#জোড়া_শালিকের_সংসার
#মুন্নী_আরা_সাফিয়া
#পর্ব_০৭
|৯|
নির্ঝরের কেবিনে খেয়া বসে আছে।নির্ঝর নেই এখানে।সে ম্যানেজারের সাথে কথা বলছে বাইরে।খেয়া উঠে দাঁড়িয়ে কেবিনের চারপাশ ভালো মতো দেখতে শুরু করলো।
কাচের জানালার সামনে থেকে বেশ কিছুক্ষণ সে বাইরে তাকিয়ে রইলো।কাচের ভেতর দিয়েও প্রকৃতি দেখার আলাদা আনন্দ আছে।
নির্ঝরের অফিসটি ছয় তলায়।নিচ দিয়ে ব্যস্ত নগরী।কত ব্যস্ত সবাই।একমাত্র খেয়াই দিন দিন অসাড়,নিষ্ক্রিয় হয়ে যাচ্ছে।
বড় করে শ্বাস নিল সে।
ঘুরে টেবিলের কাছে আসল।আজকের খবরের কাগজ।সে হাত বাড়িয়ে খবরের কাগজটা হাতে নিল।
খবর কাগজ সরাতেই একটা ডায়েরি নজরে এলো।নির্ঝর ডায়েরি লিখে?ডায়েরিতে কি লিখে?
বেশ কৌতূহল নিয়েই সে ডায়েরিটা হাতে নিল। পরপর পেইজ উল্টালো।
প্রথম পেইজে কিছু একটা লেখা হয়েছিল।কিন্তু কি লেখা হয়েছিল তা বোঝার উপায় নেই।কারণ তার উপর কলমের ঝড় বয়ে গেছে।
নিচের তারিখটা অক্ষত আছে।আজ থেকে প্রায় এক বছর আগের তারিখ।
খেয়া পরের পেইজ উল্টাল।পনেরো-বিশটা পেইজের মতো ছেঁড়া।ডায়েরিটার এমন করুন দশা কেন?
ছিঁড়ে ফেলা পেইজ গুলোর অজানা লেখা পড়তে না পারায় বেশ মন খারাপ হলো তার।বাকি অংশে কি লেখা আছে পড়ার জন্য দ্রুত পাতা উল্টাল।
মাঝামাঝি জায়গা একটা ছন্দ লেখা।
“তুমি অন্য কারো মোহে আকুল?
দেখতে পাও না এই আমি তোমাতে কতটা ব্যাকুল!”
এই লাইন দুটো খেয়ার বেশ পছন্দ হলো।তার মানে সত্যি নির্ঝরের ছন্দ মেলানোর রোগ হয়েছে?
পরের পেইজ উল্টানোর আগেই পেছন থেকে নির্ঝরের কন্ঠ কানে আসলো।
__’কি করো?’
খেয়া ডায়েরিটা বন্ধ করে পেছন ঘুরে সামান্য হেসে বলল,
__’কিছু কি করার কথা?’
নির্ঝরের নজর খেয়ার হাতের ডায়েরিটার উপর পড়তেই ভয়ার্ত চোখে তাকাল।দৌঁড়ে এসে ডায়েরিটা একপ্রকার কেড়ে নিয়ে বলল,
__’পড়েছো কিছু?’
__’পড়তে দিলেন কই!তার আগেই এসে হাজির।’
নির্ঝর বড় করে শ্বাস নিল।
__’বাঁচলাম।’
__’সামান্য ডায়েরিতে হাত দিতেই বাঁচা মরার প্রশ্ন আসছে কোথা থেকে? ‘
__’ও তুমি বুঝবে না।’
__’বুঝিয়ে বললে তো বুঝবো, নাকি?’
__’তুমি কি সত্যিটা শুনতে চাও?নাকি কথার কথা জিজ্ঞেস করছো?’
খেয়ার ভেতর দিয়ে শীতল রক্ত বয়ে গেল।ইদানীং সে কি বাড়তি কথা বলে?ডায়েরিতে কি লেখা আছে কেন জানতে চাইবে?
তবে সে আন্দাজ করতে পারলো কার ব্যাপারে লেখা আছে।
কথা ঘুরানোর জন্য বলল,
__’আপনার অফিসের কাজ শেষ?যাবেন না?’
__’হুঁ!ল্যাবে একবার যেতে চেয়েছিলাম।তবে আজ আর যাবো না।’
__’আপনার ল্যাব ট্যাব নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই।যন্ত্রপাতি দেখলেই মাথা ঘুরে।’
নির্ঝর হেসে দিল।ডায়েরিটা পুনরায় টেবিলের ড্রয়ারে রেখে বলল,
__’চলো তো!বাইরে বের হবো এখন।’
নির্ঝরের পেছন পেছন হেঁটে খেয়া গাড়িতে উঠলো।
|১০|
__’কোথায় যাবে?কোন পার্ক,রেস্টুরেন্ট নাকি নদী?’
__’আমার কোনো ইচ্ছে নেই।আপনার যেখানে যেতে মন চায় যান।’
__’তুমি কি কোনো কারনে আপসেট?যেতে চাচ্ছো না?না যেতে চাইলে সমস্যা নেই।গাড়ি ঘুরিয়ে বাসায় যাই।’
__’বেশি কথা না বলে গাড়ি চালান তো!’
বলেই খেয়া গাড়ির সিটে হেলান দেয়।নির্ঝর এক পলক খেয়ার দিকে তাকিয়ে গাড়ি চালানোতে মন দেয়।
আধ ঘন্টা পর একটা রেস্টুরেন্টের সামনে গাড়ি থামায় সে।খেয়ার দিকে তাকায়।চোখ বন্ধ করে আছে।ঘুমিয়ে পড়েছে হয়তো!
নির্ঝর তাকে ডাক দেয় না।গাড়ি এক সাইডে পার্ক করে চুপচাপ বসে থাকে।
গাড়ির সিটে হেলান দিয়ে সেও খেয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে।খেয়া আজ নীল রঙের শাড়ি পড়েছে।নীল রঙটা কি মেয়েদের বেশি প্রিয়?
বাংলাদেশের অর্ধেকের বেশি মেয়েদের নীল রঙের প্রতি আলাদা উইকনেস রয়েছে।বিশেষ করে অল্প বয়সী মেয়েদের মধ্যে এই প্রবণতা বেশি দেখা যায়।
অল্প বয়স বলতে আবেগের বয়সটা!আচ্ছা, নীল রঙের সাথে আবেগ নামক অনুভূতির কোনো যোগসূত্র আছে?এর আগে কেউ কি গবেষণা করেছে নীল রঙ পছন্দের কারন?
তবে নীল শাড়িতে খেয়াকে বেশ মানিয়েছে।কি সুন্দর লাগছে তাকে?আচ্ছা, খেয়া কি সত্যিই এত সুন্দর নাকি শুধুমাত্র তার চোখে?
নির্ঝর নিজের অজান্তে খেয়ার দিকে একটু ঝুঁকলো।সে চাচ্ছে খেয়া মাথাটা তার কাঁধে রেখে ঘুমাক।
অতি সাবধানে সে খেয়ার মাথাটা নিজের কাঁধে রাখলো।খেয়ার মাথার চুল ছোট ছোট ক্লিপ দিয়ে খোঁপা করা।সে কিছুক্ষণ তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল।
হঠাৎ করে তার রাতের করা কাজটা আবার করার তীব্র ইচ্ছে জাগলো।খেয়ার গালে চুমু দেয়ার জন্য মুখটা নিচু করতেই ধপ করে খেয়া চোখ খুলল।
ব্যাপারটার জন্য নির্ঝর মোটেই প্রস্তুত ছিল না।সে হতভম্বের মতো বড় বড় করে তাকিয়ে রইলো।
খেয়া কপাল কুঁচকে তাকিয়ে আছে।যেন বোঝার চেষ্টা করছে কি হচ্ছে!
একটুপর যখন বুঝতে পারল সে নির্ঝরের কাঁধে মাথা রেখেছে, দ্রুত সরে বসল।শাড়ির আঁচল ঠিক করে বলল,
__’এসে গেছি?নামবো?’
__’হুঁ!’
খেয়া জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল।এটা একটা রেস্টুরেন্ট দেখে সে চিন্তিত গলায় বললো,
__’আপনি না বললেন ঘুরতে যাবেন,তাহলে রেস্টুরেন্টে কেন?’
নির্ঝর গাড়ির চাবিটা পকেটে পুড়ে বলল,
__’তোমার মন মেজাজ আজ ভালো নেই। তাই সিদ্ধান্ত বদলেছি।খেয়েই চলে যাবো।’
__’আমার মন মেজাজ আর কোনোদিন ভালো হবে না।এমনই থাকবে সারাজীবন।’
__’মনের উপর কারো হাত নেই।এমনকি নিজের ও না।মন নামক শব্দটার ওপর কারো অধিকার খাঁটে না।ভবিষ্যতে দেখা গেল,তুমি আগের চেয়েও হাসিখুশি আর উৎফুল্ল হয়ে গেলে।শুধুমাত্র সময়ের ব্যাপার।’
__’আজকাল মনে হয় আমার মধ্যে মন নামক বস্তুটিই নেই!আবার তার পরিবর্তন।’
নির্ঝর মনে মনে বলল,
__’তোমার মনকে নতুন করে জাগাব আমি।একদিন তোমার মনে শুধু আমান বিচরণ থাকবে।এই নির্ঝর জুবায়ের থাকবে।আর সেটা তুমি নিজ মুখে স্বীকার করবে।’
পরিস্থিতি হালকা করার জন্য মুখে এক গাল হেসে বলল,
__’ Come over the hills
and far with me,
and be my love in the rain..
বলোতো এটা কার বাণী?’
খেয়া মুচকি হেসে বলল,
__’জানলেও বলবো না।’
__’তুমি জানোই না।নাও,এখন গাড়ি থেকে নামো।কিছু খেয়ে নিই।’
গাড়ি থেকে নেমে দুজন রেস্টুরেন্টে ঢুকলো।প্রবেশ পথের শুরুতেই ডান দিকের ফাঁকা টেবিলটাতে দুজন বসল।রেস্টুরেন্টে মানুষ অনেক কম।খেয়া স্বস্তি পেল!
__কি খাবে বলো?’
__’আমার মতামত চাইলে শুধু বলবো এক কাপ কোল্ড কফি।আর কিছু নাহ।’
খেয়াকে অবাক করে সত্যি সত্যি নির্ঝর দুটো কোল্ড কফি অর্ডার করলো।
কয়েক মিনিটের মধ্যে কফি এসে পৌঁছাল।খেয়া নেড়েচেড়ে একটু আড়ষ্ট হয়ে কফির কাপে চুমুক দিল।
খেয়া মাথা নিচু করে আছে।কোনো কথা বলছে না।নির্ঝর তাকে প্রশ্ন করে বিরক্ত করলো না।
এই যে খেয়ার এত কাছাকাছি সে বসে আছে এতেই সে খুশি।
আধ ঘন্টা পর নুহার জন্য আইসক্রিম কিনে তারা রেস্টুরেন্ট থেকে বের হলো।
গাড়ির কাছে হেঁটে যেতেই দেখে জাহিদ দাঁড়িয়ে আছে।তার সাথে জাহিদের সমবয়সী একটা মেয়ে।
জাহিদ মেয়েটার হাত ধরে আছে।
খেয়া হাঁটা থামিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে পড়লো।তার চোখ ছলছল করছে।ততক্ষণে নির্ঝরেও চোখে পড়েছে জাহিদকে।
নির্ঝর জাহিদকে ভালো করেই চিনে।বিয়ের আগে খেয়ার সাথে বেশ কয়েকবার দেখেছে।দু একবার তার সাথেও কথা হয়েছে।
জাহিদও বেশ অবাক হয়ে তাদের দুজন কে দেখছে।একটুপর কয়েক পা এগিয়ে এসে কুটিল হাসি হেসে বলল,
__’বাহ!আমি ডিভোর্স দিতে না দিতেই পুরনো প্রেমিককে জুটিয়েছ?খবর নিয়ে জানলাম তার বাসাতেই নাকি থাকো।তা বিয়ে সাদি করেই রাসলীলা শুরু করেছ নাকি লিভ টুগেদার?’
জাহিদের কথা শেষ হতে না যতক্ষণ, ততক্ষণে তার নাকে একটা ঘুষি পড়েছে।নির্ঝরের ঘুষি খেয়ে সে একটু ছিঁটকে পিছিয়ে গেল।
(চলবে)
#জোড়া_শালিকের_সংসার
#মুন্নী_আরা_সাফিয়া
#পর্ব_০৮
নির্ঝরের ঘুষি খেয়ে জাহিদ ছিঁটকে কিছুটা পেছনে সরে গেল।আবার মারার জন্য উদ্যত হতেই খেয়া তার হাত টেনে ধরলো।
কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,
__’কি করছেন কি?মাথা খারাপ হয়ে গেছে আপনার?’
জাহিদ কাটা ঠোঁটের কোণা থেকে ব্লাড মুছে বলল,
__’শালা!আমার ব্যবহৃত জিনিস, যেটা আমি ছুঁড়ে ফেলে……….. ‘
জাহিদের কথা শেষ করতে না দিয়েই খেয়ার হাত এক ঝটকায় সরিয়ে কলার ধরে এলোপাথাড়ি কিল, ঘুষি শুরু করলো নির্ঝর।জাহিদও থেমে নেই।সেও নির্ঝরকে ঘুষি দিল।
খেয়া চিৎকার করে কান্না করে দিল।নুহার জন্য কেনা আইসক্রিমের ব্যাগ ফেলে রেখে নির্ঝরকে টেনে সরানোর চেষ্টা করতে করতে বলল,
__’ওকে ছাড়ুন।প্লিজ ওকে ছাড়ুন।’
নির্ঝরের দুচোখ রক্তবর্ণ ধারণ করেছে।চোয়াল শক্ত হয়ে গেছে।জাহিদকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল।হাত মুঠ করে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
__’এই বাস্টার্ড কি বলছে তুমি শুনেছ?ওর সাহস কি করে হয় তোমাকে নিয়ে এসব বলার?’
__’মিথ্যে তো বলেনি।’
খেয়ার বলা শেষ হতে না হতেই নির্ঝর ঠাস করে তার গালে একটা চড় বসিয়ে দিল।
খেয়া গালে হাত দিয়ে অশ্রু ঝরা চোখে অবাক হয়ে তার দিকে তাকাল।জাহিদ ও তার পাশের মেয়েটাও ভীত চোখে তাকিয়ে আছে।
নির্ঝর সবার দৃষ্টি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে খেয়ার হাত ধরে জাহিদের কাছে নিয়ে গিয়ে বলল,
__’তোর মতো রাবিশের মুখ বন্ধ করার জন্য আজ, এই মুহূর্তে আমি খেয়াকে বিয়ে করবো।ও আমার জীবনের সবচেয়ে দামী মুক্তা।আমি নিজের থেকে বেশি ওকে সম্মান করি।আর সেই তুই?ওকে নিয়ে আজেবাজে কথা বলিস?তোর জিভ টেনে যে আমি ছিঁড়ে ফেলিনি তাতেই অনেক কিছু! ‘
একটু থেমে বলল,
__’আজকের পর থেকে যদি তোকে কোনোদিন খেয়ার আশপাশে দেখি তাহলে ওই দিনই হবে তোর শেষ দিন।মনে রাখিস! ‘
বলেই খেয়াকে টেনে গাড়িতে উঠে গাড়ি স্টার্ট দিল।
জাহিদ তার পাশে থাকা ভীত চোখের মেয়েটিকে ধরে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতে উঠতে পারলো না।
|১১|
নির্ঝর ফুল স্পিডে গাড়ি ড্রাইভ করছে।খেয়া নিঃশব্দে কান্না করছে আর আড়চোখে বার বার নির্ঝরের দিকে তাকাচ্ছে।
নির্ঝর এখনো চোয়াল শক্ত করে আছে।কোনো কথা বলছে না।খেয়া বেশ বুঝতে পারলো সে এখনো রেগে আছে।কিন্তু রাগের মাথায় যদি তাকে সত্যি সত্যি বিয়ে করে ফেলে?
না, এটা কখনোই হতে পারে না।সে এই জীবনে আর কাউকে নিজের সাথে জড়াবে না।স্বয়ং জাহিদকেও না!
খেয়া সাহস করে নির্ঝরকে বলল,
__’একটু আস্তে ড্রাইভ করুন।আমি ভয় পাচ্ছি। ‘
নির্ঝর কোনো উত্তর দিল না।গাড়ির স্পিড আরো বাড়িয়ে দিল।গাড়ি এখন উল্কার বেগে ছুটে চলেছে।মনে হচ্ছে যেকোনো সময় কোথাও আঘাত হানবে।
খেয়া বেশ ভয় পেল।সে শক্ত করে সিটবেল্ট ধরে নির্ঝরকে বলল,
__’আপনি পাগল হয়ে গেছেন?কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে?’
খেয়ার মুখে পাগল কথাটা শুনে নির্ঝর আরো চটে গেল।খেয়া তার সব কর্মকান্ড পাগলামি মনে করছে?কেন বুঝতে পারছে না এসব সে ভালোবাসার জন্য করছে?ভালোবাসা থেকে করছে?
কেন বুঝতে পারছে না কেউ তাকে নিয়ে বাজে কথা বললে তার কলিজায় লাগে?নাকি বুঝেও বুঝতে চায় না?
সে রেগে বলল,
__’হ্যাঁ,আমি পাগল হয়ে গেছি।পাগলামির দেখেছ কি?সবে শুরু।একটুপর তুমিসহ গাড়িটা একটা খাদে ফেলে দিবো।খাদ খুঁজছি চারপাশে। দেখতে পাচ্ছো না?’
__’কি?আপনি পাগল হয়ে গেছেন।গাড়ি থামান!আমি নেমে যাবো!’
__’নো থামাথামি।তওবা করে নাও মনে মনে।পরে আর সময় পাবে না হয়তো।দুজন একসাথে মরব।’
খেয়া জোরে জোরে কান্না শুরু করে দিল। এখনই এত অল্প বয়সে মরতে চাচ্ছে না সে।কলেজে থাকতে একবার সাজেক ঘুরতে যেতে চেয়েছিল।আর সময় বা সুযোগ কোনোটাই হয়ে উঠেনি।
নির্ঝরকে দেখে তার মোটেই মনে হচ্ছে না সে ইয়ার্কি করছে।তাছাড়া সে মজা করার মুডে নেই।
খেয়ার কান্নার শব্দে নির্ঝর চিল্লিয়ে বলল,
__’খবরদার,কান্না করবে না!কান্না করে কোনো লাভ হবে না।আমি ডিসিশন নিয়ে নিয়েছি।’
__’প্লিজ এমন পাগলামি করবেন না।’
__’তুমিই তো বললে আমি পাগল!তাহলে ভয় কেন পাচ্ছো?পাগলের কাজই তো পাগলামি করা।’
নির্ঝরের কথা শুনে খেয়া আরো জোরে কেঁদে উঠলো।
ঠাস করে গাড়ির ব্রেক কষে নির্ঝর।খেয়া মুখ থু্বড়ে পড়তে পড়তে নিজেকে সামলে নেয়।কিছুক্ষণ ধাতস্থ হয়ে গাড়ির কাচ দিয়ে পরিষ্কার দেখতে পারে একটা ব্রিজের উপর গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। নিচে গহীন নদী।
নির্ঝর গাড়িতে হেলান দিয়ে মাথা চেপে ধরল।একটু পর শান্ত স্বরে বলল,
__’আমি এখন সিরিয়াস কথা বলবো।আমাকে বিয়ে করতে হবে তোমার।তাও আবার আজকে।এক ঘন্টার মধ্যে।রাজি?’
খেয়া বিস্ফারিত নয়নে বলল,
__’অসম্ভব! ‘
__’বেশ!আমি জানতাম তুমি রাজি হবে না।সেজন্য বিকল্প হিসেবে গাড়িটা ব্রিজ থেকে নিচে ফেলে দিবো।দুজনের ঝামেলা চুকে যাবে।আমি আর নতুন করে কোনো ঝামেলাতে জড়াতে চাই না।’
__’দেখুন,একটু বোঝার চেষ্টা করুন।’
__’নো বোঝাবুঝি।এমনেই অনেক বুঝি আমি।তাছাড়া পাগলরা একটু বেশিই বুঝে।তোমার বোঝানোর প্রয়োজন দেখছি না।তিন পর্যন্ত কাউন্ট করবো আমি।এর মধ্যে বিয়েতে হ্যাঁ অথবা না বলে দিবে।একটা কথা।আমি কিন্তু এখন নিজের মধ্যে নেই।ইমপালস এর উপর নির্ভর করে যেকোনো সময় যেকোনো কিছু করতে পারি।’
খেয়া কান্না করতে করতে বলল,
__’বিয়ে কি ছেলে খেলা নাকি?বললেন আর রাজি হয়ে গেলাম।প্লিজ একটু বুঝুন।আমি আপনাকে বিয়ে করতে পারবো না।’
খেয়ার কথা শেষ হতেই নির্ঝর গাড়ি স্টার্ট দিয়ে এলোমেলো ভাবে ড্রাইভ শুরু করলো।খেয়া স্তব্ধ হয়ে বসে থাকতে পারছে না।গাড়িতে দুলুনি সৃষ্টি হয়ে গেছে। সে কান্না করতে ভুলে গেছে যেন!
নিজের সিটেও ঠিকমতো বসে থাকতে পারছে না দুলুনির জন্য। হঠাৎ করে গাড়ি সোজা ব্রিজের কর্ণারে গিয়ে আঘাত হানার আগেই সে নির্ঝরের এক হাত জড়িয়ে চোখ বন্ধ করলো।
জড়ানো গলায় বললো,
__’আমি রা-রাজি।আপনাকে বিয়ে করতে রাজি!’
খেয়ার কন্ঠ কানে আসতেই নির্ঝর দ্রুত ব্রেক কষে দিল।
সেও চোখ বন্ধ করে বড় বড় করে শ্বাস নিল।সে আজ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল।সত্যি সত্যি গাড়িটা নিচে ফেলে দিত।
একটুপর চোখ খুলে খেয়ার দিকে তাকাল।খেয়া এখনো তার বাম হাত জড়িয়ে আছে।তার শরীর কাঁপছে।প্রচন্ড ভয় পেয়েছে।
নির্ঝর বাম হাত দিয়ে তাকে কাছে টেনে নিল।খেয়াও গুটিশুটি হয়ে তার বুকে মুখ লুকাল।
__’চোখ খুলো খেয়াতরী।উই আর সেইফ নাও!’
খেয়া কোন কথা বলল না।নির্ঝর আবার বলল,
__’আ’ম সো মাচ টায়ার্ড অফ এক্টিং কুল!আজ সত্যি সত্যি কিছু একটা করে ফেলতাম।ধন্যবাদ, শেষ সময়ে আমাকে কন্ট্রোল করার জন্য।’
খেয়া এবারও জবাব দিল না।নির্ঝর তার মুখের দিকে তাকিয়ে হালকা করে ডাক দিল।
__’খেয়া?এই খেয়া?কথা বলো।দেখো আর কোনো ভয় নেই।আমরা নিরাপদ এখন।’
খেয়ার শরীর নিস্তেজ হয়ে গেছে।নির্ঝর তার গালে হাত রেখে বুঝতে পারলো সেন্সলেস হয়ে গেছে।গাড়ির ড্রয়ার থেকে পানির বোতল বের করে কয়েক ফোঁটা ছিটিয়ে দিল।জ্ঞান ফেরানোর পুরনো এবং কার্যকর পদ্ধতি।
খেয়া পিটপিট করে তাকাল।ভয়ার্ত চোখে নির্ঝরকে দেখল।পরমুহূর্তে নিজেকে নির্ঝরের বুকে আবিষ্কার করে সারা মুখে লজ্জার আভা ফুটে উঠলো।সে সরে যেতে নিতেই নির্ঝর আটকাল।এক হাতে জড়িয়ে বলল,
__’একটু পানি খাও!’
__’ছাড়ুন।খাচ্ছি।’
নির্ঝর তাকে ছেড়ে দিল।খেয়া নিজের সিটে পুনরায় বসে ঢকঢক করে পুরো বোতল খালি করল।
নির্ঝর খালি বোতলের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে চেয়ে বলল,
__’আমার জন্য একটু রাখলে না?’
খেয়া উত্তর দিল না।জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল।নির্ঝর তার দিকে এক পলক চেয়ে গাড়ি স্টার্ট দিল।
|১২|
নিঃশব্দে বিয়ের কাজ মিটে গেল।নির্ঝর গাড়ির স্টিয়ারিং এ হাত রেখে একটা দম নিল।তার বুকের ভেতর সুখের ঝড় বয়ে যাচ্ছে।আপাতত তার পাশে থাকা মেয়েটা দূরের কেউ নয়।অন্য কেউ নয়।তার বউ!শুধুমাত্র তার বউ!
সে মনে মনে তিনবার উচ্চারণ করলো,
__’বউ!বউ!বউ!’
কি যে ভালো লাগছে!খেয়া এখন সম্পূর্ণ রূপে তার।তাদের মাঝে আর কোনো দেয়াল সে থাকতে দিবে না।
নির্ঝর পার্লারের সামনে গাড়ি থামিয়ে খেয়ার দিকে তাকাল।বিয়ে বলে কথা।খেয়াকে তো একটু সাজগোজ করতে হবে।
তবে সে উল্টো কাজ করছে।তিন কবুল বলে,রেজিস্ট্রারে সিগনেচার করে,বৈধ ভাবে তারা স্বামী স্ত্রী হওয়ার পর খেয়াকে পার্লারে নিয়ে এসেছে।
নির্ঝর খেয়ার দিকে তাকাল। খেয়ার অভিব্যক্তি বুঝতে পারছে না।তার মনে কি চলছে সেটাও বোঝার ক্ষমতা নেই!
__’পার্লারে এসে গেছি।হালকা করে সাজগোজ করবে।জানি,এসবের কোনো দরকার ছিল না।কিন্তু নুহার কথা ভেবে এসব করা।নুহাকে বুঝাতে যাতে সুবিধা হয় সেজন্য এই পন্থা।’
খেয়া জবাব দিল না। কবুল বলার পর সে আর একটা কথাও বলেনি।
নির্ঝর গাড়ি থেকে নেমে খেয়ার পাশের দরজা খুলে দিল।খেয়া নিঃশব্দে নেমে নির্ঝরের পাশে দাঁড়াল।তারপর হাঁটা ধরলো দুজন।
সে খেয়ার হাতের দিকে তাকাল।হাত বাড়িয়ে ধরতে নিতেও আড়ষ্ট হয়ে সরিয়ে আনলো।মেয়েটার উপর সব অধিকার থাকার পরো সে মেয়েটিকে কোনো কিছু নিয়ে ফোর্স করতে চায় না।
তার মন বলছে খেয়া একদিন তার ভালোবাসার জালে নিজেকে জড়িয়ে ফেলবে।তাও আবার খুব মারাত্মক ভাবে।তার পুরো অস্তিত্ব জুড়ে শুধু নির্ঝর নামক শব্দটার বিচরণ থাকবে।
ড্রয়িং রুমের সোফায় পাশাপাশি বসে আছে নির্ঝর আর খেয়া।বিয়ের সাজে খেয়াকে মানুষ বলে ভ্রম হচ্ছে।আর নুহা একটু দূরে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে দেখছে দুজনকে!
(চলবে)