ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল
পর্ব_১৪
লেখিকা : আফরোজা আক্তার
সকাল বেলা প্রায় ৯ টায় ইরফানের ঘুম ভাঙে তাও বেলীর ডাকে । বেলী কয়েকবার ডাকে ইরফানকে । ঘুম থেকে উঠে ভ্যাবলার মত বেলীর দিকে তাকিয়ে থাকে ইরফান । কাল রাতের স্বপ্নটা এখন অবদি তার মস্তিষ্কে ঘুরপাক খাচ্ছে । ইরফানকে এমন দেখে বেলী প্রশ্ন করে ,
– কি হইছে ,
-………..
– এই যে , কি হইছে , এইভাবে তাকিয়ে আছেন যে ?
-…………
– এই যে , কি হলো ? উঠেন , নাস্তা বাড়ছি
– তু,,,তুমি যাও , আমি উঠতেছি ।
বেলী ইরফানের কথায় চলে যায় । আর ইরফান খাটে বসে কাল রাতের স্বপ্নটা নিয়ে ভাবতে থাকে । এটা কি স্বপ্ন ছিল , এমন ভয়াবহ স্বপ্ন তাও বেলীকে নিয়ে । এর আগে কখনো দেখে নি ইরফান । প্রায় ১০ মিনিট পর সে বিছানা থেকে নামে । কল পার গিয়ে দেখে বেলী আগে থেকে ইরফানের জন্যে ব্রাশ , পানি , টাওয়াল সব এনে রাখছে । ইরফান শুধু গিয়ে মুখ ধুবে । বেলীর সব কাজ কেন জানি ইরফানের খুব ভালো লাগে । কিন্তু স্বপ্নের কথা আবারও মনে পড়ে যায় তার ৷ তবুও নিজেকে শক্ত রেখেছে সে । হাত মুখ ধুয়ে ঘরে গিয়ে বসে ইরফান । বেলী নাস্তা দিয়ে রাখছে আর নিজেও সেখানে দাঁড়িয়ে আছে । ইরফান নাস্তা খেতে বসেছে ।
– তুমি খেয়েছো ?
– হু
– বাবা কই ?
– বাজারে গেলো দেখলাম ।
– আচ্ছা শুনো সব গুছাও , বিকেল ৪ টার গাড়িতে যাবো আমরা ।
– সব গুছানোই আছে ।
– ওকে , এটা কি রান্না করছো ?
– দই পেতেছিলাম ।
– কখন আমি যে দেখলাম না ?
– রাতেই পেতে রাখছিলাম ।
– ওহ , এত গুন পাও কই ?
– তবুও মন পাওয়ার গুন নাই,,,,,,,,,,
বেলীর কথাটা আস্তে আস্তে বললেও ইরফানের কানে ঠিকই গেছে । ইরফানের কান হচ্ছে হরিণের কানের মত । খাড়া খাড়া কান তাই তো আস্তে কথাও কানে যায় । বেলী সব কিছু গুছিয়ে রেখে রান্নাঘরের দিকে যায় । ওইদিকে কাজের মহিলাটাও চলে আসে । বেলী তার সাথে কথায় লেগে যায় ।
– কেমন আছেন খালা ?
– আলহামদুলিল্লাহ ভালা আছি , তুমি কিরাম আছ ?
– আমিও ভালো , খালা আপনাকে কি বাবা বেতন কম দেয় ?
– না তো ,
– তাহলে খালা ঘরবাড়ি এত নোংরা রাখেন কেন ? আমি কাল এসে দেখি এই অবস্থা । আজকে সকালে বাবার রুমের , ইরফানের রুমের , সামনের রুমের চাদর পর্দা সব ধুয়ে দিছি । মাকরসার বাসা গুলাও পরিষ্কার করেন না । বাবার বয়স হইছে খালা । আপনার ভরসায় তো তার ছেলে তারে এইখানে রাখছে তাই না ?
– আমি তো সব করি-ই ।
– আপনি সব করলে আমাকে সব করতে হইতো না খালা । বয়স্ক মানুষ একটু দেখে শুনে রাখবেন খালা ।
– আইচ্ছা , আর কি কি কাম আছে কও আমি কইরা দিয়া যাই ।
– আজকে আর কোন কাজ নাই , সব কাজ শেষ করে ফেলছি আমি ।
– এত তাড়াতাড়ি ?
– আমি সেই ভোরে থেকে সব কিছু করছি খালা , আমরা আজকে চলে যাবো । আপনি বাবাকে দেখে রাইখেন খালা , আর কাল থেকে আইসেন ।
– আইচ্ছা , তাইলে আমি যাইগা ।
– আচ্ছা , যান ।
জানালা দিয়ে সবটা শুনে নেয় ইরফান । বেলী সব দিক দিয়েই সম্পূর্ণা । কাজে কর্মে , আচার ব্যবহারে । কেন যেনো আগে বেলীকে মনে ধরলো না ইরফানের । এটা ভেবেই ইরফান এখন মাথা ফাটায় । সবাই ঠিকই বলে বেলী আসলেই ফুল । সদ্য কলি থেকে ফোঁটা এক নিষ্পাপ ফুল , এক নিষ্পাপ বেলীফুল ।
দুপুর প্রায় ১২ টা নাগাদ রুবির ফোন । ইরফান তখন পুকুর ঘাটে বসা , রুবির ফোনগুলো সে দেখতে পাচ্ছে কিন্তু আজকে ইচ্ছে করেই ফোন ধরছে না সে । তার ভালো লাগছে না রুবির সাথে কথা বলতে তাই সে ফোন ধরে নি । প্রায় ৭/৮ টা ফোন দেয় রুবি । ইরফান তখন ফেসবুকে ছিল , রুবি ফোন দেয়ার পর ফেসবুক লগ ইন করে ইরফানকে এক্টিভ দেখতে পায় । ঢাকায় বসা রুবির মাথায় আগুন ধরে যায় । উলটাপালটা টেক্সট করতে থাকে ইরফানকে সে ।
– আমি ফোন দিলে তুমি ফোন ধরো না কেন ?
– আমাকে এখন মজা লাগে না তাই না ?
– লাগবে কিভাবে , এখন তো বউ আরেকটা কাছে আছে , তাই না ?
– গ্রামে বসে থেকে কার বাল ফালাও ?
– বেলী এত ভালো কিভাবে হলো , এইনা ওরে দেখতে পারতা না ?
– ওহ বুঝতে পারছি , বিছানায় ভালো ঝড় তুলতে পারে , তাই না ?
– তা কেমন এঞ্জয় করো , ও-কে যখন খাও ?
– তুমি তো দারুণ খেলোয়াড় , এক সাথে দুইটারেই খেতে পারো , ক্ল্যাপ হবে তোমার জন্য ।
– গাছেরও খাও তলার টাও কুড়াও , বাহ ।
– তোমার সেক্স পাওয়ারের তারিফ করতে হয় , ট্রাস্ট মি । দারুণ পাওয়ার তোমার । ওরে প্রেগন্যান্ট করেই ঢাকাতে নিয়ে এসো , কেমন ?
রুবির মুখ থেকে এমন অশ্লীল আর নোংরা ভাষাগুলো আর সহ্য হয় নি ইরফানের । একজন উচ্চ শিক্ষিত মেয়ের মুখ থেকে এইসব নোংরা মানসিকতার অশ্লীল ভাষা কিভাবে আসে এটাই সন্দেহের । ইরফানের শরীর তখন রাগে কাঁপতে থাকে , এই মুহুর্তে যদি রুবি তার সামনে থাকতো তাহলে সে রুবিকে জবাই দিতো । ইরফান সাথে সাথে ফোন দেয় রুবিকে । রুবিও ফোন রিসিভ করে । ইরফান রুবিকে হ্যালো বলারও সুযোগ দেয় নি । ফোন ধরার সাথে সাথে শুরু করে ইরফান ,
– তুই কি মানুষের বাচ্চা ?
– ওই খবরদার ,
– এই চুপ , জানোয়ার মেয়ে , বেয়াদব মেয়ে কাকে কি বলস তুই , কাকে কি বলস ?
– তোকেই বলি , বুঝোস না তুই ?
– ওয়াও , তুই এখন আমাকে তুই তুকারিও করস ?
– করবো না , তুই করস কেন ? আমাকে কি বেলী পাইছস নাকি তুই ?
– ভাগ্যিস , ভাগ্যিস তুই বেলী না । কারণ তুই বেলীর পায়েরও যোগ্য না ।
– খবরদার ইরফান মুখ সামলাও ,
– এই আমার নাম মুখে নিবি না তুই , তুই এইসব কি লিখছিস , তোর মুখ এত নোংরা কেন ? তুই না ইংলিশে গ্রেজুয়েশন করছিস , তোর মুখ এত খারাপ কেন ?
– তো আমি এত খারাপ এখন ?
– আলবাত খারাপ , শুধু খারাপ না তুই স্বার্থপর মহিলা । তুই কেমন মেয়ে হলে কিভাবে নিজের স্বামীর সেক্স পাওয়ার নিয়ে কথা বলিস , ছিহ !
– ও বলাতে এখন খারাপ হয়ে গেছি ?
– এটা কি ভালো কথা ছিল , কসম আল্লাহর তুই আমার সামনে থাকলে এতক্ষনে তুই জবাই হয়ে যাইতি রে । শুকুর আদায় কর তুই ।
– আমার গায়ে হাত তুলে দেখো খালি একবার , হাতটা মুচড়ে ভেঙে দিতে ক মিনিটও লাগবে না আমার ।
– এতেই বোঝা যায় তুই কত ভালো । কেন এখন হাত ভেঙে দিবি কেন , আমি যখন তোর কথায় বেলীকে মারতাম তখন খুব মজা লাগতো তাই না ?
– বড্ড বেশি বেলী বেলী করতেছো ? আমিও দেখবো কয়দিন এই বেলী থাকে ?
– যে মেয়ের মুখ থেকে এত নোংরা ভাষা বের হয় সে আরও জঘন্য হতে পারে । আর হ্যাঁ , রুবি শুন , বেলী বড্ড বেশিই বোকা না হয় এতদিনে আমি আর তুই জেলে থাকতাম । কারণ আমিই সব থেকে বেশি অপরাধী ওর কাছে । আর যেই পাওয়ারের কথা বললি না তুই ? তাহলে শুন আমি এই ইরফান আহমেদ এখন অবদি শুধু তোকেই ছুয়েছে । আর রইলো কথা সেক্সের , ওইটাও তোর সাথেই করছি তুই ব্যাতিত এখন অবদি অন্য কারো সাথে আমার কিছুই হয় নাই না হয়েছে আমার বিবাহিত বউ বেলীর সাথে না হয়েছে অন্য কারো সাথে । তোর মুখ এত খারাপ এত খারাপ যা ভাবতেও অবাক লাগে । আপাতত আমাকে না করবি ফোন আর না করবি ম্যাসেজ , ভালো থাক ।
ইরফান লাইনটা কেটে দেয় । তার প্রচুর পরিমাণ রাগ উঠেছে । তাই যতটুকু পেরেছে আপাতত ফোনে ঝেড়েছে বাকিটা ঢাকাতে গেলে ।
[ বিঃদ্রঃ কথায় আছে শিক্ষাই আদর্শ , কিন্তু বর্তমানে শিক্ষিত মানুষরাই পশুর মত আচরণ করে । একজন মেয়ে তার উপর শিক্ষিত কিন্তু তার মুখ থেকেই বেরিয়ে আসে যত রকমের নোংরা আর অশ্লীল ভাষা তাও নিজের স্বামীর প্রতি । বর্তমান যুগে এইসব কিছু মেয়ে/মহিলা আছে যাদের শিক্ষার অভাব নেই কিন্তু মনুষ্যত্বের বড় বেশি অভাব । কারণ এরা দম্ভের চোটে নিজেদের অনেক বড় কিছু মনে করে । আর এদের সাথে মিলেও তেমন । ইরফানের মত পুরুষরা পরে এইভাবেই ধরা খায় । নিজে বেশি বুঝলে এইরকম হওয়াটাই অনিবার্য ]
ইরফান পুকুর ঘাট থেকে বাড়ির ভেতরে এসে দেখে তার পাশের বাড়ির চাচাতো ফুফাতো বোনেরা সবাই মিলে বেলীকে ধরেছে । বেলীকে খেলতে বলতেছিল সবাই ।
– ভাবী আসো খেলি ?
– কি খেলবো ?
– কিত কিত ,
– নাহ গো , একটু পরে আজান দিবে আর বাবাও চলে আসবে । গোসল করবো , নামাজ পড়বো ,
– আজান দিতে এহনও এক ঘন্টা বাকি ,
– তোমরা খেলো আমি দেখি ,
– আগে তো খেলতা ভাবী , ঢাকা যাইয়া পাল্টাইয়া গেছো ।
– এমন কিছুই না গো ,
– তাইলে খেলো ,
– আচ্ছা তাড়াতাড়ি করো , বাবা আসার আগে । ৯ এর ঘর বানাও
– চারকোণা খেলবা নাকি ক্রস খেলবা ভাবী ?
– চারকোণা টাই বানাও ,
– আইচ্ছা
বেলীর এক ননদ কিত কিতের ঘর বানিয়ে ফেলেছে । ইরফান দূর থেকেই সব দেখছিল । ইরফান আর সামনে এগিয়ে যায় নি । কারণ সে জানতো তাকে দেখলে বেলী আর খেলবে না । তাই সে দূরেই দাঁড়িয়ে আছে আর দেখছে বেলী কিভাবে খেলে ।
– এই শুনো আমি আগে খেলবো কিন্তু ,
– কেন ভাবী ,
– কি কেন , আমিই আগে খেলবো ,
– তাইলে তো আমরা হাইরা যামু , তুমি তো একেবারেই সব শেষ দেও ।
– আউটও হইতে পারি ?
– তুমি আর আউট ,
– আমিই আগে খেলবো , দেও ।
তারপর বেলী গুটি নিয়ে খেলা শুরু করে । এক্কা দোক্কা তিনকা এক এক করে নয় পর্যন্ত খেলে দেয় । বেলী বরাবর এইধরনের গ্রাম্য খেলা ভালো খেলতে পারে । ওড়নাটাকে পেচিয়ে খুচে তারপর খেলে সে । খেলার সময় লাফানোর জন্য চুল গুলো খুলে যায় বেলীর । তখন তাকে একদম গায়ের মেয়ের মত লাগছিল । ইরফান আর এক মুহুর্তের জন্যেও দেরি করে নি । তাড়াতাড়ি মোবাইলটা বের করে বেলীর কয়েকটা ছবি তুলে । মুগ্ধ নয়নে বেলীর ছেলে মানুষী দেখছে ইরফান । এক সময় আজান পড়ে যায় আর তাদের খেলাও শেষ হয়ে যায় । বেলী তাড়াতাড়ি মাথায় কাপড় দিয়ে ঘরে চলে যায় । লাফানোর কারণে পানির পিপাসা পেয়ে যায় তার । তাই পানি খাওয়ার জন্যে ঘরে যায় সে ।
ইরফান তখন ঘরে গিয়ে বেলীর দিকে চেয়ে আছে । দিনের পর দিন এ যেন এক নতুন বেলী তার সামনে ধরা পড়ছে । তার সামনে এই বেলীফুল একদম চুপচাপ শান্ত কিন্তু অন্যদের সাথে এই বেলীফুল একদম অন্যরকম । দুই জায়গায় দুই রকম চরিত্র তার । ইরফানকে চেয়ে থাকতে দেখে বেলী তাকে ডাক দিয়ে উঠে ।
– কিছু বলবেন ?
-…………
– এই যে ,,
– হু ,
– কিছু বলবেন ?
– এক্কা দোক্কা তো ভালোই খেলতে পারো ।
ইরফানের কথায় থতমত খেয়ে যায় বেলী , তার মানে ইরফান তার খেলা দেখে ফেলছে । তাই তাড়াতাড়ি করে সেইখান থেকে উঠে যায় সে ।
– কল পাড়ে আপনার জন্য পানি তুলে দিতেছি আপনি গোসল করতে আসেন ।
এই বলে বেলী উঠে যায় , তখনই ইরফান হাতটা ধরে নেয় বেলীর ।
– এই বেলীফুল সবার সামনে এত প্রাণবন্ত আর চঞ্চলা তাহলে আমার সামনে এত নুয়ে থাকে কেন ?
বেলী কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে তারপর মাথা তুলে ইরফানের দিকে তাকায় । বেলী অত্যন্ত শান্ত নজরে ধীর গলায় বলে উঠে ,
– এই বেলীফুল আগে হেসে উঠতো , আর এখন এই বেলীফুল প্রতিনিয়ত ঝরে যাচ্ছে । ঝরতে ঝরতে এক সময় হয়তো ঝরেই যাবে । কারণ এই বেলীফুল আর সতেজ নেই এই বেলীফুল হলো ঝরে যাওয়া বেলীফুল ।
.
.
চলবে……………….