জানালার ওপারে পর্ব-১+২

0
1774

#জানালার_ওপারে
– ঈপ্সিতা শিকদার

একদা যাকে স্বামী রূপে চেয়েছি,তাকে দুলাভাই ডাকবো ভাবতেই গা গুলাচ্ছে। অবশ্য তখন তাঁর যোগ্য ছিলাম, এখন নয়৷ সে জীবনে এসেছিল অনাকাঙ্ক্ষিত ঝড়ের মতো। এই মনগড়া প্রেমকাব্যটা তেমন বড়ো নয়, তবে অনুভূতির বিচারে ক্ষুদ্রও নয়। তা-ই আজ লিখছি।

🥀🌺পৃষ্ঠা- ১
বিয়ে বাড়িতে গাউনের চেইনটা নষ্ট হয়ে খুলে গিয়ে একরকম বিচ্ছিরী পরিস্থিতিতে পড়ে গিয়েছি! দূরে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেগুলা হাসতে হাসতে নানা মন্তব্য করছে। সরেও যেতে পারছি না, দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে লজ্জায় চোখের জল বিসর্জন দিচ্ছে।

ঠিক তখনই কারো বজ্রকণ্ঠে কেঁপে উঠি আমি। চোখ তুলতেই দেখি এক অচেনা আগুন্তক সেই ছেলেগুলোকে ধমকাচ্ছেন,
“তোদের সাহস তো কম না! এখানে এসে বেয়াদবী! পিঠের ছাল তুলে দিব একদম! আজকেই লাস্ট এর পর যদি দেখেছি কোনো দিন সারা এলাকা ল্যাংটা করে চড়াবো।”

লোকটার ধমকে এই দিকটা মুহূর্তেই জনমানব শূন্য হয়ে গিয়েছে। তিনি আমার দিকে তীক্ষ্ম দৃষ্টি রেখে এগিয়ে আসছেন। আমি কাচুমাচু হয়ে দাঁড়াই।

“দেখে-শুনে জামা পরে আসবে না, মেয়ে? এখন এমন মূর্তির মতো না দাঁড়িয়ে ওড়না দিয়ে গা ঢেকে নেও। আর তুমি কে?”

“আমি আপনাদের পাশের বাড়ির…”

ইতস্তত ভঙ্গিমায় উত্তর দিতে দিতে ওড়নায় হাত রাখতেই তিনি মুখ বাঁকান। কিঞ্চিৎ খোঁচা দিয়ে বললেন,

“আজকালকার জামাগুলোর ওড়না আসলে ওড়না তো নয় যেন মশারির নেট। আমি চোখ বন্ধ করছি আমার সামনে এসে দাঁড়াও। কী হলো দাঁড়াও মেয়ে! দেখো আমার সারাদিন পড়ে নেই! আর না তুমি নায়িকা, না আমি নায়কদের মতো কোর্ট প্যান্ট পরে আছি যে তোমাকে দিব। একমাত্র পাঞ্জাবি তোমায় দিলে মানুষ যা তা ভাববে।”

তাঁর ধমকে আমি তাড়াতাড়ি কোনোরকম অরগাঞ্জার ওড়নাটা গায়ে জড়িয়ে তাঁর সামনে দাঁড়াই। তিনি আমার সাথে তালে তাল মিলিয়ে যতোটা সম্ভব আমাকে আড়াল করে হাঁটছেন। অসম্ভব রকমের অস্বস্তি বোধ হচ্ছে কোনো অচেনা ছেলের এতো কাছে আসায়, যদিও ছোঁয়া লাগেনি, তবে দূরত্বও এতোটাই কম যে তাঁর উষ্ণ শ্বাসও আমি বোধ করতে পারছি না।

কমিউনিটি সেন্টারের মানুষের সমারোহ কম থাকা দিক দিয়ে আমাকে একটি বিশালাকার কামরায় নিয়ে আসে, বোঝা যাচ্ছে এটা ড্রেসিং রুম কাম রেস্ট রুম বউয়ের জন্য।

ঢুকে উলটো দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলেন,
“দেখো মেয়ে, ঐ কর্নারের চেঞ্জিং রুমে আমার বোনের একটা শাল রাখা আছে। প্যাঁচিয়ে নেও। এর চেয়ে বেশি সাহায্য আমার দ্বারা হবে না।”

তিনি অন্যদিকে তাকিয়ে থাকলেও আমি চিন্তায় বিভোর হয়ে মাথা ঝাঁকাই। অতঃপর আমি চেঞ্জিং রুমে ঢুকি। সেই অচেনা যুবক চলে যাওয়ার জন্য দরজা খুলতে অগ্রসর হয়।

এমন সময় একজন মধ্যবয়স্ক নারী ‘আরিশা’ বলে চেঁচাতে চেঁচাতে এ ঘরে ঢোকেন। লোকটার এই আওয়াজ শুনে কী হলো কে জানে ছুটে এসে আমার পিছনে চেঞ্জিং রুমে ঢুকে দরজা লক করে দিলেন।

আমি তখনও তাঁর বোনের ওড়না পরিনি। বরং, নিজের ওড়না বা হিজাবটুকুও গায়ে নেই। আবারও ঢেকে-ঢুকে পরতেই নিচ্ছিলাম তিনি ঢুকেন। আঁতকে উঠে যেই না চিৎকার করে কিছু বলতে যাবে তিনি কাছে এসে মুখ চেপে ধরেন।

“দেখো মেয়ে, আমার মামী এসেছেন। তিনি যদি ভুলেও আমার সাথে এই ছেঁড়া পোশাকের কোনো মেয়েকে দেখে সারা দুনিয়ার সাথে আমার সাদা চরিত্রকে ফুটবল বানিয়ে খেলবেন। দয়া করে চুপ থাকো।”

তিনি হুমকি দিলেন না অনুরোধ করলেন বুঝলাম না। কথাগুলো অনুরোধবাচক হলেও, কণ্ঠের তেজ আর কঠোরতাটা হুমকির মতোই। আমি চুপ করে থাকলাম। তবে আমার বড্ড বেশিই দমবন্ধ লাগছে, অস্বস্তিও হচ্ছে। চেঞ্জিংরুমটা অনেক ছোটো একজন মানুষ দাঁড়ানো জন্যই ঠিক আছে, তাও অতিরিক্ত স্বাস্থ্যবানদের জন্য নয়। সেখানে ছেলেটা আমার সাথে, ছুঁই ছুঁই দূরত্ব আমাদের।

এ কোন বিপদে পড়লাম আমি! মাথাটা ভনভন করছে আমার। বাহিরে থেকে শোনা যাচ্ছে তাঁর মামীর বিড়বিড় করার শব্দ, পদচারণার আওয়াজ। হুট করেই তিনি চেঞ্জিং রুমের দরজায় ধাক্কা দেন।

“এই চেঞ্জিং রুমের আবার কী হলো? খুলছে না ক্যানো?” আরও জোরে জোরে ধাক্কা দিতে শুরু করেন। ভেঙে হলেও যেন এ দ্বার আজ খোলা অত্যাবশ্যকীয় কর্ম এই নারীর জন্য।

আমার ভয়ে কেঁদে দেওয়ার দশা! বুদ্ধিদীপ্ত ছেলেটি কড়া চোখে তাকায় আমার দিকে, ইশারায় চুপ থাকতে বলে।

হাসি হাসি মুখ করে শুধায়,
“আরে মামী, আমি এইখানে৷ আমার পায়জামা কীসের সাথে খোঁচা খেয়ে যেন ছিঁড়ে গিয়েছে। চেঞ্জ করছি। আপনার আনা ঐ সুন্দর ধুতি আর পাঞ্জাবি পরছি মামী। কী সুন্দর মামী, পুরাই আপনার মতোন। তবে ডিস্টার্ব কইরেন না। তাহলে কিন্তু সুন্দর হবে না পরা, তা না হলে মানুষ আপনার চয়েসের প্রশংসার জায়গা দুর্নাম করবে।”

লোকটার কথায় মহিলাটি মুহূর্তেই যেন উত্তেজিত এবং আনন্দিত হয়ে উঠেন। খুশিতে গদগদ কণ্ঠে বলে উঠেন,
“ওহ, আবেগ বাবা তুই আমার দেওয়া কাপড় পরছিস! তোকে তো আগেই বলেছিলাম পরতে! যাই হোক আমি তাহলে বাহিরেই বসছি। দেখতে ভালো মতো পরছিস না কি! পরে তো মানুষ আমার পছন্দের দোষ ধরবে!”

তাঁর কথা শুনতেই আমার চোখ গোল গোল হয়ে যায়। আর সাথের মানুষটি তাৎক্ষণাৎ নিজের কপালে জোরালো চাপড় মারেন। চিন্তায় মাথা টনটন করছে আমার, আমার মা বা অন্যকেউ যদি ঘুণাক্ষরেও খবর পায় এ বিষয়ে। তাহলে আমার তো পটল তুলতে হবে।

কোনোকালেই টেনশন মাথায় নিতে পারি না আমি, আজও তাই হলো। ধীরে ধীরে চোখের সামনে অন্ধকার ছেয়ে যাচ্ছে। তবে কি নিজের মান-সম্মান আজ ধুলোয় মিশতে চলেছেই?! অন্ধকারে তলিয়ে যেতে যেতে শুধু একটাই দোয়া করলাম, এ পরিস্থিতি থেকে রেহাই, নিজের মান-সম্মানের রেহাই।

চলবে…

#জানালার_ওপারে
||২য় পর্ব||
– ঈপ্সিতা শিকদার
“ভাবী, আপনার মাইয়ার তো বিয়ে হইবো না। যেই কাণ্ড কইরা বইয়া আছে, তার উপর নাই রূপ, গুণ। জামাই পাইবো কইত্তে?” ডায়ারিটা বন্ধ করে ড্রইংরুমে আসতেই শুনতে পাই প্রতিবেশি কাকীর এমন কটাক্ষ।

বেশ রাগ হলো, উত্তর দিতে চাইলাম কিন্তু দিতে পারলাম না। আমি অসহায়, আল্লাহ আমায় অসহায় করেছেন। মাঝে মাঝে খুব করে জানতে ইচ্ছে আমি কি ইচ্ছে করে করেছি নিজের ক্ষতি? কেউ কি নিজে যেঁচে নিজের পায়ে কুড়াল মারে?

নির্বাক আমি কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে চুপচাপ রাতের খাবার খেতে বসি। কাকী বেরিয়ে যেতে যেতে মুখ বাঁকিয়ে বলেন,
“এমন অবস্থায়ও খাবার গিলে কীভাবে মানুষ!”

আর খাবার খেতে ইচ্ছে করে না। ভাতে পানি ফেলে উঠে যাবো ঐ মুহূর্তে আম্মু এসে বলে,

“হাফসার সাথে আবেগের এঙ্গেজমেন্টের ডেট ফিক্সড হয়ে যাবে। হয়তো সামনের শুক্রবারেই এঙ্গেজমেন্ট। এই মাত্র ফোন করে জানালো।”

হৃদয়ে, মস্তিষ্কে পাহাড় সমান ভার অনুভব হচ্ছে। এলোমেলো পদচারণায় কোনোরকম বিছানায় বসলাম। কেন আপনি আমার হলেন না আবেগ ভাই? কেন আপনার জানালার ওপারেই রয়ে গেলাম আমি আর আমার মনগড়া প্রেমকাব্য? যদি না হওয়ারই হয় তাহলে একবার নাহয় ভুলবশত সাক্ষাৎ হয়েই গিয়েছিল দ্বিতীয়বার এলেন কেন?

ভাবতে ভাবতেই ডায়েরি নিয়ে বসলাম। লিখতে শুরু করলাম সেই আমাদের দ্বিতীয় সাক্ষাতটি।

🥀🌺 পৃষ্ঠা- ২
ভার্সিটিতে প্রথম দিন এসে এভাবে সিনিয়র ভাইকে চড় দিয়ে বসবো এ ব্যাপারটা পুরোই অকল্পনীয় ছিল। এক ঝাঁক বাচ্চা সহ মা মুরগীর দৌড়ানি খেয়েছেন কখনও? আমি খেয়েছিলাম ছোটো বেলায় একবার। আমার এখন তেমনই বোধ হচ্ছে। সিনিয়র ভাইদের ভয়ে আমি লুকিয়ে আছি একটা জনমানবশূন্য ক্লাসরুম।

আচ্ছা, ভাইয়াকে কী কল দিব? কিন্তু সে জানলে আবার কেমন প্রতিক্রিয়া দেখাবে? আমার কপালে মনে হয় আজ দু’দিন যাবত শনিই নাচছে। কথাটা ভাবতেই শুনতে পেলাম সেই পরিচিত বজ্রকণ্ঠ,

“এই মেয়ে বের হয়ে আসো ওখান থেকে। এখনই বের হয়ে আসো।”

অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘরে দরজা খুলে একফালি আলোর সাথে প্রবেশ করেছে একজন। আলো-ছায়ার খেলায় তাঁর চেহারা দৃশ্যমান নয়। ভিতরে প্রবেশ করলে দেখতে পাই তিনি তো গতকালের আগুন্তক।

সাথে সাথেউ বিয়ে বাড়ির ঘটনা মনে পড়ে গেল। জ্ঞান ফিরার পর নিজেকে আবিষ্কার করেছিলাম নিজের বেডরুমে। আমাকে অবাক করে আব্বু-আম্মু তেমন কিছুই আমায় বলল না।

শুধু বলল,
“হতচ্ছাড়া মেয়ে! না খেতে, না খেতে এমন দশা বানিয়েছিস এখন যেখানে সেখানে জ্ঞান হারাস। মানুষ তো মনে করবে আমরা কিপটে। আর যদি খাওয়া নিয়া টালবাহানা করেছিস!”

তারা চলে গেল। আমাদের বাসায় থাকা দুঃসম্পর্কের কাজিন হাফসাকে জিজ্ঞেস করলে সে জানায়, আমি না কি ওয়াশরুমের সামনে বেহুশ হয়ে পড়েছিলাম। বউয়ের ছোটোবোন না কি আমায় দেখে সবাইকে জানায়।

আমি তাড়াতাড়ি উঠে আমার জামা চেক করলাম। দেখি চেইন খুলা জায়গাটুকু প্রায় পঞ্চাশ-ষাটেক সেফটিপন দিয়ে আটকানো। তখনই নিজের হাতে চোখ গেল আমার। সেখানে যথাসম্ভব ছোটো অক্ষরে লিখা,

“মেয়ে এতোটুকুতে অজ্ঞান হয়ে পড়লে হবে৷ আরেকটু হলো মেয়ে জনিত কাণ্ডে ফেঁসে যেতাম আমি।”

“এই মেয়ে! কই গায়েব হলা?”

তুড়ি বাজিয়ে জিজ্ঞেস করলেন লোকটি। আমি তাঁর দিকে তাকালাম। তিনি আবারও মুখি খুললেন,

“মেয়ে তোমার সাহস তো কম না, তুমি ভার্সিটিতে আজ প্রথম এসেই সিনিয়রের গায়ে হাত তুলেছো। এতো দুঃসাহস কীভাবে হয়?”

আমি কোণঠাসা কণ্ঠে উত্তর দিলাম,
“দেখুন, আমার কোনো দোষ নেই। তারা আমাকে জোরাজুরি করছিল সিগরেটে মুখ দিতে। আমার অনুমতি ছাড়া আমাকে ছুঁলে বা আমাকে দিয়ে কিছু করাতে চাইলে এমনই হবে।”

তিনি তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকালেন আমার দিকে। যেন খুব গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন। আমি আবার যেন গতকালের মতো অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে পড়লাম।

কয়েক মুহূর্ত পর তিনি ফোন বের করে কাউকে কল করে আমার দিকে চোখ রেখেই বললেন,
“হ্যালো কই তুই শফি? ছেলেপেলেগুলাকে নিয়ে আয়, আজ ঠ্যাং ভেঙে শায়েস্তা করেই ছাড়বো!”

তাঁর কথা শুনে আঁতকে উঠলাম আমি। ইচ্ছে করছে দৌড়ে চলে যাই। কিন্তু ভয়ে পা দুটো যেন জমে গিয়েছে। মনে আল্লাহর নাম নিচ্ছি, প্রার্থণা করছি এদের হাত থেকে মুক্তির।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে