ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল
পর্ব_৩৫
লেখিকা : আফরোজা আক্তার
সকালের দিকে রান্নাঘরে নাস্তা বানাচ্ছিলো বেলী । মিনু খেয়াল করছে বেলী নাকে কাপড় দিয়ে রান্না করছে । বেলীর চোখ মুখের অবস্থা ভালো না । তার কিছুক্ষণ পরেই সে মিনুকে বলে ,
– মিনু ,,,
– জ্বে ভাবী ,
– ডিমটা পোস করো তো ,
– আপনেই করেন ভাবী , আমার ডিম পোস সুন্দর অয় না । পরে ভাইয়ে রাগারাগি করে ।
– আরে করো তো , আমার ভালো লাগছে না ।
– আপনে এমন নাকে কাপড় দিয়া থুইছেন কিত্তে ?
– গন্ধ আসতেছে ,
– ও মা এডি কয় কি হেতি ? কই গন্ধ , কিয়ের গন্ধ । ভাবী কি সব কন আপনে ?
– তুমি ডিম টা পোস করবা কিনা ?
বেলীকে রাগতে দেখে মিনু তাড়াহুড়ো করে ডিম ভেজে টেবিলে দিয়ে আসে । মিনুর কেমন কেমন জানি লাগছে , বেলী এইভাবে আছে কেন ? এরই মাঝে বেলী দুপুরের খাবার রান্নার জন্যে পেঁয়াজ কাটতে থাকে । ওমনি বেলী চেঁচিয়ে ওঠে ।
– মিনু , করো কি ?
– আবার কিয়াচ্ছি ,
– পেঁয়াজ সরাও আমার সামনে থেকে ,
– আল্লাহ গো কি কইতাছেন এইসব আপনে ?
– গন্ধ লাগে সরাও এইগুলা ,
এই কথাটা বলতে দেরি আছে কিন্তু বেলীর বমি করতে দেরি নাই । রান্নাঘরের বেসিন এর মধ্যে গর গর করে বমি করে দেয় সে । মিনু বেলীর বমি করা দেখে তাড়াতাড়ি পানি নিয়ে আসে । বেলী চোখে মুখে পানি দিয়ে মিনুর দেয়া পানি খেয়ে নেয় । মিনুর সন্দেহ আরও গাঢ় হয়ে যায় ।
এরই মাঝে রুম থেকে ইরফানের ডাক পড়ে । পানির গ্লাস রেখে চোখ মুখ মুছে বেলী রুমে যায় । ইরফানের ফরমায়েশ , বেলীকে টাই বেঁধে দিতে হবে । বেলী আর কথা না বাড়িয়ে টাই বেঁধে দেয় ইরফানের । ইরফান বেশ বুঝতে পারছে বেলীর হয়তো শরীর ভালো নেই । তাই নিজেই বেলীকে জড়িয়ে নেয় আর বলে ,
– শরীর কি বেশি খারাপ লাগে ?
– হ্যাঁ , অনেক খারাপ লাগতেছে ।
– আজকে তো অফিসে যেতে হবে , কাল দেখি ডক্টরের কাছে নিয়ে যাবো ।
– আরে ধুর , লাগবে না । এমনিই ঠিক হয়ে যাবে । আপনি আসেন খেয়ে নিন ।
– চলো ।
নাস্তার টেবিলে আরেক কাহিনী । ইরফান নাস্তা করছে আর বেলী নাকে হাত দিয়ে বসে আছে । ইরফান নাক দিয়ে কয়েকবার স্মেল নেয় পরে বেলীকে জিজ্ঞেস করে ,
– তুমি নাকে হাত দিয়ে বসে আছো যে ?
– গন্ধ আসে ,
– কই থেকে গন্ধ আসে । আমি তো এমন কিছুই পাচ্ছি না ।
– আমি পাইতেছি , আপনি খেয়ে নেন । আমি রুমে যাই ,
– কি রুমে যাই , তুমি খাবা না ।
– উহু ইচ্ছা করতেছে না ।
– আরে শুনো ,,,,,,, এই বেলী
ইরফানের কথায় পাত্তা না দিয়ে বেলী রুমে গিয়ে শুয়ে থাকে । রান্নাঘর থেকে মিনু সবটাই খেয়াল করে । ইরফান নাস্তা খেয়ে বেরিয়ে যায় । পুরো টেবিল গুছিয়ে মিনু বেলীর কাছে যায় । রুমে গিয়ে দেখে বেলী তখন মোবাইলে তার মায়ের সাথে কথা বলছে । তাই মিনু রান্নাঘরে এসে বাকি কাজ গুলো সেড়ে নেয় । অন্যদিকে বেলী তার মায়ের সাথে কথা বলায় ব্যস্ত ,
– হ্যাঁ মা বলো ,
– কথা দেখি এমনে কইতাছস ,
– মা শরীরটা ভালো না ,
– কি হইছে ,
– কি জানি মা , বুঝতেছি না তো । মাথা ঘুরাচ্ছে , বমি আসে ।
– তেতুল খা , পেশার লো মনে হয় ।
– হু , আচ্ছা মা রাখি ।
– জামাই কই ?
– অফিসে চলে গেছে ।
– আইচ্ছা রাখ ,
মায়ের সাথে কথা বলে বেলী আবারও শুয়ে থাকে । শান্তি পাচ্ছে না সে শরীরে । কেমন জানি লাগছে তার কাছে ।
কিছুক্ষণ পর আবারও বেলীর মায়ের ফোন আসে । বেলী ফোন রিসিভ করে কানে নেয় ।
– হ্যালো , কি গো মা , আবার ফোন দিলা যে ?
-……………………
– কি দব বলো মা , আরে নাহ এমন কিছুই না মা ।
-…………………
– মা এইসব কিচ্ছুই না । রাখি আল্লাহ হাফেজ , নিজের যত্ন নিও ।
বেলী ভ্রু গুলো কুচকে ফোনটা কেটে দেয় । তার পর পরই মিনুকে ডাক দেয় সে , তার ডাকে মিনু বেচারিও দৌড়ে চলে আসে ,
– জ্বে ভাবী ডাকছিলেন ,
– মিনু , শুনো না একটু ,
– জ্বে ভাবী কন কি কইবেন ।
– সোনা পাখি আজকে একটু নিজে রান্না করো না । আমার খুব খারাপ লাগতেছে । ভিষন মাথা ঘুরাচ্ছে , মনে হয় উঠে দাঁড়ালেই পড়ে যাবো ।
– আইচ্ছা ভাবী আমিই রান্না কইরা ফালামু , আপনে শুইয়া থাকেন ।
– ঠিকাছে রে পাখি । আর শুনো ,
– জ্বে ,
– দরজাটা আটকে দিও , আর রান্নাঘরের দরজাটা ভেতর থেকে আটকে দিয়ে তুমি রান্না করো যাতে গন্ধ এই রুম অবদি না আসে ।
মিনুর কাছে কেমন কেমন জানি লাগছে বেলীর কথাটা । এতদিন পর এই প্রথম বেলী এমন সব কথা বলছে । মিনু চুপ করে বেলীর দিকে তাকিয়ে আছে । বেলী আবারও মিনুকে ডাক দেয় ।
– মিনু , এই মিনু ,,,,,,,
– জ্বে ভাবী ,
– কি বললাম বুঝছো ?
– আইচ্ছা ,
– তাহলে দরজাটা আটকাও ,
– আইচ্ছা ।
বেলীর রুমের দরজা আটকে দিয়ে মাথা চুলকাতে চুলকাতে মিনু রান্নাঘরে যায় । তারপর নিজে নিজেই বলতে থাকে ,
– আমাগো বাইত এক ভাবীরে দেখছিলাম এমন কত্তে । হেতির সব কিছুর ভিত্রেই গন্ধ লাগতো । বমি করতো কতক্ষণ পরে পরে । খাইতো না এমন কি রানতোও না । এহন দেহি বেলী ভাবীরও এই রোগে পাইছে ।
প্লেট বাটি মাজতে মাজতে মিনুর একটা কথা মনে পড়ে যায় ।
– ওরে ওরে , হের মাসখানেক পরেই তো মনায় অইলো । ও আল্লাহ তাইলে কি বেলী ভাবীর বাচ্চা অইবো ?
মিনু প্লেট বাটি বেসিনের উপরে রেখেই দৌড় দেয় বেলীর রুমে । বেলী তখন বিছানায় এক পাশ হয়ে শুয়ে আছে । মিনু গিয়ে বেলীর সামনের দিকে নিচে ফ্লোরে হাটু গেড়ে বসে । তারপর বেলীকে ডাক দেয় সে ।
– ভাবী , ও ভাবী ,,,,,,,
মিনুর ডাকে বেলী চোখের উপর থেকে হাত সরিয়ে মিনুর দিকে তাকায় । বেলী বুঝতে পারে মিনু হয়তো তাকে কিছু বলতে চাচ্ছে । কারণ মিনুর চোখে মুখে কেমন যেনো অনেক আগ্রহ দেখা যাচ্ছিলো তখন । বেলী মিনুর গালে হাত দিয়ে হালকা হেসে বলে ,
– কিছু বলবা মিনু ?
– একখান কতা কইতাম চাই ,
– বলো , আমি শুনতেছি ।
বেলীর কথায় মিনু নড়ে চড়ে বসে । বেলীর হাতটায় নিজের হাত রাখে মিনু । তারপর বলে ,
– কতা ডা হইলো গিয়া আমাগো বাইত এক ভাবী আছিল , হেতিও আপনের মতই করতো ।
– কি করতো ?
– এইযে আপনি এহন যা করতাছেন ?
– আমি কি করলাম আবার ?
– এইযে এইসব কিছু ,
– কি বলছো , কিছুই বুঝতেছি না আমি ।
– মানে হইলো গিয়া ভাবী , আমাগো বাইত যেই ভাবী আছিলো হেতিও আপনার মত গন্ধ গন্ধ করতো , খাইতো না আবার রানতোও না । হের মাস খানেক পরেই মনায় অইছে ।
– কে হইছে , মনা কে ?
– মানে বাচ্চা আরকি আমি আদর কইরা মনা কই ।
– এটা আমায় বলে কি লাভ হলো তোমার , ভাবী গো ভাবী , নিশ্চয়ই আমনেরও বাচ্চা অইবো ।
বেলী মিনুর কথা শুনার পর কতক্ষণ মিনুর দিকে তাকিয়ে থাকে । তারপরে কি যেনো চিন্তা করে । আর তারপর অত্যন্ত শান্ত গলায় মিনুকে বলে ,
– তুমি গিয়ে রান্না করো , এই সব বিষয়ে পরে কথা বলবো । কেমন ?
– ভাইয়েরে কইয়েন ডাক্তারের কাছে নিয়া যাইতে ।
– আচ্ছা বলবো , তুমি গিয়ে রান্না করো ।
– কি রানতাম ,
– যা মন চায় , তবে তোমার ভাইয়ের জন্যে রুই মাছ ভুনা করে রাখিও ।
– আচ্ছা ,
– দরজা লাগিয়ে দিয়ে যাও ,
– আইচ্ছা ভাবী ,
বেলী কিছুক্ষণ শুয়ে শুয়ে মিনুর কথা গুলো অনুধাবন করতে থাকে । কিছুক্ষণ আগেও বেলীর মা ফোনে ঠিক কথাই গুলো-ই বলে ছিলেন । কিন্তু বেলী তখন কথা গুলো আমলে নেয় নি । কি করবে না করবে সে কিছুই ভেবে পাচ্ছে না । চিন্তাটা মাথার মধ্যে চেপে বসে আছে । বেলী উচ্চ শিক্ষিত না বলেও একেবারে মূর্খও নয় । তাই ইউটিউবে সার্চ করে অনেক কিছুই দেখে নেয় । তখন তার খেয়াল হয় , তার এই মাসে মান্থ মিস হয়ে গেছে । এইসব চিন্তায় তার শরীর আরও খারাপ হয়ে যাচ্ছে । কাকে বলবে কার কাছ থেকে পরামর্শ নিবে কিছুই জানে না সে । না নিজে বের হয় বাসা থেকে না পরিচিত কেউ আছে । যা করতে হয় ইরফানই করে দেয় । এখন শুধু অপেক্ষা রাতের । ইরফান আসলে তাকে সবটা খুলে বলবে বেলী ।
রাত প্রায় ৯ টা নাগাদ ইরফান বাসায় আসে । আজ কেন যেনো অনেক খুশি সে । বেলীর জন্যে ফুচকা নিয়ে আসছে আজকে ইরফান । ইরফানকে খুশি দেখে বেলী তার কারণ জানতে চায় ,
– আজ এত খুশি কেন ?
– আমি যাস্ট বিশ্বাস করতে পারছি না বেলী ।
– কি হয়েছে ,
– ৬ মাসের মাথায় আরেকটা প্রমোশন ।
– সত্যিইই ,,,,,,
– সত্যি , আজকেই স্যার কেবিনে ডেকে নিলেন , আর আজকেই সব বললেন ।
– যাক আলহামদুলিল্লাহ , আল্লাহ পাকের কাছে লাখ লাখ শুকরিয়া ।
– এইসবই তোমার নামাজ আর দোয়ার ফল ।
– আপনারে বলছে , শুনেন আল্লাহ পাকের কাছে চাওয়াও লাগে আবার নিজের প্রচেষ্টাও লাগে । আমি চেয়েছি তা ঠিক আর এতে আপনারও প্রচেষ্টা ছিল তাই আপনার ভাগ্যে তা এসেছে ।
বেলীর কথার যথার্থতা বুঝতে পারে ইরফান । বেলীর দিকে এক নজরে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে মনে মনেই বলতে শুরু করে দেয় সে ,
– এই নারীর আমলেই আল্লাহ পাক আজ আমার ঘরে এবং আমার কর্মজীবনে এত সাফল্য এনে দিয়েছেন । আল্লাহ পাক আমার ভাগের সমস্ত হায়াত তুমি এই নারীর ভাগে দিয়ে দিও ।
অপরদিকে বেলীও মনে মনে বলতে থাকে ,
– আল্লাহ পাক তোমার কাছে লাখ লাখ শুকরিয়া জানাই । তুমি এইভাবেই আমার সংসার স্বয়ংসম্পূর্ণ রাখো এবং আমার চুল এর অধিক হায়াত তুমি আমার স্বামীকে দান করো ।
তারপর বেলীকে ফুচকা খেতে বলে ইরফান ওয়াসরুমে ঢুকে যায় । কিন্তু এইসব কথার মাঝে বেলী ইরফানকে আসল কথাই বলতে ভুলে যায় । তার যে কিছু কথা বলার ছিল ইরফানকে ।
রাতে খাবার পরে ইরফান শুয়ে আছে । কিছু একটা ভাবছে সে । বেলীর কি হয়েছে ? রাতের খাবার সময়েও একই কাহিনী করেছে বেলী । কোন তরকারি নেয় নি সে । শেষে পানি দিয়ে ভাত মেখে খেয়েছে । বেলী তখম ও-পাশে মুখ ফিরিয়ে শুয়ে আছে । বেলীর মনেও খচ খচ করছে কিভাবে বলবে ইরফানকে । কিন্তু না বলেও উপায় নেই তার । কারণ এখানে ইরফান ছাড়া তার পরিচিত আর কেউই নেই তার । মিনু এইসব কিছুই বুঝে না কারণ সে অবিবাহিতা । তবুও যতটুকু জ্ঞানে এসেছে তাই বলেছিল মেয়েটা দুপুরে ।
বার বার ইরফানকে বলতে চাইছে সে কিন্তু লজ্জার কারণে বলতেও পারছে না কিছু । ওইদিকে ইরফানের মনে বেলীকে নিয়ে হাজারটা চিন্তা হচ্ছে । আজকে সকালে এমন করলো , মিনুর থেকে শুনেছে দুপুর বেলা রান্নাও সে করে নাই আর এখনও খাবার খেতে গিয়ে এমন করলো । তারপর একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে দিয়ে বেলীকে ডাকে ইরফান ।
– বেলী , এই বেলী
বেলী তখনও সজাগ ছিল । ইরফানের ডাকে হু বলে সাড়া দেয় সে ।
– এইদিকে ফিরো তো ।
তখন সে ইরফানের কথায় ইরফানের দিকে ঘুরে যায় ।
– কি হয়েছে তোমার , আমায় বলবা একটু ?
– কই কি হয়েছে ?
– আজকে দুপুরে রান্না করো নাই , খাবারও খাও নাই , এখনও এমন করলা । কি হয়েছে ?
ইরফানের কথায় বেলী সাহস পায় । তখন সে বলা শুরু করে ,
– আমার না কেমন কেমন জানি লাগে , সব কিছু থেকে গন্ধ আসে ।
– কিসের গন্ধ , বাসা তো কত পরিষ্কার ।
– জানি না , তবে আমার একটা কথা আছে ।
– হ্যাঁ বলো ,
– এইদিকে আসেন ,
– আর কত আসবো ,
– আরও কাছে আসেন ,
– কি ব্যাপার , আজকে এত কাছে ডাকছো যে , খুন করার প্ল্যান আছে নাকি ?
– উফফফ , এখানে আসেন ,
– আচ্ছা বলো ,
তারপর ইরফানের কানের কাছে গিয়ে বেলী তার মান্থ মিসের কথা জানিয়ে দেয় । সাথে বেলীর সব অসুবিধার কথাও বলে দেয় এবং দুপুরে মিনুর বলা কথাগুলোও বলে দেয় । এইসব শুনে ইরফান সোজা শোয়া থেকে উঠে বসে যায় । ইরফানকে এইভাবে বসতে দেখে বেলীও বসে যায় ।
– কি হলো ,
– সত্যিই কি মিস হয়ে গেছে ?
বেলী তখন মাথা নিচু করে হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়ে । তখন ইরফান মুচকি হেসে বেলীকে জড়িয়ে ধরে আর বলে ,
– কাল সকালেই মেডিকেল নিয়ে যাবো , কেমন ?
– হু ,
– এখন ঘুমিয়ে যাও ।
ইরফান বেলীর কপালে চুমু দিয়ে বেলীকে শুইয়ে দেয় । আর বেলীও শুয়ে যায় ।
অপেক্ষা কাল সকালের । মেডিকেল গিয়ে কি হবে বাকিটা আল্লাহর হাতে ।
.
.
চলবে……………………….