“জ্যোৎস্নার ছল” পর্ব ১.
আমি ঘর থেকে বেরুলাম। বাসার কোনোদিকে সাজসজ্জা করা হয়নি। বাবা বললেন, বিয়ে একটি স্বাভাবিক ব্যাপার, ঠিক জন্মদিনের মতো। এ নিয়ে এতো তুলকালাম করার প্রয়োজন কী? আমি দুই বিয়েই স্বাভাবিকভাবে করেছি।
পাত্র পক্ষের লোক মাত্র তিনজন এসেছে, রুবী ভাবি বলেছে। তিনি আমাকে চোখে চোখে রাখছিলেন। পালানোর প্রয়োজন হলে সাহায্যও করবেন। কিন্তু আমার ভাবশূন্য মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু পেড়ে দেখতে পারছেন না।
আমাকে লাল বেনারসি পরিয়ে সোফায় বসানো হলো। এই রঙের শাড়ি পরে কতই না অস্বস্তি লাগছে! অগভীর রাত। বাইরে হয়তো কেউ একজন গেইটে হেলান দিয়ে চিরাচরিত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। কী ভাবছে সে? সে সম্ভবত এই মুহূর্তে খুব স্বাভাবিক, খুব সাহসী। যে কাজটি করতে এসেছে, তার জন্য এমন মনোবল লাগেই।
হয়তো সাদিকের আসার কথাই বলার জন্য একটু পর আকুপাকু করে রুবী ভাবি এগিয়ে এলেন। কিন্তু তার আসার আগেই এক লোক আমার পাশে বসে পড়েছে।
‘আমি ওয়াজেদ। আমার কথা শুনেছেন নিশ্চয়।’
আমি চোখ তুলে তাকালাম। তিনি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন, আমার সাথে চোখাচোখি হওয়ার পর তা সহসা তার জিবে আসার আগে আটকে গেল। তিনি আমার দিকে এক পলক ঘোরের মধ্যে তাকিয়ে থেকে ইতস্তত করে চোখ ফেরালেন। এই লোকটির নাকটি খুব চিকন। কিন্তু চেহারার সাথে বেশ মানাচ্ছে।
‘আমি এই..ও’
তিনি কথা গুছিয়ে বলতে পারলেন না।
‘আপনার স্ত্রী আসেননি?’
‘সে? না। বলে তো ছিলাম। কিন্তু সায় দেয়নি।’ তিনি বরের দিকে তাকালেন। আবার আমাকে বললেন, ‘আপনি চিন্তা করবেন না। আপনার মা আমাদের সবই বলেছেন। তুষারের এতে আপত্তি নেই। সে কিন্তু আপনাকে সুখে রাখার চেষ্টা করবে। আর আপনি তুষারের সম্বন্ধে সব জানেন তো?’
আমি কিছু বলার আগে ছোট মা তাকে ডেকে নিয়ে গেলেন, এখন বরের বসার সময় হয়েছে জানিয়ে। মনে মনে হাসলাম, আমি যদিও ওই লোকটির দিকে তাকাইনি, তবু নিশ্চিত তিনিও আমার দিকে তাকাননি। এমন নিরস লোক আমাকে সুখে রাখবে? আর ছোট মা তাকে ‘সবই’ বলতে কী বলেছেন?
যে লোকটির চেহারা পর্যন্ত কখনও দেখিনি, সে লোকটি আমার পাশে বসার পর ভিন্ন এক অনুভূতি আমার মাঝে খেলে গেল। সে সাদা পাঞ্জাবি পরেছে, আমি লাল শাড়ি। আমাদের কি সত্যিই একটি জুটির মতো দেখাচ্ছে?
বিয়েটা হয়ে গেল। একটি ব্যাপারে অবশ্য ভালো লাগল। কাল থেকে আর এই বাসায় থাকতে হবে না। আমি আর এই বাসায় ফিরব না। আর এখানে না থেকেই আমি প্রতিশোধটা নেব।
বর ভাইয়ার সাথে নিচে চলে গেল। আমি আমার ঘরটিকে শেষবারের মতো দেখতে এলাম। এখন আমি লোকটির সাথে কোথায় যাব তা পর্যন্ত জানি না। এই দুইদিন বাবা কেবল বলেছিলেন, পাত্রপক্ষের সামনে ভালোভাবে থাকবে। এমন পাত্র পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। তিনি আর কিছুই বলেননি, না আমি জিজ্ঞেস করেছি।
সালমা তার বিছানায় বসে বলল, ‘বিয়ের সময় মেয়েরা নিচের দিকে তাকিয়ে থাকে আর ছেলেরা সামনের দিকে তাকিয়ে থাকে কেন?’
আমি তার দিকে বিরক্তি নিয়ে তাকালাম, ‘মেয়েরা অনেককিছু ভাবে। আর ছেলেরা কিছু ভাবে না বলেই।’
‘ছেলেরা কিছু ভাবে না কেন?’
‘কারণ ছেলেরা বিয়ে করে। আর মেয়েদের বিয়ে হয়।’
‘তাহলে তুমি কী ভাবছিলে?’
‘কী ভাবছিলাম? জানি না।’
আচ্ছা, নীলিমা কি কখনও জানবে আজ আমার বিয়ে হয়ে গেছে? আর মা? তিনি কি কোনো ধরনের প্রতিক্রিয়া দেবেন? মেয়েদের বিয়ের সময় নানাকিছু বুঝানোর জন্য হয়তো নানা কেউ থাকে। আমার বেলায় কেউ ছিল না তা কি আদৌ কেউ জানবে?
আমি বইয়ের খালি শেলফটির দিকে তাকালাম। শাহনাজ আপা টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘যে খেলাটা খেলতে যাচ্ছ, তা কিন্তু খুব ডেঞ্জারাস। এখনও সময় আছে নিজেকে পাল্টানোর। নিজের মাঝে সেই অনন্যাকে আনার, যে একসময় রঙধনুর মাধ্যমে অনেকের মুখে হাসি ফুটিয়েছে।’
‘থ্যাংকস। আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম।’
শাহনাজ আপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সামনে থেকে চলে গেলেন। আমার রয়ে যাওয়া সর্বশেষ প্রিয় জিনিস আরসি-এর অ্যালবামটি বেডের নিচে রয়ে গেছে। আমি তা লাগেজে ভরে নিলাম। লাগেজে তেমন কিছু নেই, দুই চারটি কাপড় ব্যতীত। লোকটি কী বলবে? ধনী লোকের মেয়ের কিনা কাপড় নেই? আমি বলব, তুমি কেন আমাকে বিয়ে করেছ? তোমার কয়েকটি কাপড় আমাকে দিয়ে দাও না!
আমি স্পষ্ট বুঝতে পাচ্ছি, কেউ একজনের পায়ের কদম অদূরে গিয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে। নিচের গেইটের সামনে হয়তো এখন কেউ নেই। আমি আমার বিছানায় বসলাম। জীবন কতই না বিচিত্র! এতদিন একটি মেয়ে এই বিছানায় শুয়ে কেবল একটি লোকের কথাই সবসময় ভেবেছে। কাল তার চলে যেতে হবে অন্য একটি অজানা অদেখা লোকের সাথে। কিন্তু আমি একদম ভেঙে পড়ছি না।
আমি যখন গাড়িতে উঠলাম, তখন ভাইয়া আর রুবী ভাবি ব্যতীত বিদায় দেওয়ার জন্য কেউ ছিল না। স্বপ্না, তার মা-বাবা, নাহিদ ভাইয়া, ফরহাদ ভাইয়া, মা, বাবা, নীলিমা এই জায়গায় তারা কেউ নেই। শাহনাজ আপা হয়তো বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছেন। হয়তো আফসোস করছেন, আমাকে এখন থেকে আমাকে উপদেশ দিতে পারবেন না।
আমাদের গাড়িটি ছেড়ে দেওয়ার পর একমাত্র রুবী ভাবির চোখে পানি দেখা গেল। এরপর আমি এক অজানা ভবিষ্যতের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমালাম। গাড়ির চলছেই চলছে। বাইরের অন্ধকার রাত দেখতে দেখতে আমি এক স্মৃতিতে ডুব দিলাম। সবকিছুই জীবন্ত হয়ে চোখের সামনে ভাসছে, ঠিক যেন তা বর্তমানে ঘটছে।
দুরুদুরু বুকে রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে রইলাম। অনেকগুলো গাড়ি এলো আর আমার কাপড়ে হাওয়া লাগিয়ে চলে গেল। আমি একবিন্দু নড়লাম না। আমার গন্তব্য আমার সামনে, রাস্তার ওপাশে। কিন্তু যাওয়ার সাহসটুকু পাঁচ মিনিট অবধি জোগাতে পারছি না।
একটি ছেলে চায়ের দোকান থেকে মাঝে মাঝে আমার দিকে তাকাচ্ছে। সে সমানে চা বানিয়ে চলেছে। সে কি বুঝতে পারছে, আমি কতবড় একটি পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি? নজর আবারও পড়ল ‘জোহরা টেইলার্স’ লেখাটির উপর। আসলে এটি নয়, দোকানটির ঠিক উপরের তলায় যে ঘরটি আছে, তা নিয়েই আমি চিন্তিত। ওখানে কীভাবে যাব? কীভাবে বসব? কীভাবে কী করব সবই কেমন যেন ওলট-পালট হয়ে যাচ্ছে। কোনো মেয়ের একটি ছেলেকে প্রপোজ করা কিন্তু মোটেই সহজ ব্যাপার নয়।
দীর্ঘ এক শ্বাস ফেলে রাস্তা পার করলাম। এরপর সিঁড়ি বেয়ে দ্বিতীয় তলায় উঠে গেলাম। প্রথমে যে ঘরটি আছে, তাতেই আমি মূলত কোচিং করতে আসি। অনেকবড় একটি ঘর। মোটামুটি স্কুলের একটি ক্লাসরুমের সাইজের। কিন্তু এখানে এখনও কেউ আসেনি। আসবেই বা কী করে। আমিই যে তাড়াতাড়ি এসেছি!
এরপরের ঘরটি কিন্তু ততটা বড় নয়। ওখানের দরজা খোলা আছে। আহ্! বইয়ের দিকে তাকাতে তাকাতে কতবার যে চোখ এদিকে যায়, হিসাব রাখিনি। আমি নিজেকে খুব স্বাভাবিক রেখেই দরজার কাছে গেলাম। ছোট ছোট বাচ্চারা বসে আছে। তারা খাতায় নীরবে কী যেন লিখছে। বোর্ডের দিকে তাকাতেই আমার হৃদপিণ্ড প্রতিবারের মতোই লাফ দিয়ে উঠল। লোকটি বোর্ডে অংক করিয়ে দিচ্ছে। আশ্চর্য! তার পিঠ দেখেও আমার এই অবস্থা হয় কেন? নাকি ভালোবাসার মানুষের উপস্থিতির কারণে প্রতিটি মেয়েরই এই দশা হয়?
তার ঘোরার অপেক্ষায় আমি নীরবে দাঁড়িয়ে রইলাম। ইচ্ছে হলো না, গলা খাঁকারি দিয়ে তার একান্ত মনযোগে বিঘ্ন ঘটানোর। সে লিখতে থাকুক, আমি এভাবেই অনন্তকাল তার দিকে চেয়ে থাকতে পারব। আচমকাই তার লেখা ফুরিয়ে গেল। দেখলাম, সে আমার দিকেই চেয়ে আছে।
‘অনন্যা, কিছু বলবে?’
এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি মাসে জিতে নিন নগদ টাকা এবং বই সামগ্রী উপহার।
শুধুমাত্র আপনার লেখা মানসম্মত গল্প/কবিতাগুলোই আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হবে। এবং সেই সাথে আপনাদের জন্য থাকছে আকর্ষণীয় পুরষ্কার।
গল্পপোকার এবারের আয়োজন
ধারাবাহিক গল্প প্রতিযোগিতা
◆লেখক ৬ জন পাবে ৫০০ টাকা করে মোট ৩০০০ টাকা
◆পাঠক ২ জন পাবে ৫০০ টাকা করে ১০০০ টাকা।
আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এই লিংকে ক্লিক করুন: https://www.facebook.com/groups/golpopoka/?ref=share
‘না না ভাইয়া। আমি আসলে একটু তাড়াতাড়ি চলে এসেছি। এখানে কি বসতে পারি? ওই ঘরে আমার একা বসে থাকতে ভয় করছে।’
সে নীরবে মাথা নেড়ে বাচ্চাদের জিজ্ঞেস করতে লাগল, অংক বুঝেছে কিনা। আমি পেছনের খালি একটি বেঞ্চে বসে পড়লাম। আরেকটু আগে এলে নিশ্চয় তাকে একা পেতাম। দেরি করার জন্য এখন নিজের উপরই রাগ হচ্ছে। যাইহোক, আমি অন্তত তার দিকে অপলক চেয়ে থাকার সুযোগ তো পাচ্ছি।
ইশ, যদি সাদিক ভাই আমাদের পড়াত তবে কেমন হতো? আমি কি একটুও পড়াশোনা করতে পারতাম? নিশ্চিত পারতাম না। মনটা বারবার বলতে থাকত, ওর মুখটা কী সুন্দর দেখ। চোখে কী ভোলা ভোলা ভাব! এই চেহারা কি আর দশটা ফরসা ছেলের মতো? এই ফরসা মুখে যে লাবণ্যটা ছড়িয়ে আছে, তা কি আর কোনোদিকে দেখতে পাবে? বেঁটেও নয়, লম্বাও নয়, এরকম পারফেক্ট সাইজের কোনো ছেলেকে কি পাওয়া যাবে? সাদিক ভাই সবসময় পাঞ্জাবি পরে আসে। মাঝের মধ্যেই শার্ট-প্যাণ্টে তাকে দেখা যায়। তাকে পাঞ্জাবি কি শার্ট সবকিছুতেই দারুণভাবে মানায়। নাকি লোকটিই বিশেষ বলে আমার এমনটা মনে হয়?
সাদিক ভাই হঠাৎ আমার দিকেই তাকিয়ে বলল, ‘এতো তাড়াতাড়ি কেন এসেছ? এখনও সবে আটটা বেজেছে। তোমাদের কি আজ রাকিব স্যার পড়াবে না?’
‘হ্যাঁ, প্রতিদিন তো সাড়ে আটটা থেকে পড়ান। আমার ফ্রেন্ড ফোন করে বলল আজ কিনা আটটায় পড়াবেন। হয়তোবা সে আমার সাথে মজা করেছে। আমি এখানে বসে থাকলে আপনার সমস্যা হবে না তো?’
সে কিছু না বলে মাথা এদিক-ওদিক নাড়ল। বন্ধুদের সাথে তো বেশ জমিয়ে কথা বলতে পারে! আমার বেলায় কেন মুখ দিয়ে সামান্য ‘না’ শব্দটিও বেরুয় না? এবার আমি বাইরের দিকে তাকিয়ে বসে রইলাম। সে কি বুঝছে না, আমার এইবারও কোনো এক অজুহাতে তাড়াতাড়ি আসার কারণটা? তার কি মনে নেই, আগেও ঠিক এভাবে একবার এসে বসে থেকে তার দিকে অপলক তাকিয়ে রয়েছিলাম?
গালে হাত ঠেকিয়ে খাতায় হিজিবিজি আঁকতে শুরু করলাম। এক ফাঁকে তার দিকে তাকালে সে তাড়াতাড়ি চোখ সরিয়ে নিল। আমার মনের প্রাচীর বেয়ে এক আনন্দ বয়ে গেল। এমন আনন্দের মুহূর্ত বোধ হয় আমার জীবনে আগে কখনও আসেনি। হয়তোবা এটা লজ্জারই কারণ যে, আমি উঠে পড়লাম। কোনোদিকে না তাকিয়ে পাশের ঘরটায় চলে এলাম।
স্বপ্না এসেছে! আমাকে দেখে সে শয়তানি হাসি হাসল। এসে কেন আমাকে ডাকেনি?
‘কিরে কবে এলি?’
‘কিছুক্ষণ হলো। স্যার আর পাঁচটা মিনিট পর চলে আসবেন।’ সে গলা উঁচিয়ে বলল, ‘তোকে ভুল টাইম বলে মজা করলাম তার জন্য এক্সট্রিমলি সরি।’
আমি মুচকি হেসে তাকে চুপ করতে বললাম। মেয়েটি আর হলো না। সে ফিসফিস করে বলল, ‘কী হলো?’
‘তোর মাথা।’
‘আমার মাথা মানে কী? এতক্ষণ কী করেছিলি?’
‘নাচছিলাম। ও যে ওর স্টুডেন্টদের সাথে নিয়ে নাচছিল, আমিও সাথে দিলাম আরকি।’
‘বাহ্ বেশ তো। তোকে আমি একটা বুদ্ধি দেই। তুই আগামীবার নাচতে নাচতে ইচ্ছাকৃতভাবে হোঁচট খেয়ে ফ্লোরে পড়ে যাবি। কিন্ডারগার্টেনের কিছু বাচ্চা তো আর তোকে ধরে তুলতে আসবে না। সাদিক ভাই নিজেই আসবে। আর তখন তুই সুযোগ পেয়ে যাবি তাকে কানে কানে কিছু বলার।’
‘ওয়াও! আর আমার হাত-পায়ের কী হবে?’
‘হাত-পায়ের কী দরকার? তোর কাছে তো সাদিক ভাইয়ের গুরুত্ব এরচেয়ে বেশি।’
বাচ্চাদের ছুটি হয়ে গেছে। সাদিক ভাই বেরিয়ে এলো। ওর পেছনে বাচ্চারা হৈচৈ করে বেরুচ্ছে। সাদিক ভাই চলে গেলে অন্য দুটো টিচার এসে দুই ব্যাচ স্টুডেন্ট পড়ায়। তার চলে যাওয়ার পর আমি স্বপ্নার দিকে তাকালাম।
‘আর হবি না। উনি যাওয়ার সময় মুচকি হাসছিলেন দেখেছিস? নিশ্চয় তোর কথাগুলো শুনেছে।’
স্বপ্না তার সেই পরিচিত শয়তানি হাসি হাসল।
কিছুক্ষণ পর রাকিব স্যার এলেন। আমাদের পড়ালেন। কিন্তু আমি তার একটি শব্দও খেয়াল করিনি। আমার মনের পর্দায় কেবল একটি চেহারাই ভাসছে। নিচের দিকে চেয়ে থাকা তার ভোলা দুটো চোখ, ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা মুচকি ওই হাসি কিছুতেই মনের পর্দা থেকে সরানোর মতো নয়।
কলেজ শেষে বাসায় ফিরে এলাম। ইন্টারের দ্বিতীয় বর্ষ সবে শুরু হয়েছে বিধায় তেমন একটা ক্লাস হচ্ছে না। কাজেই তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে আসি। আজ মনটা এতোই উৎফুল্ল যে, বাবার কথার উত্তর সঠিকভাবে দিলাম। তিনি সোফায় বসেছিলেন। আমাকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, ক্লাস কেমন করলে? বললাম, এইতো ভালো। সুযোগ পেয়ে তিনি আরেকটি প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে বসলেন।
‘পড়াশোনা কেমন চলছে?’
‘ভালোই চলছে।’
এটুকুই তার সাথে কথা বলে নিজের ঘরে চলে এলাম। আমার এই ঘরে কী নেই? এখানে থাকলে মনে হয়, আমার আর কিছুর প্রয়োজন নেই। মোটকথায় অন্য কোনোদিকে তৃপ্তি না পেলেও আমি এই জায়গায় অবশ্যই তৃপ্তি পাব। আমার বেড়ানো হয় না। কাজেই এই জায়গায় থেকে আমি ভ্রমণ করি। অভিজানে যাই। মা থাকতে বাবার মাধ্যমে বিদেশ থেকে অনেক কিছুই আনিয়েছিলেন। বলতে গেলে কোনোকিছুর অভাব রাখেননি।
ফার্নিচারের অভাব নেই। সবই অত্যাধুনিক। ঘরও গোছানোর প্রয়োজন হয় না। বুয়াই সবকিছু করে দেন। আমাকে সুখী করার জন্য এসবকিছুর অবদান নিতান্তই কম। আমার সুখের উৎস জুড়ে রয়েছে জানালার পাশের শেলফটি।
বই পড়তে খুব ভালোবাসি। ভ্রমণকাহিনি, থ্রিলার, রহস্যময়, ভৌতিক গল্পই সাধারণত পড়ে থাকি। আমার মা ছিলেন একজন বইপ্রেমী। মূলত তার কারণেই ছোটবেলা থেকে বই পড়া আমারও শখ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মায়ের রেখে যাওয়া বইগুলো আমি পড়ে থাকি। তাছাড়া কেউ আমাকে গিফট দিতে চাইলে বলি, আমার পছন্দের বই গিফট হিসেবে যেন দেয়।
রাতটায় আমার মোটেই গল্পের বই পড়তে ইচ্ছে হলো না। কলেজের কিছু পড়া শেষ করে বিছানায় গিয়ে ধপ করে শুয়ে পড়লাম। মস্তিষ্কের প্রতিটি কোণ আশ্চর্য রকমের ফাঁকা হয়ে গেছে। মস্তিষ্কের চারিটা দিক খুব নিস্তব্ধ। কেমন এক প্রশান্তি মনের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে আছে!
(চলবে..)
লেখা: ফারিয়া কাউছার