“জ্যোৎস্নার ছল” পর্ব ৭.
মা-বাবার মাঝে দিনে অন্তত একবার অবশ্যই ঝগড়া হতো। সে ঝগড়া কী যে মারাত্মক, আমি আর ভাইয়াই তার সাক্ষী। বাবা দেখতে খুবই সাদামাটা এক মানুষ, যার দিকে তেমন কারও তাকাতে ইচ্ছে হয় না। এমন লোকই টাকার জোরে বিয়ে করেছেন আমার মায়ের মতো অতীব সুন্দরি এক মহিলাকে। মাকে কেউ না দেখলে ঠিক বুঝতে পারবে না তিনি কতটা সুন্দর। তার টানা টানা চোখের সৌন্দর্য ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। মা অন্যান্য সুন্দরিদের মতোই অহংকারী ছিলেন। তিনি হাসলে তাঁর গালের দু’পাশে ভাঁজও পড়ায় হাসলে তাঁকে অত্যন্ত মায়াবী দেখায়। তিনি বলতে গেলে খুবই অহংকারী। বাবার গৌরব ছিল, তাঁর অতীব সুন্দর এক বউ আছে। আর মায়ের ক্ষোভ ছিল তার মতো অনন্য এক মেয়েকে বাবার মতো লোক আত্মসাৎ করেছে। দু’জনের দু’প্রান্তের চিন্তা-ভাবনার জন্যই কখনও তাদের মন কাছে আসেনি। মায়ের কেবল কোনো এক উপলক্ষের প্রয়োজন হতো বাবাকে তুচ্ছ করার। আর আমার জেদি বাবাও কখনও বলতে ছাড়তেন না কীভাবে তাঁর টাকায় মা চলছে, কীভাবে সেই সৌন্দর্য বর্ধন করছে।
প্রথমে ভাইয়া জন্ম নেয়। মা খুব আশ্চর্য হয়ে ভাবতেন, সে কেন তাঁর কিছুই পায়নি। তার নামকরণ পর্যন্ত বাবাই করেছিলেন। এরপরের বার মা খুব আশাবাদী ছিলেন, এইবার তাঁর মতো কেউ আসবে। আমি এলে মা যেন চাঁদকে হাতের মুঠোয় পেলেন। আমার নাম তিনি খুব শখ করেই দিলেন অনন্যা।
মাস দুয়েক না যেতেই আমার রং পাল্টে যেতে শুরু করে, যেমনটা অনেক বাচ্চার ক্ষেত্রেই হয়। মা আমাকেও বাবার মতো ভাবতে শুরু করলেন। পরের বার যখন তিনি কোনোকিছু আশা করেননি, তখন জন্ম হয় তাঁর প্রত্যাশার মতোই একজন।
নীলিমার চোখগুলো মায়ের মতো না হলেও সে যেন মায়েরই একটি কপি। এমনকি চরিত্রের দিক থেকেও সে মায়ের মতো ছিল। আমার আর ভাইয়ার সাথে তার খুব অমিল ছিল। দু’জনকেই নীলিমা সমানে অবজ্ঞা করত। তার কথা কখনও মনে পড়ে না। মায়ের অভাবও কখনও অনুভব করি না। তিনি মা হিসেবে এতটা ঘনিষ্ঠতা দেখাননি যে, তাঁর প্রতি মায়া জাগবে। অবশ্য নীলিমার ক্ষেত্রে অনুভূতিটা জন্ম নিতে পারে। আমি জানি না।
সেদিন শাহনাজ আপা এসে মিষ্টি এক হাসি হেসে বললেন, ‘আগের চেয়ে দেখি লম্বা হয়ে গেলে।’
‘তাই? আমার তো লাগছে আমি আগের মতোই আছি।’
‘নিজের কাছে নিজের পরিবর্তন ধরা পড়ে না।’
‘তাইতো।’
এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি মাসে জিতে নিন নগদ টাকা এবং বই সামগ্রী উপহার।
শুধুমাত্র আপনার লেখা মানসম্মত গল্প/কবিতাগুলোই আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হবে। এবং সেই সাথে আপনাদের জন্য থাকছে আকর্ষণীয় পুরষ্কার।
গল্পপোকার এবারের আয়োজন
ধারাবাহিক গল্প প্রতিযোগিতা
◆লেখক ৬ জন পাবে ৫০০ টাকা করে মোট ৩০০০ টাকা
◆পাঠক ২ জন পাবে ৫০০ টাকা করে ১০০০ টাকা।
আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এই লিংকে ক্লিক করুন: https://www.facebook.com/groups/golpopoka/?ref=share
‘আমি এখানে থাকব। তোমার কোনো অসুবিধে নেই তো?’
‘না। আমার বরং ভালোই লাগবে। এখানে আমার একা থাকতে হতো। বই ছাড়া কোনো সঙ্গী ছিল না। সালমা খুব বিরক্তিকর।’
‘ইসলামিক বই পড়?’
‘তেমন একটা পড়া হয় না।’
‘ওহ্। আমারও একা থাকা পছন্দ নয়। এইজন্য খালার কাছে চলে এসেছি। তো কলেজ কেমন চলছে? তুমি কোন ইয়ারে যেন?’
‘এইতো এবার ফাইনাল এক্সাম দেবো।’
‘এইচএসসি পরীক্ষার বাকি আর মাত্র দেড় মাস। বাহ্। সময় যেন খুব দ্রুতই চলে যাচ্ছে। এইদিন যেন তোমার সাথে দেখা হয়েছিল। অথচ তিন-চারটে বছর হয়ে যাচ্ছে। ওঁর মৃত্যুরও এক বছর কবে পেরিয়ে গেছে বুঝতে পারিনি।’ তার চেহারা তৎক্ষণাৎ পাল্টে গেল স্বামীর ব্যাপার আসায়।
তিনি শ্বশুরবাড়িতে আলাদা থাকতেন। তিনি আর তার স্বামী একটি ফ্ল্যাটে থাকতেন। তার কোনো বাচ্চাও না থাকায় স্বামীর মারা যাওয়ার পর তিনি একদমই একা হয়ে পড়েছেন। দ্বিতীয় বিয়ের জন্য এখনও তিনি হয়তো প্রস্তুত নন। নিঃসঙ্গতা হয়তো তাকে আরও দুঃখী করে দিয়েছে। এইজন্যই হয়তো তিনি এখানে চলে এসেছেন। তার প্রতি করুণা জাগায় কিছু বিরক্তি কমে এলো। ছোট মা বললেন, তিনি থাকলে বাসায় শৃঙ্খলা বজায় থাকবে।
শাহনাজ আপা রাতে যখন কোরআন পড়তে বসলেন, তখন নিচ থেকে গানের আওয়াজ ভেসে এলো। আমি সবে পড়াশোনা শেষ করে উঠলাম। তিনি আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘গান-বাজনা কোথা থেকে আসছে?’
‘এইতো নিচে কিছু ভাইয়ারা গাইছেন। নিচের ফ্ল্যাটে বাড়ির মালিকের ছেলে তার স্ত্রীকে নিয়ে থাকে। ওই ভাইয়া তার কাজিনদের মাঝের মধ্যে এখানে নিয়ে আসেন। তারা এভাবে আড্ডার ছলে গানও করে।’
‘এসব গানবাজনা তো ঠিক না।’
‘কেবল আজরাতটাই তারা এসব করবে।’
‘তুমিও কি এসব পছন্দ কর?’
উত্তর না দেওয়ার জন্য বললাম, ‘আমি কি গিয়ে ওসব বন্ধ করে আসতে বলব?’
‘তুমি চাইলে বলে আসতে পার।’
ওরা আড্ডা দেবে। আমি থাকব না। এমনটা হয় নাকি? নিষেধ করতে আসার অজুহাতে তাদের সাথে আড্ডা দিতে চলে এলাম। ফরহাদ ভাইয়া আমার কথায় গান বন্ধ রাখলেন, কিন্তু আড্ডা বন্ধ হলো না। বেশিরভাগ কথা রঙধনু নিয়েই হচ্ছে। কারণ একজন আইডিয়া দিয়েছে, এখন টাকার পাশাপাশি কিংবা টাকা না থাকলে কারও শীতবস্ত্র বা যেকোনো কাপড় বা অব্যবহার্য জিনিস ইত্যাদি দান করতে পারার সুযোগ করে দেওয়ার কথা।
এটা নিয়ে অনেক কথাবার্তা হলো। আজকালকার লোকেরা নিজ থেকে তো আর সাহায্য করতে এগিয়ে আসে না। তাদের সাহায্য করার জন্য ঠেলে দিতে হয়। কথা এটাই ফাইনাল হলো, কাজটি বছরে একবার করার চেষ্টা করবে আর তা বাড়ি বাড়ি ঘুরেই।
এতদিন সাথী একবারও আসেনি। আজ এসেছে। সে পড়ার চাপেই আসেনি। নিজ থেকে এসে সে আমায় বলল, ‘ওয়াও! তোমাকে তো খুব সুন্দর দেখাচ্ছে!’
আমি একটু অবাক হলাম, ‘তাই?’
‘হ্যাঁ, আগের চেয়ে খুব সুন্দর হয়ে গেছ। প্রেমে-ট্রেমে পড়লা নাকি?’
‘প্রেমে পড়লে মেয়েরা বুঝি সুন্দর হয়ে যায়?’
‘তা জানি না। তবে হয়তোবা কিছু মেয়ে হয়।’
‘ইন্টারেস্টিং একটি ব্যাপার। তা তোমার কী ব্যাপার? তুমিও যে সুন্দর হয়ে গেলে!’
সে খানিকটা লজ্জা পেয়ে বলল, ‘আমার বিয়ের কথা চলছে মানে বর ঠিক হয়েছে। হয়তোবা বিয়ে হয়ে যাবে পরীক্ষার পর।’
‘তাড়াতাড়ি হয়ে যাচ্ছে না?’
‘আজকাল তো অনেকেরই তাড়াতাড়ি হয়। আবার যারা চায়, তারা বিয়ে দেরিতেই করে। আর তাছাড়া বাবা-মা যা করছেন, আমার ভালোর জন্যই করছেন।’
‘বোধ হয় আমি কখনও বিয়ের কথা ভাবি না, এইজন্যই বিয়ের কথা ভাবলে উদ্ভট লাগে।’
খবার সারার পর শাহনাজ আপা শুতেই ঘুমিয়ে পড়লেন। আমার এতো তাড়াতাড়ি ঘুম আসে না। স্বপ্নাও শোয়ার পর পাঁচ মিনিটেই ঘুমিয়ে পড়ে। সাথীর সাথে কথা বলায় একটি লাভ হয়েছে। শাহনাজ আপাকে মিথ্যা বলতে হয়নি। তাকে বলেছি, একটি বান্ধবীর সাথে কথা বলতে বলতে নিচ থেকে আসতে দেরি হয়ে গেছে।
সালমা শোয় ঘরের দ্বিতীয় বিছানায়। তাই আমি এই যাবৎ একাই ঘুমিয়েছি। আপার মিষ্টি ঘ্রাণটা নাকে এসে লাগছে। সাথীর সাথে বিয়ের বিষয়ে কথা বলাটা আর এই ঘ্রাণটা মিশ্রিত হয়ে আমার মাঝে ওলট-পালট ভাবনা জাগাল। কী হবে যখন আমার পাশে বিয়ের পর কেউ ঘুমোবে? আজ যেটুকু অস্বস্তি হচ্ছে, তার চেয়ে কি বেশি হবে? আশ্চর্যজনক ভাবে মনটা সাদিককে কখনও প্রেমিকের চেয়ে বেশিকিছু মনে করেনি। তাই এসব ভাবতে লজ্জাই লাগে। লজ্জা না, সঙ্কোচ বললেই বুঝি ঠিক হবে।
নিজেকে শোধালাম, লজ্জা নয়, সঙ্কোচ নয়। তুমি যাকে মনেপ্রাণে ভালোবাসো, তাকেই বিয়ে করবে। তার ব্যাপারে সঙ্কোচের কী আছে?
কিন্তু যতই নিজেকে বুঝাই না কেন, কোনো লাভ নেই তাতে। কখনও সাদিক হাত ধরলে আমাকে যেন রাজ্যের সঙ্কোচ এসে ভর করে। একদিনের কথা, কলেজ মিস দিয়ে আমি সাদিকের সাথে ঘুরতে গিয়েছিলাম।
তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘তোমার পরিবারের লোকগুলোকে আমি দেখতে চাই। আমাকে কি তোমার বাসায় নিয়ে যাবে? তোমার বড় আপুর সাথেও একবার দেখা করার খুব ইচ্ছে আছে।’
সে ইতস্তত করে বলল, ‘এখন তো নিয়ে যেতে পারব না। তোমাকে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে পারতাম। কিন্তু আমরা আমার এক চাচার পরিবারের সাথে থাকি। চাচা খুব স্ট্রিট এক লোক। এমনকি বাবাও তাঁর উপর কথা বলার সাহস পান না। তিনি প্রেম-ভালোবাসা পছন্দ করেন না। তাছাড়া আমি সবে মাস্টার্স করছি। বিয়ের ব্যাপার হলে অন্য একটি কথা ছিল। আগে পড়াশোনা শেষ করি। এরপর চাকরি করে কিছু একটা হবে।’
আমি তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। কখনও তার কাছে আমি আমাদের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করিনি। কেমন যেন ভয়-ভয় লাগে। সে আগে থেকে এসব কথা বলে দেওয়ায় আরও ভয় করছে। কারণ অনেকেরই ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা মতো হয় না।
সে আমার চোখে ভীতি দেখতে পেল। সেই পরিচিত টালমাটাল করানো মুচকি হাসিটি দিয়ে সে আলতো করে আমার গাল ছুঁয়ে কপালে চুমু খেল। আমি ঠিক কতটা সংকুচিত হলাম বলার মতো নয়।
সে আমাকে বলল, ‘চিন্তা করো না। চাচা কয়েকটি মাস পর নিজ বাড়িতে চলে যাবেন। তাঁর বাসাটি বাঁধা শেষ হলে তিনি চলে যাবেন। আমরা যেকোনো সময় বিয়ে করতে পারব।’
বিয়ের কথাটি শুনে আমি তার দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারলাম না। প্রতিটি মেয়ের ক্ষেত্রেই কি এমন হয়? অনেক কষ্টে তার দিকে তাকালাম। কিন্তু কিছু বললাম না। ধীরে ধীরে একগাদা সংকোচের সাথে তার কাঁধে মাথা রাখলাম। সেও আমার মাথায় তার গাল ঠেকিয়ে রাখল।
পরদিন আসমা ভাবি খাতা-কলম নিয়ে সত্যিই পড়তে এলো। সাথে এনেছে তার পিচ্চি মেয়েটিকে। ভাবির কথায় আমি মেয়েটিকে বর্ণমালা শেখাতে লাগলাম এবং তাকে ইংরেজি। তিনি ইংরেজির প্রতিই বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছিলেন।
সকালটা আমার খুব দ্রুতই কেটে গেছে। যখন দুপুর হলো, তখন আমাকে পুরনো খারাপ লাগাটা আবার ভর করল। এখানে আসার পর থেকে একের পর এক ওই আপনজনগুলোর কথা মনে পড়ছে, যাদের আমি স্বেচ্ছায় ত্যাগ করেছি। আজ খুব করে মনে পড়ছে স্বপ্নার কথা। আমরা কত বছরই না একসাথে ছিলাম! যে মেয়ে আমার কাছে কিছু গোপন রাখত না, সেই কীভাবে নাহিদ ভাইয়ার কথা গোপন করেছে? সে আমাকে বলতে পারত, কেন ভাইয়া আমাকে নিয়ে এতো জিজ্ঞাসাবাদ করতেন। আমার আর সাদিকের কারণেই যে তিনি সারাটা দিন খাটের নিচে শুয়ে ছিলেন, তা সে আমাকে কেন জানায়নি?
তুষার থাকলে তাকে বলতে পারতাম স্বপ্না কেমন স্বভাবের ছিল। সে নিশ্চয় স্বপ্নার নকল করার চেষ্টা করে আমার মন ভালো করতে চাইত। অবশ্য ওর চেষ্টা দেখে আমার মন কিছুটা ভালোও হতো। কিন্তু তার ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যাবে। আমি বাইরের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বেরুলাম।
নদীর পাড়ে একটি গাছের সাথে হেলান দিয়ে বসে পানির প্রবাহের দিকে চেয়ে রয়েছি। মৃদুমন্দ বাতাস আমাকে ছুঁয়ে দিয়ে আমার বিষণ্ণতাকে আস্তে আস্তে মুছে নিয়ে যাচ্ছে। জীবনটা আমার সাথে কী করে গেছে এখনও আমার বুঝা হয়ে উঠছে না। এসব অশান্তির পেছনে কি আমিই ছিলাম? কথাটি ভাবতে না ভাবতেই আমি প্রসঙ্গ পাল্টাই। নিজের উপর পড়া দোষগুলো মানুষ সবসময় এড়িয়ে যায়। আমি মানুষই।
সন্ধ্যা হয়ে গেলে মনে হলো, কাছে কোথাও যেন খুব শোরগোল হচ্ছে। না, তা এই নদীর পাড়ের হিন্দু বাড়ি থেকে আসছে না। আমি পেছনে তাকিয়ে হকচকিয়ে গেলাম। কালো অবয়বটা দ্রুত বেগে আমার দিকে এগিয়ে এসে আমার হাতটা খপ করে ধরল।
ভীত কণ্ঠে বললাম, ‘তুষার। কী হয়েছে?’
কিছু চিৎকারের আওয়াজে আমি পেছনে ফিরে দেখলাম, আরও কিছু কালো অবয়ব গাছের সারির কাছে এসে দাঁড়িয়ে পড়েছে। তুষার তাদের চলে যেতে বলল। ওখান থেকে শরীফ ভাইয়ের গলার আওয়াজ ভেসে এলো, ‘কাসু ভাবীজান ঠিক আছে তো?’
তুষার কিছু না বলে আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। তার চোখে আশ্চর্য রকমের অদৃশ্য আগুন দাউদাউ করে জ্বলছে।
‘কাউকে বলে বেরিয়েছিলে?’
তার কণ্ঠ এতোই কর্কশ শোনাল যে, মনে হলো এই কণ্ঠকে আমি চিনিই না। আমি নীরবে মাথা দুলালাম।
‘আমি না তোমাকে বেরুতে নিষেধ করেছি? আমার কথাকে কথার মতো লাগে না? তোমাকে অন্য কোনো সময় এখানে আনব বলিনি? বলো, বলিনি? এভাবে কেউ না জানিয়ে বেরুয়? তোমাকে যে আমি মানুষ নিয়ে বাড়ি বাড়ি খুঁজে বেড়াচ্ছি ধারণা আছে? এক্ষুণি বাসায় চল আমার সাথে।’
সে আমার আরেকটি কথা না শোনে শক্ত করে আমার হাত চেপে ধরে আমাকে বাসায় নিয়ে এলো। ঘরে ঢোকার পর সে দরজা বন্ধ করে ঘন ঘন শ্বাস নিচ্ছে। আমি ভয়ে ভয়ে বিছানায় বসলাম। তুষার ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে শুরু করেছে, ঠিক বাবার মতো। কিন্তু শান্ত ভঙ্গিতে নয়। সে কাঁপছে।
আমি মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলাম। এই মুহূর্ত ঠিক কী চাই আমি নিজেই জানি না। কিন্তু খুব অসহায় বোধ করছি।
তুষার এতো তাড়াতাড়ি শান্ত হয়ে যাবে কল্পনা করিনি। সে এসে মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে বলল, ‘কী হয়েছে? বাসায় যাবে?’
আমি চোখ মুছে বললাম, ‘না।’
‘কারও কথা মনে পড়ছে?’
‘বাবার রাগ উঠলে তিনি ঠিক এইভাবেই পায়চারি করতেন। এরপর.. এরপর তিনি আমার প্রিয় জিনিস পুড়তেন।’
এই প্রথমবারের মতো তুষার নকল করছে না।
‘আমি সরি। এমন ব্যবহার করা উচিত হয়নি। কেউ আমার অবাধ্য হলে.. যাইহোক, তোমার ভাবা উচিত ছিল। যেমনই হোক, তোমার দায়িত্ব এখন আমার উপর। এভাবে না বলে একা কোনোদিকে যেয়ো না। বাইরের সব মানুষ বিশ্বাসের যোগ্য নয়।’
সে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘এখানে বসে থেকো না। রান্নাঘরে এসে আমাকে কাজে সাহায্য করো।’
আমি তার সাথে রান্নাঘরে কাজ করতে গেলাম। এমন সময় কারেন্ট চলে গেল। সে চার্জ লাইট নিয়ে আসে।
‘এখানে সবসময় কারেন্ট থাকে না।’
‘দিনের অর্ধেক সময়ই থাকে না।’
‘হু।’
বেশ কিছুক্ষণ চারিদিকটা নীরব রইল। দূরে কোথাও উলু দেওয়ার আওয়াজ ভেসে আসছে। হয়তোবা আমারই শোনার ভুল।
তুষার বলল, ‘আজ কার কথা মনে করছিলে?’
‘আমার বেস্ট ফ্রেন্ড স্বপ্নার কথা।’
‘সে এখন কোথায়?’
‘আছে। ওর সাথে আমি কথা বলি না।’
‘সে কেমন?’
‘খুব কথা বলে। বেশিরভাগ ফালতু কথা। শপিং-এর বিষয়, তাকে কে কী বলেছে, বাসায় বা বেড়াতে গেলে কোন ঘটনা ঘটেছে এই ধরনের।’
‘তাহলে আমি কিছু ফালতু কথা ট্রাই করে দেখি। শুনো, ইয়ে.. ‘
সে যেন আর কথা খুঁজে পাচ্ছে না। তাকে আগে এতো তাড়াতাড়ি ব্যর্থ হতে দেখিনি। তার মনে কি কোনো অর্থহীন কথাও নেই?
‘সরি। আমার ভাণ্ডারে কোনো কথা নেই। কাজে যাই। ওখানে কারও সাথে তেমন কোনো কথা হয় না। কাজ শেষে বাসায় ফিরি। মাঝে মাঝে শরীফের সাথে এদিক-ওদিক যাই। ওহ হ্যাঁ, শরীফকে ওর পাওনা শোধ করেছি।’
‘কেমন পাওনা?’
‘এই দুয়েকটা ঘুষি দিয়েছি।’
সে কথাটি এতোই স্বাভাবিকভাবে বলল যে, আমি না হেসে পারলাম না। তার রান্না শেষ হয়ে গেছে। আমরা খেতে বসলাম। সে প্রতিবারের মতো লম্বার চেয়ারটিতে আমার পাশে বসল। আমার কতটাই না সঙ্কোচ হচ্ছে! সে এতো নিশ্চিন্তে কীভাবে থাকতে পারে?
‘খাচ্ছ না কেন?’
‘খাচ্ছি।’
আমি খাওয়ায় মনোযোগ দিলাম। আমার চোখ একবার বিনা নোটিশেই ওর দিকে তাকাল। তাড়াতাড়ি আমি চোখ সরিয়ে নিলাম। কেন যেন মনে হয়েছিল সে আমার দিকে আড়চোখে তাকিয়েছে। হয়তোবা আমার মনেরই ভুল।
‘আস্তে খান।’
‘আস্তে খাওয়া জোরে খাওয়ায় কী রাখা আছে? খেলেই হলো।’
আমি তার হাত থামিয়ে দিলাম।
‘আস্তে খান। এভাবে তাড়াহুড়ো করে খেতে নেই।’
‘খেলে কী হবে?’
‘আমি বলছি খাবেন না।’
সে এতোই আস্তে আস্তে খেতে লাগল যে, আমি কোনোভাবে হাসি চেপে রাখলাম। তবে কিছু বললাম না। ফলসরূপ আমি খেয়ে উঠার পর তার খাওয়া আরও পাঁচ মিনিট যাবৎ দেখতে লাগলাম। লোকটিকে বাধা না দিয়ে দেখছি। আমার ভালো লাগছে। যত দেখছি ততো ভালো লাগছে।
‘শুনো, আমার দুইদিন বাইরে থাকতে হবে। তোমার কষ্ট হবে না তো?’
‘না।’
‘ওহহো, তোমার তো আবার সময় কাটে না। সময় কাটবে তোমার জন্য এমন কী করতে পারি?’
‘বই আনতে পারেন।’
‘কেমন বই?’
‘যেমনটা খুঁজে পান।’
‘ঠিক আছে। কাল বিকেলে সাথে করে নিয়ে আসব।’
সে বই নিয়ে এলো। কিন্তু আমার পড়া হলো না। তার চলে যাওয়াটা আমার উপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে জানতাম না। সে থাকলে আমি আমার অতীত থেকে দূরে থাকার কারণ খুঁজে পাই। সে না থাকায় অতীতের স্মৃতিগুলো আমাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। এতোই যে, মনে হচ্ছে, বর্তমান বলতে কিছুই নেই।
(চলবে…)
লেখা: ফারিয়া কাউছার