফ্টি প্রেম দেখে নিজেকে বড়ই এতিম ফিল হচ্ছে। টিকে থাকতে পারছিনা।;
“শালা, তোর তো নজর ভালোনা।;
“পারছিনা ভাই। না চাইতেও নজর চলে যাচ্ছে।;
আরও টুকটাক কথা চললো বেশ খানিকটা সময়। ততক্ষণে একবারের জন্যেও শ্রাবণের বুক থেকে মাথা তোলেনি ইশা। সামনের লুকিং গ্লাস থেকে পেছনের সবটাই দেখা যায়। মায়া প্রতিটি সেকেন্ড কেবল ওদেরই পর্যবেক্ষণ করে গেছে। না কথা বলেছে, না চোখ সরিয়েছে।
তন্ময় আর মায়াকে বাসায় নিয়ে আসলো শ্রাবণ। তন্ময় আসতে চাচ্ছিলোনা একদমই। আর এর কারনটা অবশ্যই মায়া। তন্ময় শ্রাবণের খুব কাছের ফ্রেন্ড হলেও মায়ার সাথে তার বন্ধুত্ব বেশ জোরালোই ছিলো। তবে যেদিন থেকে তন্ময় জানতে পারে মায়া শ্রাবণকে পছন্দ করে, সেদিন থেকেই তন্ময় সাবধান হয়ে যায় মায়ার ব্যাপারে। মায়ার জন্য শ্রাবণের জীবনে কোনো বিপত্তি এলে সে মানতে পারবেনা। কারন, শ্রাবণ বরাবরই ভালোবাসার ব্যাপারে ভীষণ সেনসিটিভ। সে ইশাকে ছোট বেলা থেকেই ভালোবাসে। আর সে কখনো চাইবেনা কেউ এসে তাদের মাঝে তৃতীয় ব্যক্তির নাম কুড়িয়ে নিক। তাই আজ যখন বন্ধু মহলে শ্রাবণের নাম উঠলে, তখন তন্ময় বারবার করে শ্রাবণের বিষয়টা পাল্টে অন্য বিষয়ে কথা বলতে আগ্রহ দেখিয়েছে। কারন সে জানে, মায়া আজও শ্রাবণকে আগের মতোই চায়।
তানিকে নিয়েও সবে সবে বাসায় ফিরলো আরব। শ্রাবণ ইশাকে নিয়ে এলে আরব একাই চলে যায় তানিকে আনতে। তানি বাসায় ফিরে শ্রাবণকে দেখতে আমোদে আটখানা হয়ে গেলো। দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে বসে রইলো অনেক্ষণ। ফের নাক টেনে টেনে বাচ্চাসূলভ গলায় কত যে গল্প। মায়াকে দেখে চোখ কুঁচকে তাকালো তানি। মুখ বেঁকিয়ে মায়াকে ঘুরেফিরে দেখতে লাগলো। মায়াও দেখছে তানিকে। মায়া কিছু জিজ্ঞেস করবে তার পূর্বেই তানি ইশার গা ঘেঁষে ফিসফিসিয়ে বলে উঠলো,
“এই মেয়েটা কে রে আপা। কেমন করে তাকিয়ে থাকে ভাইয়ার দিকে?;
“তোর ভাইয়ার বন্ধু;
তানির কুঁচকানো মুখটা আরও কুঁচকে গেলো। এই জবাবে ও সন্তুষ্ট নয়। ভাইয়ার বন্ধুকে পছন্দ হয়নি তানির। নীচে সবার গলা পেয়ে উড়তে উড়তে এলো তুতুন। তিতিরও এলো। এবার বেশ কিছু দিন যাবতই এ বাড়িতে রয়েছে তিতির।
সবাইকে দেখে ক্রমশ কৌতুহল বাড়ছে মায়ার। ধীরপায়ে এগিয়ে গেলো শ্রাবণের পাশে। সবাইকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করলো,
“এরা সবাই তোর বোন নাকি?;
মায়ার প্রশ্নে ইশা সহ সবাই তাকায় মায়ার পানে। এমনকি তন্ময়ও। যেন অস্বাভাবিক কোনো প্রশ্ন করেছে সে। শ্রাবণ হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ে। অতঃপর বলে,
“হ্যাঁ, পরিচয় করিয়ে দেই। ও হচ্ছে তিতির, ও হচ্ছে তানি আর ইনি হচ্ছেন আমাদের সবার প্রিয় তুতুনপাখি।;
মায়া মৃদু হাসে। শ্রাবণ এবার বোনদের উদ্দেশ্যে বলে,
“আর ও হচ্ছে মায়া, আমার ক্যাম্পাসের সবচেয়ে গুড ফ্রেন্ড।;
মায়ার মুখটা নিভে গেলো এমন করে পরিচিতি পেয়ে। গুড ফ্রেন্ড? জাস্ট?
“হ্যালো মায়া আপু।;
“হাই;
তিতির আর তুতুন হাই জানালো মায়াকে। মায়া জোরপূর্বক হেসে হাত নাড়লো।
“আর ওকে তো সবাই চিনোই।; তন্ময়কে দেখিয়ে।
তুতুন বলে উঠলো,
“আমি তো চিনিনা।;
তুতুনের কথায় হেসে উঠলো সবাই। তন্ময় এগিয়ে এসে তুতুনের গাল টেনে বলল,
“হাই তুতুনপাখি। আমি তন্ময়। নাম তো শুনাহি হোগা।;
তন্ময়ের শ্যামসুন্দর গায়ের রঙ। সুঠাম দেহ। ঠোঁটে মিষ্টি হাসির রেখা। বড় বড় নেত্রদ্বয়। তুতুন সবটা পর্যবেক্ষণ করে বলল,
“হাই তন্ময়। আমার নাম তুতুন। আমি ক্লাস নাইনে পড়ি।;
তুতুনের পরিচয় পেয়ে চমৎকার হেসে উঠলো তন্ময়। পরক্ষণেই কপাল চাপড়ে বলল,
“এই যাহ! আমি তো কোনো ক্লাসেই পড়িনা।;
তন্ময়ের বলার ভঙ্গিতে খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো তুতুন। তন্ময় পূনরায় ওর গাল টেনে বলল,
“তোমার হাসিটা তো ভীষণ সুন্দর তুতুনপাখি। এমন চমৎকার হাসি তুমি কোথা থেকে শিখলে।;
তুতুন লজ্জা পাওয়া চোখে তাকালো। এর প্রতিত্তোরে কিছু বলতে পারলোনা।
#চলবে
#ডাকপিয়নের_ছুটি_নেই 🌼
#লেখিকা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
#পর্ব______৩৭.
“তুমি জানো, শ্রাবণের কাছে আমার দুই হাজার একশ আট খানা চিঠি আছে!;
মায়ার চতুরতা দেখে মৃদু হাসলো ইশা। শ্রাবণ দু’দিন পর বাড়ি ফেরাতে বাড়ির পরিবেশটা ঈদের চেয়ে কিছু কম নয়। ভাই বোনদের হুল্লোড়, বড়দের আনন্দ। সব মিলিয়ে ত্রিশটা রোজার পরে ঈদের আনন্দটাই উপলব্ধি হচ্ছে ইশার। তাই সেই আনন্দ আরও একটু প্রগাঢ় করতে ইশা আজ প্রথমবারের মতো রান্না ঘরে ঢুকেছে। অবশ্য বিয়ের পর এই প্রথম। বিয়ের আগে টুকটাক অনেক রান্নাবান্নাই করেছে ইশা। সন্ধ্যার নাস্তা বানাবে ও। মায়া অনেক ভালো রাঁধতে পারে এই বলে সেও এলো ইশাকে হেল্প করতে। তবে ইশা প্রথমেই বুঝেছিলো, মায়া ওকে হেল্প করার জন্য আসছেনা। মনেমনে অবশ্যই অন্য বদ চিন্তা আছে মায়ার।
“তোমার খারাপ লাগলোনা শুনে?;
ইশার হাসি মায়াকে আশাহত করলো। মায়ার উদ্দেশ্য সফল হলোনা বুঝতেই অবাক গলায় জিজ্ঞেস করলো কথাটা। ইশা ময়দা মাখাচ্ছে। হাতটা মাখোমাখো হয়ে আছে পানি যুক্ত ময়দায়। সেই হাতটা তুলে মায়ার সামনে ধরতেই ভয় পেয়ে সরে গেলো মায়া। ইশা সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে পূর্বের হাসি ঠোঁটের কোনে এঁটে রেখেই বলল,
“না গো, যদিনা তোমার পাঠানো চিঠি গুলো আমি রোজ নিয়ম করে এই হাতে আ*গুনে না পো*ড়াতাম।;
চমকে উঠলো মায়া। ক্ষোভ মিশ্রিত নয়নে তাকালো ইশার পানে। যেন ইশা মস্ত বড় পাপ করেছে। আর এই পাপের কোনো ক্ষমা নেই।
“আমার পাঠানো চিঠিগুলো তুমি প্ পুড়িয়ে ফেলেছো?;
“হ্যাঁ, কেন? তুমি কি ভেবেছিলে তোমার পাঠানো চিঠিগুলো পড়ে আমি শ্রাবণকে ভুল বুঝে দূরে সরে যাবো? ওহ মায়া আপু, সব কিছু এতো ইজি ভাবলে চলে নাকি? তুমি শ্রাবণকে চিনোনা? জানোতো, সে কেমন! যেখানে তুমি চার-চারটা বছর ধরে সামনে থেকেও মানুষটাকে এক ইঞ্চি পরিমান পরিবর্তন করতে পারোনি, সেখানে কিনা এই সামান্য ক’টা চিঠি শ্রাবণকে পাল্টে ফেলবে! হাসালে। আর যদি আমার কথা বলি, তাহলে বলবো আমি বড্ড বোকা। আগেপরে কিছু না ভেবেই মানুষটাকে হারানোর ভয়ে কেঁদেছি।;
ইশার গলা অত্যন্ত স্বাভাবিক। আর এতোটাই স্বাভাবিক যে মায়া এতেই দম ছাড়ছে বারবার। এক সুক্ষ্ম ব্যাথা ভেতরটা ক্রমাগত ছিদ্র করে যাচ্ছে মায়ার। ইশা কেন শ্রাবণকে এতোদিনেও ভুল বুঝতে পারলোনা? তবে কি তার ভালোবাসায় কোনো খামতি বা কমতি ছিলো? ছিলো বৈ কি! অবশ্যই ছিলো। নয়তো ইশা এতোটা কনফিডেন্স নিয়ে ওর পাঠানো চিঠিগুলো ন/ষ্ট করতোনা।
“তুমি কখনোও পড়োনি চিঠিগুলো?;
“পড়ার মতো আমার অঢেল বই ছিলো, অঢেল মানুষও ছিলো অবসর সময়টাকে মন মতো কাটানোর। তাই সত্যি বলতে তোমার চিঠিগুলো আমি কখনোও আগ্রহ বাড়িয়েও দেখিনি।;
রান্নাঘরের দরজায় ঠকঠক শব্দ হলো। ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো ইশা আর মায়া। তিতির, তানি আর তুতুন দাঁড়িয়ে আছে। ওরা তাকাতেই তিতির ভ্রুকুটি করে বলল,
“খুব গম্ভীর আলোচনা চলছে মনে হচ্ছে। কি ব্যাপার আমার ভাইয়ের বউ? সব ওকে তো?;
মায়ার বড্ড কষ্ট হচ্ছে, হিংসে হচ্ছে ইশাকে দেখে। সবাই ওকে কেন এতোটা ভালোবাসে। আর এই যে প্রতিটা মুহুর্তে তারা কোনোনা কোনো ভাবে ইশাকে শ্রাবণের নামের সাথে জুড়ে রাখে! এটা একদম সহ্য করতে পারছেনা মায়া।
ইশা চোখ জোড়া ছোট করে তাকায় তিতিরের পানে। গাল ফুলিয়ে বলে,
“এখনই পর করে দিলে তো, মনে থাকবে আমার!;
বলেই আবার নিজের কাজে ব্যস্ত হয়। তুতুন সবার আগে ছুটে এসে ইশাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে ওর কাজ দেখতে থাকে। অতঃপর তানি আর তিতির ঢুকে ভেতরে। ইশার কথায় তিতির মুচকি হেসে মায়াকে উদ্দেশ্য করে বলে,
“আমার ভাইকে বিয়ে করে নিলো, আর তাকে নাকি আমার ভাইয়ের বউ বলে ডাকা যাবেনা! তুমি বলো মায়া আপু, এখানে দোষটা কোথায়?;
মায়া অন্যমনস্ক থাকায় ঠিক ভাবে খেয়াল করেনা তিতিরের কথাটা। তিতির উত্তরের আশায় হাসি মুখেই চেয়ে থাকে মায়ার দিকে। তানি ভ্রু কুঁচকে প্রথম থেকেই চেয়েছিলো মায়ার পানে। ওকে এরূপ অন্যমনস্ক দেখে তানি শয়তানি হেসে এগিয়ে যায় মায়ার পানে। মায়ার পেছনে দাঁড়িয়ে হঠাৎ বিকট চিৎকার করে বলে ওঠে,
“মায়া আপু তোমার মাথার উপর দুটো তেলাপোকা বেলি ডান্স করছে!;
মায়ার ধ্যান ভাঙে তানির চিৎকারে। অতঃপর যে বাক্যটি সর্বপ্রথম তার মনে আতংক সৃষ্টি করে সেটা হলো মাথার উপর দু’টো তেলাপোকা! ভয়ে আতংকে মায়ার অবস্থা খারাপ হয়ে গেলো মাত্র কয়েক সেকেন্ডে। চিৎকার করতে করতে হঠাৎই লাফাতে শুরু করলো মায়া। মায়ার চিৎকারে আতংকগ্রস্থ গোটা খান বাড়ি। রান্নাঘর থেকে এমন বিকট গলার চিৎকার শুনে ছুটে এলো সবাই! মায়া রীতিমতো ব্যাঙের মতো লাফাচ্ছে। শ্রাবণ, তন্ময়, আরব এমনকি বাড়ির মহিলা সদস্যরাও ছুটে এলেন। ইশাকে চুলার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সবার প্রথমে ইশাকে নিয়েই আতংক বাড়লো। শ্রাবণ দৌড়ে এসে ইশাকে টেনে নিয়ে গেলো অন্যপাশে। উদগ্রীব গলায় জিজ্ঞেস করতে লাগলো,
“কি হয়েছে, কি হয়েছে? সব ঠিকাছে তো?;
আফিয়া বেগম, নুপুর বেগম, মরিয়ম বিবি সবারই একই ভয়। হঠাৎ কানে ভেসে আসলো মায়ার গলা,
“ইশাকে ছাড়ো, ওর কিছু হয়নি! হয়েছে আমার।;
সবার দৃষ্টি এবার মায়ার উপর। শ্রাবণ মায়ার আপাদমস্তক একবার দেখে বলল,
“কি হয়েছে তোর? চেঁচালো কে?;
মায়া কান্না করে ফেলবে, এমন ভাবেই বলে উঠলো,
“অনেক কিছু!;
শ্রাবণ ইশার হাত ছেড়ে মায়ার দিকে আসতে নিলে তানি শ্রাবণকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“কিছুই হয়নি ভাইয়া। মায়া আপু অযথাই ভয় পাচ্ছে।;
“ক্ কেন, তুমিই তো বললে আমার মাথার উপর দু’টো তেলাপোকা!;
মায়ার মুখে ‘তেলাপোকা’ শুনে সবাই একসাথেই বলে উঠলো,
