“জ্যোৎস্নার ছল”পর্ব ১২.
তুষারের সাথে ডাক্তারের চেম্বারে এসেছি। আজ সুন্দরি ডাক্তারটি আছে। তিনি তুষারের দিকে ভ্রূ কুঁচকিয়ে তাকালে সে মুখ লুকায়।
সে বলল, আমার স্ত্রীর কী হয়েছে একটু দেখুন।
তার বলা স্ত্রী শব্দে আমার মাঝে অপ্রত্যাশিত এক হাওয়া বয়ে যায়। এমন করে তো আমাকে আগে কেউ স্ত্রী বলে দাবি করেনি।
ডাক্তার আমার চেকআপ করে বললেন, উনি কি কিছু খাননি?
তুষার আমার দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকাল।
‘খাবার-দাবার না করার ফলেই তিনি উইক হয়েছেন। আমি ওষুধ দিচ্ছি। জ্বর শীঘ্রই চলে যাবে।’
‘কাজের কাজ হয়নি। এভাবে ওকে রেখে যাওয়াও উচিত হয়নি। হয়তো রান্না করতে পারেনি। আমি ফিরে আসার পর দেখতে পেয়েছি, ও শুয়ে রয়েছে। আমার দিকে চোখ খুলেও তাকাতে পারছে না। তারপর দেখি জ্বর এসেছে।’
কয়েকদিন তুষার আমার খুব সেবা-যত্ন করেছে। কাজে যায়নি। বারবার জিজ্ঞেস করেছে, তুমি বই পড়নি, আসমা ভাবীকেও ডাকোনি। কী হয়েছিল তোমার?
তাকে কীভাবে বুঝাই ওই দুইদিনের কথা। আমি এতোই বিধ্বস্ত এবং অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম যে, বর্তমানে কী ঘটে যাচ্ছে আমার সেই হুঁশই ছিল না। তুষার না থাকলে আমাকে অতীত এতটুকু জব্দ করে ফেলবে ভাবিনি।
সাদিকের কথা আমার এখনও মনে পড়ে। তুষার তা স্পষ্ট দেখতে পায়। সে যখন জিজ্ঞেস করে, এইবার কাকে মিস করছ। আমি বলে দেই, কাউকে না। আমি চাই না সে সাদিকের নকল করুক, সে সাদিকের অবস্থানে দাঁড়াক। সাদিকের মতো কেউ হতে পারবে না। অন্তত ওর ওই ভোলা চোখ আর মুচকি হাসি দেখার অভাব অন্য কেউ পূরণ করতে পারবে না।
বিয়ের আগে আমি ভাবিইনি আমার এখানের জীবন এতোটা কল্পনাতীত হবে। তুষার সকাল বেলা চলে গেলেও আমার মোটেই বিরক্তিকর লাগে না। আসমা ভাবি আরও কয়েকটি বাচ্চা কোথা কোথা থেকে জুটিয়ে এনেছে। তিনি প্রথমদিন বললেন, ‘তুমি খুব ভালা পড়াও গো অনু। হের লাইগা আমি আরও কিছু পোলারে আনছি। তুমি এদের এহন থাইকা পড়াইবা। যদি টেহা চাও, তো আমি দিমু। এদের মা’রে বিনা বেতনে পড়াবার কথা কওনের পরই এদের দিছে।’
‘ভাবি আমি কি তোমাকে বেতনের কথা বলেছি? তার প্রয়োজন নেই। বরং এদের পড়াতে আমার খুব ভালো লাগবে। তাছাড়া আমরা যেটুকু জানি, সেটুকু নিঃস্বার্থে বিলানো উচিত। কারও প্রয়োজন হলেই সে এই বিলানোর বিনিময়ে টাকা নিয়ে থাকে। আমার তো প্রয়োজন নেই।’
মোটামুটি একটি ছোট পাঠশালাই যেন। আমাকে সাদিকের সেই ঘরের কথা মনে করিয়ে দেয়, যেখানে সে বেশিরভাগ বাচ্চাকে বিনামূল্যে পড়াত। একদিন আমার মাথায় একটি পরিকল্পনা খেলে গেল। তুষার আমাকে একা কোনোদিকে যেতে দেয় না। আমি কিনা নদীর পাড়ে যাওয়ার জন্য আকুপাকু করি। আসমা ভাবিকে এই বিষয় পেড়ে দেখে বললাম, কেমন হয় যদি আমি তোমাদের ওখানে পড়াই? আমার এখানে তো জায়গার খুব সমস্যা হয়।
তিনি এতেও রাজি হয়ে গেলেন। পড়ালেখায় তার এরকম আশ্চর্য টান দেখে একদিন জিজ্ঞেস করেই ফেললাম, তার মনে কী আছে।
তিনি বললেন, ‘জানো, আমি দুই-তিনবার এই জায়গা থেকা পালাইছিলাম। আমার পড়ার অনেক শখ ছিল। আমার এক মামা শহরে থাহেন। তার মাইয়া তোমারই মতন কলেজে লেখাপড়া করছে। আমারও এমন করি পড়ার অনেক ইচ্ছা। দুয়েকবার আমি কেউরে না বইলা মামার বাসায় চলি গেলাম। মামারে কয়েকবার আমারে পড়ানোর কথা কইছি। কইছি, এর বিনিময়ে আমি তার ঘরে কাম করমু। যতবার গেছি, ততবার এই কথাখান কইছি। তিনি মানেননি। এরপর আর যাওয়া হয়নি। গেরামের মাইষে আমারে লই বহুত আজেবাজে কথা কইছে। আমি আর তোমার ভাইজান এতে কান দি নাই। তুমি দেখবা, আমার লগে তেমন কেউ মাততে চায় না। দুয়েকজনের কানে গেছে, আমি পড়ালেখার লাইগা এমন করছি। হেতারা তো কয়, পড়ালেখার লাইগা মাইয়াগো এমন কইরতে তারা বাপের জনমে হুনেনি। কিন্ত কে বুঝিব শিখার মূল্য আর আনন্দ।’
আমার উপলব্ধি হলো, আমরা দাঁত থাকতে দাঁতের মর্ম সত্যিই বুঝি না। আজ আমি হয়তোবা আরও এগিয়ে যেতাম। আর এমন কারও সাথে বিয়ে হতো না, যে কিনা ক্লাস টেন পর্যন্ত পড়েছে। কিন্তু তুষার মাঝে মাঝে চমৎকার ইংরেজি শব্দ বলে থাকে।
এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি মাসে জিতে নিন নগদ টাকা এবং বই সামগ্রী উপহার।
শুধুমাত্র আপনার লেখা মানসম্মত গল্প/কবিতাগুলোই আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হবে। এবং সেই সাথে আপনাদের জন্য থাকছে আকর্ষণীয় পুরষ্কার।
গল্পপোকার এবারের আয়োজন
ধারাবাহিক গল্প প্রতিযোগিতা
◆লেখক ৬ জন পাবে ৫০০ টাকা করে মোট ৩০০০ টাকা
◆পাঠক ২ জন পাবে ৫০০ টাকা করে ১০০০ টাকা।
আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এই লিংকে ক্লিক করুন: https://www.facebook.com/groups/golpopoka/?ref=share
এখানে আসার দশদিন পর, নিজের পরিবারের কথা ভাবতে ভাবতে আচমকাই তুষারকে তার পরিবারের কথা জিজ্ঞেস করে বসলাম।
সে কিছুক্ষণ নীরব থেকে বলল, ‘আমি কারও ভাই হই না, তবে আমার একটি বোন আছে। তার নাম ইশা।’
‘তাই? তাহলে ওয়াজেদ ভাই কে? তার সাথে তোমার কীভাবে বন্ধুত্ব হয়েছে?’
‘এই বাসাটি তারই। আর ওয়াজেদ ইশার স্বামী।’
আমি বেশ কিছুক্ষণ ভেবে উঠতে পারলাম না। বিয়ের রাতের কথা মনে পড়ে গেল, যখন ওয়াজেদ ভাইকে বলেছিলাম ভাবি কেন আসেনি। তিনি তুষারের দিকে তাকিয়েছিলেন। তাহলে কি এমন এক সরল মনের লোকের সাথে তার বোনের কোনো ঝগড়া হয়েছে?
‘তারা এখন কোথায় থাকে?’
‘তোমার বাড়ির চেয়ে বেশি দূরে না। অনেক সুন্দর একটি দু’তলা বাসায় ওরা থাকে। খুব সুন্দর আর মনোমুগ্ধকর জায়গাটি। চারিদিকে বাগান, সীমানার কাছে ঝাউগাছ, বাগানের চারিদিকে ফুলের গন্ধ, সুখী-সুখী এক ভাব এগুলো মিলিয়ে জায়গাটি অসাধারণ।’ সে এমন ঘোরের মধ্যে বলল যেন তার চোখের সামনে এসব ভাসছে।
‘তাই? তুমি কি ওখানে গিয়েছিলে?’ সে নীরবে মাথা নাড়ল।
‘পরিবারের আর কারও সম্বন্ধে বললে না।’
সে ইতস্তত করে বলল, তোমাকে একটা জিনিস দেখানোর কথা ছিল। সে ব্যস্ত হয়ে পড়ে যে ড্রেসিং টেবিলের উপর বসেছিল, তার নিচের ড্রয়ার খোঁজ করতে লাগল। অবশেষে সে কিছু কাগজ বের করে আনে।
সে আমার সামনে বুঝানোর ভঙিতে বসে পড়ে বলল, ‘এই কাগজগুলোতে দেখ। ওখানে আমার নামে একটি জায়গা আছে। জায়গাটি আমার খুব প্রিয়। মাঝে মাঝে আমার শান্তিময় পরিবেশের প্রয়োজন হলে ওখানে যাই।’
‘বুঝেছি। কিন্তু আমাকে কাগজ কেন দেখাচ্ছ?’
‘যদিও দুটো মানুষ জায়গাটিতে আছে, তারা দেখবে। কিন্তু তুমি চাইলে এর দায়িত্ব নিতে পারবে। জায়গাটি মা আমার নামে করেছিলেন, তাই তাঁর স্মৃতি হিসেবে তা তোমার নামে করতে পারছি না। কিন্তু তোমাকে আমি ওটা সম্পূর্ণ তোমার ভাবার অধিকার দিলাম।’
তার মা হয়তো আর নেই। আমি কথাটি বাড়ালাম না। হয়তো সে কষ্ট পাবে বলেই মুখে তাদের কথা এই প্রথম এনেছে।
তুষারকে যতটা মিশুক দেখায়, সে ততটা মিশুক নয়। যা আছে, তা আমার কারণেই হয়েছে, আমাকে খুশি রাখার জন্যই হয়েছে। আমি মাঝে মাঝে খেয়াল করি তুষারও কোথাও যেন হারিয়ে যায়, যেভাবে আমি আপনজনের স্মৃতিতে হারিয়ে যাই। সে নিজেকে যে ব্যক্তি হিসেবে দেখাতে চাইছে, সেই ব্যক্তি সে নয়। তার মাঝে মাঝে উগ্র মেজাজ দেখে মনে হয়, সত্যিই তুষারকে চেনার শেষ নেই। মাঝে মাঝে খুব রাগ হয়, সে আমার দিকে তাকায় না। মাঝে মাঝে আড়চোখে তাকায়, কিন্তু ধরা পড়তে দেয় না। কিছুদিন পর আমি আর থাকব না ভেবেও এই লোক কীভাবে এতো স্বাভাবিক হয়ে সংসার করছে আমার বুঝার সাধ্যের বাইরে।
এখানে আসার ষোলো দিন পর। আমি দুপুরে বিছানায় বসে প্রতিদিনের মতোই বিরক্তিকর সময় কাটাচ্ছি। তুষার যখন জিজ্ঞেস করে আমার কিছু লাগবে কিনা, তখন আমি বলে দেই, আমার জন্য একটি বই আনবেন। সে কোথা থেকে যেন পুরনো বই এনে বলে, কিছু মনে করবে না। এখানে লাইব্রেরি নেই। সেকেন্ড হ্যান্ড বইই পেয়েছি। এরপর থেকে সে পাঁচ দিনে একবার করে আমাকে একটি নতুন বই দিয়ে যায়। কখনও কখনও সে রোমান্টিক গল্পের বই আনে। আমি ধরেও দেখি না। আনন্দের চেয়ে তো কষ্টই বেশি পাব। বই পড়তে পড়তে দরজায় দু’বার টোকা পড়ল। তুষার তো এই সময় আসে না!
আমি রান্নাঘরের জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। এইদিক থেকে দোয়ারে কে দাঁড়িয়েছে পুরোপুরি দেখা যায় না। যে ব্যক্তি টোকা দিচ্ছে সে কিছু বলছে না দেখে আমার মাঝে কৌতূহল হচ্ছে। খুব সবধানে দরজা সামান্য খুলে উঁকি দিলাম। অমনিই আমার হৃদস্পন্দন দ্রুত হয়ে গেল।
‘আমি ভেতরে আসতে পারি অনু?’
আমি নীরবে দরজা খুলে দিলাম। বাবা ভেতরে ঢুকে চারিদিকটা দেখতে লাগলেন। আমার লাগছে, আমি যেন ঘোরের মধ্যে আছি। সেই ঘোরের মধ্যেই বাবাকে পানি এনে দিলাম। ডগডগ করে তিনি খেয়ে ফেললেন। এতদূর এসে নিশ্চয় তার খুব ক্লান্তি লাগছে। আমি তাকে খাবারও এনে দিলাম। তিনি খেলেন না।
‘কেমন আছ অনু?’
‘ভালো।’
‘তুষার কোথায়?’
‘কাজে গেছে।’
‘কবে ফিরবে?’
‘সন্ধ্যা নাগাদ।’
‘ততক্ষণ তুমি একা থাক?’
‘সকালে থাকি না। দুপুর থেকে সন্ধ্যা অবধি।’
তিনি বেশ কিছুক্ষণ নীরব রইলেন।
‘তুমি ফোন করো না কেন?’
‘তুষার তার ফোন কাজে যাওয়ার সময় নিয়ে যায়।’
‘বাকি যেকোনো সময় তো ফোন করতে পারতে।’
‘কী ভেবে এখানে এলেন বাবা?’
‘আমি আমি.. কী বলব ভেবে পাচ্ছি না। খোঁজখবর নিয়ে তোমার সন্ধান পেয়েছি।’
‘কেন? আপনি জানতেন না আমাকে কোথায় বিয়ে দিয়েছেন?’
‘ওয়াজেদের কাছে শুনে আরমিন বলেছিল, তুষারের একটি দু’তলা বাসা আছে। আমরা ওখানে গিয়ে দেখে এসেছিলাম। কারে করে কিছু মেহমান এসেছে দেখে বাসায় যাইনি। এমন বাড়ি থাকলে ছেলেটি সম্ভবত ভালোই হবে ভেবে তোমাকে বিয়ে দিয়েছিলাম।’
‘ছোট মা ভুল বুঝেছিলেন, বাসাটি তুষারের না, ওয়াজেদ ভাইয়ের ছিল।’
‘হ্যাঁ হয়তো। আমি তোমার কোনো খোঁজখবর পাচ্ছি না দেখেই ওয়াজেদকে ফোন দেই। সে তোমাদের ঠিকানা দিয়েছে। এর আগে জানতাম না, তুমি নিজ বাসা থেকে এতো দূরে থাক।’
‘আমার নিজ কোনো বাসা নেই।’
‘আমি রাগের চোটে একটা ভুল করে ফেলেছি। এর জন্য এমন করছ কেন?’
‘একটি ভুল? বাসার বিষয় নিয়ে আমার ক্ষোভ বেশি নেই। কেন আমি যোগাযোগ রাখিনি জানেন? আপনি তো অবশ্য এই দিক থেকে কোনো ভুল কথা শুনেননি যে, তুষার নামের লোকটি আমাকে শাসনে রাখবে? ছোট মা নিশ্চয় এটা বলেছেন। আপনি ইচ্ছাকৃতভাবেই আমাকে এমন এক লোকের কাছে বিয়ে দিয়েছেন, যার আবেগ বলতে কিছু নেই, কেবল দায়িত্বের খাতিরেই আমার দেখাশোনা করে। এখানে একটি ভুল না। আপনি তিনটি জীবন নিয়ে খেলেছেন বাবা। জানেন, আমি আমার জীবন কীভাবে কাটাচ্ছি? যান্ত্রিক যে জীবনটা দিলেন, তাতে আনন্দ আনার জন্য আমি বাচ্চাদের পড়িয়ে সময় কাটাই। মাঝে মাঝে পাগলের মতো কাঁদতে থাকি। আর বাকিসময় বাস্তবে বসে ভাবতে থাকি অতীতের আনন্দময় দিনগুলোর কথা। এমন কার সাথে হয় বাবা? মানুষ বর্তমানে বসে ভবিষ্যতের কথা ভাবতে থাকে। আমার কাছ থেকে তো বর্তমান আর ভবিষ্যৎ দুটোই ছিনিয়ে নিলেন। এখানে কি মাত্র একটি ভুল? আপনি যেমন চেয়েছেন তেমনটাই হচ্ছে। আমি এখন একটি বাধ্য মেয়ে গিয়েছি।’
কিছুক্ষণ পর বাবা চলে গেলেন। আমার ভেতর থাকা সুপ্ত অনুভূতিগুলো পুনরায় আমাকে ছোবল মারছে। আমি মাথা চেপে শুয়ে পড়লাম।
বিকেলে ঘুম ভাঙল তুষারের ডাকে। সে বিছানার শেষদিকে বসে বলল, ‘আজ কি বই পড়নি?’
‘পড়া হয়নি।’
‘কেন?’
‘বাবা এসেছিলেন।’
‘কবে? আমাকে জানালে না কেন?’
‘বাবা জাস্ট কিছুক্ষণের জন্য এসেছিলেন, আমাকে দেখতে।’
‘ওহ। তা মন খারাপ?’
‘না। আমার রাগ উঠলে ঘুম একটু বেশি হয়।’
‘রাগ কেন উঠেছে? আমার কাছে বিয়ে দিয়েছেন বলে?’
আমি কিছু না বলে উঠে বসলাম।
‘ক্ষেতে যাবে?’
‘কোথায়?’
‘ক্ষেতে। এখানে ওয়াজেদের একটি জমি আছে। আমি চাষবাস করি।’
‘তাই নাকি?’
তার সাথে আমি বাড়ির পেছনের বিলে গেলাম। ওখান থেকে সামনের দিকে দূর-দূরান্ত পর্যন্ত বাড়ি দেখা যায় না। কত জমি! তুষার আমাকে ক্ষেত দেখাতে নেয়। টমেটোর চাষ করেছে সে। দূর থেকে দেখলে লাল ফোঁটাগুলো খুব সুন্দর দেখায়। তুষার কিছু কিছু টমেটোতে যত্ন সহকারে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে, যেন তার পালিত সন্তান। সে আমাকে ক্ষেতের পাশে একটি পুকুর দেখাল। তার পাশে আছে একটি দু’তলা বাড়ি। তুষার বলল, ‘এটি এখানের বড়পুকুর। এখানে অনেক মাছ। মাছ মাঝে মাঝে অনেকে ধরতে আসে। মালিক কিছু বলে না। অ্যাই, চল মাছ ধরি। আমি আগে কখনও ধরিনি। স্রেফ দেখেছি। এখন তুমিও যখন আছ..’
‘স্রেফ দেখেছ মানে? স্রেফ কী?’
‘স্রেফ মানে শুধু, কেবল।’
‘ওহ, আমার কিন্তু মাছ ধরার অভিজ্ঞতা নেই।’
‘আরে তোমার ধরা লাগবে না। আমিই ধরব। তুমি এখানে দুই মিনিট অপেক্ষা করো। আমি একটি বড়শি আনছি। কোথাও যেয়ো না বুঝেছ?’
আমি পুকুরপাড়ে ঝোপঝাড়ের পাশে বসে রইলাম। সে পাঁচ মিনিট পরে এলো।
‘সরি, বড়শি খুঁজতে দেরি হয়েছে।’
ওর প্যাণ্টের পকেট ফুলে থেকেছে। কী খুঁজছিল আমার বুঝতে দেরি হয়নি। মাঝে মাঝে সে সিগারেট কোথায় রেখে দেয় ভুলে যায়। সে বসে আমাকে মাছ ধরা শেখাতে লাগল। টোপ ফেলার পর কীভাবে কখন মাছ এসেছে বুঝা যাবে সে একদম খুব সুন্দর করে বুঝিয়ে দেয়। আমার অনিচ্ছা দেখে সে নিজেই টোপ ফেলে সিগারেট ধরিয়ে বসে রয়েছে। কিছুক্ষণ পরেই মাছ পাওয়া যায়। পরপর তিনবার সে বুঝতে পেরেছে মাছ এসেছে, অমনিই বড়শী টেনে নিয়েছে। ব্যাপারটা আমার ইন্টারেস্টিং লাগতে শুরু করছে।
আমি তুষারকে বলে বড়শি নিয়ে দুয়েকবার চেষ্টা করে মাছ ধরায় সফল হলাম। আমাদের মাঝে লেগে গেল প্রতিযোগিতা কে কার আগে মাছ ধরতে পারে। আমরা মাছ ধরতেই লাগলাম। মাছ ধরার শেষ নেই। একসময় আমরা পানির খুব কাছাকাছি নেমে মাছ ধরতে শুরু করি। আমি একটি মাছ ধরতে যাওয়ায় তুষার ধাক্কা খেয়ে পানিতেই পড়ে গেছে।
তুষার ডুবছে। আমি চিৎকার করলাম। পরক্ষণে সে নিজেই সাঁতরে এসে উঠে যায়। আমি অপরাধীর ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইলাম। মুহূর্তেই কিছু লোক পুকুরের কাছে এসে পড়েছে। এতক্ষণে খেয়াল করলাম, চারিদিকে অন্ধকার নেমে এসেছে!
এক মোটাসোটা লোক ভেজা তুষারের দিকে এবং পরে আমার দিকে টর্চের আলো ফেলে বলল, ‘কে তোমরা? এখানে কী করছ?’
আমাকে ধরে আনা কালো এক নাক বাঁকানো লোক বলল, ‘সাবজি, হেরা তো আমনের পুকুরের মাছ সব তুইলা ফেলাইছে।’
‘দেখি তো। দেখি তো। ওমা, এক বালতি। তোমরা কোথাকার মানুষ? আগে তো দেখি নাই।’
‘আমি তুষার। ও আমার বউ।’
‘ও আচ্ছা, তুমি না ওয়াজেদের বাসায় থাক? কী ভেবে মিয়া এতো মাছ তুললা?’
আমি আর তুষার একে অপরের দিকে তাকালাম। কেন এতো মাছ ধরলাম তা সেও হয়তো জানে না। আমরা মজা করায় এতোই ব্যস্ত হয়ে পড়লাম যে..
বাঁকা নাকের লোকটি বলল, ‘সাবজি, মাছের চক্করে হেরা কহন মইরা পড়ত হেরাই জানত না। আমনে যদি পানির আওয়াজ না হুনতেন.. আল্লায় জানেন কী অইত।’
‘হ্যাঁ, আল্লাহ তোমাদের বাঁচাইছে। মাছের অতিরিক্ত লোভ ভালো না। এতে মানুষের জানও যায়। আর এত্তগুলা মাছ কি তোমরাই লই যাইবা?’
‘না না,’ তুষার মাথার পানি ঝেড়ে বলল, ‘আমাদের মাছ লাগবেই না। এগুলো নিয়ে নেন বা পুকুরে ফেলে দেন, যাই করেন আমরা যাই।’
মালিক কিছু মাছ রেখে বাকিগুলো পুকুরে ফেলে দিলেন। আমরা বাসায় নীরবে চলে এলাম। সে সমানে বিড়বিড় করছে, অতিরিক্ত হয়ে গেছে। অতিরিক্ত হয়ে গেছে।
(চলবে..)
লেখা: ফারিয়া কাউছার