জলছবি পর্ব-২৬

0
1009

#জলছবি
#পার্ট_২৬
#কাজী_সানজিদা_আফরিন_মারজিয়া
.

হসপিটালের কড়িডোরে উদগ্রীব হয়ে পায়চারী করছে নিষাদ, সৃজন, শ্রেয়া আর কিছু অন্যান্য ছেলে। তারা ফয়সালের এলাকার। তারাই হসপিটাল এনেছে এবং নিষাদ, সৃজনকে খবর দিয়েছে। ঘটনা সামনে থেকে উপলব্ধি এবং ঘটনার মূল ভূমিকায় থাকার ফলে তারা আতংকিত বলেই মনে হলো। একজন আরেকজনের দিকে ভীত চোখে চাইছে বারবার। সকলের চোখমুখ ফুলে আছে। মুখমণ্ডলের বিভিন্ন স্থানে লালচে দাগ হয়ে আছে। চোখের পাশ, ঠোঁটের পাশ সহ সারা মুখজুরে মাইরের দাগ। তাদের প্রত্যেকের পরিহিত শার্টের গায়ে ছোপ ছোপ রক্তের ছাপ। ফয়সালের রক্ত বোধহয়। লাল রক্ত এখন কালচে বর্ণ ধারন করেছে।

কিছুক্ষণের মাঝেই এসে উপস্থিত হলো নোলক, নবনী। আরমান নিয়ে এসেছে ওদের। মাগরিবের নামাজ পড়েই বেড়িয়ে পড়েছে। ঐ নামাজের হিজাব পরিহিত অবস্থাতেই চলে এসেছে দুই বোন। নোলক এসে বলল,
“তোরা প্রাঙ্ক করছিস, তাই না দোস্ত? এই ফয়সালটাও না! ভালো হলো না আর। সবসময়, সবকিছু নিয়ে ফাইজলামি ওর! সবসময় কি ফাইজলামি ভালো লাগে বল? কই ফাজিলটা?”
নিষাদ কিছু বলল না। ভেজা দৃষ্টিতে আইসিইউর দিকে তাকালো।

শ্রেয়া নোলককে এসে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। নোলক শুধু বলল,
“ও তো বিকেলে আমায়….!”
এরপর আর কিছু বের হলো না মুখ দিয়ে। সময় এত দ্রুত বদলে যায়? লোকে বলে, খারাপ সময় শেষে, ভালো সময় আসে। কিন্তু নোলক ভাবে, ওর জীবনে কেন একের-পর-এক খারাপ-ই হয়ে চলছে? আরো কি বাকি আছে সামনে? হায় আল্লাহ্‌! রক্ষা কর!
শ্রেয়া ছেড়ে দাঁড়াতেই নোলক এক হাতে নবনীকে ধরে পাশের বেঞ্চটাতে বসলো। হাত-পা কাঁপছে মেয়েটার। নোলক বলে, আপু আইসিইউতে ছেলেটা!
নবনী বলে, আল্লাহ্‌ ভরসা।

লুবনা তখনও আসেনি। জানানো হয়েছে তাকেও।
আরমান সৃজনের আর নিষাদের কাছ থেকে আদ্যপ্রান্ত জানতে চাইলো। সৃজন ঐ ছেলেগুলোর দিকে তাকালো। তাদের ভেতর থেকেই হ্যাংলা পাতলা একজন বিস্তারিত বলল।
যার সারসংক্ষেপ, এলাকার কিছু ছেলেপেলের সঙ্গে বেশ কিছুদিন যাবত ফয়সালের গ্যাঞ্জাম চলছিলো। গ্যাঞ্জামের কারন ছেলেগুলো নিজেদের রাজনৈতিক ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে এলাকার মেয়েদের টিজ করা, চাদা তোলা থেকে শুরু করে নানান অরাজকতার সৃষ্টি করে চলছে। মূলত তারা রাজনৈতিক কোনো নেতা নয়, নেতাপেতাদের সাঙ্গপাঙ্গ।

একটু নিজের খেয়ালে চলার ফলে ফয়সালের কানে যখন এসব আসলো এবং নিজে পরখ করে দেখলো, ঘটনা সত্য, তখন সে হুমকি ধামকি দিয়ে আসলো। ফয়সালের দলও মোটামুটি ভারি হওয়ার ফলে তারা তখন কোনো প্রতিক্রিয়া করলো না। নিরবে হয়েই ছিল। কিন্তু তাদের কর্মকান্ডও থামালো না। তারা তাদের খেয়ালেই চলছিল। বরং তাদের ভেতর থেকেই বেশ কিছু চোর-ছ্যাচর এর উদয় হলো। এক পর্যায়ে ফয়সাল নেতাফেতাদের সঙ্গেও কথা বলল। তারা আশ্বস্ত করে বলেছিলো, দেখবে বিষয়টা।
তাদের ‘দেখা’ ঐ ‘দেখা’ অব্দি-ই থেকে গেল। দেখা আর হলো না। সব চলছিলো যেমন-তেমন। কিন্তু বিপত্তি ঘটলো আজ। ফয়সালের সঙ্গে থাকা ছেলেগুলোর মধ্য থেকে একজনের সঙ্গে তর্কাতর্কির এক পর্যায়ে হাতাহাতি হলো, তাকে একা পেয়ে মারা হলো। তখন সেই ছেলেটাই ফয়সালকে ফোন করে সব বলে। ফয়সালের মাথায় রক্ত চেপে গেল। সে তৎক্ষণাৎ সেই স্থানে গেলো।
ফয়সাল এবং ফয়সালের সঙ্গে ছিলো তারা, যারা হসপিটাল নিয়ে এসেছে। ফয়সাল প্রথমে শান্ত ভাবেই জানতে চাইল, “কেন মেরেছে?”
তাদের একজন উগ্র স্বরে জবাব দিল,
“ইচ্ছে হয়েছে তাই মেরেছে। প্রয়োজনে আরো মারবো। আমাদের কাজে নাক গলাতে আসলে আরো বেশি মার খেতে হবে।” মা-মা-বাপ তুলে গালি দেয়া হলো। সঙ্গে সঙ্গে
ফয়সালের শান্ত মেজাজ অশান্ত হলো। শার্টের হাতা গোটাতে গোটাতে বলল,
“আরো মারবি? মার, আমার সামনে মার। দেখি তোর সাহস কত?”
“মারলে, কী করবি তুই?” ছেলেটা এমন প্রতিক্রিয়া ফয়সাল দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“দেখতে চাস কী করবো? দেখ তবে!”
বলেই সজোরে এক ঘুষি মারলো ছেলেটা মুখে। ছেলেটা পড়ে গেল। ফয়সাল কলার টেনে উঠাতে উঠাতে বলল,
“দিজ ইজ দ্যা লাস্ট ওয়ার্নিং। মনে রাখিস।” বলে ধাক্কা মেরে কলার ছাড়ে।
পাশ দাঁড়িয়ে থাকা চার-পাঁচজনের মধ্য থেকে একজন হুশিয়ার করে বলল,
“দেখ ফয়সাল? তুই কিন্তু বাড়াবাড়ি করছিস! এর ফল কিন্তু খুব খারাপ হবে, বলে দিলাম।”
ফয়সাল এবার সেই ছেলেটাকে পরপর দুই-তিনটা ঘুষি মেরে বলল,
“ফয়সালকে ভয় দেখাচ্ছিস? যাদের দাপটে এমন বলছিস, জেনে রাখ, তাদেরকে এই ফয়সাল গোনায়ও ধরে না। নিজের দাপটে পারলে কিছু কর। দেখি তোর সাহস কত?”
এরপর সেই ছেলেগুলো কিছু ককরার আগেই ফয়সালের সাথে যেই দুই তিনজন ছিলো তারা সবাই মিলে ঝাঁপিয়ে পড়লো বখাটেগুলোর উপর। এলোপাথাড়ি তাদের মারলো। পাগলের মতো মারলো। ওই দিক থেকেও পাল্টা আক্রমণ করা হলো। যে যেভাবে পারছিলো সেভাবে। ফয়সালের হাত ফেটে রক্ত বের হয়ে গেল, সে থামলো না।

দুই গ্রুপের হাতাহাতির এক পর্যায়ে বখাটেদের মধ্য থেকে কেউ একজন আকস্মিক ফয়সালের পেটে ছুড়ির আঘাত করে। ফয়সাল পেটে হাত দিয়েই উল্টো ঘোরে। যে আঘাত করলো তাকে পাল্টা একটা হিট করলো। তারপর আর পারলো না। মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। ঝাপসা হয়ে এলো চোখের সামনের সবকিছু। তেজী ছেলেটা নিস্তেজ হয়ে যেতে লাগলো মূহুর্তেই। চোখের সামনে ভেসে উঠলো প্রিয় কিছু মুখ। আহারে! মা টার জন্য বেশি দুঃখ লাগলো। কেমনে থাকবে তার মা-টা! তার মনে হলো সে মারা যাচ্ছে।
না, মারা যায়নি তখনই।
ফয়সালের সাথের ছেলেগুলো দিশেহারা হয়ে ফয়সালের কাছে আসলো। আর ঐ ছেলেগুলো তখন পালিয়ে গেলো। ছেলেটা মরে গেলে ফেঁসে যাবে যে!
পুলিশিকে ইনফর্ম করা হয়েছে অনেক আগেই। ফয়সালের সাথের ছেলেগুলোই ইনফর্ম করেছে। পুলিশ সেই স্থানে গেলো। ছেলেগুলো তখন তড়িঘড়ি করে ফয়সালকে হসপিটাল আনলো।
পুলিশ বখাটেগুলোর নাগাল পায়নি। পায়নি নাকি পেতে চায়নি তা ঠিক বোঝা গেল না।

খানিক বাদে পুলিশ হসপিটাল এলো। ফয়সালের সাথের ছেলেগুলোকে ধরে নিয়ে গেলো। তাদের থেকে স্টেটমেন্ট নিবে এবং রোগীর জ্ঞান না ফেরা অব্দি তারা পুলিশ হেফাজতে থাকবে বলে ধরে নিয়ে যাওয়া হলো।

ঘড়ির কাটা টিকটিক করে ঘুরছে, রাত বাড়ছে, বাড়ছে ভয়।
লুবনা এসেছে অনেক পরে। এসে থেকেই কেঁদে যাচ্ছে। গুনগুন স্বরে কান্না। লুবনার বাবা-ই দিয়ে গিয়েছেন। প্রথমে অবশ্য তিনি ফয়সালেই বকাঝকা করেছে। লুবনাকেও প্রমাণ দেয়ার মতো করে বলেছে, বলেছিলাম না? মিললো আমার কথা? এমন উগ্র ছেলেপুলে হলে এমন দূর্ঘটনা তো তাদের নিত্যদিনের সঙ্গি! অযথা কেন তাকে কেউ মারতে যাবে? নিশ্চয় উগ্রতা করেছে। আমি আগেই বুঝেছিলাম!

লুবনা কোনো প্রতিত্তুর করেনি। সে তখন হতভম্ব। বিশ্বাসই করছিলো না! এখনও করছে না। এই ছেলে ছাড়া ওর চলবে কি করে? অসম্ভব।
লুবনা বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“বাবা আমায় ওখানে নিয়ে চলো প্লিজ। প্লিজ বাবা।”
ভদ্রলোক গলে যায়। মেয়ের কান্না তাকে অবাক করে, পিড়া তৈরি করে মনে। কোনো কিছু অভাব মেয়ের দেয়নি। এমন আর্তনাদ করে কাঁদতেও দেখেনি কখনো। কাঁদবে কেন? মেয়ে তার কাঁদতে পারবে না। তিনি নিয়ে আসেন হসপিটালে।
সেই এসে থেকে গুনগুন করে কেঁদে যাচ্ছে। কারো মানা শুনছে না। নার্সদের নিষেধও মানছে না। আমিনুল হক বললেন,
“আহা! কাঁদছ কেন? কাঁদলে কি সমস্যার সমাধা হয়ে যাবে? তুমি বাসায় চলো। এখানে আর থাকতে হবে না। কেঁদে কেঁদে পাগল হয়ে যাচ্ছে। বাকি বন্ধুরাও তো এখানেই আছে। বাচ্চাদের মতো করছে কেউ? বাসায় চলো তুমি।”
এই কথাতেই লুবনা একটু চুপ হয়। আমিনুল হক বেশিক্ষণ থাকতে পারেন না। তিনি লুবনাকে রেখেই ফেরত আসেন। আসার আগে বলে আসেন কিছুক্ষণ পর এসে নিয়ে যাবেন। কান্নাকাটি যেন না করে।

মেয়ে কি আর সেই মানা শোনে?
আমিনুল হক চলে যেতেই তার কান্নার প্রখরতা আবার বেড়ে যায়। সবার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে চেয়ে বলে,”দোস্ত? ছেলেটার বেশি কিছু হয়নি তো, তাই না? ঠিক হয়ে যাবে, না? আবার আমায় বকবে, তাই না বল? সব আবার আগের মতো হয়ে যাবে, তাই না?”

সবাই চুপ হয়ে থাকে। উত্তর তো তাদেরও জানা নেই। নোলক এই এতক্ষণ পর আর সামলাতে পারে না নিজেকে। নবনীকে আঁকড়ে ধরে। টপটপ করে পানি পড়ে চোখ ভেদ করে। বন্ধুমহলের সবচাইতে দাপুটে ছেলেটাকে ছাড়া পুরো মহলটাই ঝিমিয়ে পড়ে। মন ভেঙে চুরমার হয়।

ফয়সালের মা আসে আটটা নাগাত। তাকে জানাতে ফয়সাল নিষেধ করেছিলো। যেই আদেশ অনুসারেই প্রথমে কেউ জানায়নি। কিন্তু এক কান দুই কান হতে হতে তার কানেও পৌছে যায়। এই মহীয়সী নারী হাউমাউ করে কেঁদে উঠেনি। ভেঙে পড়েনি। হেঁটে হেঁটে পাশের বাড়ি যায়। সেই বাড়ির ছেলেটাকে খুব শান্তস্বরে বলে,
“আমাকে একটু হাসপাতালে দিয়া আসবি, বাজান? আমার পোলাডারে কতক্ষণ দেখিনা। একটু দিয়া আসবি বাপ? একলা যাইতে কষ্ট হইবো। একটু দিয়া আয়।”

এমন অনুরক্তি কেউ ফেলতে পারে? ছেলেটাও পারেনি। নিয়ে আসে।
হাসপাতে এসেও খুব স্বাভাবিক। সবাই তাকে দেখে চুপ হয়ে গেলেও সে বলে,
“আমারে দেইখা থাইমা গেলা মনারা? থামন লাগবো না। দুঃখ হইলে দুঃখ করবা। দুঃখ চাইপা রাখতে হয় না। আমার পোলাডা কই? কই রাখছে তারে?”
নিষাদ আর সৃজন তাকে ধরে একটা বেঞ্চে বসায়।
তিনি তার মতো করেই আবার বলে,
“ওই ঘরটাতে রাখছে, না? পোলাডারে বাপেরেও ওই ঘরে রাখছিল। তারপর…..তারপর আর ফিরলো না। আমার কথা কেউ শোনে নাই। পোলাডার বাপেও শোনে নাই, পোলাডাও শোনে নাই। রাগ, জিদ, মেজাজ গরম কইরা শেষে গিয়া ওই ঘরে ঢোকে! ওর বাপ না জানক, ওয় তো জানত, ওয় ছাড়া আমার আর কেউ নাই! কত কইরা না করছি, মাথা গরম করিস না, সব কিছুতে মাথা ঘামাইস না। শুনলো না আমার কথা। আমার কথা কেউ ভাবে না।
পোলাডা না খাইয়াই বাইর হইয়া গেলো। বইলা গেলো আমি যদি না খাই, তাইলে সে আর আমার লগে কথা কইবো না। আমি তো খাইছি, ওয় কেন এখনও চুপ? একটু উঠতে কইবা তারে, বাজান? ওর লগে বেশিক্ষণ কথা না কইয়া থাকতে পারি না। কষ্ট লাগে।”

সবাই নিরবে দুঃখ বিসর্জন দিলেও লুবনা আর্তনাদ করে উঠলো।

একজন নার্স অপারেশন থিয়েটার থেকে ব্যাস্ত গতিতে বেড়িয়ে এলেন। দেখে মনে হলো তার খুব তাড়া। সেই তাড়ার মাঝেই নিষাদ জিজ্ঞেস করলো,
,”কেমন আছে ও?”
নার্স তাড়াহুড়ো করে বললেন,
“খুবই ক্রিটিকাল অবস্থা। যা কিছু হতে পারে। মনোবল শক্ত করুন আপনারা। আর দোয়া করুন। প্রচুর ব্লিডিং হয়েছে উনার।”
বলেই চলে গেলেন। কিছুর প্রয়োজন পড়েছে বোধহয়।
লুবনা নোলিকের হাত ধরে বলল,
“এই উনি এমন ফালতু কথা বলল কেন? মনোবল শক্ত করবো মানে? এই দোস্ত, আমার ফয়সালকেই লাগবে। ওরে আমি খুব ভালোবাসি দোস্ত। বিশ্বাস কর। এই উদ্ভট, বদমেজাজি ছেলেটাকেই আমার সুস্থ চাই। মনোবল সুস্থ ফুস্থ বুঝি না।”
বলেই মুখ ঢেকে কাঁদে।
কোহিনূর বেগম কেমন অসহায় দৃষ্টিতে এদিক ওদিক চায়। তারপর ঢলে পড়ে শ্রেয়ার কোলে।….(চলবে)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে