ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল পর্ব_৩৬

0
2001

ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল
পর্ব_৩৬
লেখিকা : আফরোজা আক্তার

মেডিকেলে বসে আছে বেলী আর ইরফান । অফিসের এক কলিগকে বলে দুই ঘন্টার ছুটি নিয়েছে বেচারা । ইদানীং অফিসে প্রচুর কাজের চাপ বেড়ে গেছে তার । প্রমোশন হওয়া মানেই কাজের চাপও বেড়ে যাওয়া । ইরফান বেলীর পাশে বসে আছে । বার বার বেলীর দিকে চোখ যাচ্ছে তার । হিজাব পরে ভালোই লাগে বেলীকে । তবে মুখটা অনেক শুকনা লাগছে বেলীর । অবশ্য না লাগার-ই কথা , আজকে তিনটা দিন খাওয়া কি জিনিস সে ভুলেই গেছে । বেলী এমন এক নারী যার দিকে নজর দিলে চোখ সহ পুরো শরীর শান্ত হতে বাধ্য ।
ইরফানের মাথায় বেলীর বলা কথাটা ঘুরপাক খাচ্ছে ।

– মান্থ মিস হয়ে গেছে , তার মানে কি ওর বাবু হবে ?

মনে মনে বলতে থাকা কথাগুলো বার বার ইরফানের মনকে অস্থির করে দিচ্ছিলো ।
আবারও সে ভাবনার মাঝে ডুব দেয় ।

– সাহেব ভাইয়ের ওয়াইফের বাবু হলো কয়েকমাস আগে ৷ বেচারা অনেক চিন্তিত থাকতো দেখতাম । অবশ্য তার ওয়াইফকে দেখার মানুষের অভাব নেই কিন্তু ও-কে কে দেখবে । ওর তো আমি ছাড়া কেউ নেই এইখানে ।

ইরফান চুপ করে কপালে হাত দিয়ে বসে আছে । অপেক্ষা ইউরিন টেস্ট এর রেজাল্টের । মেডিকেলে আসার পরেই গাইনিকোলোজিস্ট ডক্টর বললেন আগে ইউরিন টেস্ট করানোর জন্যে । তাই ডক্টরের কথা মত আগে টেস্ট করিয়েছে বেলী । রিপোর্ট সরাসরি ডক্টরের কেবিনেই দেয়া হয় । আর এইখানে বেলী আর ইরফানকে কেবিনে যেতে বলে এক নার্স । নার্সের কথায় বেলী আর ইরফান পা রাখে ডক্টরের কেবিনে । ডক্টর দুজনকে সামনে বসিয়ে রেখে সব কথা ক্লিয়ার করে নেয় ।

– ডেট মিস হয়েছে কবে নাগাদ ?

ডক্টরের প্রশ্নে অনেকটাই সংকোচবোধ করছিলো বেলী সাথে ইরফানও । ইরফান টেবিলের দিকে তাকিয়ে আছে । বেলীও চুপচাপ । তখন ডক্টর আবার বলেন ,

– দেখুন এইভাবে চুপ থাকলে কিভাবে হবে ? কথা তো বলতে হবে কারণ আমি প্রশ্ন করবোই , আর উত্তর না দিলে আমি বুঝবো না কিংবা বুঝাতে পারবো না । তাই চুপ করে না থেকে কথা বলতে হবে , কেমন ?

অতঃপর বেলী আর ইরফান ডক্টরের কথাতে অনেকটা সংকোচ মুক্ত হয় । ডক্টর নাসিমা পারভীন আবারও প্রশ্ন করেন বেলীকে ,

– ডেট মিস হয়েছে কবে নাগাদ ?

তখন বেলীই উত্তর দেয় ,

– এই মাসেই ।
– কিন্তু আপনি তো কনসিভ করেছেন প্রায় এক মাস হবে । মানে প্রায় এক মাস শেষ হয়ে যাচ্ছে ।

ডক্টরের কথায় বেলী ইরফান দুজনেই অবাক । ইরফানের মনে কিসের যেন এক শীতল বাতাস বয়ে গেলো । সে বাবা হবে , তারও বাবু হবে । বেলী যে তাকে এত ভালো খবর দেবে সে ভাবে নি । তখন বেলী আবার বলে ওঠে ,

– কিন্তু আমি তো গত মাসেও,,,,,,,,,,,,,,,,
– হ্যাঁ হয় অনেক সময় এমন , এটা ব্যাপার না । এখন বলুন কি সমস্যা হয় আপনার ?

তখন বেলী তার সমস্ত সমস্যার কথা বলতে শুরু করে দেয় ,

– আমি খেতে পারি না , গন্ধ লাগে শুধু , এমন কি যেই রান্না আমি করতাম সেই রান্নাও এখন আর করতে পারি না । শুধু গন্ধ লাগে সব কিছুতে ।
– বমি কেমন হয় ?

তখনই ইরফান বলে ওঠে ,

– আসার সময়ও বমি করে আসছে । খাবার তো মুখেই তুলতে পারে না । পানি ঢেলে ভাত খায় তাও যদি পেটে থাকে । খেয়েই ফেলে দেয় সব ।
– আসলে প্রেগন্যান্সির সিমটমই এইসব । সমস্যা নেই আমি মেডিসিন দিয়ে দিবো , খাওয়াতে থাকুন আর ওনার শরীর তো অনেক দুর্বল । এইভাবে থাকলে তো পরে ব্লাড দিতে হবে । ওনার ব্লাডের প্লাটিলেটও কম ।
– কি করতে হবে এখন ?
– মেডিসিন দিয়ে দিবো , আর বেশি বেশি খেতে হবে । বমি হবে এটা স্বাভাবিক কিন্তু খেতে হবে ।

বেলী চুপ করে না থেকে নিজেই আবার বলতে শুরু করে ,

– আমার তো সব কিছু থেকে গন্ধ আসে । আমি তো খাবারের কাছেই যেতে পারি না ।
– এটা বললে তো হবে না । খেতে হবে না হয় বাবু ভালো থাকবে না ।

ডক্টরের সাথে কথা বলে বেলীর জন্যে ওষুধ কিনে দুজনে মিলে রিক্সায় উঠে যায় । রিক্সায় উঠা মাত্রই ইরফান রিক্সাওয়ালাকে সাবধানে রিক্সা চালাতে বলে দিয়েছে । বেলী চুপ করে আছে । মনের মধ্যে এক অস্থিরতা কাজ করছে । সে মা হবে , তার ভেতর আরেকটা জীবন । আরেকটা শরীর একটু একটু করে বেড়ে উঠবে । এ যেন এক অন্য রকম অনুভূতি । অন্যদিকে ইরফান কি করবে না করবে কিছুই ভেবে পাচ্ছে না । এটা রাস্তা না হলে সে লাফাতো । সে বাবা হবে , ভাবতেই প্রাণ তার জুড়িয়ে যাচ্ছে । এমন সময় বেলীর হাতে হাত রাখে ইরফান । ইরফানের হাতের স্পর্শ পেয়ে বেলী ইরফানের দিকে তাকায় । ইরফান চাপা হাসি দিয়ে বেলীকে দুই চোখ টিপ দেয় । ইরফানের এই আচরণে বেলীও মুচকি হাসি দেয় । বেলীর হাসিয়ে যেন হাজারো প্রশান্তি বিরাজ করে । ইরফান তখনই মোবাইলে তার বসের কাছে মেইল করে দেয় সে আজ অফিসে আসতে পারবে না কারণ তার ওয়াইফ অসুস্থ । ইরফান খবরটা শুনার পর একদম অন্যরকম হয়ে গেছে । সে আজ অফিসে যাবে না , তার ইচ্ছে করছে না অফিস যেতে । আজ সারাদিন সে বাসাতে থাকবে । বেলীর কাছে থাকবে । ৫ মিনিট পর ইরফানের মেইলের উত্তর আসে । বস ছুটি দিয়ে দিয়েছে । এখন শুধু বাসায় যাওয়ার অপেক্ষা । বেলীকে চুপ থাকতে দেখে ইরফান বলে উঠে ,

– কি হলো চুপচাপ যে ?
– এমনি ,
– কিছু খাবা ?
– উহু ,
– হায়রে , তোমার খাবারে কি সমস্যা । ডক্টর কি বলছে শুনছো তুমি ?
– আমার ভালো লাগছে না ।
– বেলী,,,,,,,,,,,?
– হু ,
– আমার না কেমন জানি লাগছে ?
– কেন কি হয়েছে আপনার আবার ,
– কিছু না ,
– শরীর খারাপ আমার , কেমন জানি লাগে আপনার , এটা কোন কথা ?

ইরফান চুপ করে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে । বেলীও তখন চুপ হয়ে যায় । বেলী তখন আবারও বলতে শুরু করে ,

– আমি ভাবছি মিনুর কথা ,
– কেন , ও আবার কি করলো ?
– পুরা বাসা মাথায় তুলবে ,
– হা হা হা ।

বাসায় এসে ইরফান আর বেলী দুজনেই রুমে চলে যায় । মিনু তখন কাজে ব্যস্ত ছিল তাই তেমন কিছু বলে নি । বেলী ভেবেছে ইরফান হয়তো আবার কিছুক্ষণ পরেই আবার বেরিয়ে যাবে । কিন্তু বেলী তো জানে না যে ইরফান ছুটি নিয়ে নিয়েছে আজকে । বেলী রুমে গিয়ে হিজাব খুলে ফ্যানটা ছেড়ে একটু ফ্যানের নিচে দাঁড়ায় । ইরফান তখনই দরজাটা আস্তে করে লাগিয়ে দেয় । তারপর বেলীকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে । এইভাবে ইরফানকে জড়িয়ে ধরতে দেখে বেলীও অবাক হয়ে যায় । বেলী সেখানে চুপ করেই দাঁড়িয়ে আছে । ইরফান বেলীকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বুকে টেনে নেয় । বেলীর মাথায় চুমু দিয়ে আরও নিবিড় ভাবে আঁকড়ে ধরে তার বেলীফুলকে । বেলীও তখন পরম যত্নে ইরফানকে জড়িয়ে ধরে । বেলীকে খাটে বসিয়ে দেয় ইরফান । ঠোঁটে দুজনেরই হাসির চিহ্ন । ইরফান তখন বেলীর পেটে হালকা করে ছুয়ে দেয় আর বলে ,

– বেলী এখানে আমাদের বাবু আছে ?
– হু ,
– আমি বাবা হবো ,
– হু ,
– কেউ আমায় বাবা / আব্বু এইসব বলে ডাকবে ,
– হু ,
– বেলী তুমি কি জানো তুমি আমায় কতটা সুখ দিয়েছো । সত্যিই নিজেকে আজকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুখী মানুষ মনে হচ্ছে । আমার মত মানুষের কপালে এত সুখ আছে ।
– কেন থাকবে না , আর আপনি অফিসে যাবেন না ?
– বেলী , আর ভালো লাগে না আপনি আজ্ঞে । এইবার বন্ধ করো । যার তার সামনে আপনি আপনি বললে কেমন শুনায় ।
– তো কি বলতাম ,
– কেন তুমি বলা যায় না ?

বেলী তখন নিজের মাথাটা নিচু করে রাখে । তখন ইরফান বেলীর দিকে তাকিয়ে থাকে আর মনে মনে বলে ,

” আজকে তোমার মুখ থেকে তুমি বের করেই ছাড়বো আমি ”

যেইভাবা সেই কাজ , ইরফান চেপে ধরে বেলীকে । খাটে শুইয়ে দেয় সে বেলীকে । আর নিজেও সাইড থেকে বেলীর উপর উপুর হয়ে শুয়ে যায় । বেলীর দিকে আপন মনে চেয়ে আছে সে । বেলীর নজরও ইরফানের দিকে ।

– তুমি করে বলো ,

ইরফানের কথায় বেলী অন্যদিকে ফিরে তাকায় । ইরফান তখন বেলীর গালে ধরে বেলীকে তার দিকে ফিরায় ।

– তুমি করে বলতে বলছি ,
– তুমি তো মুখ দিয়ে আসে না ।
– বললেই আসবে , বলো ।
– আসে না তো ,
– আজকে কিন্তু এইভাবেই আটকে রাখবো ,
– এহহহহহহ ,
– হু , তুমি বলো ।
– আমি আপনি করেই বলি ,
– নাহ , তুমিই বলতে হবে ।
– আমি তুমি করে বলতে পারি না তো ।
– বাবুর মা যদি এত ত্যাড়া হয় তাহলে আমার বাবুটার কি হবে , সেও ত্যাড়া হবে ।
– এহহহহ , আমার বাবু লক্ষী হবে ।
– তাহলে তুমি করে বলো ।

ইরফানের অনেক জোড়াজুড়ির পর বেলী বাধ্য হয় ইরফানকে তুমি করে বলতে । অবশেষে তার মুখ থেকে তুমি বের করে আনে ইরফান । এরই মাঝে দুজন কিছুক্ষণ হাসি-ঠাট্টাও করে নেয় । ইরফান হঠাৎ করেই ইমোশনাল হয়ে যায় । সে বেলীর গালে তার এক হাত দিয়ে স্পর্শ করে । ইরফান তখন হঠাৎই কিছু কথা বলা শুরু করে । বেলী এক ধ্যানে ইরফানের কথা গুলো শুনতে থাকে ।

– বেলী জানো , আমি না জন্মের পর মাকে দেখি নাই । বাবার কাছে শুনেছিলাম আমাকে জন্ম দিতে গিয়ে আমার মা মারা গেছেন । আমি ধরতে গেলে অনেকটাই মা হারা ছিলাম । সেই আমার সন্তান হবে ।

কথা গুলো বলার সময় ইরফানের চোখ বেয়ে পানি পড়ে যায় । ইরফানের চোখের পানি দেখে বেলীর কলিজায় কামড় পড়ে যায় । বেলী আলতো করে ইরফানের গালে ধরে । শান্তনা দেয়া ছাড়া আর কিছুই করার নেই তার ।

– আমাদের সন্তান মা বাবা দুজনকেই পাবে ইনশাআল্লাহ ।

বেলীর কথায় ভরসা পায় ইরফান । চোখের পানি গুলো মুছে বেলীকে জড়িয়ে ধরে ইরফান আর নিজের মনের মধ্যে জমাট বাঁধা কিছু কথা বলতে থাকে সে ,

– আচ্ছা মেয়ে বাবু হবে নাকি ছেলে বাবু হবে ?
– আমি কি করে বলবো ,
– তোমার কি বাবু চাই ?
– আল্লাহ পাক যা দিবে তাতেই খুশি । আপনার কি চাই ?
– আবারও আপনি ??
– আচ্ছা , ঠিকাছে তুমি । তোমার কি চাই ?
– একটা মেয়ে বাবু ঠিক তোমার মত ।
– যদি ছেলে বাবু হয় ?
– তাহলেও ক্ষতি নেই । আল্লাহ পাক যা দিবেন তাতেই খুশি ।
– ওহ ,
– আচ্ছা বাবুর ছোট ছোট হাত পা হবে আর ও অনেক নরম তুলতুলে হবে তাই না ।
– আগে তাকে আসতে দেও ভালো ভাবে । সে আসুক আগে ।

ইরফানকে হাসি মুখে কথা গুলো বলে বেলী । এমন সময় বেলী আবার বলে উঠে ,

– অফিস যাবা না ?
– ছুটি নিয়ে নিছি , আজকে তোমার সাথে কাটাবো ।
– আমি তো ভালো আছি ।
– বেলী প্লিজ নিয়ম করে মেডিসিন গুলো নিতে হবে ।
– হ্যাঁ খাবো ।

এমন সময় মিনু বাহির থেকে চিৎকার করতে থাকে ,

– বাইরের তেন আইয়াই ভিত্রে ঢুইক্কা গেছে , না বুঝি মিনুরেও কই মিনুর কি চিন্তা অয় না ? থাউক গিয়া আমি কিডা , আমি তো কামের মাইয়া ।

বেলী আর ইরফান ভেতর থেকে মিনুর কথায় খিল খিল করে হাসে । তারপর ইরফান উঠে গিয়ে দরজা খুলে দেয় । মিনু তখন সোফা গুছাচ্ছে । ডাইনিং টেবিলের কাছে এসে জগ থেকে পানি ঢালতে ঢালতে মিনুকে উদ্দেশ্য করে ইরফান বলে ,

– মিনু তোর মনা আসবে রে , মিষ্টি খাওয়া তোর ভাই ভাবীকে ।

এমন কথায় মিনু চোখ বড় বড় করে তাকায় ।

.
.

চলবে…………………….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে