#জ্যামিতিক_ভালোবাসা- ৬ষ্ঠ পর্ব
©শাহরিয়ার
ঠিক চারটার সময় ইকরা সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে থাকে। ডাইনিং এ বসে থাকা সোহান সেদিকে তাকিয়ে বসা থেকে দাঁড়িয়ে যায়। অপলক নিচে নামতে থাকা ইকরার দিকে চেয়ে রয়। চোখের পলক যেন কোন ভাবেই ফেলতে পারছিলো না সোহান। প্রিয় নীল রঙের শাড়ির সাথে ম্যাচিং করে হাতে নীল চুড়ি পরেছে। খোঁপায় গোলাপ ফুল আর চোখের পাপড়ি টানা কালো কাজলে। সোহান মনে মনে বলে উঠলো অপূর্ব। কখন যে ইকরা সোহানের সামনে চলে এসেছে সেদিকে সোহানের খেয়াল নেই। এক দৃষ্টিতে সোহান চেয়েই রয়েছে।
ইকরা:- সোহানের সামনে দাঁড়িয়ে কানের কাছে হাত নিয়ে তুড়ি মেরে এই এভাবে তাকিয়ে আছো কেন?
সোহান:- চমকে উঠে তোকে দেখছিলাম। ইস গোলাপের জায়গায় যদি কাঁঠ গোলাপ হতো তাহলে আরও সুন্দর মানাতো তোকে।
ইকরা:- কে এনে দিবে শুনি আমার কি আর এ বাড়িতে আপন বলতে কেউ আছে?
সোহান:- আচ্ছা যা কোন একদিন এনে দিবো এখন চল দেরী হয়ে যাবে না হলে, অনেকটা পথ যেতে হবে।
— দু’জন বাসা থেকে বের হয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়ালো। একটি রিক্সাও দেখা যাচ্ছে না, এদিকে বাহিরে এখনো ভালো রৌদ্দের তাপ রয়েছে। সোহান ইকরার দিকে তাকিয়ে বললো চল মোর পর্যন্ত হেঁটে যাই।
ইকরা:- ঠিক আছে।
— বলে সোহানের সাথে সাথে হাঁটতে শুরু করলো, কয়েক পা হেঁটে ইকরা দাঁড়িয়ে গেলো। সোহান পিছু ফিরে তাকিয়ে কি হলো?
ইকরা:- শাড়ি পরে এভাবে একা আমি হাঁটতে পারি না।
সোহান:- তাহলে কি করবো? এদিকে তো কোন রিক্সাও নেই।
— বলতে বলতে আবার ইকরার সামনে এসে দাঁড়ালো। ইকরা নিজের হাত সোহানের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে। ধরে রেখো তাহলেই আমি হাঁটতে পারবো। ইকরার হাতের দিকে হাত বাড়াতেই সোহানের হার্টবিট বাড়তে শুরু করলো। তবুও সাহস করে সে হাত বাড়িয়ে ইকরার হাতটাকে হালকা করে চেঁপে ধরলো। সোহানের হাতের স্পর্শে ইকরা মিষ্টি করে হাসি ফুটিয়ে সোহানের পাশে হাঁটতে শুরু করলো আর মনে মনে বললো গাধা একটা।
সোহান:- কিছু বললি?
ইকরা:- কই নাতো।
সোহান:- ওহ আচ্ছা আমি মনে হয় ভুল শুনেছি।
ইকরা:- ইস এই অবস্থায় যদি তোমার প্রেমিকা দেখে ফেলে তুমি আমার হাত ধরে নিয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছো, তবে তোমাকে যে কি করবে। ভাবতেই আমার কেমন জানি হাসি পাচ্ছে।
সোহান:- ইকরার কথা শুনে জোড়ে জোড়ে হাসতে হাসতে না আমার কোন প্রেমিকা আছে আর না এসব নিয়ে টেনশন আছে বরং নিজের চিন্তা কর একবার যদি তোর বয়ফ্রেন্ড দেখে ফেলে তাহলে কেমন হবে ব্যাপারটা?
ইকরা:- হুর আমার ঐসব কিছু নাই।
সোহান:- কি বলিস সত্যিই তোর কোন বয়ফ্রেন্ড নেই?
ইকরা:- বললাম তো নেই, তোমার বিশ্বাস না হলে আমার কিছু করার নেই। ঐসব প্রেম ভালোবাসা আমার দ্বারা হবে না। আচ্ছা তুমি বলো তোমার কেমন মেয়ে পছন্দ খু্ঁজে দিবো।
সোহান:- থাক লাগবে না।
ইকরা:- উহু বলোতো তুমি।
সোহান:- চোখ দুটো টানা টানা, ঠোঁটে লেগে থাকবে মিষ্টি হাসি। মায়াবী সে হাসিতে আমার মন হারাবে। তার কথায় মুক্তা ঝরবে আমি মুগ্ধ হয়ে তার দিকে চেয়ে রইবো। তার হাইট তোর মত হলে ভালো হবে একটু কম বেশী হলে সমস্যা নেই। তবে ঠিক তোর মত ঠোঁটের নিচে একটা তিল থাকা চাই তো চাই। তা না হলে আর আমার প্রেম ভালোবাসা হবে না বুঝলি।
ইকরা:- তুমি চিন্তা করো নাতো আমি ঠিকই খুঁজে এনে দিবো এমন মেয়ে।
সোহান:- সত্যি এনে দিবি?
ইকরা:- মনে মনে তোমার মাথাটা ফাঁটিয়ে দিবো। হ্যাঁ সত্যি দিবো।
— সোহান মনে মনে আস্ত মাথা মোটা একটা মেয়ে এতো করে বুঝালাম তবুও বুঝলো না। আর কি করে বুঝাবো তোকে?
— ইকরা এতো সুন্দর একটা সুন্দরি মেয়ে পাশে থাকার পরেও সে অন্য মেয়েকে নিয়ে কল্পনা করছে। ইচ্ছে করছে একটা ধাক্কা মেরে ড্রেনে ফেলে দিতে।
— দু’জনের ভাবনা জুড়ে শুধুই দু’জন অথচ কাউকে কেউ বলতে পারছে না কতটা ভালোবাসে। রিক্সায় উঠে শ্যামলীর উদ্দেশ্যে রওনা হলো দু’জন পাশাপাশি বসেও তাদের মাঝে অনেকটা গ্যাপ রেখেছে সোহান। ভাঙা রাস্তার কারণে ঝাঁকুনি লাগছে বার বার, ইকরা ঝাঁকুনিতে বার বার সামনে চলে যাচ্ছে শাড়ি পিছলে। কি করবে ভেবে না পেয়ে সোহানের হাতের ভিতর নিজের একটা হাত ঢুকিয়ে শক্ত করে চেঁপে ধরতেই সোহানের শরীর বা দিকে কিছুটা ঝুঁকে এলো। দু’জনের দেহের সাথে দেহের স্পর্শে দু’জনই কিছুটা কেঁপে উঠলো। সোহান এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো ইকরার দিকে।
ইকরা:- যেন সব ভুলে গিয়েছে ভুলে গিয়েছে এখনো বলতে পারেনি সোহানকে ভালোবাসি কিংবা সোহানএ কোন দিন বলেনি ওকে ভালোবাসে তবুও নিজের মাথাটা সোহানের কাঁধে রেখে সোহানকে প্রশ্ন করলো কি দেখো এমন করে?
সোহান:- কিছুটা বিব্রত হলেও নিজেকে সামলে নিয়ে, ইকরার চুলে হাত দিয়ে কি যেন একটা উড়ে এসে তোর চুলের মাঝে পড়েছিলো।
ইকরা:- তুমি মিথ্যা বলছো আমি তোমাকে চিনি তুমি মিথ্যা বললে তোমার কপালে ঘাম জমতে শুরু করে যেমনটা এখন তোমার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে শুরু করেছে।
সোহান:- আরও বিব্রত হয়ে গেলো কি বলবে ঠিক বুঝতে পারছে না, তবে কি ইকরা বুঝে ফেললো সে তাকে ভালোবাসে? নাকি ও অন্য কিছু মনে করলো। আরে না আমি কেন মিথ্যা বলবো তোকে?
ইকরা:- মানুষ অনেক কারণে মিথ্যা বলতে পারে তা ভালোর জন্যও হতে পারে আবার খারাপের জন্যও হতে পারে। নিজেকে বাঁচানোর জন্যও বলতে পারে আর অন্যকে বাঁচানোর জন্যও বলতে পারে।
সোহান:- এতো সময়ে নিজেকে বেশ ভালো ভাবেই সামলে নিয়েছে। তাই ইকরার দিকে কিছুটা ঘুরে একটা কানে হাত দিয়ে খুব বেশী পেঁকে গেছিস তাই না।
ইকরা:- উফ ছাড়ো লাগছেতো মানুষ কি মনে করবে?
সোহান:- ইকরার কান থেকে হাত সরিয়ে নিতে নিতে মানুষেরটা আমি খাই ও না পরিও না বুঝলি। যে মানুষ কি করলো তা নিয়ে আমার মাথা ব্যথা থাকবে।
— দু’জন গল্প করতে করতে এক সময় শ্যামলী বাস স্ট্যান্ডে চলে আসলো রিক্সা। রিক্সা থেকে নেমে বাস কাউন্টারে যেয়ে সকলের জন্য টিকিট কিনে নিলো। তখন শেষ বিকেলো কিংবা সন্ধ্যার প্রথম প্রহর। সোহান ইকরার চোখে চোখে রেখে বললো কোথায় যাবি এখন?
ইকরা:- হাত বাড়িয়ে সোহানের হাত চেঁপে ধরে যেখানে নিয়ে যাবে তুমি।
সোহান:- চল পালিয়ে যাই দু’জন যেদিকে দু’চোখ যায়।
ইকরা:- সোহানকে কিল ঘুষি মারতে মারতে এই আমরা কি চোর নাকি ডাকাত পালিয়ে যাবো। আর তোমার সাথে কেন পালাবো আমি তোমার কে হই?
সোহান:- আরে থাম থাম মানুষ তাকিয়ে মজা নিচ্ছে মাফ চাই তোকে কোথাও যেতে হবে না। চল সামনের দিকে হেঁটে যাই। তারপর রিক্সা নিয়ে চলে যাবো।
— দু’জন হাঁটতে শুরু করলো। কিছুটা পথ হেঁটে আবারো রিক্সায় উঠলো। গল্প করতে করতে রিক্সা ধানমন্ডি লেকের কাছে চলে আসলো দু’জন রিক্সা থেকে নেমে একটা ফুচকার দোকানের সামনে যেয়ে দাঁড়ালো। পুরো আকাশ তখন কালো হয়ে আছে যে কোন সময় বৃষ্টি নামবে বলে।
সোহান:- ইকরার মুখোমুখি একটা চেয়ার টেনে বসতে বসতে মনে হয় বৃষ্টি নামবে।
ইকরা:- খুশি হয়ে তাই, নামলে নামুক আমি ভিজবো।
সোহান:- পাগল নাকি ভিজে জ্বর বাধাবি নাকি?
ইকরা:- মোটেও না বৃষ্টিতে ভিজতে আমার ভীষণ ভালো লাগে। আমার কিছুই হবে না।
সোহান:- ঐসব চলবে না, শেষে জ্বর আসলে আমাকেই সবার বকা শুনতে হবে।
ইকরা:- চুপ একদম চুপ, বেশী কথা বললে আমি বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করবো তখন সব মানুষ জন এসে তোমার হাত পা ভেঙে দিবে।
সোহান:- কেন কেন আমি কি করছি?
ইকরা:- এই যে কোন কথা শুন না তাই।
সোহান:- আমি তোর কথা শুনবো নাকি তুই আমার কথা শুনবি?
— দু’জন কথা বলতে বলতে ফুচকা চলে আসলো।
ফুচকা খেতে খেতে ঝুম বৃষ্টি শুরু হলো। দু’জন তাড়াতাড়ি ফুচকা শেষ করে উঠে দাঁড়ালো। সোহান কোথাও দাঁড়ানোর জন্য জায়গা খুঁজলো। আর ইকরা বৃষ্টিতে ভেজার জন্য হাঁটতে শুরু করলো। ইকরার এমন অবস্থা দেখে সোহান মনে মনে বলে উঠলো পাগলী একটা।
ইকরা:- কই আসো না কেন?
— সোহান ইকরার সাথে হাঁটতে শুরু করলো।
সোহান:- অনেকটা পথ কিন্তু তোর হাঁটতে কষ্ট হবে।
ইকরা:- কিছু হবে না বুঝলে। আমি অনেক হেঁটেছি।
সোহান:- হেঁটেছিস কিন্তু তা জামা পরে শাড়ি পরে না।
ইকরা:- সোহানের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে তুমি ধরে রাখো তাহলেই হবে।
— সোহান ইকরার দিকে চেয়ে হাত বাড়িয়ে দিলো। ইকরার কপাল বেয়ে টপটপ করে বৃষ্টির পানি পরছে। পুরো শরীর বৃষ্টিতে ভিজে গেছে। দু’জন গল্প করতে করতে হাঁটছে সোহান মনে মনে বলছে এই পথ যদি শেষ না হতো। তাহলে হয়তো আমিই হতাম পৃথিবীর সবচেয়ে সুখি মানুষ। ইকরা মনে মনে বুঝে না কিছু এতো কাছে এক সাথে পাশাপাশি হেঁটে চলছি, একটু বেশী সময় একান্ত কাছে পাবার জন্য। অথচ সে বুঝতেই পারছে তাকে আমি ভালোবাসি কত।
চলবে…