#জোড়া_শালিকের_সংসার
#মুন্নী_আরা_সাফিয়া
#পর্ব_১৬
__’পুষ্প তুমি?’
খেয়া চমকায়!এই ছেলেটা আবার কে?পুষ্পর পরিচিত কেউ?
ছেলেটা নিজে থেকে একরাশ অবাকত্ব নিয়ে প্রশ্ন করে,
__’কি হলো কথা বলছো না যে?তুমি বেঁচে আছো?এটা কিভাবে সম্ভব?নির্ঝর আমাকে এতবড় মিথ্যে কথা কেন বলবে?’
খেয়া উত্তর দেয় না।কি বলবে সে?
সে দ্রুতপায়ে পেছন ঘুরে হেঁটে আসতে নিতেই ছেলেটা পেছন থেকে বলে,
__চলে যাচ্ছো যে?আমায় চিনতে পারছো না?আমি রাহাত!’
খেয়া পেছন ঘুরে তাকায় না।তাকানোর যথোপযুক্ত কোনো কারণও নেই।কারন এ জীবনে সে রাহাত নামের কাউকে চিনে না!
যত দ্রুত সম্ভব নুহার হাত ধরে হেঁটে গাড়িতে উঠে।পেছনের সিটে বসে বড় করে শ্বাস নেয়।ড্রাইভার গাড়ি ছাড়ার আগে সে জানালার কাচ দিয়ে আরেক বার তাকায়।
রাহাত নামের ছেলেটা দিশানের হাত ধরে চিন্তিত মুখে গেটের বাইরে বের হয়েছে!সে চোখ সরিয়ে নেয়!
গাড়ি চলছে আপনমনে।অন্যান্য দিন খেয়া সারা পথ নুহার সাথে প্রচুর কথা বলে।কিন্তু আজ সে বড্ড চুপচাপ।আজ কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।
মনের গহীনে তলিয়ে দেখলো যে সেখানে চিন্তার বীজ রোপন হয়েছে।সে সত্যিই চিন্তিত!রাহাত নামের ছেলেটা নতুন ঝড় নিয়ে আসবে না তো তার জীবনে?
__’মা,দিশানের কাকু তোমায় পুষ্প বললো কেন?’
নুহার প্রশ্নে খেয়া চমকে তার দিকে তাকাল।নুহা অধীর আগ্রহে তার দিকে তাকিয়ে আছে।সে উত্তরের আশা করছে।কি উত্তর দেবে তাকে?
সে অপ্রস্তুত হেসে বলল,
__’তুমি দিশানের কাকুকে চিনো?’
__’হুঁ!চিনি তো।বাবাই এর আগে একবার তার সাথে কথা বলেছে।’
খেয়া ভাবে নির্ঝর রাহাত নামের ছেলেটাকে চিনে কিভাবে?তবে কি রাহাতের সাথে পুষ্পর কোনো সম্পর্ক ছিল?কি সম্পর্ক ছিল পুষ্পর সাথে তার?
__’নুহা!তুমি দিশানের কাকুকে কি বলে ডাকো?’
__’কেন?আঙ্কেল বলে ডাকতে বলেছে বাবাই।কিন্তু তার সাথে আমার আর দেখা হয়নি।আজ তো আমার দিকে তাকায়নি!’
__’অহ।এখন তুমি আমার কোলে মাথা রেখে একটু ঘুমানোর চেষ্টা করো।কেমন?’
নুহা মুখ ফুলিয়ে বলে,
__’আগে তুমি বলো,দিশানের কাকু তোমায় পুষ্প কেন বললো?’
নুহার জিদ সম্পর্কে খেয়া অবগত।সে এর উত্তর না শুনে কিছুতেই ছাড়বে না।সে হাসার চেষ্টা করলো।
হেসেই বলল,
__’উনি মনে হয় আমাকে অন্য কারো সাথে গুলিয়ে ফেলেছে।ওনার পরিচিত কারো চেহারা হয়তো ঠিক আমার মতো!বাদ দাও তো!ঘুমাও।’
খেয়া জোর করে নুহার মাথা তার মাথা তার কোলে রাখে।নুহা মুচকি হেসে চোখ বন্ধ করে।
সে নুহার দিকে তাকায়।নুহার চেহারা ভারী মিষ্টি।দেখলেই বোঝা যায় নুহার মা-বাবা অনেক বেশি সুন্দর ছিল।
খেয়া নির্ঝরের বাসায় পা রাখার পরপরই কেন জানি মেয়েটাকে ভীষণ ভালোবেসে ফেলে।তার ছোটবেলা থেকে বাচ্চা-কাচ্চা অনেক প্রিয় ছিল।ইয়াতিম খানার ছোট বাচ্চাদের সে অনেক আদর করতো!
নুহাকে পেয়েই সে জাহিদের কষ্টটা ভুলতে পারে সহজে।প্রথম দিন নির্ঝরের বাসায় আসার পর সে ভেবে রেখেছিল পরের দিন মহিলা হোস্টেলে থাকার ব্যবস্থা করবে।কিন্তু সে পারেনি!
কিছুদিন যেতেই সে একপ্রকার নুহার প্রতি দূর্বল হয়ে পড়ে।রোজ রাতে নুহাকে বুকে জড়িয়ে ঘুমানো যেন তার অভ্যাস হয়ে যায়।পিচ্চিটাকে ভীষণ আপন মনে হয়।অনেক ভালো বাসে তাকে!নুহাকে সে কখনো মায়ের অভাব বুঝতে দেবে না।
খেয়ার চোখ ভরে উঠে। গভীর মমতায় নুহার মাথায় হাত বুলায়!
২২.
রাতের বেলা ডাইনিং এ খেতে বসে খেয়া উসখুস করে।বার বার নির্ঝরকে রাহাতের কথা বলতে নিয়েও পারে না।আবারও বাঁধা পড়ে।
আজ দুদিন হলো সে নির্ঝরকে রাহাতের কথা জিজ্ঞেস করার চেষ্টা করছে।কিন্তু করতে পারেনি।
নির্ঝরের অসুস্থতার মাঝে তাকে নতুন করে টেনশনে ফেলতে চাচ্ছে না সে।সে ঠিক করে রেখেছে নির্ঝর আর একটু সুস্থ হলেই জিজ্ঞেস করবে।
আজ তিনদিন পর নির্ঝর নিচে নেমেছে।নিজে থেকেই ডাইনিং এ খাওয়ার বায়না ধরেছে।খেয়া না করেনি।
খেয়া নুহাকে শেষ লোকমা দিয়ে নিজে খাওয়ার জন্য প্লেটে খাবার নেয়।নুহার খাওয়া শেষ হতেই সে এক দৌঁড়ে ড্রয়িং রুমে সোফায় গিয়ে বসে।টিভিতে তার কার্টুন দেখার সময় হয়ে গেছে!
খাওয়ার মাঝে নির্ঝর জমিলা খালার দিকে চেয়ে বলল,
__’খালা,কিছু বলবেন?’
জমিলা চমকে উঠে।তার চোখ বড় বড় হয়ে যায়।ছোটবেলা থেকেই সামান্য অবাক হলে তার চোখ বড়ো বড়ো হয়ে যায়।
সে আমতা আমতা করে বলে,
__’গ্রামের বাড়িতে আমার বড় একটা মাইয়া আছে।ওর থাকনের কোনো জায়গা নাই।এতদিন মামুর বাড়ি থাকতো।তারা আর রাখবো না।বলতেছিলাম কি,যদি তোমরা রাজি থাকো তয় ওরে এইহানে লই আসি।হারাডা দিন টুকটাক কাজ করবো আর রাতের বেলা আমার কাছে থাকবো।’
বলে জমিলা ভয়ে ভয়ে তাকায়।নির্ঝর কিছু বলার আগেই খেয়া ঝটপট বলে,
__’খালা তুমি কালকেই ওকে এখানে নিয়ে আসো।কোনো চিন্তা নেই।’
পরমুহূর্তে নির্ঝরের কথা মনে পড়ায় সে নির্ঝরের দিকে তাকায়।এটা তো নির্ঝরের বাড়ি।সে সিদ্ধান্ত নিচ্ছের কেন?
খেয়ার অপরাধীর মতো ফেস দেখে নির্ঝরের হাসি পায়।সে মুচকি হেসে বলে,
__’খালা,আপনাকে আগেই বলেছি,আপনার মেয়েকে নিয়ে আসুন।কোনো সমস্যা নেই।খেয়া ওকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিবে।’
খেয়া সাহস পেয়ে বলল,
__’খালা, আপনার মেয়ে কোন ক্লাসে পড়ে?’
__’অত সতো বুঝি না।কলেজে উঠবো মনে হয়।’
__’নাম কি ওর?’
__’মিতু।’
__’বাহ!কি মিষ্টি নাম।’
নুহাকে ঘুম পাড়িয়ে খেয়া নির্ঝরের দিকে তাকালো।নির্ঝর রুম দিয়ে পায়চারি করছে।হেঁটে এ মাথা থেকে ও মাথা যাচ্ছে।রাতের বেলা সেই ডিনার শেষ হতে না হতেই সে এমন শুরু করেছে।
খেয়া বিরক্ত হয়ে বলল,
__’এভাবে হাঁটাহাঁটি করছেন কেন?কয় বার বারণ করবো?’
নির্ঝর হাঁটা থামিয়ে সোফায় বসলো।সত্যি সত্যি ক্লান্ত হয়ে গেছে সে।
সামান্য হেসে বলল,
__’হাঁটাহাঁটি বাদ দিলাম।এখন বসে আছি। খুশি?’
__’না,খুশি না।এবার শুয়ে পড়ুন।অনেক রাত হয়েছে।ডাক্তার রাত জাগতে,হাঁটাহাঁটি, নড়াচড়া করতে বারণ করেছেন।’
__সো হোয়াট?ডাক্তারদের কাজই হচ্ছে এক গাদা কাজে বাধ সাধা।ওসব মানলে মানবজীবন চলবে কিভাবে?’
খেয়া কপাল কুঁচকে বলল,
__’আপনি এবার শুয়ে পড়বেন কি না সেটা বলুন।শেষ বারের মতো বলছি।’
খেয়ার অধিকারবোধ নির্ঝরের প্রচুর ভালো লাগলো।সে কিছু পিঞ্চ কথা বলতে নিয়েও বললো না।
মুচকি হেসে বলল,
__’যদি একটা গান শোনাও তাহলে ঘুমিয়ে পড়তে পারি।’
খেয়া অবাক হয়ে বলল,
__’আমি গান পারি?আপনি বললেই হলো?’
__’যেমন খুশি তেমন সাজো এর মতো যেমন পারো তেমন গাও।’
__’পারবো না আমি।আমি ঘুমিয়ে পড়লাম।ইচ্ছে হলে শুয়ে পড়বেন।’
খেয়া সত্যি সত্যি শুয়ে পড়লো।গায়ে গলা পর্যন্ত চাদর টেনে নুহার দিকে ঘুরে চোখ বন্ধ করলো।
নির্ঝর কিছুক্ষণ সোফাতে বোকার মতো বসে রইলো।অতঃপর ক্ষীপ্রপায়ে এসে নুহার বাম পাশে কোল বালিশ রাখলো।নিজে খেয়ার পাশে শুয়ে ডান হাতটা খেয়ার গায়ের উপর রাখলো।
খেয়া চমকে একটু ঘোরার চেষ্টা করলো।কিন্তু পারলো না।নির্ঝর পেছন থেকে শক্ত করে জড়িয়ে চোখ বন্ধ করলো।
সে নির্ঝরের হাত সরানোর চেষ্টা চালিয়ে বলল,
__’কি করছেন?নুহার পাশে গিয়ে ঘুমান।’
নির্ঝর ঘুমাতুর কন্ঠে বলল,
__’নুহা ঘুমের ঘোড়ে মাথায় ব্যথা দিয়ে ফেলতে পারে।তখন আবার হসপিটালে যেতে হবে।আর হসপিটালে ফিনাইলের গন্ধ।ঘুমাও তো!’
খেয়া আর কিছু বলল না।সে চোখ বন্ধ করে নির্ঝরের স্পর্শটুকু অনুভব করার চেষ্টা করলো।
নির্ঝর বিড়বিড় করে বলল,
__’শুভরাত্রি খেয়াতরী!’
(চলবে)