“তেলাপোকা”
“হ্ হ্যাঁ! ত্ তেলাপোকা!;
তানি আর পারলোনা নিজেকে সামলাতে। ইশাও তাই। সঙ্গে তিতির আর তুতুনও যোগ হলো। সশব্দে হাসতে লাগলো চারবোন। বাকিরা ভড়কানো দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো তাদের পানে। মায়া ভ্যাবাচেকা খেয়ে আছে। হাসছে কেন ওরা? ভাবতে গেলে তার একটি কথা মনে পড়ে। আর সেটা হলো,
“মায়া আপু তোমার মাথার উপর দুটো তেলাপোকা বেলি ডান্স করছে!;
মায়ার রাগান্বিত হলো নিজের বোকামোর কথা ভেবে! কথাটা সে ভালো করে না শুনেই রিয়াক্ট করে ফেললো। পরক্ষণে রা*গ হলো তানির উপর। ও আসছে থেকে এই মেয়েটা একটার পর একটা কান্ড করেই যাচ্ছে। এই যে একটু আগেই তো, কফি দেওয়ার নাম করে একমগ গরম কফি ওর ওড়নায় ঢেলে দিয়েছি। আবার সেই ওড়নায় ইচ্ছে করে দুটো পিঁপড়া ছেড়ে দিয়েছে। সবটাই ইচ্ছে করে করেছে তানি। খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে মায়া। কিন্তু শ্রাবণের বোন বলেই কিছু বলতে পারছেনা।
“তানি কি শুরু করেছিস তুই? বাড়িতে কাউকে শান্তিতে থাকতে দিবিনা নাকি?;
নুপুর বেগম শাসানী কন্ঠে বলে উঠলো। তানি ইনোসেন্ট মুখ করে হাসি থামায়। ইনোসেন্ট গলাতেই ফের বাক্য আওড়ায়,
“মা আমি কি করলাম? বাড়িতে সবাই তো কমবেশি আমার এসব কথায় অভ্যস্ত, তাই কেউ আমাকে সিরিয়াসলি নাওনা। আজ একজনকে পেয়েছি যে আমাকে সিরিয়াসলি নিয়েছে। এই সুযোগ আমি কেন হাতছাড়া করবো?;
মেয়ের এহেম কথাতে রাগী চোখে তাকালো নুপুর বেগম। দ্বিতীয়বার বকে উঠবে তবে তার পূর্বেই থামিয়ে দিলো শ্রাবণ। ইশাও থামালো বলেকয়ে,
“থাকনা ছোট মামি, ছোট মানুষ একটু দুষ্টুমিই না হয় করেছে!;
মায়ার শরীর জ্বলে যাচ্ছে রাগে। ছোট মানুষের এই নমুনা? ওর চেয়ে তো ওর ছোট বোনটা বেশি ম্যাচিউরড।
“দুষ্টুমি করে মানুষের হার্ট এট্যাক করানোর জোগাড়, তাইতো!;
নুপুর বেগমের রাগ কমলোনা মেয়ের উপর থেকে। পরের বাক্যটি আওড়াতে আওড়াতে অনেকের থেকে বাধাপ্রাপ্ত হলো। তানির ন্যাচার সম্মন্ধে সবারই ধারণা রয়েছে। এটা তো কিছুই না। এমনও হয়েছে অনেককে ও সত্যি সত্যি তেলাপোকা এনে ভ*য় দেখিয়েছে।
“আমাদের তানিটা খুবই দুষ্ট। আমাদের তো হাড়মাংস জ্বালিয়ে খায় একদম। তুমি কিছু মনে করোনি তো ?;
বললেন আফিয়া বেগম। মায়া জোরপূর্বক হেসে জোরপূর্বক মাথা নাড়ে। সে অনেক কিছু মনে করেছে! তবে মুখে কিছুই বলার নেই।
এক এক করে সবাই চলে গেলো রান্নাঘর থেকে। শুধু দাঁড়িয়ে রইলো তারা চারবোন। মায়া যেতে যেতে তীর্যক দৃষ্টি নিক্ষেপ করেছে তানির প্রতি। তবে তানির তাতে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই। সে তার বোনদের সাথে তাল মিলিয়ে হাসতে ব্যস্ত।
রাত আটটা। তন্ময় এবং মায়া চলে গেছে মিনিট দুয়েক হবে। শ্রাবণ আর আরব ওদের গাড়ি অব্দি ছেড়ে এলো। শ্রাবণ বাসায় ঢুকতেই মায়ের প্রশ্নের সম্মুখীন হলো,
“মেয়েটা তোকে ভালোবাসে, তাই না?;
মায়ের করা আচানক প্রশ্নে শ্রাবণ একটু থমকায়। মায়াকে সে এখানে আনতে নারাজ ছিলো মনেমনে। তবে বন্ধুত্বের দোহাই দিয়ে মায়া তাকে একরকম জোর করেই এসেছে এখানে।
শ্রাবণ কয়েক মুহুর্ত ভাবতে সময় নেয়। ভেবে জবাব দেয়,
“হ্যাঁ মা। তুমি ঠিকই ধরেছো!;
আফিয়া বেগমের মুখে আঁধার নেমে এলো। বলল,
“আশ্চর্য, তাহলে তুমি ওকে এ বাড়িতে কি করে নিয়ে এলে? একবারও আমাদের কথা ভাবলেনা? আমাদের ছাড়ো একবার ইশার কথা ভাবতে! ওর কাছে ব্যাপারটা কতটা সহনীয় ছিলো ভেবে দেখেছো?;
শ্রাবণ মায়ের মুখ চেয়ে অসহায় গলায় বলল,
“সরি মা! আমি সরাসরি না করতে পারিনি। তন্ময়…;
“সরাসরি না বলতে পারতে হবে তোমাকে। এটা কোনো মজার বিষয় নয় শ্রাবণ। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে ইশাকে তুমি বিয়ে করেছো। এতো মজবুত সম্পর্কটাকে কোনো উটকো ঝামেলার জন্য ন-ষ্ট হতে দিওনা। মনে রেখো তুমি ইশাকে ভালোবাসেছো, সারাজীবন সুখে রাখবে বলে কথা দিয়েছো। সেটাকে কারোর জন্য তাসের ঘর করে ফেলোনা!;
“আমি ভুল করেছি মা, এই ভুল আর দ্বিতীয়বার কখনোও হবেনা।;
“ঠিকাছে। এখন ঘরে যাও। একটু ফ্রেশ হয়ে রেস্ট নাও।;
শ্রাবণ মাথা নেড়ে চলে যায় নিজের ঘরে। ইশা ঘরেই ছিলো। শ্রাবণের লাগেজ থেকে তার জামাকাপড় বের করছে। শ্রাবণকে রুমে ঢুকতে দেখে ইশা একখানা মিষ্টি হাসি উপহার দেয়। শ্রাবণও একই ভাবে হাসে। সে কিছু বলতে চায় ইশাকে। মায়ার ব্যাপারে। তবে কোথা থেকে শুরু করবে বুঝতে পারছেনা।
“ফ্রেশ হবে? টি-শার্ট আর ট্রাউজার দিবো?;
কাজে মনোযোগ রেখেই গিন্নিদের মতো প্রশ্ন করে ইশা। শ্রাবণ আর পারেনা টিকে থাকতে। মায়ের কথাগুলো মনে গেঁথে গেছে একদম। ইশা অলরেডি মায়াকে নিয়ে ভীষণ আপসেট ছিলো! তাকে বারবার একটা কথাই বলছিলো যে ও ভয় পাচ্ছে! ভয় পাচ্ছে মায়াকে নিয়ে। যদি কোনোভাবে তাকে কেঁড়ে নেয় মায়া?
ইশার ভাবনাগুলো অবান্তর হলেও কষ্টটা অবান্তর ছিলোনা একদমই। বোঝে সে। শ্রাবণ ছুটে আসে একরকম। ইশার প্রশ্নের কোনোরূপ জবাব না দিয়ে পেছন থেকে আঁকড়ে ধরে ইশাকে। ইশা হকচকিয়ে যায় শ্রাবণের কান্ডে। ভড়কে যাওয়া গলায় কিছু জিজ্ঞেস করবে ভাবলো তবে তার পূর্বেই শ্রাবণ ওকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে ওর ঠোঁটজোড়া প্রগাঢ় ছোঁয়ায় আলিঙ্গন করলো। ইশা মুষড়ে গেলো শ্রাবণের গভীর স্পর্শে। অনুভূতিদের তীব্র যাতনায় ভেতর থেকে যেন ভাজ হয়ে গেলো ইশা। এসব অনুভূতিদের সাথে পাল্লা দিতে দিতেই শ্রাবণ পেছন থেকে দরজাটা আঁটকে দিলো। ফের ইশাকে নিজের বাহুডোরে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিয়ে পূনরায় ওর ওষ্ঠদ্বয়কে স্পৃষ্ট করলো নিজের অধর দ্বারা। দু’জন দু’জনাতে আষ্টেপৃষ্টে থাকাবস্থাতেই শ্রাবণ ইশাকে নিয়ে গেলো বিছানায়। আর সময় নিলোনা অপ্রয়োজনীয় কোনো ভাবনাতে। ইশাকে নিয়ে শুয়ে পড়লো। এবার ওর ঠোঁট ছেড়ে নেমে এলো গলায়। উন্মাদ হয়ে যায় ক্ষণেই। কি করেছে সে জানেনা। তবে এই মুহুর্তে ইশাকে কাছে না পেলে আর সে টিকে থাকতে পারবেনা এই ধরণীতে। এমতাবস্থায় ইশার কাতর গলায় ছোট্ট একটি শব্দ ভেসে এলো,
“তুমি ঠিকাছো?;
#চলবে
#ডাকপিয়নের_ছুটি_নেই 🌼
#লেখিকা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
#পর্ব_______৩৮
শৈত্যপ্রবাহ প্রবাহ শুরু হয়েছে। শীতের মৌসুমেও গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিতে সিক্ত হচ্ছে ধরণী। আলোহীন আবদ্ধ ঘরটায় কেবল ঊর্ধ্বশ্বাসের ওঠানামা। ইশার করা প্রশ্নটিতে শ্রাবণ হুঁশের দেশে ফিরে আসে। তড়াক করে ইশাকে ছেড়ে উঠে বসে সে। ঘন দীর্ঘশ্বাসের ওঠানামা খানিকটা স্থগিত হলে করুণ গলাতে বলে,
“ফ্রেশ হয়ে আসছি, মাকে রাতের খাবার দিতে বলো!;
বলে শ্রাবণ উঠে যেতে নিলে আচমকা টান অনুভব করে বাঁ হাতের তর্জণী আঙ্গুলে। শ্রাবণ ঘাড় ফিরিয়ে পেছন তাকালে দৃষ্টি যায় মনোহারিণীর আকুল অক্ষিপটে। কিছু বলছে তার অক্ষিপট। কোনো বার্তা দিচ্ছে হয়তো। শ্রাবণ আপন মনে বোঝার চেষ্টা চালালো। তবে কতটুক বুঝলো জানা নেই। সে চেষ্টা চালাতে চালাতেই পূণরায় বসলো আগের জায়গায়। ইশা শুয়ে আছে পূর্বের স্থানে। শ্রাবণ ব্যাকুল নয়নে দৃষ্টি বুলালো ইশার মুখবিবরে। বলল,
“খারাপ লাগছে? সরি!;
ইশা না সূচক মাথা নাড়ে। ঠিক শ্রাবণের ন্যায় ব্যাকুল হয়ে বলে,
“নিজের বউকে ভালোবাসবে, তাতেও অনুমতি নিতে হয় বুঝি? বড্ড বোকা তুমি,পাষাণ।;
শ্রাবণের ভেতরটা র*ক্ত শীতল হয়ে উঠলো। ঠোঁটের কোনো জমে গেলো তুষ্ট হাসি। ইশার মুখ বিবরে স্থীর দৃষ্টি রেখে বলল,
“বেশি ভদ্র হয়ে গেলাম কি?;
ইশা অভিমানি গলায় বলল,
“তা নয়তো কি?;
“তবে, বেহায়া হয়ে যাই? কি বলো?;
ইশার কথা আঁটকে যায় গলায়। শ্রাবণ কথাতে বেশ ওস্তাদ। কথা দিয়েই মানুষ পটিয়ে ফেলতে পারে। এই যে এখন? এহেম কথাতে যে ইশার হৃদস্পন্দন লক করে দিলো? সে খবর আছে কি তার?;
ইশার হাতের মাঝে শ্রাবণের হাতটা আঁটকে যেতেই শ্রাবণ পুরোটা ডুবে গেলো ইশার মাঝে। কেবল রয়ে গেলো দু’জনের ঊর্ধ্বশ্বাসের উর্ধ্বগতি। বুক ভারী হয়ে চোখের কোন থেকে ক্রমেই জল গড়িয়ে গেলো অজানা সুখে। বারেবারে সেই সুখের বহিঃপ্রকাশে শ্রাবণের উদাম দেহে স্পষ্টাকারে বেশ অনেকটা নখের আচর বসে গেলো। শ্রাবণ হাসলো আর সুযোগ দিলো তার মনোহারিণীকে। ভীষণ সুখে ভরিয়ে তুললো উপযুক্ত সময়টাকে।
______
রাতের খাবার বসে গেছে টেবিলে। সকলের ডাক পড়তেই বিছানা ছেড়ে লাফিয়ে উঠলো ইশা। কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে টেরই পায়নি। হন্তদন্ত হয়ে উঠতে যেয়ে পাখির ন্যায় শ্রাবণের খাঁচায় বন্ধী হলো সে। শ্রাবণ একটানে ইশাকে নিজের নগ্ন বুকে অভিনিবিষ্ট করলো।
“ক্ কি করছো? নীচে ডাকছে সবাই। এখন উঠতে হবে!;
শ্রাবণ জবাব দিলোনা। সে দৃষ্টি বুলাচ্ছে এলোমেলো ইশাতে। ঘরে ড্রিম লাইট জ্বলছে। সেই আলোতেই আধো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ইশাকে। কানের লতি টকটকে লাল হয়ে আছে ইশার। তার হঠাৎ মনে পড়লো সে ইচ্ছে করেই কামড় দিয়েছিলো। এরজন্য ইশা দু’টো মা*রও লাগিয়েছিলো তাকে। মুচকি হেসে সন্তর্পণে হাত বুলালে ওখানে। ইশা স্বল্প শিহরণে কেঁপে উঠলো। অনুভূতিতের মেলা বসতে অজ্ঞাতসারে নেত্রদ্বয় বন্ধ করে ফেললো। শ্রাবণের এবার চোখ পড়লো ইশার গলায়। কম করে হলেও পরপর তিন চারটে দাগ কড়া চোখে চেয়ে আছে তার দিকে। বুকের ভেতরটা মোচড় দিলো শ্রাবণের। ইশাকে নিয়েই লাফিয়ে উঠে বসলো সে। এটা সে কখন করেছে! মনে পড়ছে না তো।
“আহ্।;
গলায় হাত রাখতেই কাতর কন্ঠে ব্যাথা জানান দিলো ইশা।
“বেশি ব্যাথা?;
“হু!;
“কখন করলাম, মনে পড়ছেনা একদমই।;
“থাকনা। ক্ষিদে পেয়েছে। খেতে চলো!;
“না, বসো এখানে। কিছু একটা লাগিয়ে দেই।;
শ্রাবণ উঠতে নিলে ইশা তার হাত ধরে থামিয়ে দেয়। বাঁধ সাধা গলায় বলে,
“কিচ্ছু লাগবেনা। এই সুখের ব্যাথা আমি এতো সহজে ভুলতে চাইনা। সময় নিক সারতে। যতদিন এসব থাকবে, ততদিন তোমাকে খুব কাছ থেকে উপলব্ধি করতে পারবো। তোমাকে তো আবারও যেতে হবে চট্টগ্রাম! (মন খারাপের সুরে) তখন এগুলোই হবে আমার সুখের স্মৃতি।;
ইশার মন খারাপ ধরতে শ্রাবণের বেশি বেগ পেতে হয়নি। ইশার মলিন চাহনি আহত করলো তার বক্ষপিঞ্জর। কাছে টেনে ইশার মাথাটা বুকের মাঝে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রেখে বলল,
“তোমাকেও নিয়ে যাবো এবার। আর একা ছেড়ে থাকতে পারবোনা।;
“কি করে যাবো, ফাইনাল এক্সাম চলছে তো!;
শ্রাবণের মাথায় ছিলোনা ব্যাপারটা। সে নিজের কথায় নিজেকেই বকলো মনে মনে। ইশা পরীক্ষা রেখে কি করে যাবে? কথাটা ভেবে বললে তো আর আলাদা করে ওর মনের কষ্টটা বাড়তো না।
ইশার মন ভুলাতে শ্রাবণ ওকে টেনে তুলে কপালে ছোট্ট একটা ভালোবাসার ছোঁয়া এঁকে বলল,
“ঠিকাছে। এবারের ট্রিপ ক্যানসেল।;
“তুমিও যাবেনা?;
বিস্ময়ের সাগরে তলিয়ে শুধালো ইশা। শ্রাবণ চোখ টিপে বলল,
“নতুন বউকে রেখে কি করে যাই?;
“ইশশ ঢং!;
ইশার লজ্জা রাঙা মুখশ্রী আচানক শ্রাবণের বুকে তোলপাড় শুরু করলো। এতক্ষণ সে খেয়াল না করলেও হঠাৎ বুকটা চিনচিন করছে তার। ইশার এই রূপটা একদমই নতুন তার কাছে। এর আগে কখনোও দেখার সৌভাগ্য হয়নি তার।
শ্রাবণের উষ্ণ হস্তদ্বয় এসে ঠেকলো ইশার লাল টুকটুকে গালে। শ্রাবণ এগিয়ে আসছে ঘোর লাগা নয়নে। ইশা হাসফাস করে উঠলো হঠাৎ। লজ্জায় আবারও ম*রিম*রি দশা ওর। বুকের ভেতর ঢোল পেটাচ্ছে কেউ। হাতপা নিশপিশ করছে, শরীর জমে যাচ্ছে। দু’জনের মাঝে তখন দেড় ইঞ্চি তফাৎ। ইশা চোখ বন্ধ করে সায় জানালো শ্রাবণকে। শ্রাবণ যখনই ইশার কম্পিত ওষ্ঠজুগল আলিঙ্গন করবে, ঠিক তখনই দরজায় ঠকঠক করে কড়া নাড়ে কেউ। চমকে ওঠে দু’জনেই। ক্ষণেই বর্তমানে ধরা দিয়ে একে অপরকে দেখে লজ্জা মিশ্রিত নয়নে। শ্রাবণ মাথা নীচু করে কপাল চুলকায়। ইশা কোনো রকম বিছানা হাতড়ে ওড়নাটা নিয়ে দৌড়ে যায় ওয়াশরুমে। শ্রাবণও শার্ট উঠিয়ে জড়িয়ে নেয় শরীরে-। বোতাম গুলো সম্পূর্ণ লাগিয়ে এলোমেলো চুলগুলো ঠিক করতে করতে চলে যায় দরজা খুলতে। দরজার অপর পাশে ভঙ্গ হৃদয়ে দাঁড়িয়ে আরব। চোখমুখ একদমই শুকনো। শ্রাবণের কপালে চিন্তার সুক্ষ্ম ভাজ পড়ে। চিন্তান্বিত গলাতে জিজ্ঞেস করে,
“কি হয়েছে?;
_____________
ছাদের এক কোনে দোলনায় বসে আছে আরব আর শ্রাবণ। হাতে ধোঁয়া উড়ানো কফির মগ। ইশা মাত্রই দিয়ে গেলো দু’জনকে। শ্রাবণ মগ দু’টো রেখে ইশাকে রুমে যেতে বলল। আরবের মুখ শুঁকনো দেখে ইশা জানতে চেয়েছিলো কি হয়েছে?’ শ্রাবণ বলল, ‘পরে বলছি’ ইশা আর কোনোরূপ প্রশ্ন না করে চলে যায় রুমে। ছাদে আজ বেশ ঠান্ডা। তারউপর খনেখনে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি। এমন ঠান্ডায় বাইরে যত কম থাকা যায়।
“কফিটা খা। ভালো লাগবে।;
“না ভাইয়া, ভালো লাগছেনা।;
“কি সমস্যা খুলে বল?;
শ্রাবণের সোজাসাপ্টা প্রশ্ন আরবকে স্বাভাবিক রাখলেও সে যা বলতে চলেছে, সেটা স্বাভাবিক ভাবে বলতে পারছেনা। মনে হচ্ছে ভেতর থেকে বারবার কেউ আটকাচ্ছে তাকে। বাঁধা দিচ্ছে বলতে।
“ভাইয়া আমি বিয়ে করতে চাই।;
শ্রাবণ কফির মগে চুমুক দিয়ে খানিক কফি মুখের ভেতরে নিতে নিতে আরবের এহেম বাক্য প্রলাপে আর গিলতে পারলো না কফিটা। বিষম খেলো সে। কাশতে কাশতে মাথায় হাত চেপে বিস্ময় নিয়ে বলে উঠলো,
“বিয়ে! কাকে?;
আরব মাথা নুইয়ে রইলো। কিছুক্ষণ আগে নামিরার কল এসেছিলো। প্রতিদিনকার মতো সে ভালো মনেই কলটা রিসিভ করে, তবে নামিরা যে খবর দিলো,তাতে সে আর ভালো মন দিয়ে স্বাভাবিক ভাবে বসে থাকতে পারেনি। অস্বাভাবিক ভাবে সাহায্যের জন্য দৌড়ে এসেছে ভাইয়ের কাছে।
“নামিরার বিয়ে ঠিক হয়েছে!;
অশান্ত মনে বলল আরব। শ্রাবণ তখন নিজের হাত পরিষ্কার করছে কফি পরাতে। নামিরার বিয়ে ঠিক হয়েছে শুনে সে পূণরায় বিস্মিত হয়ে তাকায় আরবের পানে। অবাক কন্ঠে জানতে চায়,
“নামিরা? ওহ দ্যাটস আ গুড নিউজ। তো এই নিউজের সাথে তোর বিয়ে করার কি সম্পর্ক?;
ভাবুক গলাতে জিজ্ঞেস করলো শ্রাবণ। আরব অতিষ্ট হয়ে ওঠে। হাতের কফিটা নীচে নামিয়ে রেখে ভাইয়ের দিকে ঘুরে বসে বলে ওঠে,
“সম্পর্ক আছে! তুই বুঝতে পারছিস না?;
শ্রাবণ কাঁধ নাচিয়ে না সূচক মাথা নেড়ে বলল,
“নো। ক্যান ইউ এক্সপ্লেইন?;
আরব দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। হতাশ গলায় বলে,
“আ্ আমি নামিরাকে ভালোবাসি। আমাদের বেশ কিছুদিনের রিলেশন!;
“হোয়াট! আর ইউ সিরিয়াস?;
“ইয়াহ্। ভাইয়া প্লিজ কিছু একটা কর। ওর হিটলার মা আর মামু এবার ওকে বিয়ে দিয়েই ছাড়বে।;
“আমি কি করবো? ভালো তুই বাসিস। ফাইটও তোকেই করতে হবে আরব। এখানে আমার কি করার আছে?;
“আমি বেকার একটা ছেলে। আমি কি করে এই মুহুর্তে নামিরার মায়ের সামনে গিয়ে দাঁড়াবো। তাছাড়া মাস্টার্স শেষ করে চাকরির জন্য, বা বিজনেসের জন্য ট্রাই করতেও এনাফ টাইম প্রয়োজন।;
“সিম্পল সলিউশন, আমাদের ফ্যামিলি বিজনেসে ঢুকে পর।;
“না, এটা সম্ভব নয়। আমি নিজে কিছু করতে চাই ভাইয়া।;
“হ্যাঁ আমি তো বলছিনা তুই কিছু করবিনা। দেখ, আফটার গ্রাজুয়েশন তোকে নিজের থেকে কিছু করতে হলেও এনাফ মুলধনের প্রয়োজন। তখন তোকে হয় বাবাইয়ের কাছে না হয় দাদাজানের কাছে হাত পাততে হবে! তো কেন তুই এই মুলধনটা নিজের পরিশ্রমে বানিয়ে পূণরায় নিজে কিছু করবিনা। ইট’স আ গ্রেট এচিভমেন্ট ছোটু। ডোন্ট মিস ইট।;
আনন্দে চোখ জোড়া উৎফুল্ল হয়ে উঠলো আরবের। হ্যাঁ শ্রাবণের বুদ্ধিটা মন্দ নয়। সে এটাই করবে। কিন্তু নামিরা? নামিরার বিয়েটা আপাতত কি করে আটকাবে?
“কিন্তু ভাইয়া নামিরার বিয়েটা কি করে আঁটকাবো?;
“আঁটকাতে হবে কেন? নামিরার বিয়েটা হবে। তবে অন্যকারোর সাথে নয়, তোর সাথে।;
“কি করে?; উদগ্রীব কন্ঠে।
“সেটার ব্যবস্থা আমি করবো। এখন কফিটা খা তো চুপচাপ।;
আরবের মন ফুরফুরে হয়ে গেলো। ওর ইচ্ছে করছে ভাইকে জড়িয়ে ধরতে। এতো ভালো পরামর্শ শ্রাবণ ছাড়া আর কেউই দিতে পারবেনা। শ্রাবণের মতো এমন একজন ভাই পেলে সত্যি জীবন স্বার্থক।
পরের দিন বেলা থাকতে থাকতেই খান সাহেব এবং শ্রাবণ গিয়ে হাজির হলো নামিরার বাসায়। নামিরার মামুও বাসায় ছিলেন এ বেলায়। নামিরার বিয়ে নিয়ে তাদের টুকটাক প্রস্তুতি চলছে। ছেলে পছন্দ হয়েছে। কাল তারা নামিরাকে দেখতে আসবেন বলে জানিয়েছেন। তবে মাঝপথে নামিরার জন্য ঠিক করা এই পাত্রকে বাদ দিতে হলো খান সাহেবের কথা শুনে। তিনি তাদের পানে আতিথেয়তার হাত বাড়িয়ে দিলেন। জানালেন নামিরাকে তাদের আরবের জন্য নিতে চান তিনি। আরব ভালো ছেলে। নম্র-ভদ্র। এমনকি ভবিষ্যতে ভালো কিছু করার সামর্থ্যও ওর মাঝে আছে। কেবল খান সাহেবের নাতির পরিচয় নয়, সে একসময় নিজের পরিচয়েই চলতে পারবে।
আরবের বেকারত্ব নিয়ে নামিরার মামু প্রশ্ন করলে, শ্রাবণ জানায়, আরব পড়াশোনার পাশাপাশি তাদের পারিবারিক ব্যাবসা সামলাচ্ছে। সেই হিসেবে আরব বেকার নয়। সব শুনে নামিরার মামুরও আর আপত্তি করার কোনো জায়গা রইলোনা। নামিরার মাও খুশি, মামুও খুশি। খান সাহেব জানালেন সবার এক্সামের পাট চুকে গেলেই আরব এবং নামিরার এনগেজমেন্ট হবে। আপাতত ওরা শান্ত মনে পরীক্ষার ঝামেলা শেষ করুক।
#চলবে