#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফাতিমা_আক্তার_অদ্রি
শব্দ সংখ্যা:২৩৯০
পর্ব-০৯
শিহরণ সকাল সকাল মর্নিং ওয়াকের জন্য বেরিয়েছে। রাতে ঘুমোতে খুব দেরি না হলে সচরাচর তার মর্নিং ওয়াকটা মিস হয় না। আজও মিস হয়নি। সকালের সতেজ হাওয়াতে এমনিতেই মন প্রাণ জুড়ে এক ভালো লাগার অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ে সমস্ত শরীর ও মন জুড়ে। এই অনুভূতির ক্ষেত্রে শিহরণ নিজেও তার ব্যতিক্রম নয়। প্রকৃতি তাকে দারুণভাবে টানে। তবে প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য উপভোগ করার পাশাপাশি সে অন্য একজনের মধ্যে বুঁদ হয়ে গেছে। তার জন্য কনফেস করাটা খুব বড়ো কোনো ডিল নয়। তবুও কেন যে সে এতটা অপারগ তা সে নিজেই বুঝতে পারে না! এই যে তার চারপাশের জগত জুড়ে কতো মোহনীয়, সৌন্দর্যে ভরপুর কতো তরুণীরা ঘুরঘুর করতে থাকে। শিহরণ তাতে কোনো ভ্রুক্ষেপই করে না। তার ওসব বিরক্ত লাগে। ওদের এহেন আচরণ তার কাছে ন্যাকামির মতো মনে হয়। কিন্তু কেন যেন তার সামনে নির্বিঘ্নে ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ করতে থাকা মেয়েটার প্রতি তার দুর্বার আকর্ষণ। দশ বছর! কতটা বেশি সময়। স্কুল লাইফ, কলেজ লাইফ , ভার্সিটি লাইফ তিন তিনটা লাইফেও সে এই মেয়েটার প্রতি থাকা তার আকর্ষণকে দমন করে পারেনি। অথচ এই দুর্দমনীয় আকর্ষণের কারণেও সে কখনো তার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়নি । সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। অথচ আজ তাকে কাছ থেকে দেখে তার নিজেকে বড্ড বেশি ধৈর্যহীন মনে হয়েছে। যদিও সে সর্বক্ষণ নির্বিকার থাকার সর্বাত্মক চেষ্টা করেছে। তবুও সে যে দুর্বল হয়ে পড়েছিল তা অন্য কেউ না বুঝলেও সে তো জানে।
সেদিন অফিসের কফি কর্নারে যখন ছোঁয়া কফি তৈরী করছিল তখন তার মনে হয়েছিল একবার ছোঁয়ার হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলতে, ‘ভালোবাসতাম।আজও ভালোবাসি। ভবিষ্যতেও ভালোবাসব।’
তবে সে কিছুই বলতে পারেনি। কেবল মুগ্ধ হয়ে দেখেছিল ছোঁয়াকে। যা সে করে আসছে প্রতিনিয়ত। তাই যখন নিজেকে নিয়ন্ত্রণহীন মনে হলো তখন খুব দ্রুত সরে পড়ল তার সামনে থেকে। দূর থেকেও ভালোবাসা যায় তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ বোধহয় সে নিজেই! এই যে এতটা বছর ধরে নিজের মনের মধ্যে ছোঁয়াকে লালন করে আসছে। তাতে তো তাকে সেই উপাধিটা দিতেই হয়। তাই না ?
এই যেমন এখনও হাঁটতে হাঁটতে যখন এই পার্কটার কাছাকাছি আসলো তখন ছোঁয়াকে দেখে থমকে দাঁড়াল। একটা ছোটখাটো ঝোপ আছে এদিকটায়। শিহরণ সেই ঝোপের আড়াল থেকেই মুগ্ধ হয়ে দেখছে ছোঁয়াকে। কালো ট্রাউজার আর মেরুন রঙের একটা ফতুয়া পরেছে সে। চুলগুলো উঁচু করে বেঁধেছে। সামনের দিকে কয়েক গোছা চুল এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে অযত্নে। ঘর্মাক্ত মুখের উপর সকালের সোনালি রোদ আদর মেখে দিচ্ছে। শিহরণের বড্ড ইচ্ছে হলো ওই চুলগুলো নিজ হাতে ছোঁয়ার কানের পেছনে গুঁজে দিতে। কিন্তু…সংবরণ করল নিজের এই অবাধ্য ইচ্ছেটাকে বহু কষ্টে কেবল সঠিক সময়ের অপেক্ষায়।
এক্সারসাইজ শেষে ছোঁয়া পার্কে একটা বেঞ্চে বসে পানি খাচ্ছিল। সাইফ এসে তার পাশে বসল। বলল, ‘রাউন্ড শেষ?’
ছোঁয়া মাথা ঝাঁকাল। মৃদু তিরস্কার করে বলল, ‘তোর মতো না-কি?’
সাইফ বিরক্তি মিশ্রিত কণ্ঠে বলল, ‘আই নো আ’ম লেইট লতিফ। সো ইউ ডোন্ট হ্যাভ টু রিমাইন্ড মি দ্যাট।’
‘ওকে, বস। গো এহেড।’ ছোঁয়া পরাস্ত ভঙ্গিতে বলল।
সাইফ রাউন্ড দিতে দ্রুত দৌড়ানো শুরু করল।
সাইফকে ছোঁয়ার পাশে দেখেই শিহরণের মাথা খারাপ হয়ে গেল। একদম সকাল সকালই মেজাজটা তিরিক্ষি হয়ে গেল। শিহরণ ঝোপের আড়াল থেকেই ছোঁয়াকে পর্যবেক্ষণ করছে। ছোঁয়া হয়তো তাকে দেখেওনি। তবে সাইফ দ্রুত প্রস্থান করাতে শিহরণের হৃদয়ের উপর থেকে একটা বিশাল আকারের পাথর সরে গেল। সে মুহূর্তেই খুব হালকা অনুভব করল। তারপর বাসার উদ্দেশ্যে পা বাড়াল। এখনও ঠিক সময় আসেনি। তার নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারানো চলবে না। এখানে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে ওই প্রাণোচ্ছল মুখটা দেখলে সে নির্ঘাত নিয়ন্ত্রণহারা হয়ে যাবে।
সাইফ রাউন্ড শেষে ছোঁয়ার সামনে এসে হাঁপাতে লাগল। ছোঁয়া তা দেখে তিরস্কারের সুরে বলল, ‘তুই তো মোটুও না! তারপরেও এত দুর্বল ক্যান? আর তোকেই কি না মা আমার বডি গার্ড বানাল! হাহ্!’
সাইফ তখন তার টি শার্টের হাতটা ভাজ করে বাহু দেখিয়ে বলল, ‘দেখ! আমার বডিগার্ডের মতো শরীর বলেই তো আমাকে বডিগার্ড বানিয়েছে।’
‘তুই কি নিজেকে সালমান খান ভাবিস? ভুলেও ভাববি না!’ ছোঁয়া যেন সাইফকে সতর্ক করল।
সাইফ হাসতে হাসতে বলল, ‘আমি সালমান খান কেন ভাবব নিজেকে? আমার তো একটা বিশেষ পরিচয় আছে না-কি?’
‘হুম! আছে বইকি। আমার বডিগার্ড। আমার এমপ্লয়ি। আমার কাজিন। আরও বলতে হবে জনাব?’
‘নো মোর আইডেন্টিটি ইজ নিডেড ফর মি, দ্যা মোস্ট বিউটিফুল প্রিন্সেস।’ সাইফ রাজকীয় ভঙ্গিতে বলল।
ছোঁয়া সাইফের কথার উত্তর না দিয়ে বাসার উদ্দেশ্যে হাঁটতে শুরু করল। তার পিছু পিছু হাঁটতে হাঁটতে সাইফ আবার বলল, ‘তো আজ কি প্রিন্সেস শপে আসবেন?’
ছোঁয়া বিরক্তির সুরে বলল, ‘এসব কি শুরু করেছিস? আ’ম নট এনি কাইন্ড অব প্রিন্সেস। আ’ম জাস্ট এ অর্ডিনারি গার্ল।’
সাইফ এবার পরাস্ত ভঙ্গিতে বলল, ‘খালামণির জন্য তো তুই প্রিন্সেসই।’
ছোঁয়া বলল, ‘হুম। বাট নট ফর ইউ। গট ইট?’
সাইফ বলল, ‘ওকে। দ্যান ইউ আর দ্যা মোস্ট ইরিটেটিং গার্ল অব দ্যা ওয়ার্ল্ড।’
ছোঁয়া হাসতে হাসতে বলল, ‘নাউ ইটস্ সাউন্ড মাচ ব্যাটার দ্যান প্রিন্সেস। বাই দ্যা ওয়ে, আই লাইকড ইট।’
সাইফ তার বুকের বাঁ পাশে হাত দিয়ে ঘায়েল হওয়ার অভিব্যক্তি করল। বলল, ‘তেরি বো মুচকান ঘায়েল কর দিয়া মুঝে।’
ছোঁয়া গম্ভীর কণ্ঠে এবার বলল, ‘এবার কিন্তু ওভার এক্টিং হয়ে যাচ্ছে সাইফ!’
সাইফ বাধ্য ছেলের মতো আর একটা কথাও বলল না। ছোঁয়া তা দেখে মুচকি হাসছে। অবশ্য সাইফ তা দেখল না।
______________________
শিহরণ ঘামে ভিজে চুপচুপে হয়ে বাসায় ফিরেছে । বাসায় এসেই সে নিজের রুমে চলে গেল। শাওয়ার নিয়ে ফ্রেশ হতেই ড্রয়িং রুমে এসে বসল। টিভিটা ছাড়তেই নিত্যদিনের সেই পরিচিত সংবাদ শুনতে পেল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যয়নরত এক ছাত্রীকে খুন করা হয়েছে। খুনের দায়ে অভিযুক্ত তার শ্বশুর ও স্বামী। শিহরণ ভেবে পেল না মানুষ এতটা নির্মম কী করে হতে পারে!
এই তো সেদিন সন্ধ্যায় আবার শুনতে পেল বাবা সন্তানের কাছে টাকা চেয়েছে তাই তার তিন সন্তান আর সন্তানের স্ত্রী মিলে সেই বৃদ্ধ লোকটিকে বেঁধে ইচ্ছেমতো পিটিয়েছে। মানুষ এতটা নির্মম কী করে হতে পারে! শিহরণ ভেবে পায় না! এসব দেখলেই তার খুব কষ্ট লাগে। ইচ্ছে করে পুরো সমাজ ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে। কিন্তু এই প্রশাসনিক কাজের দায়িত্ব তো তার না। সে বুঝতে পারে না প্রশাসন করেটা কী! এত এত অন্যায় অবিচার হয়ে যাচ্ছে চারদিকে অথচ প্রশাসনের টনক নড়ছে না। ধর্ষণ, ছিনতাই, রাহাজানি, পারিবারিক কলহ এক নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সাব্বির আহমেদ অফিসের জন্য রেডি হয়ে এসে বসলেন ড্রয়িংরুমে। শিহরণের ভ্রু কুঞ্চিত দেখে তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘ কী হয়েছে আমার আব্বুটার?’
শিহরণ বাবার দিকে তাকিয়ে নৈরাশ্য মিশ্রিত কণ্ঠে বলল, ‘আচ্ছা, আব্বু! মানুষ এতটা নিষ্ঠুর কী করে হতে পারে? এভাবে একজন মানুষ অন্য আরেকজন মানুষকে কীভাবে খুন করে ফেলতে পারে? শুধুমাত্র জাগতিক সুবিধা লাভটাই কি সব? মানবতা, নৈতিকতা, মনুষ্যত্ববোধ বলে কি কিছুই নেই?’
সাব্বির আহমেদ ছেলেকে জহুরি চোখে পরখ করলেন। তার দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, ‘অবশ্যই আছে। মানবতাবোধ, মনুষ্যত্ববোধ, নৈতিকতা সব কিছুই আছে। আবার লোভ, ঈর্ষা আর হিংস্রতাও আছে। যার দরুন মানুষ জাগতিক সুবিধা লাভের উদ্দেশ্যে নিজের মধ্যের ভালো সত্তাকে লুকিয়ে বা ধ্বংস করে খারাপ সত্তাটার বহিঃপ্রকাশ করে থাকে।’ একটু থেমে তিনি আবারও গুরুগম্ভীর কণ্ঠে বললেন, ‘প্রতিটি মানুষের মধ্যেই দুটো সত্তা সমানভাবেই থাকে। এখন কে কোন সত্তার বহিঃপ্রকাশ করবে সেটা তার উপর নির্ভর করে। অথবা তার পারিপার্শ্বিক অবস্থার উপরে নির্ভর করে।’
বহ্নি তার বাবার সাথে সুর মিলিয়ে বলল, ‘আব্বু একদম ঠিক বলেছে। সত্যিই একজন মানুষের মধ্যে দুটো সত্তা থাকে। মানুষের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতার উপর নির্ভর করে তার মধ্যের কোন সত্তাটি প্রাধান্য পাবে আর কোনটি প্রাধান্য পাবে না। আর এই কারণেই তো আমরা এক এক সময় মানুষের এক একটা রূপ দেখি।’
সাব্বির আহমেদ বহ্নির মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘একদম ঠিক বলেছে আমার আম্মুটা।’
বহ্নি হেসে বলল, ‘আব্বু এসব তো তোমার কাছ থেকেই শিখেছি।’
শিহরণ বহ্নিকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘মাই ব্রিলিয়ান্ট সিস্টার।’
‘উঁহু! ইউ আর ফার মোর ব্রিলিয়ান্ট দ্যান মি।’ বহ্নি প্রতিবাদের সুরে বলল।
‘একদম না। তুই বেশি ব্রিলিয়ান্ট ।’
‘তুমি বেশি ব্রিলিয়ান্ট।’
‘থামো তোমরা। দুজনেই সমান ব্রিলিয়ান্ট। আর দুজনেই সমান আবেগী।’ সাব্বির আহমেদ ছেলে আর মেয়ের ঝগড়া থামাতে উঁচু কণ্ঠে বললেন।
বহ্নি অবিশ্বাসের সুরে বলল, ‘আবেগী আর আমি? আব্বু তুমি ঠিক আছ তো? আমাকে আবেগী বলছ?’
‘হুম! অবশ্যই তুইও খুব আবেগী।’
‘আমি তো আমার ভেতরে কোনো আবেগ খুঁজে পাই না আব্বু?’ বহ্নি প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে বলল।
‘পাবি। আমার আব্বুটার চাইতেও আম্মুটা বেশি আবেগী।’ সাব্বির আহমেদ দৃঢ় কণ্ঠে বললেন।
শিহরণ প্রাণ খুলে হাসল বাবার কথা শুনে। সহাস্যে বলল, ‘এবার দেখেছ আমার বার্বি ডলটা ও আবগী। হা হা হা।’
‘ভাইয়া…!’ বহ্নি চোখ বড়ো বড়ো করে বলল, ‘এখন একদম এসব বলবে না। আমি মোটেও আবেগী না। বুঝেছ?’
শিহরণ ভয় পাবার ভঙ্গি করে বলল, ‘ওপস্! খুব ভয় পেয়েছি। চোখ দিয়েই কি খুন করবি?’ বহ্নিকে জড়িয়ে ধরে বলল,’মাই কিউট ভ্যাম্পায়ার সিস্টার। আচ্ছা তোর ভ্যাম্পায়ারের মতো বড়ো বড়ো দাত আছে না-কি দেখা তো!’
‘আব্বু দেখ তো। ভাইয়া সবসময় এমন করে।’
সাব্বির আহমেদ শিহরণ আর বহ্নির দিকে তাকিয়ে হাসলেন শুধু। কিছুই বললেন না। মনে মনে বললেন, ‘ভাই বোনের এই বন্ধন যেন চিরকাল অটুট থাকে।’
ভাইবোনের খুনশুটিতে বাধা দিল মিষ্টি। সে এসে চেঁচিয়ে বলল, ‘আপনাদের খেতে ডাকতেছে আন্টি। শুনতে পান না?’
শিহরণ বলল, ‘আসছি। তুই যা।’
নাশতা খেতেই আসতেই সাবিহা সাবরিন অভিযোগ করে বললেন, ‘আজ আমাকে বাদ দিয়েই বাবা আর ছেলে মেয়ে মিলে মজা করলে। আর এদিকে আমি নাশতা বানাতে বানাতে অজ্ঞান হবার দশা।’
মিষ্টি না বুঝে বলল, ‘আন্টি! তাহলে তোমার হুঁশ ফিরল কি করে?’
মিষ্টির কথা শুনে সবাই একযোগে হাসতে লাগল। সাবিহা সাবরিন ধমকে বললেন, ‘এবার হাসাহাসি বন্ধ করো সবাই। খাবার খেয়ে তারপর না হয় আবার শুরু করবে। এখন চুপচাপ খাবার শেষ করো।’
মিষ্টি কাঁচুমাচু হয়ে আবার বলল, ‘বহ্নি আপু! আমি কি ভুল কিছু বলেছি?’
বহ্নি হাসতে হাসতে বলল, ‘না রে মিষ্টি তুই ভুল বলিসনি । তুই মিষ্টি কথা বলেছি। তাই আমরা সবাই মজা পেয়েছি।’
মিষ্টি শিহরণের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘সত্যি ভাইয়া?’
‘নয়তো কি? একদম সত্যি।’ শিহরণ হাসি চেপে রেখে বলল।
মিষ্টি যেন আশ্বস্ত হলো শিহরণের কথায়। সে এবার সবার সাথে নাশতা খেতে শুরু করল।
________________________
মাহফুজ হক ডাইনিং টেবিলের চেয়ারে বসেই খবরের কাগজে বুঁদ হয়েছিলেন। একটু বয়স হলেই বোধহয় খবরের কাগজের প্রতি কেমন যেন একটা বন্ধন তৈরী হয়। রাদিদ ফুফাকে দিন দুনিয়া ভুলে খবরের কাগজে বুঁদ হয়ে থাকতে দেখে প্রতিবারই মনে মনে ভাবে এই একটা কথা। তার জ্বর সেরে গেছে। সকালে উঠেই গোসল সেরে ফেলেছে । তাই নিজেকে সতেজ ও প্রাণবন্ত লাগছে তার। সে ডাইনিং টেবিলের একটা চেয়ার টেনে বসতেই মাহফুজ হক খবরের কাগজ থেকে চোখ সরিয়ে তার দিকে দৃষ্টি দিলেন। গম্ভীর গলায় বললেন, ‘কী ব্যাপার? জ্বর সেরেছে?’
রাদিদ মৃদু স্বরে বলল, ‘জি , ফুফা। এখন ভালো লাগছে।’
‘তোমার কাজ কি হয়েছে? দোকানের মালপত্র সব কিনেছ তো?’ মাহফুজ হকের অনুসন্ধানী কণ্ঠ।
‘জি, ফুফা। মোটামুটি সব কেনাকাটা শেষ।’
‘ভালো করে দেখে নিয়েছ তো? ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রপাতি কিনতে বেশ সতর্ক থাকতে হয়। মাল খরাপ পড়লে তো তোমার পক্ষে আবার ঢাকায় আসতে বেশ ধকল পোহাতে হবে।’
‘জি, ফুফা। কোনো সমস্যা নেই। মানুষটা আমার পরিচিত তাই সমস্যা হবে না। খারাপ পড়লে এক্সচেঞ্জ করা যাবে। অতটুকু বিশ্বাস করা যায়।’
‘ব্যবসায় চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করতে নেই। তার উপর তোমার এসব ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রপাতি কেনার কোনো অভিজ্ঞতা তো নেই। বিশ্বাসী মানুষেরাই তো একসময় বিশ্বাসঘাতকতা করে। তাই চোখ কান খোলা রাখবে। এমনিতেই তো তুমিও তোমার মায়ের মতো খুবই নরম মনের। আর সবাইকে খুব সহজেই বিশ্বাস করে ফেল। তাই সতর্ক করলাম।’
নীরা নাশতার ট্রে এনে রাখল টেবিলের উপর। নওশীন হক চায়ের ট্রে হাতে নিয়ে আসছিলেন। তিনি রাদিদকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘তোর ফুফার এই কথার সাথে আমি একদম একমত।’
‘আফরিন কই?’ নীরার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন নওশীন হক,’এখনও ঘুম থেকে উঠেনি মেয়েটা?’
নীরা বলল, ‘ না আম্মু।’
‘ডাকিসনি কেন ওকে?’ ধমকে বললেন তিনি।
‘আম্মু আমি তো ডেকেছি। কিন্তু আপু আমাকে বালিশ ছুঁড়ে মেরেছে। বলেছে আর যদি ওকে ঘুম থেকে ডাকতে যাই তাহলে আমার গলা
টিপে ধরবে।’ নীরা সোজাসাপ্টা উত্তর।
‘দেখেছেন?’ অভিযোগের সুরে বললেন নওশীন হক, ‘আপনার লাই পেয়ে পেয়ে মেয়েটার সর্বনাশ হচ্ছে। আমি এই মেয়েকে আর ঘরে রাখব না।’
‘তাহলে কোথায় রাখবে?’ মাহফুজ হক বোকার মতো প্রশ্ন করে বসলেন।
‘হ্যাঁ, ফুফু। ঘরে না রাখলে তাকে রাখবে কোথায়?’ রাদিদও ফুফার সাথে যোগ দিল।
‘কোথাও রাখব না। পড়াশুনাতেও তো তার মনোযোগ নেই তাই ওর বিয়ে দিয়ে দিব। আমি শীঘ্রই ওর বিয়ের ব্যবস্থা করব।’ নওশীন হক তার স্বামীর দিকে তীক্ষ্ম চোখে তাকিয়ে বললেন, ‘এই বিষয়ে আমি আর আপনার কথা শুনব না। মনে রাখবেন?’
‘ইয়ে! তাহলে তো বেশ হবে। আপুর বিয়ে তো অনেক মজা করব আমরা সবাই মিলে। ইয়ে।’ নীরা খুশিতে লাফিয়ে উঠল।
রাদিদ চুপ করে বসে ছিল। নীরা রাদিদের হাত ধরে বলল, ‘ভাইয়া! তোমরা সবাই আসবে কিন্তু । মামিকেও আনবে।’
মাহফুজ হক নীরকে ধমকে উঠলেন। বললেন, ‘সবসময় তোমার ফাজলামি। কোনো বিয়ে হবে না এখন। আমার মেয়ে পড়াশোনা শেষ করার আগে কোনো বিয়ে হবে না।’
আফরিন চোখ কচলাতে কচলাতে ডাইনিং রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে জড়ানো গলায় বলল, ‘এই সকাল বেলা তোমরা কার বিয়ের কথা বলছ?’
নীরা আগ্রহী গলায় বলল, ‘আপু! আম্মু বলছে তোমাকে বিয়ে দিয়ে দিবে।’
আফরিনের মাথায় যেন বাজ পড়ল। তার চোখ থেকে ঘুম পালিয়ে গেছে। ভূতগ্রস্তের মতো কতক্ষণ মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকল। তারপর বাবার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আব্বু! এসব কী শুনছি?’
মাহফুজ হক খুব ভালো করেই চিনেন নিজের মেয়েকে। তাই পরিস্থতি সামলাতে তিনি বললেন, ‘আরেহ্! না রে মা। আমরা তো রাদিদের বিয়ের কথা বলছি। আমার আম্মুকে এত তাড়াতাড়ি বিয়ে দেবার কোনো ইচ্ছে নেই আমার।’
রাদিদ ভ্রু কুঁচকে কপালে ভাজ ফেলে বলল, ‘আমার বিয়ে মানে…?’
মাহফুজ হক রাদিদের কথা সম্পূর্ণ করতে দিলেন না। বললেন, ‘আচ্ছা, আফরু! তুমি কি দেখবে তোমার ভাইয়ের জন্য মেয়ে?’
আফরিন চোখে মুখে রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে বলল, ‘নো ড্যাড! ওদের ফ্যামিলিতে কোনো মেয়ে থাকতে পারবে না! সো মাচ লো ক্লাস! তার উপর কেমন একটা ঘর। পুরো দম বন্ধ হবার জোগাড় হয়ে যায়।’
নওশীন হক তৎক্ষনাত ধমকে বললেন, ‘এসব কী কথা? দিন দিন এত অভদ্র হচ্ছ তুমি, আমি অবাক হচ্ছি কেবল। আর আমি মোটেই রাদিদের বিয়ের কথা বলছি না। আমি তোমার বিয়ের কথা বলছি। তুমি পড়াশুনাও করবে না তাহলে তোমাকে এখানে বসিয়ে রেখে তো লাভ নেই। স্বামীর ঘরে যখন যাবে তখন আপনা থেকেই সব ঠিক হয়ে যাবে। তখন এই উগ্র চালচলনে কোনো কাজ হবে না।’
‘ড্যাড!’ আফরিন গগণবিদারী চিৎকার দিয়ে বলল, ‘দেখলে তো মা সবসময় আমাকে বকে। আর আমি তোমার পছন্দে বিয়ে করব না। আমি আমার পছন্দে বিয়ে করব।’
রাদিদের এসব শুনতে খুবই খারাপ লাগছিল। মনে হচ্ছে একটা নীল রঙা কষ্টের দলা গলার ঠিক কাছটাতে আটকে আছে। খুব কষ্ট হচ্ছে তার। তাদের আর্থিক অবস্থা এতটাও খারাপ না যে কথায় কথায় এমন অপমান সহ্য করা লাগবে। তবে সে মনে মনে পরিকল্পনা করে রেখেছে নতুন আরেকটা বিজনেস করার। যার কারণেই এবার ঢাকায় আসা। একটা কম্পিউটারের দোকান শুরু করতে যাচ্ছে সে। স্থানীয় একটা সরকারি ট্রেনিং সেন্টার থেকে প্রশিক্ষণও নিয়েছে সে। ফুফু বকা দেয় বলেই সে এখানে এসে উঠে। আর নীরা তো তাকে পেলে ছাড়তেই চায় না। এই যেমন এখন তার আর এখানে থাকতে মন চাইছে না। তবুও সে যেতে পারবে না। কারণ এই পরিবারের সদস্যদের মধ্যে একজনের কথা শুনতে তার খারাপ লাগলেও অন্য তিনজন মানুষ তো তাকে অনেক বেশিই ভালোবাসে। আর নীরা তো তার জান!
নীরা রাদিদের দিকে তাকাল। সে বুঝতে পারছে তার রাদিদ ভাইয়ার মনটা খারাপ হয়ে গেছে। তাই সে বলল, ‘রাদু ভাইয়া! চলো তো আমার সাথে আমার রুমে। আমাদের নবীনবরণ অনুষ্ঠানে আমি কোন শাড়িটা পড়ব তা একটু বলে দাও। আমি একদম বুঝতে পারছি না।’
রাদিদ আমতা আমতা করে বলল, ‘আমি শাড়ির কী বুঝি বল তো?’
‘তুমি সব বুঝেও না বুঝার ভান করে থাকা মানুষ। আমি সব না বুঝলেও এটা খুব ভালো করে জানি।’ নীরা বিজ্ঞ মানুষের মতো করে বলল।
তারপর রাদিদকে টানতে টানতে নীরা নিজের রুমে নিয়ে গেল। নওশীন হক একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করলেন। তিনি এটা ভেবে খুশি হলেন যে নীরা পরিস্থিতি বুঝে রাদিদকে নিয়ে গেল। একটু হলেও বুঝে তার ছোট মেয়েটা অথচ বড়ো মেয়েটা বড্ড অবুঝ। দুই মেয়ে যেন চুম্বকের দুই বিপরীত মেরু!
__________________________