ছোঁয়ার শিহরণ ২য় খন্ড পর্ব-৬৮+৬৯

0
1771

#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফাতিমা_আক্তার_অদ্রি
পর্ব-৬৮

শিহরণ প্রতিনিয়ত এক অবর্ণনীয় যুদ্ধ করে যাচ্ছে ছোঁয়াকে পুনরায় নিজের পায়ে হাঁটতে দেখার জন্য। প্রতিদিন খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে ছোঁয়াকে নিয়ে পার্কে চলে যায় তারপর অফিসে। এটা তার নিত্যকার রুটিন। ও অফিসে থাকলে একজন ফিজিওথেরাপিস্ট ছোঁয়ার দেখভাল করে। সাবিহা সাবরিনের সাথে ছোঁয়ার সম্পর্ক এখনও স্বাভাবিক হয়নি। তবে ধীরে ধীরে তার রাগটা হয়তো প্রশমিত হচ্ছে। আজকেও ছোঁয়াকে নিয়ে পার্কে এসেছে শিহরণ। ফিজিওথেরাপিস্টের পরামর্শ অনুযায়ী শিহরণ প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। মাঝেমধ্যে ছোঁয়া হাল ছেড়ে দেয়। হতাশ গলায় বলে, ‘আমার দ্বারা হাঁটতে পারা সম্ভব নয় শিহরণ।’

শিহরণ তখন রেগে যায়। পরক্ষণেই শান্ত হয়ে ছোঁয়ার পাশে বসে তার হাত দুটো নিজের হাতে মুষ্টিবদ্ধ করে নিয়ে বলে,’আমার বিশ্বাস তুমি হাঁটতে পারবে। আমার এই বিশ্বাসকে সত্য প্রমাণ করার জন্য কি তুমি আমার সঙ্গ দেবে না?’

ছোঁয়া তখন অবাক বিস্ময়ে শিহরণের দিকে তাকায়। তার চোখ জোড়া অশ্রুসিক্ত হয়ে ওঠে। সে নির্দ্বিধায়, নিঃসঙ্কোচে শিহরণকে জড়িয়ে ধরে চোখের নোনা জলে শিহরণের বুক ভিজিয়ে দেয়। আবেগে ধরে আসা গলায় কোনোমতে বলে, ‘আমি যে এতোটা লাকি তা আজকের এই অক্ষমতা না থাকলে হয়তো কখনোই বুঝতে পারতাম না।’

শিহরণ তখন দুষ্টুমির স্বরে বলে, ‘উহুঁ, এতোটা লাকি তুমি নও, প্রিয়তা। এখন আমি তোমার সেবা করছি কারণ ইন ফিউচার তোমার সেবার আমার খুব প্রয়োজন হবে। ননস্টপ টুয়েন্টি ফোর আওয়ার, মাইন্ড ইট!’

ছোঁয়া তখন সোজা হয়ে বসে লজ্জাবনত কণ্ঠে বলে, ‘আচ্ছা, তাহলে এই ব্যাপার!’ পরক্ষণেই পরাস্ত ভঙ্গিতে বলে উঠে, ‘ঠিক আছে, জাহাপনা, আপনার ইচ্ছে শিরোধার্য! আপনার সেবাতেই এই জীবন উৎসর্গ করতে চাই।’

শিহরণ হাসে। তারপর আবার শুরু হয়ে যায় ছোঁয়াকে ধরে ধরে হাঁটানোর চেষ্টা। ছোঁয়ার কষ্ট হয় তবুও শিহরণের মুখের দিকে তাকিয়ে সে জোর চেষ্টা চালায়। শিহরণের বিশ্বাসকে সম্মান করে সে নিজের সর্বোচ্চটুকু দেয়।

পার্কের প্রতিটা মানুষ শিহরণের নিত্যকার এই চেষ্টাতে মুগ্ধ হয়, কখনও আফসোস করে এই ভেবে–অযথা কষ্ট করছে ছেলেটা, মেয়েটা কখনোই হাঁটতে পারবে না। কেউ কেউ বলে এতো বড়ো পরিবারের ছেলের কি দরকার ছিল একটা পঙ্গু মেয়েকে বিয়ে করার! কেউ কেউ বলে ছেলেটা হাঁটতে না পারা মেয়েটাকে ভীষণ ভালোবাসে। আর মনে মনে প্রার্থনা করে যেন তাদের ভালোবাসার জয় হয়।
_____________________

মায়ের করুণ অবস্থার কথা জানার পর থেকে অতল অপ্রকৃতিস্থের ন্যায় আচরণ শুরু করেছে। সারাটা রাত নির্ঘুম কাটিয়ে দিল। তার অশ্রুসিক্ত দু’চোখের পাতা কোনোভাবেই এক হতে চাইছে না।

একটা সময় শেষে সে বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। তার এখন কিছুই ভালো লাগছে না। একদিকে মায়ের জন্য কষ্ট হচ্ছে, অন্যদিকে বাবার চরিত্র সম্পর্কে জেনে তার মধ্যে একটা ভয় জেগে উঠেছে। সে কী তার বাবার মতো হয়ে যাবে? দুশ্চরিত্র! লম্পট! মাদকাসক্ত! যদি হয়ে যায় তবে তার এঞ্জেলের কী হবে? তার এঞ্জেলও কি তার মায়ের মতো পাগল হয়ে যাবে? না, এটা সে কিছুতেই হতে দিবে না! কখনও না। তবে কি সে সরে যাবে তার এঞ্জেলের জীবন থেকে?

আজানের সুর ভেসে আসছে। ভোর হতে শুরু করছে। অতল তার সিদ্ধান্ত নিয়েই নিল। এটাই ঠিক হবে সবার জন্য। সকাল সকাল ফ্রেশ হয়ে কেউ ঘুম থেকে ওঠার আগেই অভুক্ত অবস্থাতেই অতল বেরিয়ে গেল।

রাস্তায় বেরিয়ে অতল বিক্ষিপ্তভাবে পা ফেলছে। তার নিজেকে দিশেহারা লাগছে। তার বোকা মা টা এতোটা কষ্ট করেছে কেবল তাকে পৃথিবীর মুখ দেখাবে বলে! অতলের ভেতর থেকে একটা আর্তনাদ বেরিয়ে এলো, ‘মা, মা, আমার বোকা মা, আমার সহজ-সরল মা! কেন তুমি আমাকে একা ছেড়ে গেলে, মা? কেন তুমি চলে গেলে আমাকে একা ছেড়ে? কেন, মা? তুমিই আসলেই বোকা, তবুও তো তুমি আমার মা! আমার তো তোমাকেই দরকার ছিল, মা। আমরা দুজন মিলে কি ওই নরপিশাচটার সাথে লড়তে পারতাম না?’

হঠাৎ করেই অতলের মনে হলো সে বহুদূরে চলে যাবে। সবার কাছ থেকে সে দূরে চলে যাবে। অনেক দূরে! কিন্তু কোথায়?

একসময় অতলের মনে হলো সে রাদিদের বাসায় চলে যাবে। ব্যস, টিকিট কেটে বাসে উঠে গেল।
________________

কুমিল্লা পৌঁছে অতল রাদিদকে ফোন দিল। রাদিদ ভীষণ অবাক হলো। দোকানে কাজের ছেলেরা না থাকায় সে দোখান বন্ধ করে রাদিদকে রিসিভ করতে গেল। স্টেশনে এসে অতলকে এরকম বিধ্বস্ত অবস্থায় দেখে ভীষণ অবাক হলো রাদিদ। তবে কারণটুকু জিজ্ঞেস করার সাহসও পেল না। অতলের এমন বিধ্বস্ত হবার পেছনে নিশ্চয়ই কোনো শক্তপোক্ত কারণ আছে-তা আন্দাজ করতে পারাটা রাদিদের জন্য খুব কঠিন কিছু নয়।

ফাইজা বেগম অতলকে দেখেই আন্দাজ করতে পারলেন তার মনের উপর দিয়ে একটা বড়ো-সড়ো ঝড় বয়ে গেছে। ভীষণ মায়া হচ্ছে তার ছেলেটার উপর। একটা সময় রাদিদও এই ছেলেটার মতোই বিধ্বস্ত ছিল। দিন-রাত খেটে তাদের ভরণপোষণ করেছে, ভাইবোনদের লেখাপড়া করার অর্থের যোগান দিয়েছে। স্বামীর মৃত্যর পর থেকে তিনি প্রায় অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। তখন কেবল রাদিদ আর নীলা ছিল। রাদিদ দোকান শেষে রাত জেগে তার সেবা করেছে। আজ এতোটা বছর পরে তিনি যেন অতলের মাঝে রাদিদের ছায়া দেখলেন। তার দু’চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠতে চাইছে। তিনি বহুকষ্টে তা সংবরণ করে আদুরে গলায় অতলকে কাছে ডাকলেন। তারপর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘কেমন আছ বাবা? ফ্রেশ হয়ে আসো, আমি খাবার দিচ্ছি।’

তারপর রাদিদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘বড়ো খোকা, তোর কাপড় তো আমার এই খোকার গায়ে খুব সহজেই ফিট হয়ে যাবে। ওকে তোর থেকে কিছু কাপড় বের করে দে পরার জন্য।’

ফাইজা বেগমের এমন কথাতে অতলের কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসছে। সে অনেককিছু বলতে চেয়েও কিছু বলতে পারল না।

বাথরুমে ঢুকে অতল পানির কল ছেড়ে দিয়ে এতক্ষণ অবধি চেপে রাখা কষ্টটা বের করে দিল। তার বুকটা ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে। মাকে খুব মনে পড়ছে! মাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে! ইশ, কেন মায়ের একটা ছবি চাইল না সে! এখান থেকে শীঘ্রই চলে যাবে। তারপর মায়ের একটা ছবি নেবে সে। ছবিটা সর্বক্ষণ নিজের সাথে রাখবে। কখনও নিজের কাছ থেকে আলাদা করবে না, কখনোই না।

অতলের দেরি দেখে রাদিদ দরজায় করাঘাত করে বলল, ‘অতল, তোর হয়েছে? মা তোর জন্য খাবার রেডি করে বসে আছে।’

অতল কণ্ঠ যথাসম্ভব স্বাভাবিক করে বলল, ‘এইতো এক্ষুনি আসছি।’

খেতে বসে অতল শুধু খাবার নাড়াচাড়া করছে। খাচ্ছে না। অথচ পেটে ভীষণ খিদে! গতকাল থেকে কিছুই খাওয়া হয়নি তার। পিউ ইশারায় তার নানুকে দেখাল। নীলাও দেখল তার সামনে বসা ছেলেটার চোখ দুটো কেমন যেন রক্তশূন্য-চোখে থাকা চশমাটাও সেই রক্তশূন্য চোখ দু’টো আড়াল করতে পারল না, চেহারাটা বড্ড ফ্যাকাশে হয়ে আছে, চুলগুলো উস্কখুস্ক। নীলা বলল, ‘কী হলো ভাই, তুমি খাচ্ছ না কেন?’

ফাইজা বেগম বললেন,’তুই হচ্ছিস আমার বড়ো খোকার বন্ধু। তার মানে তুইও আমার আরেকটা খোকা। মায়ের হাতে খেতে কি কোনো আপত্তি আছে আমার খোকাটার?’

ফাইজা বেগম প্রশ্ন করলেন বটে তবে কোনো উত্তরের অপেক্ষা করলেন না। অতলের খাবারের প্লেটটা নিজের কাছে নিয়ে নিজ হাতে খাইয়ে দিলেন আতলকে। অতল অবাক চোখে তাকিয়ে থাকল রাদিদের মায়ের দিকে। কে জানে, হয়তো রাদিদের মায়ের মাঝে তার নিজের মাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে!

খাবার শেষ হতেই ফাইজা বেগম আদেশ দেবার ভঙ্গিতে অতলকে বললেন, ‘এবার সোজা ভাত ঘুম দিবি। রাতে যে ঘুমাসনি সেটা আমাকে বলার কোনো প্রয়োজন নেই। আমি তোকে দেখেই বুঝতে পেরেছি।’

অতলের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে পিউর দিকে তাকিয়ে বললেন,’পিউমণি, নতুন মামাকে বিরক্ত করবে না কেমন?’

পিউ নানুর কথায় উপর-নিচে মাথা দুলাল। তারপর মায়ের সাথে ঘুমাতে গেল।

রাদিদ দোকানে যাবার আগে অতলকে বলল, ‘তুই আমার রুমে শুয়ে বিশ্রাম নে। কিছু লাগলে মা অথবা আপাকে বলিস।’

মাকে উদ্দেশ্য করে রাদিদ বলল, ‘আমি আসছি, মা।’

ফাইজা বেগম রাদিদের কপালে চুমো খেয়ে বললেন, ‘আমার লক্ষ্মী বাবা, দেখে শুনে যাস। রাতে বেশি দেরি করিস না।’

ফাইজা বেগম অতল ঘুমিয়েছে কি না তা দেখার জন্য রাদিদের ঘরে উঁকি দিতেই দেখতে পেলেন অতল বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসে আছে। ছেলেটাকে দেখে তার কেবলই রাদিদের কথা মনে হচ্ছে! রাদিদের কষ্টের দিনগুলোতে সে কেবলই দিয়ে গেছে বিনিময়ে কিছুই পায়নি। তিনি এসে বিছানায় বসে অতলকে বললেন, ‘কী রে এখনও ঘুমাসনি কেন? আচ্ছা, আমিই ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছি। তুই আমার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়।’

অতল দ্বিরুক্তি না করেই শুয়ে পড়ল। ফাইজা বেগমের অতলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন আর মনে মনে ভাবছেন আহা রে আমার বড়ো খোকা! বাবাকে হারিয়ে যখন সবাই বিধ্বস্ত তখন সেই সকলের ঢাল হয়ে দাঁড়াল। অথচ রাদিদের ঢাল হিসেবে কেউ ছিল না। যে বিনাশর্তে, বিনা পারিশ্রমিকে সবার খেয়াল রাখে, তার খেয়াল রাখার জন্য ও কারো প্রয়োজন হয়। এটা আমরা প্রায় ভুলে যাই।

পিউর কোনোভাবেই ঘুম আসছিল না। পাশ ফিরে মায়ের দিকে একবার তাকাল। নীলা ঘুমিয়ে পড়েছে।
তাই সে বিড়ালের মতো করে পা টিপে টিপে উঠে রুম থেকে বেরিয়ে পড়ল। সে সচরাচর নতুন কোনো মানুষকে দেখলে প্রথমে দূর থেকেই পর্যবেক্ষণ করে। তারপর একটু একটু করে কাছে যায়। অতল যখন রাদিদের বিছানায় শুয়ে চোখ বুজে বিশ্রাম করছিল। ঠিক তখন পিউ পা টিপে টিপে ঢুকল তার বড়ো মামার রুমে। ঢুকেই অতলের মুখের দিকে ঝুকে তাকিয়ে থাকল। অতল ঝট করে চোখ খুলে ফেলল। পিউ দৌড়ে পালাতে চাইলেও পারল না। অতল ধরে ফেলল । বলল, ‘কী করা হচ্ছিল, লিটল চ্যাম্প?’

পিউ মিনমিনে স্বরে বলল, ‘এই নামে তো বড়ো মামা ডাকে। তুমি কি করে জানলে?’

‘আমি তো আরও অনেক কিছুই জানি।’

পিউ তখন বলল, ‘তাহলে তুমি কি এটাও জানো যে, বড়ো মামা তার লেখার খাতায় একটা পরীকে লুকিয়ে রাখে কেন? পরীটা ছবির মধ্যেই থাকে কেন? সত্যি সত্যি আসে না কেন?’ প্রশ্ন শেষেই পিউ উৎফুল্ল কণ্ঠে বলল, ‘জানো, পরীটা ভীষণ সুন্দর।’

অতল বুঝতে পারল না পিউর কথা। সে বলল, ‘কোন পরীর কথা বলছ, পিউমণি?’

‘দাঁড়াও দেখাচ্ছি।’ বলেই পিউ ড্রয়ার খুলে একটা খাতা বের করে সেটা অতলের দিকে এগিয়ে দিল। পিউ খুব সন্তর্পণে খাতার ভেতর থেকে ছবিটা বের করল। ছবিটা দেখার পরেই অতলের দুনিয়া উল্টেপাল্টে গেল। তারপর সে পিউকে এটা সেটা বুঝিয়ে আবারও ঘুমোতে পাঠিয়ে দিল।

অতল খাতাটা উল্টেপাল্টে দেখল। এক বসাতেই রাদিদের লেখাগুলোর কয়েক পাতা পড়ে দেখল। কয়েক পাতা পড়ার পরে অতলের কাছে অনেককিছু পরিষ্কার হয়ে গেল। রাদিদ কেন অন্য কোনো মেয়ের দিকে ফিরেও তাকায় না তা এখন তার কাছে স্পষ্ট। পড়া শেষ করতেই তার রাদিদের উপর ভীষণ রাগ হলো। পৃথিবীতে কি এই একজনই ছিল!

রাদিদের খাতার ভেতরে লুকানো ছবিটা আবারও চোখের সামনে ধরে রাখল। তার বুকটা উঠানামা করছে অস্বাভাবিক গতিতে। শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি বড্ড অস্বাভাবিক হয়ে গেছে। তার চিন্তাশক্তি যেন ক্রমশ লোপ পাচ্ছে!

একটু স্বাভাবিক হতেই সে রাদিদের খাতাটা নিজের ব্যাগে ঢুকিয়ে তখনই রওনা দিল। কাউকে কিচ্ছু না জানিয়েই!

____________________

#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফাতিমা_আক্তার_অদ্রি
পর্ব-৬৯

সাবিহা সাবরিন অতলের ব্যাপারে সবকিছুই জানালেন সাব্বির আহমেদকে। সবটা জানার পর তিনি নিজেও ভরসা পাচ্ছেন না। পিতা-মাতাকে আবেগী হলে চলে না। তাদের দেখে-শুনে, যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। যেকোনো আবেগ বা সন্তানের চাওয়া পূরণ করার পূর্বে সন্তানের মঙ্গলের কথাই ভাবতে হয় তাদের। এতে সন্তান সাময়িকভাবে তাদের উপর রাগ করলেও তাদের সন্তানের জন্য যেটা ভালো সেটাই গ্রহণ করতে হয়।

কিন্তু বিয়ের ইনভাইটেশন করা হয়ে গেছে। সবকিছুই মোটামুটি কনফার্ম। এই মুহুর্তে বিয়ে ক্যানসেল করতে হবে! সমাজের মানুষ কানাঘুষো করবে, তাদের অনেক বদনামও হবে। এমনিতেই কম কানাঘুষো হয়নি ছেলের বিয়ে নিয়ে। লোক এখনও কথা শোনাতে পিছপা হয় না।

বহ্নিকে সবকিছু বলার পরেও সে অতলের কাছ থেকে দূরে সরতে চাইল না। তার কথা হলো, অতল ওর বাবার মতো হবে না। কখনোই হবে না। সেই বিশ্বাস তার আছে।

সাব্বির আহমেদ মেয়ের মাথায় হাত রেখে বললেন, ‘মামুণি, তুমি আবেগ দিয়ে ভাবছ। আবেগ দিয়ে জীবন চলে না। ভালোবাসার মানুষকে পাওয়া জীবনের সবকিছু না হলেও অনেককিছু, তবুও জীবনের নিরাপত্তাটাই সবার আগে। সবকিছুর আগে নিজের ভালো থাকা। ভালোবাসা ধুলোমলিন হয়ে গেলে সেখানে বেঁচে থাকা দুঃসহ।’

বহ্নি তবুও তার সিদ্ধান্ত থেকে নড়ল না। অবশেষে বাবা-মা দুজনকেই বহ্নির কাছে হার মানতে হলো। তবে সাবিহা সাবরিন মানতে পারলেন না। মেয়ের হঠকারিতায় তিনি অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হলেন। মনে মনে চিন্তা করতে থাকলেন কী করা যায়! অপরদিকে সাব্বির আহমেদ খুব অসহায় বোধ করতে লাগলেন। এরকম তো হবার কথা ছিল না। কেন হচ্ছে এমন! জীবন ক্রমশ জটিল হয়ে যাচ্ছে।
_________

ফাইজা বেগম যখন দেখলেন অতল চলে গেছে তখন তিনি, নীলা আর পিউ মিলে সবখানে খুঁজলেন অতলকে। কিন্তু কোথাও খুঁজে পেলেন না। ছেলেটার জন্য তার মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেছে। তিনি সাথে সাথেই রাদিদকে কল করে জানালেন। রাদিদ নিজেও খুব চিন্তিত হয়ে পড়ল। রাদিদের সাথে কথা শেষ করে বড়ো আক্ষেপের সুরে বললেন, ‘আহা! ছেলেটার মনে বড্ড কষ্ট।’ পরক্ষণেই প্রার্থনা করার মতো করে বললেন, ‘আল্লাহ তুমি ওর মনের সমস্ত কষ্ট দূর করে দাও।’

পিউ বলল, ‘নানু, মামা কি আমার সাথে রাগ করে চলে গেছেন?

ফাইজা বেগম পিউকে কোলে নিয়ে আদর করে বললেন, ‘না, নানুভাই।’

নীলা তার মাকে বলল, ‘মা, ছেলেটাকে খুব বিষণ্ন মনে হলো। কী এমন হয়েছে ওর যে হুট করে এখানে আসলো আবার হুট করেই চলে গেল!’
_________________________

সাবিহা সাবরিন যখন দেখলেন সবকিছু প্রতিকূলে যাচ্ছে। তখন তিনি অতলের সাথে দেখা করার সিদ্ধান্ত নিলেন।

সাবিহা সাবরিনকে দেখেই অতলের ভেতরটা কেমন জ্বলে উঠল। তার ভেতরের সমস্ত হতাশা, সমস্ত কষ্ট, সমস্ত রাগ জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি থেকে নির্গত লাভার ন্যায় বেরিয়ে আসতে চাইছে। সে ব্যাঙ্গাত্মক স্বরে বলল, ‘বাহ্! আপনি আমার কাছে এলেন যে!’

সামনে উদ্ধত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটার ব্যঙ্গাত্মক স্বর বুঝতে সাবিহা সাবরিনের একটুও কষ্ট হলো না। তিনি তেজী গলায় বললেন,
‘আসতে হলো। বাধ্য না হলে কখনোই আসতাম না। আমার মেয়েটা তো তোমার মতো অকর্মণ্যের দোষ-ত্রুটি কিছুই দেখছে না। আমার স্বামীও মেয়ের ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে আছেন। তাই সবকিছু আমাকেই ভাবতে হচ্ছে।’

‘তবে কি এই অকর্মণ্যকে করিতকর্মা বানানোর তাগিদে আপনার আগমন?’ বলেই অতল তাচ্ছিল্যের সুরে হাসল।

‘সে সাধ্য আমার নেই। আমি তা করতেও চাই না। আমার জন্য কেবল এবং কেবলই আমার মেয়ের ভবিষ্যৎ গুরুত্বপূর্ণ ।’

‘এই অধম কি আপনার কোনো কাজে আসতে পারে? মানে আপনি ঠিক কোন কাজে নিয়োগ করতে চাইছেন আমায়?’

‘তোমার দ্বারা কি কোনো কাজ সত্যিই ঠিকমতো হয়, অতল? একটু ভেবে দেখো তো। আমি জানি তোমার রেজাল্ট আউট হবে কিছুদিনের মধ্যে এবং এটাও জানি যে, সেখানেও তুমি বরাবরের মতোই অকৃতকার্য হবে। আমার মেয়ের ভরণপোষণের জন্য তোমাকে তোমার বাবার দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে। তাছাড়া, তুমিও যে তোমার আসল বাবার মতো আমার মেয়েকে কষ্ট দিবে না তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তুমি কি চাও তোমার মায়ের মতো করে আমার মেয়েটাও কষ্ট পাক? এটাই তোমার ভালোবাসা? যদি তুমি সত্যিই বহ্নিকে ভালোবেসে থাকো তবে ওর জীবন থেকে সরে যাও। তার জন্য তোমার যা দরকার হয় করো কিন্তু ওকে নিজের এই অনিশ্চিত জীবনের সাথে জড়িও না। আমি তোমার কাছে আমার মেয়ের ভবিষ্যৎ ভিক্ষা চাইছি। তুমি এই মাকে নিরাশ করো না, অতল।’

কথাগুলো বলেই সাবিহা সাবরিন চলে যেতে উদ্যত হলো। অতল বলল, ‘যদি আমার বিসিএস হয়ে যায় তাহলে?’

সাবিহা সাবরিন বললেন, ‘তাহলে আমার কোনো আপত্তি থাকবে না। তবে আমি তোমাকে গ্যারান্টি দিয়ে বলছি তুমি সেখানে অকৃতকার্য হবে।’

অতল দৃঢ়ভাবে বলল, ‘সেটা সময়ের হাতেই ছেড়ে দিন না। আমার ভাগ্যকে আপনি নিজের হাতে কেন নিতে চাইছেন?’

‘ঠিক আছে। সময়ের হাতেই ছেড়ে দিলাম।’

সাবিহা সাবরিন চলে যেতেই অতল যেন স্বগোতোক্তি করল,’বিষয়টা খুব অদ্ভুত না আমার ভালোবাসা সত্য না-কি মিথ্যে তা একটা সরকারী চাকরির হওয়া বা না হওয়ার উপরে নির্ভর করছে! শুধু কি তাই, আমার চারিত্রিক সার্টিফিকেটও দেবে এই চাকরী! বাহ্, দারুণ! সত্যিই দারুণ!’

____________________

বেশ কয়েক সপ্তাহ পরের কথা, এতদিনে অতল সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়েছে। সারাটাদিন হন্যে হয়ে এখানে ওখানে ঘুরে বেড়িয়েছে। কিন্তু কোথাও শান্তি মেলেনি। শুধুই খুঁজে ফিরেছে একটু শান্তি, কিন্তু প্রকৃতির নিয়ম হয়তো এই যে, যে যাহা চাহে সে তাহা পায় না, যে যাহা চায় না সে তাহা বড়ো বাধাহীনভাবে পেয়ে যায়।

একটা পার্কে বসে নীরবে নিভৃতে বসে ছিল সে। আজও বাসায় ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হয়ে গেল। রাদিদের বাসা থেকে আসার পরদিন মেহেরুন নাহারের কাছে মায়ের একটা ছবি চেয়েছিল। মেহেরুন নাহার অনেক খোঁজাখুঁজির পরে একটা ছবি বের করে দিলেন। পুরনো দিনের ছবি, এইচ.এস.সির ফর্ম ফিলাপের আগে শান্তা তুলেছিল ছবিটা। ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। তবুও তার মায়ের চোখ দুটো যেন তাকে তার উপর হওয়া অত্যাচারের কথা বলছে। এই কয়েক সপ্তাহ ধরে এই ছবিটার দিকে তাকিয়েই সে দিন রাত পার করেছে। অতলের কানে কেবল আর্তনাদের সুর বাজছে। আজও অতল নিজের রুমে এসে দরজা বন্ধ করে দিয়ে মায়ের ছবিটা দেখছে। ছবিটা ডান হাত দিয়ে চোখের সামনে ধরে রেখেছে। ছবিটাতে হাস্যোজ্জ্বল মানুষটাকে দেখতে পাচ্ছে অতল। অথচ এই হাস্যোজ্জ্বল মানুষটা কী নিদারুণ কষ্টটাই না পেয়েছে!

রাত দশটার দিকে আয়মান ফোন করল। অতল কারো কলই রিসিভ করছে না। কারো সাথে কথা বলার মতো অবস্থা তার নেই। অতলকে ফোনে না পেয়ে আয়মান তাকে মেসেজ করল। মেসেজের টুংটাং আওয়াজ শুনে অতল মেসেজটা চ্যাক করে দেখল আজকে তার রেজাল্টের দিন। একে তো ভয়াবহ অবস্থা তার উপর রেজাল্ট! সাবিহা সাবরিনের দেওয়া শর্তের কথা তার মনে পড়ে গেল।
এই রেজাল্টের হওয়া না হওয়ার উপরে অনেককিছু নির্ভর করছে। অতল কম্পিত হাতে ওয়েবসাইটে ঢুকল। দুরু দুরু বুকে অপেক্ষা করছে সে। লিস্টে তার নামটা থাকবে তো! কিন্তু সার্ভার লোড হতে দেরি হচ্ছে। নেটওয়ার্কের জ্যামের কারণেই এটা হচ্ছে। অতল অপেক্ষা করতে লাগল। জীবনের সবচাইতে কঠিন অপক্ষা। অবশেষে সার্ভার ফ্রি হতেই লিস্টটা দৃষ্টিগোচর হলো। অতল শেষ থেকে চ্যাক করা শুরু করল, একটা সময় লিস্টের প্রথম দিকটাও চ্যাক করা হয়ে গেল। না, কোথাও তার রোল নেই। সে এবারও ব্যর্থ। বহ্নির মা হয়তো ঠিক বলেছেন সে আসল জীবনেও একজন ব্যর্থ মানুষ।

সাথে করে নিয়ে আসা রাদিদের খাতাটা সামনে পড়ে আছে। একবার ল্যাপটপের স্ক্রিনে চোখ রাখছে তো একবার রাদিদের খাতার উপরে। এভাবে কাটল বেশ কিছুক্ষণ সময়। তার মস্তিষ্ক জুড়ে বহ্নির মায়ের বলা কথাগুলো ক্রমাগত ঘুরছে। তিনি বলেছিলেন, ‘সে তার বাবার মতোই হবে। রক্ত তার রক্তের রং দেখাবেই। তিনি হাত জোর করে নিজের মেয়েকে তার কাছ থেকে ভিক্ষা চেয়েছেন।’

অতল তবুও রাজী হতে পারছিল না। যাকে সে ভালোবাসে তাকে কী করে হারাতে রাজী হবে! একটা সময় তার মনে হলো তারও তার মায়ের কাছে চলে যাওয়া উচিত। তার সত্যিই আর বাঁচতে ইচ্ছে করছে না। কেন বাঁচবে সে? কার জন্য বাঁচবে?

বহ্নির মায়ের বলা কথাগুলো তাকে দুর্বল করে দিচ্ছে । তার মধ্যে ভয় জেকে বসেছে- যদি সে তার বাবার মতো হয়ে যায়! তবে? তবে তো সে বহ্নিকেও আঘাত করতে পিছপা হবে না। না, সে কোনোভাবেই তার এঞ্জেলকে সে কোনোভাবেই হার্ট করতে পারে না। সে তার এঞ্জেলকে একটা অনিশ্চিত জীবনের দিকে টানতে পারে না। তাই সে অবশেষে কঠিন সিদ্ধান্ত নিল। এতোদিন বহ্নির সাথে তার মানসিক দূরত্ব কেবল বেড়েছে বৈ কমেনি। অতল প্রহর গুনছিল অতি আকাঙ্ক্ষিত রেজাল্টের। কিন্তু ভাগ্য তার সহায় হলো না। তাই সে মুক্তি দিবে–তার ভালোবাসাকে!
________________

বহ্নিকে বিষণ্ন মুখে দেখেই অতল বলল, ‘আমাকে মাফ করে দিস আগুনমণি। আমার পক্ষে তোকে বিয়ে করা সম্ভব নয়।’

বহ্নি বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে থাকল অতলের দিকে। নিস্তব্ধতায় ছেয়ে গেছে চারিদিক। অতল পাশেই মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা কৃষ্ণচূড়া গাছের দিকে তাকিয়ে আছে। বহ্নি বলল, ‘এসব কী বলছ তুমি?’

‘আমি ঠিকই বলছি। আমি তোকে বিয়ে রতে পারব না।’

‘কেন পারবে না?’

‘আমি তোর যোগ্য নয়।’

‘কে বলেছে? আমি কখনও বলেছি? অতীতে কী ছিল তা আমার জন্য কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। আমার জন্য শুধু তুমিই গুরুত্বপূর্ণ।’

‘আমার জন্য তুই গুরুত্বপূর্ণ না । তাই আন্টি যা বলছে তাই কর। আমি তোকে বিয়ে করতে পারব না।’

‘আমি তোমাকে ভালোবাসি। আর আমি এই বিয়েটা ভাঙব না। আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করব।’

‘আমি আর কতোবার বলব যে তোকে বিয়ে করতে পারব না।’ অতল রেগে গিয়ে বলল।

‘কেন? উপযুক্ত কারণ তো বলো আমাকে।’

‘কারণ খুব সহজ। আমি তোকে ভালোবাসি না। যাকে ভালোবাসি না তাকে নিশ্চয়ই আমি বিয়ে করব না।’

‘এতোদিন ওসব কী ছিল?’

‘সব অভিনয় ছিল।’

‘অভিনয়?’ বহ্নি বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন করল।

‘হুম, অভিনয়। আমি শিহরণের কাছ থেকে প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিলাম। আমার প্রতিশোধ নেওয়া হয়ে গেছে। এখন বিয়ে বিয়ে খেলাটা চালিয়ে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়।’

‘না, সব মিথ্যে। তুমি মিথ্যে বলছ।’

‘একদম সত্যি। আমি তোকে নয় তৃণাকে ভালোবাসি। শুধুই তৃণাকে।’

ঠিক তখন তৃণা এসে দাঁড়াল তার পাশে। অতল তার হাত ধরে বলল, ‘এই হলো তৃণা। যাকে আমি ভালোবাসি। আমি তৃণাকেই বিয়ে করব।’

বহ্নি ছলছল চোখে কেবল তাকিয়ে ছিল অতল আর তৃণার দিকে। সে কিছুই ভাবতে পারছে না। কিছুই বলেনি অতলকে। একটা অবাধ্য, তেজী জেদ তার মনের মধ্যে জেকে বসেছে। এখন সে জানে তাকে কী করতে হবে। এই জেদ তাকে অবাধ্য, অভাবনীয় কিছু করতে উস্কানি দেয়। বহ্নি নিশ্চিত এবার সে কোনো একটা অভাবনীয় কাজ করে বসবে। যেটা এক লহমায় সবকিছু তছনছ করে দিবে।
________________

রাদিদ ঢাকায় আসার পরে অতলের সাথে যোগাযোগ করার অনেক চেষ্টা করল। কিন্তু অতল কারো সাথেই কোনো যোগাযোগ করছে না। তার কাছে সবকিছুই বিষাক্ত লাগছে। কারো সিমপ্যাথি তার কাছে হ্যামলকের ন্যায় বিষাক্ত ঠেকছে। রাদিদ শেষ পর্যন্ত আশফাকের সাথে বহ্নিদের বাসায় গেল। বহ্নির সাথে বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করতে চাইছে। কিন্তু কোনোভাবেই প্রসঙ্গ তুলতে পারছে না। অবশেষে এক বুক সাহস সঞ্চার করে প্রশ্ন করেই বসল, ‘আচ্ছা, অতলের কী হয়েছে বল তো?’

বহ্নি প্রসঙ্গ পাল্টে বলল, ‘তার খবর আমার কাছে নেই। আমার খবর জানতে চাইলে বলতে পারি।’

রাদিদ একটু ভড়কে গেল বহ্নির কথার ধরন শুনে। ইতস্তত করতে করতে বলল, ‘আচ্ছা, তুই কেমন আছিস?’

বহ্নি অদ্ভুতভাবে হাসল। বলল, ‘আমি সবসময় ভালো থাকি। তুমি কেমন আছ?’

রাদিদ হেসে জবাব দিল, ‘ভালো।’

বহ্নি প্রশ্ন করল, ‘আচ্ছা, রাদিদ ভাইয়া, তুমি বিয়ে করছ না কেন?’

রাদিদ চমকাল। স্বাভাবিক হয়ে বলল, ‘এখনও সেরকম কাউকে পাইনি তাই।’

‘তোমার পছন্দ কি বিশেষ কেউ। মানে তুমি কি কাউকে পছন্দ করো?’

রাদিদ ঘোরের বশে বলেই ফেলল, ‘হুম।’

‘কাকে?’

‘কী?’

‘তুমি কাকে পছন্দ করো?’

‘সেটা এখন আর গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়। সেসব না জানাই ভালো।’

‘বলেই দেখো না।’

রাদিদ উঠে দাঁড়াল। বারান্দার গ্রিল ধরে বাইরে তাকিয়ে থেকে বলল, ‘তার ভালো থাকা আমার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আমার সাথে তার থাকা নয়।’

‘এতোটা ভালোবাসো!’

‘হুম, সে তো এমনই। তাকে ভালো না বেসে থাকা যায় না।’

‘তুমি অনেক পাল্টে গেছ।’

‘সে তো কবেই।’

‘হুম।’ নীরবতা ভেঙে করে বহ্নি আবারও প্রশ্ন করল, ‘তুমি যাকে ভালোবাসো সে যদি তোমাকে বিয়ে করতে চায় তবে কি তুমি রাজী হবে?’

রাদিদ আশ্চর্যান্বিত হয়ে বেশ কিছুক্ষণ বহ্নির দিকে তাকিয়ে থাকল। বহ্নি পুনরায় প্রশ্ন করল, ‘কী হলো বলো?’

‘সে কখনোই রাজী হবে না।’

‘এতোটা নিশ্চিত কীভাবে হচ্ছ?’

‘সে অন্য কাউকে ভালোবাসে।’

‘তবুও সে যদি তোমার কাছে আসতে চায়। তবে?’

‘সেটা কখনোই হবে না।’

‘যদি হয় তবে তুমি কী করবে?’

‘আমার না করা উচিত, তবে আমি হয়তো না করতে পারব না।’

একটা পাখি চিউ চিউ করে ডাকতে ডাকতে উড়ে গেল তাদের চোখের সামনে থেকে। তারপর একটা গাছের ডালে বসে পড়ল। নাচতে নাচতে এক ডাল থেকে অপর ডালে উড়ে বেড়াচ্ছে অবলীলায়। রাদিদের দৃষ্টি সেদিকে নিবদ্ধ হয়ে রইল।

‘তবে কি আমি তোমার সম্মতি আছে ধরে নেব?’

‘ঠিক বুঝলাম না!’

‘তুমি কি আমাকে বিয়ে করতে রাজী আছ?’

‘কী!’ রাদিদ বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে থেকে প্রশ্ন করল, ‘এসব কী বলছিস?’

‘ঠিকই বলছি। তুমি আমাকে বিয়ে করবে কি না বলো?’

‘আবেগের বশে এরকম ভুল সিদ্ধান্ত নিস না।’

‘আমি অনেকে ভেবেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তুমি রাজী থাকলেই হলো।’

‘অতলের কী হবে?’

‘অতলকে নিয়ে তোমার ভাবতে হবে না। তাকে নিয়ে কিছুই ভাবতে চাই না।’

‘এটা তুই ভুল করছিস, বহ্নি।’

‘জীবনে অনেক ভুল করে ফেলেছি। আরও একটা ভুল করে ফেললে খুব বেশি ক্ষতি হবে বলে মনে হয় না।’

‘যদি অতল তোর কাছে আবার ফিরে আসে তখন?’

‘সে ফিরবে না। আমিও তার কাছে ফিরে যাব না। এই বিষয়ে তুমি কোনো সন্দেহ পোষণ করো না।’

‘তুই কি কখনও আমাকে ভালোবাসতে পারবি?’

‘জানি না। তবে চেষ্টা করব। শুনেছি একসাথে থাকলে একটা অভ্যস্ততা তৈরী হয়ে যায়। সেখান থেকেই এক সময় ভালোবাসার সৃষ্টি হয়। হয়তো আমাদের মধ্যে ও একসময় ভালোবাসা তৈরী হয়ে যাবে।’ একটু থেমে বহ্নি হাসতে হাসতে বলল, ‘ডেভিড হার্বার্ট লরেন্স কী বলেছিলেন জানো?
In every living thing there is the desire for love. মানুষ ততক্ষণ পর্যন্ত ভালোবাসা চায় যতক্ষণ পর্যন্ত তার দেহে প্রাণ থাকবে। আমরা কেউই এই নিয়মের ব্যতিক্রম নই। তাই না?’

রাদিদ চুপ করে দাঁড়িয়ে দেখছিল। বহ্নির কথা সে ফেলতে পারে না। তবে সে অতলের সাথে একবার দেখা করবে। যাতে অতল বহ্নিকে ফিরিয়ে না দেয়। যাতে অতল ওর ভালোবাসাকে গ্রহণ করে। ও নিজেকে নিয়ে ভাবে না। ভালোবাসা মানে পেতেই হবে এমন নীতিতে সে বিশ্বাসী নয়। এতোটা বছর বহ্নির একটা ঝলকও সে দেখেনি তবুও ওর মনে বহ্নি দাপিয়ে বেড়িয়েছে। আর এখনও যদি সে না থাকে তাতে তার ভালোবাসা কমবে না। হয়তো অন্য কাউকে নিয়ে জীবন শুরু করবে, কিন্তু বহ্নির প্রতি তার ভালোবাসা অক্ষত, অম্লান থেকে যাবে। কিছু কিছু ভালোবাসা চির অম্লান, ভাস্বর থেকে যায়। না-ই-বা পাক পূর্ণতা, না-ই-বা থাকুক স্বর্ণাক্ষরে লেখা তাতে কী-ই-বা এসে যায়! না-ই-বা জানুক এই পৃথিবীর কোনো মানুষ, লোক দেখানো সমস্ত কিছুই তো ভ্রম, মিথ্যে, ছলনা।

‘Everything is fair in love and war.’ রাদিদ এই নীতিতে বিশ্বাসী নয়। ভালোবাসার মানুষের সুখেই তার সুখ। ভালোবাসা মানে পাশে থাকা, কাছে থাকা নয়। অনেকে কাছে থেকেও পাশে থাকতে পারে না। আবার অনেকে দূরে থেকেও পাশে থাকতে পারে।

________________

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে