জীবনতরী | বাংলা রোমান্টিক ছোট গল্প

0
1918

#গল্পপোকা_ছোটগল্প_প্রতিযোগিতা_নভেম্বর_২০২০
#গল্প- “জীবনতরী”
#লেখায়- মোঃ সাইফুল্লাহ হক

তারিখ- ১১-১১-২০২০

শুভদের পরিবারে একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি করিম মিয়া। কিন্তু তিনি আজ এক সপ্তাহ ধরে অসুস্থ। শরীরে জোর নেই তাই কাজে যেতে পারছেন না। বাড়িতে তিন ছেলে-মেয়ে আর স্ত্রী রহিমা অনাহারে আছে। এতদিনে জমিয়ে রাখা যেটুকু চাল-ডাল ছিল তাও কাল সকালেই শেষ হয়ে গেছে। অসুস্থ স্বামীকে রেখে রহিমাও কাজে যেতে পারছেন না। আবার এদিকে ছেলে মেয়েরা না খেতে পেয়ে কান্নাকাটি করছে।

শুভ ভাঙ্গা কুঁড়ে ঘরটার চালায় বসে আছে। ছোট্ট নিতু আর বাবলু গোমড়া মুখে হেঁটে হেঁটে ওর পাশে গিয়ে বসল। শুভর দিকে কেমন ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে। মুখে কিছু বলছে না আর বলবেই বা কি করে, কাল থেকে কিছু খায় না। গলায় হয়ত বলার মতো জোর টুকুও নেই। শুভ ওদের দিকে তাকালো, বুঝতে পারলো চোখজোড়া কী বলতে চায়! কিন্তু কি করবে, সেও তো কিছু খায়নি। পেটে একপ্রকার পাথর বেঁধে অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছু করার নেই! আবার হাঁটুর ওপর মাথা রেখে নিচু হয়ে থাকলো।
নিতুরা বুঝতে পেরেছে ওদের দাদার কাছে কিছু নেই, বিষন্ন মনে উঠে মায়ের কাছে গেল। মা তখন বাবার কপালে পট্টি বেঁধে দিচ্ছিল। সকাল থেকে প্রচন্ড জ্বর। পয়সা-কড়ি নেই, তাই ডাক্তারকেও ডাকতে পারছে না।
রহিমা এক প্রকার বাধ্য হয়ে কাজের সন্ধানে বের হতে উদ্যত হলো। অন্তত ছেলে-মেয়ে আর কর্তার জন্য কিছু খাবার ব্যবস্থা যদি হয়!

এক বাড়িতে গিয়ে দরজায় কড়া নাড়ল রহিমা। কিছুক্ষণ পর ভেতর থেকে একজন লোক বের হলেন। রহিমার দিকে একপলক তাকিয়ে পরক্ষণে ভারী গলায় একরাশ কথা শুনিয়ে দিলেন-

” আমার কাছে কোনো টাকা পয়সা নেই। যত্তসব, সকাল সকাল কোথা থেকে যে আসে কে জানে?”

কিছু বলার সুযোগও পেল না। পরনে ছেড়া শাড়ি, কুচকুচে ময়লায় ঢাকা জীর্ণ মুখ, তারওপর দুদিনের অনাহারী যে কেউ দেখলে ভিক্ষারী ভাববেই!
মুখের কোণে আঁচল কামড়ে হেঁটে চলেছে। কয়েকটা বাড়ি পেরিয়ে সমির সাহেবের বাড়ি। সমাজসেবক হিসেবে মহল্লা জুড়ে বেশ খ্যাতি। তাছাড়া এই এলাকার চেয়ারম্যানের সাথে ভালোই সম্পর্ক! চেয়ারম্যান সাহেব মাঝে মাঝেই আসেন সমির সাহেবের বাসায়। অনেক আদর আপ্যায়ন করেন সমির সাহেব। তার জন্য মোটা অঙ্কের বকশিশও পান।

দরজায় এসে ডাক দিতেই একটা ছেলে বেরিয়ে এল। রহিমার দিকে চেয়ে বলল- “ওই ফকিন্নি সাহেবকে ডাকছিস কেন?”

— “ভাইজান, একটু দয়া করেন! বাড়িতে আমার স্বামী-বাচ্চারা না খেয়ে আছে। কয়েকদিন থেকে আমার স্বামী অসুস্থ, কাজকাম সব বন্ধ। আমি নিরুপায় হয়ে কাজের সন্ধানে বেরিয়েছি! দয়া করে সাহেবকে একটু ডেকে দেন। যদি কোনো কাজ থাকে আমাকে দিলে অনেক উপকার হত! আমি আজীবন দায়ি থাকব তার তরে।” কান্না জড়িত কণ্ঠে হাতজুড়ে কথাগুলো বলল রহিমা।

“এখন হবে না যাও পড়ে এসো। চেয়ারম্যান এসেছেন তাকে খাওয়ানো হচ্ছে। বিরক্ত করো না তো! যাও, নাহলে আমারই চাকরি থাকবে না।”

অনেক অনুনয় বিনয় করতে লাগলো রহিমা। এ ছাড়া আর কিইবা করবে। এখান থেকে কোনো ব্যবস্থা করতে না পারলে আর কোথাও কিছু হবে না। রহিমার চেঁচামেচির শব্দ হয়তো সমির সাহেবের কান অবধি গেছে! তিনি রাগে গজগজ করতে করতে বাইরে এলেন। কাজের ছেলেটাকে এক ধমক দিয়ে বললেন- “এই কি হয়েছে? দেখতে পাসনি চেয়ারম্যান এসেছেন! এত চেঁচামেচি কিসের?

আমতা আমতা করে ছেলেটি রহিমার কথা বলল। রাগে দাঁত কটমট করতে লাগলেন কিন্তু পরক্ষণেই ঠান্ডা গলায় বললেন- “আমার বাসায় কোনো কাজ নেই! তুমি অন্য সময় এসো। আর হ্যাঁ, এখানে দাঁড়াও আমি একটা ব্যবস্থা করছি।”

কিছুক্ষণ পর ভেতর থেকে একজন মহিলা কিছু খাবার আর টাকা রহিমাকে দিল, আর কখনও এখানে আসতে নিষেধ করল।

রহিমা বাড়ির দিকে পা বাড়াল। পরিবারের জন্য কিছু করতে পেরে খুশিতে তার চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। মাঝরাস্তায় এসে খাবারের কথা মনে হলো, যেটুকু খাবার দিয়েছে তাতে না ভরবে স্বামীর পেট না ভরবে ছেলে-মেয়েদের। আর বাকি থাকল তার কথা! কিন্তু তাদের বুঝতে দেয়া যাবে না!
বাড়ি ফিরে টাকাগুলো স্বামীর হাতে দিয়ে বলল, “এই দেখ সমির সাহেব আমাদের টাকাগুলো দান করলেন। এবার তোমার ডাক্তার দেখানো আর ঔষধ কেনা হয়ে যাবে। শুধু তাই নয়, উনি আমাদের খাবারও দিয়েছেন!

তার কণ্ঠে পরিতৃপ্তির ছাপ । ভেতরের সব কষ্ট বালিচাপা দিয়ে পরিবারের মুখে এক চিলতে হাসি ফোটাতে কত অভিনয়ই না করতে হচ্ছে! বাইরে থেকে নিতু আর বাবলু দৌড়ে এসে মাকে জড়িয়ে ধরে বলল- “মা, মা, আমাদের খাবার এনেছ? আমাদের খুব ক্ষিদে পেয়েছে মা!
আমরা আর পারছি না, দাও মা দাও।
কান্না জুড়ে দিল নিতু। শুভ তখনও চিলেকোঠায় বসে আছে। আর ছোট ভাই-বোনদের আঁতলামি দেখছে। পরিবারে বাবা না থাকলে কতইনা কষ্ট করতে হয়, এক মুঠো ভাত খেতে। জীবনের এই ভয়ঙ্কর রুপ তার কিশোর মনকে চঞ্চল করছে। সমাজে টিকে থাকতে হলে নিজের স্বার্থের চেয়ে বড় কিছু আর ভাবতে নেই! সে ঠিক করল কাল থেকে কাজে যাবে!

“শুভ, বাপজান কই তুই? আয় এদিকে আয় কিছু মুখে দে । কাল থেকে তো তুইও কিছু খাস নি। আয় কিছু খেয়ে নিবি!” রহিমা ডাকছে।
মায়ের গলায় অসহায়ত্বের হাতছানি সে স্পষ্ট বুঝতে পারছে। চুপচাপ ঘরের দিকে পা বাড়ালো। কারণ ক্ষিদের জ্বালা সেও আর সইতে পারছে না।

গত কয়েক বছর যাবৎ,
শুভ হাইওয়ের পাশের অলিতে-গলিতে ঘুরাঘুরি করে। এখন তার কাজ অন্যের বাড়ির ভাঙ্গা জিনিসপত্র কুড়ানো। রাস্তায় পড়ে থাকা বোতল, কাগজ, ডাস্টবিন থেকে ময়লা-আবর্জনা কুড়িয়ে সেগুলো জমা করা।
সারাদিন খাটাখাটুনির পর বিকেলে বাড়ি ফেরার পথে অপলক দৃষ্টিতে দেখে স্কুলের ছেলে-মেয়েরা ছোটাছুটি করছে। শুভর ইচ্ছে ছিল সবার মতো সেও একদিন স্কুলের বারান্দায় পা রাখবে! কিন্তু দরিদ্রতার জোয়ারের উথাল-পাতাল ঢেউ তা হতে দিল না। অভাবের তাড়নায় ভাসতে ভাসতে সেই স্বপ্নের কূল ছেড়ে আজ বহুদূরে এসে পড়েছে শুভ। এখন চাইলেও সেই তীরে পৌঁছানো সম্ভব নয়! আর সমাজ কোনভাবেই মেনে নেবে না। টোকাইয়ের আবার কিসের পড়াশোনা? ওদের জনম যাবে কাগজ কুড়াতে পড়াশোনা দিয়ে কি ঘাস কাটবে?
হাজারো কটাক্ষ স্থগিত করে দিবে তাদের পথচলা,থমকে দাড়াবে নব-জাগ্রত সপ্নগুলো! তাই এত সবের পর কেউ মাথা তুলতে সাহস পায়না। শিক্ষাহীন অন্ধকার জীবনের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে চলতে থাকে।

শুভর বাবা মারা গেছেন কয়েকমাস আগে। এখন পুরো পরিবারকে দেখাশোনার ভার শুভর। শুধু কাগজ কুড়িয়ে পরিবার চালানো সম্ভব নয়, তাকে এখন অন্যকাজও করতে হবে। কিন্তু টোকাই বলে কেউ কোনো কাজ দিতে চায় না। যেখানেই যায় দুরদুর করে তাড়িয়ে দেয়! শুভ পাড়ার ছেলেদের দেখে সারাদিন অল্প কাগজ কুড়িয়েও তার চাইতেও বেশী টাকা কামাই করে! শুভর কিশোর মনে ব্যাপারটা ভালোই লাগে! তারপর সেও একই কাজে জড়িয়ে পড়ে! মাঝে মাঝে পুলিশের দৌড়ানিও খেতে হয়।

ইতোমধ্যেই শুভ কলোনির সেরা চোরাচালানকারী হিসেবে পরিচিত।
নিতু আর বাবলু এখন রোজ তিনকোনা মোড়ে একটা ছেঁড়া চট আর থালা নিয়ে বসে। হাত পাতে ফুটপাতে চলাচল করা লোকের কাছে। কেউ দেয় আবার কেউ দেয় না। ভিক্ষাবৃত্তিই ওদের পেশা। রোজ সকালবেলা এসে বসে পড়ে, দিনের শেষে সন্ধেবেলায় রহিমা এসে ওদের নিয়ে যায়। যে সময়টাতে ওদের হাতে চক-স্লেট থাকার কথা সে সময় ওদের হাতে ভিক্ষার থালা।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে