ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল
পর্ব_৩১
লেখিকা : আফরোজা আক্তার
বেলীর মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়েছে । কতদিন পর রাজু তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে । সেই চিরচেনা মুখ তার সামনে দাঁড়িয়ে । আগের থেকে বেশ বদলে গেছে সে , চোখে চশমা পড়ে এখন । অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে রাজুর দিকে । আর রাজু চেয়ে আছে তার সেই চিরচেনা কালচে ফুলের মুখের দিকে । কতটা বদলে গেছে মেয়েটা । দুচোখ বেয়ে নিজের অজান্তেই পানি গুলো গড়িয়ে পড়ে যায় বেলীর ।
– কেমন আছিস রে বেলীফুল ?
– ভালো , আপনি ?
– হ্যাঁ ভালোই আছি , কেমন ভালো আছি দেখতেই তো পাচ্ছিস ?
-,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,
– চোখে পানি কেন ?
-,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,
– এই পানির কারণ কি আমি ? নাকি হঠাৎ দেখা হয়ে যাওয়াটা , কোনটা ?
-,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,
রাজুর কোন কথার জবাবই বেলী দেয় নি । বেলীর নিরবতা আর চোখের পানিই বেলীর বলতে না পারা কথা গুলো বলে দিচ্ছে । বেলীর সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছিল রাজুর । তাই আবারও শুরু করে সে ,
– অনেক দিন পর দেখলাম তোকে । এইদিকে কি মনে করে ?
– আমি এইখানের কিছুই চিনিনা , মিনুর সাথে আসছিলাম ।
– মিনু কে ?
– আমাদের বাসাতেই থাকে ।
– তোর জামাই কেমন আছে ?
– আলহামদুলিল্লাহ ,
– তুই সুখে আছিস তো ?
রাজুর ভেতর থেকে বেরিয়ে যাওয়া প্রতিটা কথাই বেলীর অন্তরে গিয়ে লাগে । কি করতে যে সে এখানে এসেছিল আর কেনই যে রাজুর সাথে দেখা হয়ে গেল । এটা ভেবেই কষ্টে বুক ফাটে তার । সুখ নামক জিনিসটাই তো তার জীবনে ছিল না । সুখটা তার জীবনে হুট করেই চলে আসে । তাই আর বেশি কিছুই মুখে আসছে না তার ।
– কিরে , বললি না তো ?
– কি ?
– সুখে আছিস তো ?
– দেখে কি মনে হয় ?
বেলীর কথা শুনে রাজুর সব কথা গুলো যেন থমকে যায় । তার মানে বেলী ভালোই আছে । খুব সুখে আছে । এরই মাঝে বেলী বলে উঠে ,
– আপনার কি খবর ? বিয়ে শাদী করছেন ?
– নাহ ,
– ওহ , করে নিন । এভাবে আর কত দিন ?
– করতে তো চেয়েছিলামই , পারলাম আর কই ।
রাজুর ইংগিত বুঝতে বেলীর সময় লাগে নি । মিনু টাও যে কেন আসছে না । তাড়াতাড়ি বাসায় যেতে পারলে ভালো হতো ।
– দোয়া করি সুখে থাক , ভালো থাক ,
– হু ,
রাজু কেন জানি পিছনে ফিরে হাটা শুরু করে দেয় । আর একবারের জন্যেও বেলীর দিকে তাকায় নি । হয়তো তারও বুঝা হয়ে গেছে তার কালচে ফুল এখন অন্যের হয়ে গেছে । এক বুক হাহাকার নিয়ে চলে যাওয়া রাজুর পথপানে চেয়ে আছে বেলী ।
এর পর পরই মিনু চলে আসে । বেলীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মিনু তার ভ্রু কুচকে তাকায় বেলীর দিকে ।
– ও ভাবী ,,,,
-,,,,,,,,,,
– ভাবী , ও ভাবী,,,,,,,,
– হু ,
– কি গো , ইরাম আতকাইয়া উঠছেন কেন ?
– কোথায় ছিলে এতক্ষন ?
– আর কইয়েন না যেই ভিড় আছিল গো ভাবী ।
– চলো বাসায় যাবো ,
– খাইবেন না ? আমি এত্ত কষ্ট করে আনলাম ।
– খাবো তবে বাসায় গিয়ে , বাসায় যাবো এখন ।
– ভাবী আপনের শরীর ঠিকাছে নি ?
– হ্যাঁ , চলো ,
– আইচ্ছা চলেন ।
অন্তরে তার কি ঝড় বইছে শুধু সে-ই জানে । কোন রকম বাসায় পৌঁছে রুমে চলে যায় বেলী । বুকে প্রচন্ড রকম ব্যাথা অনুভব হচ্ছে তার । দরজাটা লাগিয়ে পাশেই ফ্লোরে হাটু গেড়ে বসে বেলী । বুকটা ফেটে যাচ্ছে তার । পাগল পাগল লাগছিল নিজের কাছে । দৌড়ে গিয়ে বিছানায় পড়ে বেলী । বালিশ চেপে ধরে চাপা আর্তনাদ করে কাঁদতে থাকে বেলী ।
– আজ কেন ? ইয়া খোদা আজ কেন আবার সে সামনে এলো । আসা টা কি খুব প্রয়োজন ছিল ? আমি তো নিজেকে সেই কবেই গুছিয়ে নিছিলাম , যেদিন ওনার ঘরে আসছিলাম । সব তো মেনেই নিছিলাম , তাহলে আজকে আবার কেন আল্লাহ । এই কোন খেলা খেলছেন আল্লাহ । আমি তো ওনাকে ভালোবাসি তাহলে রাজু ভাই আবার কেন এলেন আল্লাহ পাক । আল্লাহ পাক আমি সব ভুলতে চাই । সবটাই ভুলতে চাই ।
বেলী কখন যে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে যায় সে নিজেও বুঝতে পারে নি ।
ইরফান প্রায় ১৫ মিনিট যাবত দরজা ধাক্কাচ্ছে । কোন সাড়া শব্দ না পেয়ে আরও জোরে জোরে দরজায় নক করে । মিনুও প্রায় কেঁদেই দিছে । এতক্ষন যাবত ইরফান দরজা ধাক্কাচ্ছে খুলার নামই নেই বেলীর । ইরফানের কলিজায় কে যেন ছুড়ি দিয়ে কোপাচ্ছিল মনে হচ্ছে । সে প্রায় পাগল হয়ে যাচ্ছিল । একমাত্র ভাড়া বাসা বলেই দরজাটা ভাঙতে পারেনি । বেলীর কানে আচমকাই নিজের নামটা যাওয়ায় লাফ দিয়ে উঠে ঘুম থেকে ।
খাট থেকে নেমে দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দেয় বেলী । বেলী দরজা খুলার সাথে সাথে ইরফান ভেতরে ঢুকে পড়ে রুমের মধ্যে । সাথে সাথে জড়িয়ে ধরে বেলীকে সে । চোখ থেকে অবিরাম পানি পড়ছে ইরফানের । বেলীকে এইভাবে জড়িয়ে ধরতে দেখে মিনু সেখান থেকে সরে যায় আর বেলীর তো প্রায় দম বন্ধ হয়েই আসছে ইরফান অত্যন্ত শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছে তাকে ।
– দরজা বন্ধ করছো কেন তুমি , হ্যাঁ , আমি সেই কতক্ষন যাবত দরজায় নক করছি ।
-,,,,,,,,,,,,,,,,,,,
– কি হইছে তোমার , এই সময় তো কখনো ঘুমাও না তুমি ?
– একটু ছাড়েন , দম আটকে আসছে আমার ।
বেলীর কথায় ইরফান বেলীকে হালকা করে দেয় । বেলীর সামনে আজ যেন এ এক অন্য ইরফান দাঁড়িয়ে আছে । যার দুটো ভয়ার্ত চোখে শুধু বেলী নিজেকেই খুজে পায় । বেলীকে হারানোর ভয়টা কেন যেন তাকে খুব পোড়াচ্ছে । ইরফান পাগলের মত বেলীকে চুমু খেতে থাকে । কপালে , গালে , হাতে , চোখে কোথাও কমতি রাখে নি । যেন মনে হচ্ছিল তার সামনে একটা বাচ্চা শিশু দাঁড়িয়ে আছে । ইরফান বেলীকে আবারও জড়িয়ে নেয় নিজের মাঝে । বেলীকে পাগলের মত আদর করে নিজের বুকে জড়িয়ে নেয় সে ।
– কি হলো , তোমার কি হইছিল ?
– কিছু না তো ?
– আমি খুব ভয় পাইছিলাম ।
– কেন , কি ভাবছিলেন ? মরে গেছি ?
বেলীর মুখ থেকে মরা শব্দটা শুনে ইরফানের বুকে কামড় পড়ে যায় । বেলীর মুখটা সাথে সাথেই চেপে ধরে ইরফান ।
– ঘুরিয়ে এক থাপ্পড় মারবো কিন্তু বেলী , কি সব বলো ?
-,,,,,,,,,,,,,,,,,,
– আমি আমার জীবন থাকতেও তোমাকে হারাতে পারবো না । আর বার বার মরার কথা কেন বলো যখন জানো যে এটা আমি শুনতে পারি না ।
বেলী ইরফানের কথা শুনছে আর ঘড়িতে দেখছে । রাত প্রায় ১০ টার বেশি বাজে । বেলীর আজ কি হয়েছিল এতক্ষন ঘুমিয়েছে সে । আর ইরফান এত ডাকার পরেও সে শুনতে পায় নি ।
রাতে খাবার পর দুজনেই শুয়ে আছে । ইরফানের আজ মনটা ভালো নেই । কেমন যেনো ছটফট করছিল । আজ বিকালে এডভোকেটের চেম্বারে রুবিও এসেছিল । সেখানে দেখা হয় দুজনের । অবাক করার বিষয় ছিল রুবি এমন ভাব করছিল যেন সে ইরফানকে চিনেই না অথচ এই রুবিই ইরফানকে প্রেশার ক্রিয়েট করেছিল বিয়ে করার জন্যে । রুবির সাথে রুবির বাবাও ছিলেন সেখানে । রুবি তার এডভোকেটকে জানিয়ে দিয়েছে সে মিউচুয়াল ডির্ভোস চায় , সাথে কাবিনের সব টাকা । ওদের বিয়ের সময় ইরফান প্রায় ১০ লাখ টাকা কাবিন করেছিল , যার মধ্যে প্রায় ৩ লাখ টাকা ইরফান বিয়ের দিনই উশুল করে দিয়েছিল । রইল বাকি ৭ লাখ টাকা তা ইরফান তাকে নগদ দিবে বলেছে । আজ পেপারে সাইন করতে রুবির হাত কাপে নি বরং তাকে খুশিই লাগছিল । ইরফানের নিজেকেও হালকা লাগছে আজ । হয়তো দুই মাস পড়ে একেবারেই ডির্ভোস হয়ে যাবে তাদের । রুবি শুধু লাষ্টে কিছু কথা বলে গেছিল । যা ইরফানের বুকের মধ্যে তুফান শুরু করে দিয়েছে সেই বিকাল থেকেই । যখন রুবি তাকে বলেছিল ,
– মিষ্টার মাহমুদ , আমার এক্স হাজবেন্ড আমার টাকাটা পাই পাই বুঝে নিতে চাই আমি ।
– পেয়ে যাবে ।
– আর হ্যাঁ , ওয়েট এন্ড ওয়াচ , বেলীও তোমার জীবনে থাকবে না ।
– রুবি,,,,,,,
– ডোন্ট শাউট , বেলী নামক কাটা আপনা আপনিই ঝরে যাবে । শুধু মিলিয়ে নিও । তোমার সুখের ঘরে অতি শীঘ্রই গ্রহণ লাগবে । অভিশাপ দিলাম ।
– রুবিইইই ,,,,,,,,,
রুবি হাসতে হাসতে বেরিয়ে যায় । তবে রুবির পক্ষ থেকে রুবির বাবা তার কাছে ক্ষমা চেয়ে নেয় । ভদ্রলোকও মেয়েকে নিয়ে ফেঁসে গেছেন ।
তাই তো আজ বেলীকে এইভাবে দরজার ওপারে দেখে তার কলিজায় পানি ছিল না । ইরফান হুট করেই বেলীর দিকে ঘুরে যায় । বেলী তখন ঘুমাচ্ছিল , বেলীকে খুব শান্ত দেখাচ্ছিল । ইরফান তার হাতটা দিয়ে বেলীর গাল স্পর্শ করে ।
– আমি তোকে হারাতে পারবো না । কখনোই না , তবুও কেন জানি রুবির বলে যাওয়া কথা গুলো শুনে খুব ভয় লাগছে । এই প্রথম আমি খুব ভয় পাচ্ছিরে বেলী । তুই আমার হৃদয় মাঝে থাকা সেই ছোট্ট পাখি যাকে আমি আমার অন্তিম নিঃশ্বাস অবদি আগলে রাখতে চাই । তবুও কেন জানি বুকটা বার বার কেঁপে ওঠে আমার । আমি তোকে হারাবো না তো ?
ইরফানের মন বলছে এইসব । কিন্তু চোখ বলছে অন্যকিছু ।
– আমি ভালোবাসি রে বেলী তোকে , অনেক ভালোবাসি ।
.
.
চলবে,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,