জোড়া শালিকের সংসার পর্ব-১১

0
2488

#জোড়া_শালিকের_সংসার
#মুন্নী_আরা_সাফিয়া
#পর্ব_১১

|১৫|

বিকেল বেলা নুহাকে ঘুম পাড়িয়ে ছাদে উঠল খেয়া।দক্ষিণের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়াল।এখান থেকে বাসায় প্রবেশের গেইট দেখা যায়।নির্ঝরের অফিস থেকে বাসায় আসার সময় হয়ে গেছে।সে বার বার গেইটের দিকে উঁকি দিল।

নির্ঝরের বাসাটি দুতলার।নতুন,ঝকঝকে চুনকাম করা।দেখেই বোঝা যায় কয়েক বছর ধরে তৈরি।

খেয়া আবার গেইটের দিকে নজর দিল।সে প্রায় প্রতিদিনই এই সময়টাতে ছাদে এসে দাঁড়ায়।গেইটের কাছে নির্ঝরের কালো গাড়ির হর্ণ বাজানো দেখলেই সে এক দৌঁড়ে নিচে যায়।মেইন ডোরের ছিটকিনির উপর হাত রেখে অপেক্ষা করে।কিন্তু খোলে না।

যখন নির্ঝর কলিং বেল চাপে তখন মনে মনে ১ থেকে ১২০ পর্যন্ত কাউন্ট করে।এই সময়টাতে সে বেশ এক্সাইটেড থাকে।তার বুকের ভেতর ঢিপঢিপ শব্দ হয়।হার্টবিটও কেমন অগোছালো হয়ে যায়।

কিন্তু দরজা খুলে সে গম্ভীর হওয়ার ভান করে।নির্ঝরকে কিছুই বুঝতে দেয় না।

আগে সে এই কাজটি করতো না।আজ দিয়ে আটাশ দিন হলো সে এই কাজ করছে।নির্ঝরের সাথে তার বিয়ের সময়সীমা আজ ২৮(আটাশ) দিন।

নির্ঝর অফিস যাওয়ার পর সে রোজ নুহাকে স্কুলে দিয়ে আসে।দুপুরের দিকে নুহা একাই আসে ড্রাইভারের সাথে।মাঝে মাঝে সে নুহার স্কুলে গিয়ে তাকে চমকে দেয়।নুহাকে নিয়ে আশপাশে ঘুরে।নুহা কি যে খুশি হয়!

তবে বিয়ের পর থেকে সে সারাক্ষণ নির্ঝরের কেমন অভাববোধ করে।নির্ঝরের অফিসের সময়টুকু সে প্রতিটা মুহূর্ত অপেক্ষায় থাকে কখন ফিরবে! কখন ফিরবে!

নির্ঝর বাসায় থাকলে সে বেশ স্বাভাবিক ভাবেই নির্ঝরের সামনে চলাফেরা করে।কিন্তু ভেতরে ভেতরে যে তার সাথে কি হয় তা শুধু সে জানে।কেন জানি আশপাশে নির্ঝরের অস্তিত্ব টের পেলেই তার হার্টবিট লাফাতে থাকে।

মাঝে মধ্যে যখন চোখে চোখ পড়ে যায় তখন তো কথাই নেই।তার সারামুখ, কান লাল হয়ে যায়।মনে হয় এক্ষুনি কিছু একটা করে ফেলি।নির্ঝরের থেকে লুকিয়ে বাঁচি।

কিন্তু কেন এমন হয়?তার জানা নেই!

গাড়ির হর্ণের শব্দে বাস্তবে ফেরে খেয়া।কালো রঙের গাড়ি গেইটের সামনে দেখা যাচ্ছে!

সে বাচ্চাদের মতো ভো দৌঁড়ে নিচে নামে।

খেয়া দরজা খুলতেই ক্লান্ত শরীরে ভেতরে ঢুকে নির্ঝর।খেয়ার দিকে তাকিয়ে মলিন একটা হাসি দেয়।

প্রতিত্তরে খেয়াও মুচকি হাসে।

নির্ঝর নিজের রুমের দিকে পা বাড়ায়।খেয়া পেছন থেকে বলে,

__’ডাইনিং এ হালকা জল খাবার দেয়া হয়েছে।ফ্রেশ হয়ে নিচে নামুন।’

নির্ঝর একটু ঘুরে খেয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,

__’আজ একটু বেশি টায়ার্ড লাগছে।খাব না কিছু।’

নির্ঝরকে দেখে খেয়ার কেমন জানি মনে হয়।সে বলে,

__’আপনি ঠিক আছেন?’

__’ঘুমাব!নুহাকে দেখছি না!’

__’নুহা ঘুমায়।’

__’অহ।’

বলে নির্ঝর উপরের দিকে হাঁটা ধরে।নিজের রুমে ঢুকে বেডের দিকে তাকায়।নুহা নেই।হয়তো খেয়ার রুমে ঘুমিয়েছে।

খেয়ার রুমটা এখনো আগের মতোই গোছালো।দিনের বেলা খেয়া বেশিরভাগ সময় নিজের রুমে থাকে।নুহাও তার রুমে ঘুমায়।শুধু রাতের বেলা নির্ঝরের রুমে সবাই ঘুমায়।

নির্ঝর সোফাতেই বেশি ঘুমায়।নুহা জেগে থাকলে মাঝে মাঝে তাদের পাশে ঘুমাতে হয়।

গায়ের স্যুটটা খুলে বিছানায় গা মেলে দেয় নির্ঝর।জুতা খোলার ভরটুকু ধরে রাখতে পারে না।এলোমেলো ভাবে শুয়ে পড়ে।

দরজার সামনে ট্রে হাতে খেয়া দাঁড়ায়।নক করবে কি না বুঝতে পারছে না।একবার নক না করেই ঢুকে দেখে নির্ঝর শাওয়ার নিয়ে গালি গায়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।একবার নয়,বেশ কয়েকবার!ব্যাপারটা খুবই লজ্জাজনক!

সে হালকা করে টোকা দেয়।কিন্তু নির্ঝর রেসপন্স করে না।

অগত্যা সে নিজেই উঁকি দিয়ে দেখে নির্ঝর শুয়ে আছে।সে ধীরপায়ে শব্দহীন ভাবে রুমে প্রবেশ করলো।

ট্রে টা সেন্টার টেবিলে রেখে বিছানার দিকে একটু এগিয়ে গেল।ডাকতে নিয়েই বুঝতে পারলো ঘুমিয়ে পড়েছে।ফ্রেশ হওয়া তো দূরের কথা পায়ের জুতো পর্যন্ত খুলেনি।পা দুটো জুতাসহ বিছানার বাইরে ঝুলিয়ে রেখেছে।

কিছুক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে একটু একটু করে এগিয়ে গিয়ে নির্ঝরের পায়ের কাছে বসলো সে।হাতটা বাড়িয়ে পরম যত্নে নির্ঝরের পায়ের জুতা খুলে দিল।পা দুটো বিছানায় সোজা করে রাখলো।

নির্ঝর একটু নড়ে আবার চুপ হয়ে গেল।খেয়া উঠে তার গায়ের উপর চাদর দিয়ে ঢেকে দিল।

তার মনে খটকা লাগছে।সে এ বাসায় আসার পর থেকেই দেখছে নির্ঝর অনেক গোছানো এবং পরিষ্কার একজন মানুষ।সে হঠাৎ আজ এমন?
এই অবেলায় ফ্রেশ না হয়েই শুয়ে পড়েছে?অসুস্থ নাকি?

সে নির্ঝরের দিকে একটু ঝুঁকে প্রথম বারের মতো নিজে থেকে তার কপালে ডান হাতটা রাখলো।কাছে থেকে বেশ মনোযোগ দিয়ে নির্ঝরের দিকে চেয়ে রইলো।

নির্ঝর যখন বাসায় থাকে না তখন সে তার চেহারা মনে করার চেষ্টা করে। শুধু একটা অবয়ব মনে পড়ে।কিন্তু ঠিকই বহুদূর থেকে নির্ঝরের সামান্য অবয়ব দেখেই বুকের ভেতর তোলপাড় সৃষ্টি হয়।নির্ঝর আশপাশে থাকলেই সে আর নিজের মধ্যে থাকে না।

তার মনে হয় সে নির্ঝরকে কোনোদিন কাছে থেকে ভালো করে দেখেইনি।লজ্জায় নির্ঝরের দিকে সে তাকাতে নিতে প্রতিবার চোখ সরিয়ে আনে।আজ সে দেখবে।নির্ঝরকে মন ভরে দেখবে।

খেয়া বেশ সময় নিয়ে নির্ঝরের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো।তারপর চোখ বন্ধ করে চেহারা মনে করার চেষ্টা করলো।কিন্তু স্পষ্ট না।নাক মোটা না সরু,ঠোঁট কেমন,ভ্রু জোড়া লাগানো কি না, কিছুই মনে পড়লো না।

সে কিছুটা বিরক্তি নিয়েই চোখ খুলে।তার ডান হাতটা এখনো নির্ঝরের কপালে রাখা।জ্বর নেই।

সে বাম হাত দিয়ে নির্ঝরের সারামুখে হালকা করে অতি সাবধানে আঁকিবুঁকি করলো।তারপর চোখ বন্ধ করে আবার মুখটা মনে করার চেষ্টা করলো।এবার একটু স্পষ্ট।

সে খুশি হয়ে চোখ খুলল।নির্ঝরের কপালের উপর থেকে হাতটা সরিয়ে নিতেই নির্ঝর একটানে তাকে বুকের উপর ফেলে জড়িয়ে রইলো।

খেয়া চমকে বড় বড় করে তাকাল।নির্ঝরের দু চোখ এখনো বন্ধ।ঘুমের ঘোরে এসব করছে নাকি?সে নিজেকে ছাড়ানোর জন্য উসখুস করতে নির্ঝর দুহাতে আরো চেপে ধরলো তাকে।

খেয়া ভয় পেয়ে এবার আমতা আমতা করে বলল,

__’ছাড়ুন।’

নির্ঝর কোনো কথা বলল না।চোখও খুলল না।আরো জোরে চেপে ধরলো।

খেয়া ভয়ার্ত স্বরে বলল,

__’ছাড়ুন।প্লিজ।আমি শ্বাস নিতে পারছি না।’

নির্ঝর চোখ না খুলেই বলল,

__’এতক্ষণ কি করছিলে?’

__’ক-কিছু না।আমি তো মাত্র আপনার রুমে আসলাম।’

__’বেশ।তুমি যতক্ষণ না সত্যি বলছো ততক্ষণ ছাড়ছি না।’

__’ইয়ে মানে জ্বর মাপছিলাম।’

নির্ঝর এবার চোখ খুলে বলল,

__’কত ডিগ্রি দেখলে?’

নির্ঝরের চোখে চোখ পড়তেই খেয়া তোতলানো শুরু করলো।তার সারামুখে লজ্জার ছাপ স্পষ্ট।ছি!সে নির্ঝরের এতটা কাছে?একেবারে তার বুকের উপর?

নির্ঝর খেয়ার অবস্থা দেখে মুচকি হাসলো।তারপর চোখ বন্ধ করে বলল,

__’দেখেছো, আমি কি এমনিতেই চোখ বন্ধ করে আছি?আমি চোখ তুলে তাকালেই তোমার সব গুছিয়ে রাখা কথা গাট্টি বেঁধে পালিয়ে যায়।’

খেয়া নিচু স্বরে বলল,

__’আপনি কখন থেকে জেগে আছেন?নাকি পুরোটা সময় ঘুমানোর ভান ধরে ছিলেন?’

__’ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।কিন্তু ঘুমটা ভারী হওয়ার আগেই তুমি পায়ের জুতা খোলা শুরু করলে।এনিওয়েস,থ্যাঙ্কস!’

খেয়া নিজেকে আরেকবার ছাড়ানোর চেষ্টা করে বলল,

__’ছাড়ুন তো এবার।আমি কিন্তু কেঁদে দিবো।’

নির্ঝর বিড়বিড় করে বলল,

“মন নিয়ে এতবেশী করো কেন খেলা?
বুঝতে পারো? কেমন লাগে প্রিয়জনের অবহেলা!’

তারপর এক ঝটকায় তাকে তার পাশে শুইয়ে জড়িয়ে ধরলো।ঘুমজড়ানো কন্ঠে বলল,

__’আমি অনেক টায়ার্ড আজ।একটু ঘুমাতে চাই।ডোন্ট ডিস্টার্ব মি!প্লিজ!’

খেয়া চুপ হয়ে গেল।নির্ঝরের গরম নিঃশ্বার তার সারা মুখে এসে পড়ছে।তার কেমন জানি লাগছে!

|১৬|

সন্ধ্যার আযানের সময় নির্ঝরের ঘুম ভাঙলো। চোখ খুলে খেয়াকে নিজের এতটা কাছে দেখে চমকে উঠল।একটুপর তার মুখে হাসি ফুটে উঠলো।

ইদানীং খেয়ার ছোট খাটো কেয়ার গুলো তার পৃথিবী এলোমেলো করে দেয়।খেয়ার আরো কাছে যেতে ইচ্ছে করে।এত কাছে যে চাইলেও যেন খেয়া নিজে আর দূরে সরে যেতে না পারে।

সে রোজ অফিস শেষ হওয়ার অপেক্ষায় থাকে।কখন সে বাসায় যাবে।তার কলিজাদের দেখতে পাবে।কলিং বেল চাপার আগে তার বুকের ভেতর ধুকপুক করে।সে জানে দরজা খুললেই সে খেয়ার মুখ দেখতে পাবে।

এই যে রোজ জমিলা খালা থাকা সত্ত্বেও খেয়া নিজে দরজা খুলে দেয় এটাতে যে তার কি ভালো লাগে সেটা খেয়া জানে?

সে উঠে ওয়াশরুমে গেল।

ঘন্টা খানেক সময় নিয়ে শাওয়ার নিল নির্ঝর।তারপর ড্রেস পড়ে বের হয়ে আসলো।

রুমে ঢুকে দেখে বিছানা খালি।খেয়া নেই।রুমেও নেই।সে বেলকনিতে চেক করলো।নাহ!সেখানেও নেই।

হয়তো নিচে গেছে।নির্ঝর টাওয়ালটা বেলকনিতে মেলে দিয়ে রুমে আসলো।

মাথার চুল ঝেরে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়ালো।আয়নার উপর এক নজর তাকাতেই ধাড়াম করে দরজা খোলার শব্দ হলো।সে বেশ অবাক হয়ে পেছন ঘুরে তাকাল।

দরজার সামনে খেয়া দাঁড়িয়ে।সে রীতিমতো হাফাচ্ছে।নির্ঝর চোখের ইশারায় কিছু হয়েছে কি না জিজ্ঞেস করলো।

কিন্তু তার দৃষ্টিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে খেয়া দিল এক দৌঁড়।

এক দৌঁড়ে এসেই এক লাফে নির্ঝরের গলা জড়িয়ে নিজের সম্পূর্ণ ভর তার উপর ছেড়ে ছিল।আচমকা হওয়ায় নির্ঝর টাল সামলাতে না পেরে ড্রেসিং টেবিলের উপর পড়লো।টেবিলের কর্ণারে মাথা ঠুকে যেতেই সেই আর্তনাদ করে উঠলো।

(চলবে)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে