জীবনে অনেক পাগলামি করেছি

0
1496
জীবনে অনেক পাগলামি করেছি! কিন্তু আমার এই পাগলামির গল্পটা একটু ভিন্ন। কারণ, সেদিন কিছু দেখেছিলাম, কিছু শিখেছিলাম! ঘটনাটা ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারী মাসের। শীত ভালোই ছিল। সবেমাত্র ক্লাস ৯ এ উঠেছি। আমার এক বন্ধু, নামটা নাইবা বলি – সে ফয়জুন্নেসা স্কুলের এক মেয়েকে প্রচন্ড ভালোবাসতো। এক বছর পুরনো প্রেম তাদের। সে মেয়েটার স্কুল ছুটির পর দাঁড়িয়ে থাকত। মাঝে মাঝে আমাকেও জোর করত সাথে যাওয়ার। বিকেলে তার প্রাইভেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা, কিছু প্রাইভেট একসাথে পড়া, বাসা পর্যন্ত মাঝে মাঝে এগিয়ে দেওয়াও হত। তার জন্য অনেক ছেলের সাথে মারামারিও করেছে। বাসায় ফিরে ফেসবুকে চ্যাট অথবা মিনিট- এস.এম.এস কিনে মোবাইলে যোগাযোগ। চিঠি আদান-প্রদান, লুকিয়ে দেখা করা – সবই চলত!
সারাদিনের গল্পগুলা আমাকে শুনাতো। আমিও খুব সিরিয়াসভাবে শুনতাম এক প্রকার সিরিয়াস ভাব নিয়ে – যদিও আমার ভিতরে হাসি জমে পেট ফেঁটে যাওয়া অবস্থা থাকত! তখন ভালোবাসা-আবেক ব্যাপারগুলা আমার কাছে আদিখ্যেতা ছিল। হয়তো এখনো আছে! আচ্ছা যেখানে ছিলাম, মেয়েটা নাকি হঠাৎ তাকে কেমন জানি ইগনোর করছে। কেমন জানি বলতে – বাসায় প্রব্লেম, মোবাইল নিয়ে গেছে, আব্বা জেনে গেছে, আমাদের দেখে ফেলেছে। অথচ, সে দিব্যি মোবাইল ব্যবহার করছে, স্কুল-প্রাইভেটে ভালোই মজা করছে! শুধু তার সাথেই এমন বিহেভিয়ার করছিল। এত সুন্দর একটা রিলেশন, হঠাৎ কি জানি হল। আমার বন্ধু অনেক চেষ্টা করছিল রিলেশনটা টিকিয়ে রাখার। সে এটাও বলেছিল যে, এখন আপাতত আমরা কথা বন্ধ রাখি। কিন্তু মেয়ে রাজি নয়। সে সব শেষ করতে চায়, তার নাকি অনেক সমস্যা হচ্ছে। বন্ধু এইসব আমাকে বলত। আর আমিও ‘দোস্ত ছেড়ে দে’ ছাড়া কোনো কিছুই বলতে পারতাম না। কারণ, ভালোবাসা আর এমন পাগল হওয়া আমার কাছে নিছক ছেলেমানুষি লাগত!
পরিস্থিতি খুব খারাপের দিকে চলে যাচ্ছিল! বন্ধু এর মাঝে দু-তিন বার হাত কেঁটে ফেলেছে। ক্লাসে মন মরা হয়ে থাকত। বাথরুমে গিয়ে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদত। ছেলেরা তো আবার চিল্লিয়ে কাঁদে না। আসার পর দেখতাম, চোখগুলা লাল। বুঝতাম সব কিন্তু কিছু করার ছিল না আমার! অনেকদিন চলল এভাবে। আমারও কেমন জানি সহ্য হত না। কি এক মেয়ে, এটার জন্য এত পাগল হওয়ার কি আছে! অবশেষে, বন্ধুকে জিজ্ঞেসই করে ফেললাম – তুই কি চাস? কি করলে ভালো হবে? উত্তরে সে বলেছিল, ‘তাকে ভুলতে চাই!’ আমিও এটাই ভেবে রেখেছিলাম। মেয়েটাকে ভুলতে পারলেই সব ঝামেলা শেষ৷ কিন্তু একটা মানুষকে ভোলা যায় কিভাবে? তার খারাপ দিকগুলা, খারাপ কথাগুলা মনে করিয়ে, সারাদিন গেইম খেলে, ঘুরতে গিয়ে, স্কুলে মারামারি করে – বিভিন্ন কাজ করে বন্ধুর সময় ভালোই কাটছিল। কিন্তু যখন বাসায় গিয়ে রাতে একা হত, সে আবার কাঁদত! তখন আমি বুঝেছিলাম, কাউকে মনে করা যত সহজ – ভোলা তত কঠিন, অনেক কঠিন! তবে আমিও নাছোড়বান্দা, তাকে ভুলিয়েই ছাড়ব! অবশেষে, স্কুলের এক বড় ভাইয়ের সুবাদে এক কবিরাজ টাইপ কিছু একটার সন্ধ্যান পেলাম। লোকটা নাকি অনেক সমস্যার সমাধান দিয়েছে। বড় ভাইয়ের কোন এক বড় ভাই নাকি কোন সময়ে উনার ঔষধ খেয়ে কোন মেয়েকে ভুলেছে। যদিও বিশ্বাস হয়নি, তবুও চেষ্টা করতে সমস্যা কি! কিন্তু ঐ কবিরাজের ঠিকানা চট্টগ্রাম শহরের চকবাজার এলাকায়। এত দূর? বন্ধুকে বুঝিয়ে বলাতে সে রাজি, তাই আমিও রাজি হয়ে গেলাম। একদিন স্কুল না গিয়ে বিপুল উৎসাহ, কৌতুহল নিয়ে বাসে করে চট্টগ্রাম রওনা দিলাম! আমার মনে আছে, আমরা খুব খুশী ছিলাম। প্রথম কারণ, জীবনে প্রথমবার কাউকে না জানিয়ে এত দূর যাচ্ছি। দ্বিতীয় কারণ, আজ মেয়েটাকে ভুলে যাওয়া যাবে, ঝামেলা শেষ! খুব প্রকার মজা করতে করতেই চট্টগ্রাম পৌঁছালাম। সেখান থেকে লোকাল বাস করে সোজা চকবাজার। সেখানে ঐ বড় ভাইয়ের এক মামা দাঁড়ায় ছিল। আমাদের বন্ধুই বলা চলে, আগে কুমিল্লা থাকত। হালকা নাস্তা করেই রওনা দিলাম সেই কবিরাজের কাছে। একটা বিল্ডিংয়ের দোতালায় এক কাপড়ের দোকানের পাশে বসেন তিনি। ভেবেছিলাম, দেখতে লম্বা চুল, কংকাল-টংকাল নিয়ে বসে থাকা কোনো তান্ত্রিক টাইপ হবে৷ কিন্তু না, দেখতে একদম স্বাভাবিক মানু্ষ। যাই হোক, বন্ধু শুরুতে বলতে খুব লজ্জা পাচ্ছিল। কিন্তু শেষে আমার উৎসাহে সব বলেই দিল। সব শুনে লোকটি এক গ্লাস দুধ নিল৷ তারপর সেখানে কি সব বলে একটা কাগজ থেকে গুড়া গুড়া কিসব ঢেলে দিল। বলল, খাও এটা! বন্ধু গ্লাসের দিকে তাকিয়ে আছে! আমি তো সেই উত্তেজিত, এমন ঘটনা আমার জীবনে খুবই বিরল। হঠাৎ বন্ধু চিল্লিয়ে কাঁদা শুরু করল! আমি তার দিকে ফিরে অবাক। ঐ লোক এবং সাথে আসা মামাটিও অবাক। জীবনে প্রথম তাকে এভাবে বাচ্চাদের মত কাঁদতে দেখলাম। চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে কাঁদছে আর বলছে, ‘আমি খামু না, খাইতে পারমু না’! তার কান্না দেখে আমরা কেউ জোর করিনি। ঐ লোকটিকে বিদায় দিয়ে, সোজা রেল স্টেশন চলে গেলাম বাইক দিয়ে। মামার সুবাদে টিকিটও পেলাম লাকসাম পর্যন্ত। ট্রেন আগে থেকেই দাঁড়িয়ে ছিল, উঠে বিদায় দিলাম মামাকে। ট্রেন সময়মত ছেড়ে দিল। জানলার পাশে বন্ধুকে বসতে দিয়েছি৷ এই নিয়ে দু’বার বমিও করেছে। চোখগুলা ফোলা, লাল টকটকে। আসার সময় বাইকেও কেঁদেছে অনেক। অথচ চট্টগ্রাম আসার সময় কত খুশি ছিল। তাকে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম, ‘খাইলি না কেন? সব কষ্ট তো এতক্ষণে চলে যেত!’ সে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘যে চলে যাওয়ার চলে গেছে। তার জন্য থাকা কষ্টটাও চলে গেলে, কেমনে থাকমু বল? অন্তত কষ্টটা তো আছে, থাক না ঐটা৷ এই কষ্টটাই আমার ভাল্লাগে এখন। অন্তত এখন তো ওরে দেখতে পারি। ভুলে গেলে তো সব শেষ রে!’ আমি তার দিকে অনেক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম। এটার উত্তর ছিল না। হঠাৎ মনে হল, কয়েক মিনিটে আমার বন্ধু অনেক বড় হয়ে গেছে – এমন কথা তার মুখে কখনো শুনিনি। সেদিন যেন হঠাৎ আমার বিবেকবোধ টাও জাগ্রত হয়েছিল। আমি জানি না, ঐটা খেলে সে ভুলত কি ভুলত না! সব টাকা খাওয়ার ধান্দাই লাগে। কিন্তু বন্ধুর ঐ মেয়েকে ভুলে যাওয়ার ভয়টা আর কথাগুলা প্রথমবার আমাকে কিছু শিখিয়েছিল!
পুরা ট্রেনে আর কথা বলিনি আমরা। সে জানলার দিকেই তাকিয়ে ছিল, সেই ফোলা লাল চোখ নিয়ে। মাঝে মাঝে দু’এক ফোঁটা পানি পড়তে দেখেছিলাম। কুমিল্লা আসার পরদিন থেকে সে চুপচাপ হয়েছিল বটে তবে স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিল। পাগলামি আর করত না। মেয়েটার কথাও বলত না। সেদিন থেকে আমিও তাকে এই ব্যাপারে মজা নিতাম না, শুধু তার সাথে না – কারো সাথেই নিতাম না! আমার এই বন্ধু এখন বাংলাদেশের একটি স্বনামধন্য ভার্সিটিতে পড়ালেখা করছে! জানি, আজকে আমার এই লেখাটি পড়ে সে খুব হাসবে.. হয়তো! মেয়েটির খবর জানা নেই, আমরা আর খবর নেওয়ার চেষ্টাও করিনি। তখন নতুন এক রিলেশন করার কারণেই বন্ধুর সাথে এমন করেছিল, যা পরে জানতে পারি! আজ কোনো এক কারণে সেই কবিরাজ টার অনেক খোঁজ করলাম! পেলাম না, সে সেখানে নেই। হঠাৎ সেদিনের কথাটা মনে পড়ল। সেদিনও শীত ছিল, আজও শীত। অন্ধকার রুমে বালিশে পিঠ হেলান দিয়ে বসে আছি বিছানায়, গল্পটা টাইপ করে যাচ্ছি! সামনে কম্পিউটারে ইউটিউবে মৃদু আওয়াজে বাজছে সায়ানের ‘এক হারিয়ে যাওয়া বন্ধু’ গানটি! আজকের পরিস্থিতি, সেদিনের বন্ধুর কথাগুলা আর সায়ানের গান থেকে একটা লাইনই মাথায় ঘুরপাক করছে বারবার.. ‘ এই দুঃখটা হয়ে থাক, এই দুঃখটা বড় দামি ’ Arnab Sinha Roy

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে