#জোড়া_শালিকের_সংসার
#মুন্নী_আরা_সাফিয়া
#পর্ব_২৪ (অন্তিম পাতা–প্রথমাংশ)
খেয়া মাথা নেড়ে সায় জানাল।হঠাৎ নির্ঝর তার পেটে হাত রেখে বলল,
__’এখানে কে আছে?রাজকুমার নাকি রাজকন্যা?তোমার কি মনে হয়?’
খেয়া মুচকি হেসে বলল,
__’আমি কিভাবে বলবো!তবে আমার মনে হয় আপনার মতো একটা রাজপুত্র হবে!’
__’আবার আপনি?’
__’আমার তুমি বলতে কেমন লজ্জা লাগছে।রাতে থেকে বলার চেষ্টা করবো।’
__’অকে।মাথায় রাখলাম।এখন শুনো,আমার কি মনে হয় জানো?আমার মনে হয় নুহার মতো আরেকটা রাজকন্যা হবে।নুহা যত বড় হচ্ছে, ততই তোমার মতো মিষ্টি গড়নের হচ্ছে।ওর চেহারায় তোমার ছাপ স্পষ্ট।’
__’হুঁ!’
খেয়া সামনে তাকায়।শালিক পাখি দুটি কেমন ঘেঁষে গাছের ডালে বসে আছে।একটা আরেকটা মাথায় পাখা দিয়ে কেমন আলতো করে ঘঁষা দিচ্ছে।কি চমৎকার দৃশ্য!
__’দেখুন না!শালিক পাখি দুটি ডালে বসে আছে।’
নির্ঝর এক পলক চেয়ে বলল,
__’হুঁ।কিন্তু তুমি কিভাবে বুঝলে যে পাখিদুটো বসে আছে?ওরা তো দাঁড়িয়েও থাকতে পারে।মানে ওদের যে ছোট ছোট পা!বড়জোর বলা যায়, পায়ের উপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।’
__’আপনি সবকিছুতে এত উল্টাপাল্টা লজিক দেখান কেন বলুন তো!আচ্ছা, বাদ দিন।অনেক দিন আপনার কবিতা মানে ছন্দ শুনি না।একটা বলুন।’
__’এখন মাথায় আসছে না।তবুও চেষ্টা করি!
পাখিদুটো বসে আছে হয়ে জড়োসড়ো,
এক চিলতে রোদ এসে প্রেম হয়ে ঝরো!
__’বাহ!দারুণ।’
খেয়া এবার নির্ঝরের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে অভিমানী গলায় বলে,
__’আপনি আমায় নিয়ে কবিতা লিখেন না?’
নির্ঝর হেসে ফেলে।মুখটা নিচু করে খেয়ার সামনে এনে বলে,
__’আমার পদ্যের শহরের প্রতিটা শব্দ জানে তুমি আমার কাছে কতটা মূল্যবান,কতটা আপন!কতটা একান্ত আমার!’
খেয়ার মনটা খুশিতে ভরে উঠে।সে লজ্জায় মাথা নিচু করে।নির্ঝর গম্ভীর কন্ঠে বলে,
__’আজ থেকে দুই বছর আগে যখন তুমি আমার ছিলে না,যখন তোমার সাথে কাটানো স্মৃতি গুলো বাস্তবতার কাছে হার মেনে ফিকে হতে শুরু করে তখন বড্ড ভয় হয়।যদি তোমাকে ভুলে যাই?কিন্তু তুমি আমার কাছে যে শেষরাতের মিষ্টি মধুর স্বপ্ন।যে স্বপ্ন দেখে মানুষ ঘুমের ঘোরেই হাসে।হঠাৎ করে ঘুম ভেঙে গেলে মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে যায়।পরক্ষণে স্বপ্নের বাকি অংশ কল্পনায় মিলাতে শুরু করে এবং তার রেশ থেকে যায়।
সাধারণত স্বপ্ন দেখে ঘুম থেকে জেগে উঠার পাঁচ মিনিটের মাথায় স্বপ্নের অর্ধেক আর দশ মিনিটের মধ্যে স্বপ্নের ৯০% মানুষ ভুলে যায়।কিন্তু তুমি আমার কাছে এমন এক স্বপ্ন যা আমি সারাজীবন দেখতে চাই।সারাজীবন কল্পনায় নানা রঙে সাজাতে চাই।তোমায় নিয়ে পঙক্তির পর পঙক্তি লিখতে চাই।তখন তোমায় নিয়ে লেখা আমার কিছু অংশ শুনবে?’
খেয়া মাথা নেড়ে হুঁ বলে।
নির্ঝর বলে,
__’তোমারে নিয়া দিন রাত কবিতার চরণ মিলাাইতে মিলাইতে আমার ঝুলি এহন শূন্য।এহন চাইলেই আর ছন্দ মিলাইতে পারি না।আমি প্রহরের পর প্রহর নির্ঘুম কাটাই।মধ্যিরাতে ঘুম থেইকা আচমকা জাইগা কলম নিয়া বসি।যদি তোমারে নিয়া কিছু নতুন কইরা লিখতে পারি?কিন্তু পারি না!আমার নির্ঘুম রাতগুলা জানে,আমি কতটা মন থেইকা চাই তোমারে নিয়া লিখতে।নতুন কইরা তোমার সেই ভুবন ভুলানো হাসিডারে ছন্দে তুইলা ধরতে!নতুন কইরা তোমার প্রতিটি কথার মায়ায় জড়াইতে।আমি খুব কইরা চাই তোমারে নতুন কইরা ভালোবাসতে!
সত্যি কইরা কও তো!তুমি কি জাদু করছো আমারে?তোমারে নিয়া লেখা কবিতারে অভিশাপ দিছো?সেজন্যিই কি তোমারে নিয়া আর শব্দ খুঁইজা পাই না?তোমার গন্ধে আগের মতো ডুবতে পারি না?এজন্যিই কি তুমি আমার কল্পনার রাজ্যে আসতেও আজকাল কার্পন্য করো?কেন করো এমন?তুমি তো এমন ছিলে না!
কেউ না জানুক,তুমি তো জানো তোমারে নিয়া কবিতা লেখা আমার দুরারোগ্য ব্যাধি।এ ব্যাধির কোনো চিকিৎসা নাই।তারপরও কেমনে পারলা তোমারে নিয়া পূর্ণ আমার শব্দ ভান্ডার শূন্য কইরা দিতে?
শুনতে পারছো?তোমারে ফেরত চাই না আমি।তোমারে নিয়া জমানো আমার শব্দ ভান্ডাররে এট্টু ফেরত দিবা?দোহায় লাগে তোমার!ফেরত দিবা?তোমারে নিয়া যে নতুন কইরা পদ্যের শহরে প্রবেশ করতে চাই!’
নির্ঝর থামে।খেয়া অপলক তার দিকে চেয়ে থাকে।মুহূর্তে তার দু চোখ কানায় কানায় পরিপূর্ণ হয়।নির্ঝর তার জল মুছে মাথা নেড়ে কান্না করতে বারণ করে।ধরা গলায় বলে,
__’জানো খেয়া,প্রথম যখন ডাক্তার বললো আপনি বাবা হতে চলেছেন!আমি বিশ্বাস করিনি।ভেবেছি অন্য কারো রিপোর্ট আমাকে বলছে।কিন্তু ডাক্তার বেশ কনফিডেন্স নিয়ে বলে কোনো ভুল হয়নি।আপনার স্ত্রী প্রেগনেন্ট।তার গর্ভের ফিটাস বেশ বড় হয়ে গেছে।চার মাসের বেশি চলছে বাচ্চার বয়স।বাচ্চা অনেক সুস্থ।আমি নিজে আলট্রাসনোগ্রাফি করেছি।
তবুও আমার বিশ্বাস হতে চায় না।কাঁপা কাঁপা হাতে রিপোর্ট উল্টে দেখি সত্যি আমি বাবা হতে চলেছি।তখন কি যেন হয়ে গেল আমার।এক ছুটে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।ফুল স্পিডে ড্রাইভ করে সেদিনের সেই ব্রিজের উপর গাড়ি থামালাম।গাড়ি থেকে নেমে ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে রইলাম।নিচের কালো কুচকুচে পানির দিকে তাকাতেই ঝরঝর করে চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়লো।কি যে ভালো লাগছিল!সম্পূর্ণ নতুন এক অনুভূতি!যা কাউকে বলে বোঝানো যায় না।
সেখানে ঘন্টাখানেক দেরি করলাম।গাড়িতে উঠতেই তোমার কথা মনে পড়লো।নতুন এক প্রাণের জন্য তোমার কথা প্রায় ভুলতে বসেছিলাম।নিজেকে গালি গালাজ করতে করতে হাসপিটালে গিয়ে দেখি তুমি নেই!কি যে ভয় পেয়েছিলাম।অতঃপর তোমায় পেলাম।’
__’হুঁ!’
__’কিসের হুঁ?বাসায় নতুন দুটো কাজের লোক আসবে কাল থেকে।একটা কাজও করবে না তুমি।যে কোনো দরকারে তাদের বলবে।তাছাড়া আমি তো আছিই!তোমার চব্বিশ ঘন্টার পার্সোনাল এসিস্ট্যান্ট।’
খেয়া মৃদু হাসে।নির্ঝরও হাসে। ফের বলে,
__’বানাতে চেয়েছিলাম তোমায় আমার ল্যাবের এসিস্ট্যান্ট।কিন্তু হয়ে গেলাম আমি!’
__’আচ্ছা,আপনি আমার থেকে বাচ্চাকে বেশি ভালোবাসবেন?’
__’হা হা!কেন তুমি জেলাস?’
__’একদম কথা ঘোরাবেন না।সত্যি করে বলুন তো!’
__’নো টেনশন খেয়াতরী।আমার খেয়াতরীর প্রতি ভালোবাসা এবং নুহা আর অনাগত সন্তানের প্রতি ভালোবাসা আলাদা।তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা বিন্দুমাত্র কমবে না কোনোদিন।বরং বয়স বাড়ার সাথে সাথে বাড়তে থাকবে।’
খেয়া হেসে নির্ঝরের বুকে মুখ লুকায়।দূরের ডালে বসে থাকা জোড়া শালিক যেন তাদের দিকে চেয়ে মুচকি মুচকি হাসে।পাখিদের সাথে পাল্লা দিয়ে প্রকৃতিও যেন সমান তালে হাসে!
৩৫.
#এগারো_বছর_পর
__’সাইমুন ভাইয়া!’
সাইমুন ড্রয়িং রুমের এক কোণায় সোফায় বসে ফোনে গেইম খেলছিল।পেছন থেকে মেয়েলি কন্ঠে তার মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটে।কিছুটা বিরক্তি নিয়ে আবার খেলায় মনোযোগ দেয়।খেলার সময় বিরক্ত করা তার ভীষণ অপছন্দের।
__’সাইমুন ভাইয়া।কি করো?’
কেউ তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।কে দাঁড়িয়েছে তা সাইমুনের বুঝতে বাকি থাকে না।সে কপাল কুঁচকে সম্পূর্ণ ইগনোর করে।
__’তুমি শুনবে না তো?বেশ!ছাইয়ের মধ্যে চাঁদ,মানে ছাইয়ের মধ্যে মুন — সাইমুন।ছাইয়ের মধ্যে…… ‘
সাইমুন রেগে ফোন হাত থেকে সরিয়ে সামনে তাকায়।দেখে মিষ্টি দাঁড়িয়ে আছে।তার সারা মুখে হাসি যেন অথই জলের মতো উপচে পড়ছে।সে কুঁচকানো কপালের খাদটা আরো গভীর করে বলে,
__’সমস্যা কি তোর?কতবার বলেছি এসব উল্টাপাল্টা কথা বলবি না?কিসের ছাইয়ের মধ্যে মুন?হ্যাঁ?চড় দিয়ে দাঁত ফেলে দিবো।’
মিষ্টি মুখ ফুলিয়ে বলল,
__’তুমি আমার সাথে এভাবে কথা কেন বলো?’
__’কিভাবে বলতে হবে?একটুখানি মানুষ! আসে আমাকে, এই সাইমুন জুবায়েরকে জ্ঞান দিতে।যাহ,সরে যা তো।জ্বালাবি না আমায়।’
__’তুমি আমাকে তুই তুই করে কেন বলছো?আমি কিন্তু আন্টিকে বলে দিবো।’
__’এই যা তো!যা বলার বল।কিন্তু খবরদার।কানের কাছে এসে ঘ্যানর ঘ্যানর করবি না।ছোটবেলার কথা মনে নেই?ছোটবেলার মতো তুলে আছাড় দিবো কিন্তু!’
মিষ্টি ভয় পেয়ে যায়।সে এক দৌঁড়ে চলে যায়।সে চলে যেতেই সাইমুন মুচকি হাসে।তার মিতু আন্টির একমাত্র মেয়ে মিষ্টিকে সে ছোটবেলায় তুলে আছাড় দেয়নি।বরং সারাক্ষণ নিজের কাছাকাছি রাখতে চাইতো।তাকে কত আদর করতো!
মিষ্টির বয়স সাতে পড়বে।যথেষ্ট বড় হয়ে গেছে। সেজন্য সে এসব বলতে চায়না।তার কেন জানি লজ্জা লজ্জা লাগে।
সাইমুন উঠে দাঁড়ায়।মিষ্টির খোঁজে সিঁড়িতে পা রাখে।আজ সারা বাসা ভর্তি মানুষ।আজ সাইমুনের একটা বিশেষ দিন।তার একমাত্র বোন নুহা আপুর এনগেজমেন্ট আজ।যার সাথে এনগেজমেন্ট মানুষটা তার অপরিচিত নয়।বেশ ভালো পরিচয়।মানুষটা হলো দিশান ভাইয়া।
মায়ের রুম পেরিয়ে সাইমুন ছাদের সিঁড়ি ঘরের দিকে যায়।কয়েক সিঁড়ি উঠতেই দিশান ভাইয়ার সাথে দেখা হয়।
দিশান আজ গোল্ডেন কালারের পাজামা পাঞ্জাবি পড়েছে। কি সুন্দর লাগছে তাকে।দিশান সাইমুনকে দেখে বেশ খুশি হয়।বেশ আবেগমাখা কন্ঠে বলে,
__’ইয়ে মানে সাইমুন একটু টিকটিকিকে থুড়ি তোমার নুহা আপুকে ছাদে পাঠাবে?একটু ইম্পোর্টটেন্ট মানে দরকারি কথা আছে।’
__’জ্বি!’
বলেই সাইমুন উল্টো ফেরে।মায়ের রুমের পাশ দিয়ে আসতেই একটু উঁকি দেয়।মা শাড়ির কুঁচি ঠিক করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।সাইমুন এগিয়ে যায়।
__’মা!’
খেয়া চমকে উঠে।প্রতিবার যখন সাইমুন তাকে মা বলে ডাক দেয় সে চমকে উঠে।কি যে ভালো লাগে!নুহা,সাইমুনের মুখে মা ডাক যেন পৃথিবীর সবকিছুকে হার মানায়।
সে হেসে বলে,
__’শাড়ির কুচি ধরতো বাবা!’
সাইমুন মাথা নিচু করে কুঁচি ধরে।খেয়া ছেলের দিকে মায়াভরা চোখে তাকিয়ে থাকে।ছেলেটা তার কত বড় হয়ে গেছে।একদম বাবার মতো সুন্দর চেহারার হয়েছে।এই মনে হয় সেদিন ছোট ছোট হাত পা ছুঁড়ে খেলা করেছে।
ওয়াশরুমের দরজা খুলে নির্ঝর বের হলো।
(চলবে)