জোড়া শালিকের সংসার পর্ব-২২

0
2217

#জোড়া_শালিকের_সংসার
#মুন্নী_আরা_সাফিয়া
#পর্ব_২২

খেয়ার হাতের চামচ নিচে পড়ে যেতেই মৃদু শব্দ সৃষ্টি হলো।সেই শব্দে রাহাত,নির্ঝর দুজনেই তাদের দিকে তাকাল।

রাহাত হাত নেড়ে হাসিমুখে বলল,

__’আরে খেয়া যে!কেমন আছো?’

খেয়া আড়ষ্ট ভঙ্গিতে হাসার চেষ্টা করলো।রাহাত আবার আজকে তাকে খেয়া বলে সম্বোধন করছে?তাহলে কি নির্ঝরের সাথে তার কথা হয়েছে?সে মৃদুস্বরে বলল,

__’জ্বি ভা-ভালো!আপনি?’

__’অনেক ভালো।এদিকে আসো!মিতু তুমিও আসো তো। বসো আমার পাশে!’

মিতু ঝট করে বলল,

__’আমি এখানেই ঠিক আছি।’

পরমুহূর্তে মিতু, খেয়া একে অপরের দিকে তাকায়।খেয়া মিতুকে ফিসফিস করে বলল,

__’এই মিতু!তোমাকে রাহাত চিনে নাকি?মনে তো হচ্ছে অনেক ভালো করে চিনে!’

মিতু আমতা আমতা করে বলল,

__’হ্যাঁ!না মানে আপা,ওই তো আমাদের কলেজের সিনিয়র।তোমায় বলেছিলাম না সেদিন!’

__’অহ!মনে পড়েছে।’

মিতু কথা ঘোরানোর জন্য বলল,

__’আপা,নুহা কোথায়?’

__’মাত্র ঘুম পারিয়ে নিচে নামলাম।’

মিতু আর কিছু বলে না।মানে কোনো কথা খুঁজে পায় না।

খেয়া মাথা সামান্য কাত করে নির্ঝরের দিকে তাকালো।নির্ঝর এতক্ষণ চুপচাপ মুখ টিপে হাসছিল।সে হেসেই বলল,

__’খেয়া,এ হচ্ছে রাহাত!আমার ওয়ান এন্ড অনলি ফ্রেন্ড বলতে পারো।তবে আমার বাসায় তার যাতায়াত অনেক কম।ম্যাক্সিমাম সময় আমার অফিসে আসে।সেখানেই হাসি তামাশা করি আমরা।তোমার ব্যাপারে ওকে কিছু বলার সময় হয়ে উঠেছিল না।সেজন্য সেদিন হুট করে নুহার স্কুলে তোমায় দেখে চিনতে পারেনি।তবে সেদিনই ও আমাকে ফোন দিয়ে তোমার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করে।আমি সব বলে দিয়েছি।বুঝতে পেরেছো?’

খেয়ার বুকের উপর থেকে যেন পাথর সরে গেল।সে বড় করে শ্বাস নিল।যাক,বাবাঃ!এর সাথে তাহলে পুষ্পর কোনো সম্পর্ক নেই।সে তো পুরোদস্তুর ভয় পেয়ে গেছিল।

সে মাথা নেড়ে বলল,

__’হুঁ!’

তারপর রাহাতের দিকে চেয়ে বলল,

__’রাহাত ভাই,আজকে লাঞ্চ আমাদের সাথে করবেন।চলে যাবেন না কিন্তু।আমি আসছি।’

খেয়া মিতুকে ফ্রেশ হতে বলে রান্নাঘরে ঢুকলো।

মিতুর কেমন জানি লাগছে।গলা বার বার
শুকিয়ে আসছে।মনে হচ্ছে এক সাগর পানিতেও এ পিপাসা মিটবে না।বড্ড ক্লান্ত লাগছে।বুক ধড়ফড় করছে।সে কি অজ্ঞান টজ্ঞান হয়ে যাবে?

রাহাতের এই অসময়ে এ বাসায় আগমনই বলে দিচ্ছে কিছু একটা হতে চলেছে!

কোনোরকমে সামনের দিকে হাঁটা ধরলো সে।এলোমেলো ভাবে পা ফেলে ড্রয়িং রুমের পাশ দিয়ে নিজের রুমে যেতে নিতেই নির্ঝর বলল,

__’মিতু!’

মিতু দাঁড়িয়ে পড়ল।মুখে বলল,

__’জ্বি,দাভাই!’

__’আজ একসাথে লাঞ্চ করবো আমরা।দ্রুত ফ্রেশ হয়ে নাও।’

__’জ্বি দাভাই।’

৩১.

রাহাতের মুখে মিতুর ব্যাপারে সব শুনে নির্ঝর প্রথমে দারুণ চমকে যায়। রাহাত মিতুকে ভালোবাসে?কিন্তু রাহাত আর মিতুর বয়সের ডিফারেন্স তো অনেক বেশি।

রাহাত সেটাকে পাত্তা না দিয়ে মিতুকে বিয়ে করবে বলে জানায়।আপাতত নির্ঝরই খেয়ার গার্ডিয়ান।নির্ঝর তবুও জমিলা খালা আর মিতুর মতামত নেয়।তারা রাজি হতেই নির্ঝরও রাজি হয়ে যায়।তবে তাতে বাঁধ সাধে খেয়া।

খেয়ার চিন্তার কারণ মিতু অনেক ছোট।সে বলে,মিতুকে যদি রাহাত ভাই বিয়ে করতে চায় তাহলে তাকে মিতুর কলেজ পাস অবধি অপেক্ষা করতে হবে।এতে করে মিতুর প্রতি রাহাতের ফিলিংস টা কতটা গভীর তারও প্রকাশ হয়ে যাবে।রাহাত তাতেই খুশিমনে রাজি হয়ে যায়।

বেলকনিতে পাখিদের খাবার দিতে দিতে এসব চিন্তা করে নির্ঝর।চুড়ির মৃদু ঝংকারে চোখ তুলে সামনে তাকায়।খেয়া হাস্যোজ্জ্বল মুখে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।খেয়ার মুখে গোধূলি বেলার আবছা লাল রং এসে পড়েছে।কি সুন্দর লাগছে তাকে দেখতে!এই মেয়েটা কি প্রতিটা সেকেন্ডে নিজের মায়া দিয়ে তাকে ঘায়েল করবে?

নির্ঝরের হার্টবিট বেড়ে যায়।যতবার সে খেয়ার ওই চোখে চোখ রাখে ততবারই কি যেন হয়ে যায়।মেয়েটা তাকে সত্যি সত্যি বশ করেছে নাকি?নাহ!সে সহজে খেয়ার চোখে চোখ রাখবে না।নইলে যখন তখন ওই কাকচক্ষু নদীর গভীরে ডুবে যেতে তীব্র ইচ্ছে হয়।

খেয়া এগিয়ে এসে তার পাশে বসে।হাসিমুখে বলে,

__’আচ্ছা, পাখি দুটোকে যদি খাঁচা থেকে ছেড়ে দিই,মানে বন্দীদশা থেকে মুক্ত করি তাহলে পালিয়ে যাবে না?’

খেয়ার গা থেকে চিরাচরিত সেই মিষ্টি গন্ধটা এসে নির্ঝরের নাকে লাগে।বসন্তের মাতাল হাওয়ার মতো কেমন মাতাল করে দিতে চায় তাকে।কালবৈশাখীর অগোছালো ঝড়ো বাতাসের মতো তাকেও কেমন এলোমেলো করে দেয়।

সে চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করে।খেয়া তাকে হালকা ধাক্কা দিয়ে তার আরো কাছে এগিয়ে আসে।কপালে হাত রেখে চিন্তিত গলায় বলে,

__’আপনি এমন করছেন কেন?অসুস্থ লাগছে?বলুন কি হয়েছে আপনার?’

নির্ঝর চট করে মাথা পেছন দিকে সরিয়ে নেয়।তোতলানো স্বরে বলে,

__’এ-একটু পিছিয়ে বসো তো!পি-পিছিয়ে বসো।সামান্য দূরে গিয়ে বসো।’

__’কেন?দূরে বসবো কেন?’

__’তোমার গা থেকে মারাত্মক স্মেল আসছে।’

খেয়া ভ্রু কুঁচকে নিজের গা শুকেঁ।তারপর চিন্তিত স্বরে বলে,

__’কিন্তু আমি তো দুপুরে শাওয়ার নিয়েছি।এখন সবেমাত্র বিকেল।আপনার বিশ্বাস হচ্ছে না?এই দেখুন,আমার চুলও ভেজা।’

খেয়া এক গাছি চুল পেছন থেকে এনে নির্ঝরের নাকের সামনে ধরে।নির্ঝর কয়েক সেকেন্ড তার দিকে অবাক হয়ে চেয়ে থাকে। খেয়া এত বোকা কেন?

কয়েক সেকেন্ড পর খেয়াকে এক টানে কাছে নিয়ে আসে।তাকে জড়িয়ে তার ঘন চুলে মুখ ডুবায়।খেয়া কেঁপে উঠে।

নির্ঝর ভেঙে ভেঙে বলে,

__’আমি অন্য গন্ধের কথা বলেছি বোকা!বুঝতে পেরেছো?নাকি আরো বুঝাতে হবে?’

__’ন–না!ছাড়ুন!দূরে গিয়ে বসছি।’

নির্ঝর উত্তর দেয় না।বেশ কিছুক্ষণ পর ছেড়ে দেয়।খেয়া মাথা নিচু করে কয়েক হাত দূরে বসে হাত বাড়িয়ে দেয়।

নির্ঝর মুচকি হেসে খেয়ার হাতের উপর হাত রাখে।

খেয়া বাম হাতে শালিক দুটোকে নাড়া দেয়।বলে,

__’এবার বলুন তো!পাখি দুটোকে ছেড়ে দিলে কি পালিয়ে যাবে?’

__’উড়ে পালাবে না।পোষমানা পাখি!’

__’আপনি এতটা নিশ্চিত কিভাবে?’

নির্ঝর খেয়ার দিকে চেয়ে বলল,

__’তুমি কি পরীক্ষা করতে চাচ্ছো খেয়া?খাঁচা খুলে দিলে পাখি দুটো উড়ে যায় কি না?পোষ মানে কি না?’

__’আপনি ঠিক ধরেছেন।আমি একটা ক্ষুদ্র পরীক্ষা করতে চাই।পাখি দুটোকে ছেড়ে দিতে চাই।পোষ মানলে হয়তো কাছাকাছি থাকবে।আপনি রাজি আমার প্রস্তাবে?’

নির্ঝর হেসে বলল,

__’আমি বেশ বুঝতে পারছি কেন তুমি খাঁচা খুলে দিতে চাইছো।তোমার মন অনেক নরম।তুমি হয়কো পাখি দুটোর বন্দী দশা দেখে কষ্ট পাচ্ছো।ঠিক আছে।যাও পাখিদুটোর শিকল খুলে দাও।তবে আমার মন বলছে,ওরা আবার আসবে।আমাদের কাছাকাছি থাকবে।’

খেয়া সঙ্গে সঙ্গে এক লাফে নির্ঝরের হাত ছেড়ে খাঁচার শিকল খুলে দিল।জানালা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে নিজ হাতে শালিক পাখি দুটোকে উড়িয়ে দিল।

তারপর ঘুরে নির্ঝরের দিকে তাকাল।নির্ঝর উঠে এসে প্যান্টের পকেটে হাত গুঁজে তার পাশে দাঁড়াল।দুজনে একসাথে পাখিদুটোর দিকে তাকাল।পাখি দুটো উড়ে বেশদূর যায় নি।গেটের ডানপাশের দেয়ালের পাশে যে বড় কাঁঠাল গাছটা আছে,তার ডালে বসে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে।বেলকনি থেকে স্পষ্ট সব দেখা যাচ্ছে।

নির্ঝর খেয়ার দিকে তাকাল।খেয়াকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে পাখি দুটোকে মুক্ত করতে পেরে দারুণ খুশি হয়েছে।নির্ঝরের মুখেও হাসি ফুটে উঠলো।

খেয়া ঘাড় ঘুড়িয়ে তার দিকে তাকাতেই সে কাছে টেনে নিল।কপালে আলতো করে চুমু দিল।

৩২.

মিতু কলেজের গেট থেকে ভেতরে উঁকি ঝুঁকি দেয়।রাহাত আছে কি না চেক করে।সে এই সকাল সকাল বেলা ছেলেটার সামনে পড়তে চাচ্ছে না।যতসব উদ্ভট কথা বলে তার পৃথিবী উল্টাপাল্টা করে দিতে ওস্তাদ এই ছেলেটি!

সে সাবধানে ভেতরে পা রাখলো।ওড়না দিয়ে মাথা,মুখ পুরো ঢেকে আশপাশে তাকাতে তাকাতে সামনে হাঁটলো।

রাহাত আর তার বিয়েটা একদম পাকাপোক্ত হয়ে গেছে।রাহাতের বাড়ির লোকজন এসে বেশ কিছুদিন আগে তাকে আংটি দিয়ে গেছে।সে যে কাজের লোকের মেয়ে তাতে তারা অনাগ্রহ দেখায়নি।তাকে খুব সাদরে গ্রহণ করেছে।এজন্য মিতু সবার উপর কৃতজ্ঞ!

মোটামুটি এক বছর পর বিয়ে!এই এক বছর মানুষটাকে সহ্য করতে হবে।কেন জানি মানুষটার সবকিছু সহ্য করতে অনেক ভালো লাগে।

মিতুর মুখে হাসি ফুটে উঠলো।

ক্লাসের দরজার সামনে গিয়ে সে বড় করে শ্বাস নিল।এ যাত্রায় বেঁচে গেছে।রাহাতের সাথে দেখা হয়নি।রাহতের সাথে দেখা হলেই সব গুছিয়ে রাখা কথাবার্তা অগোছালো হয়ে যায়।সে লজ্জায় পড়তে চায় না।

খুশিমনে ক্লাসে পা রাখতেই চোখ বড়সড় হয়ে গেল।রাহাত শ্রেণিকক্ষের ডায়াসের উপর দাঁড়িয়ে আছে।তাকে বেশ হাসিখুশি দেখাচ্ছে। মিতু ফুঁটো বেলুনের মতো চুপসে গেল।

রাহাত এগিয়ে এসে বলল,

__’রাগিনী আমার!শুভ শুভ্র সকাল।’

মিতু কিছু না বলে বেঞ্চে বসলো।রাহাত তার মুখ বরাবর বসে বলল,

__’রাগিণী শোনো!সিরিয়াস কথা বলছি।আসলে আমার কয়েকদিন পর ফাইনাল এক্সাম।এবার ভাবছি বেশ মনোযোগ দিয়ে পরীক্ষা দিবো।তারপর বাবার বিজনেসে একটু সাহায্য করবো।দেন তোমায় বিয়ে করবো।তুমি একটু আমার জন্য প্রে কোরো,যাতে কৃতকার্য হতে পারি।’

__’আপনি পড়া পারেন কিছু?’

__’আরে!তুমি আমাকে চিনলে না।আমার মতো ছেলেদের পড়তে হয় নাকি!তোমার স্বামী চ্যালচ্যালাইয়া পাস করে যাবে।’

মিতু গোল গোল চোখে তার দিকে তাকাল।তার বড্ড হাসি পাচ্ছে।খুব কষ্টে নিজেকে সামলে রেখেছে।সত্যিই সে মানুষটাকে তীব্র পছন্দ করে ফেলেছে।

মিতু কিছু বলতে নেয়।সঙ্গে সঙ্গে তার ব্যাগে রাখা ফোনটা বেজে উঠে।আজ ফোন সাইলেন্ট করতে ভুলে গিয়েছিল।

সে ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করে দেখলো তার মা ফোন দিয়েছে।তার মা কেন ফোন দিয়েছে?তাও এই অসময়ে?

রাহাতের দিকে এক পলক চেয়ে কল রিসিভ করলো।

__’হ্যালো,মা!বলো!’

__’মিতু,তোর খেয়া আপারে হাসপাতালে নিয়া হইছে।তাড়াতাড়ি বাড়ি আয়তো!’

মিতুর বুকের ভেতর কেমন করে উঠলো।সে ভয়ার্ত গলায় বললো,

__’কেন?কি হয়েছে মা?’

__’সকালবেলা সিঁড়ি থেইকা মাথা ঘুইরা পইড়া গেছে।তাও ভালো!নির্ঝর বেটা বাড়িতেই ছিল।তুই আয়!’

ফোন কেটে যেতে মিতু কান থেকে নামায়।রাহাতের দিকে চেয়ে বলে,

__’আমাকে এক্ষুণি হসপিটালে যেতে হবে।’

কেন?কার কি হয়েছে?কে অসুস্থ?এসব প্রশ্নের মধ্যে না গিয়ে রাহাত বলে,

__’চলো!আমিও সাথে যাচ্ছি।’

মিতু কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে দ্রুত বেরিয়ে পড়ে।

(চলবে)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে