#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফাতিমা_আক্তার_অদ্রি
পর্ব-১৭
বৃষ্টিস্নাত সন্ধ্যার ক্ষণ। আকাশটা ঘনকালো মেঘে ছেয়ে গেছে। থেকে থেকে বৃষ্টি পড়ছে। বর্ষাঋতু যেন আসবে আসবে করছে। ঝুম বৃষ্টি এখন থেকেই বর্ষার আগমনী বার্তা নিয়ে এসেছে। বৃষ্টির ফোঁটা জানালার কাচে গড়িয়ে পড়ছে। শিহরণ বর্ষার ধারার জলবিন্দু গড়িয়ে পড়া জানালার কাচ ভেদ করে বিমুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে সন্ধ্যার আকাশপানে। দৃষ্টিতে মুগ্ধতা, মনের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়েছে দীর্ঘ আকাঙ্ক্ষা পূরণের তীব্র চাওয়া, প্রত্যাশিত মানুষটির আমূল পরিবর্তনের জোয়ার দেখে। মন কেবল ছুটে যাচ্ছে সেই মায়াবীর হৃদয় হরণকারী হাসির দিকে, তার কথা বলা চোখের দিকে।
শিহরণ ভারি অবাক হলো ছোঁয়ার আজকের আচরণে। তবে এজন্য তার কোনো খারাপ লাগছে না বরং মনের মধ্যে এক দুর্জ্ঞেয় ভাল লাগার অনুভূতি দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। আগের ছোঁয়া আর এখনকার ছোঁয়ার মধ্যে আকাশ পাতাল তফাৎ দেখে তার অন্তকরণ আজ ভীষণ তৃপ্ত, ভীষণ রকমের আত্মতুষ্ট । ছোঁয়ার মধ্যে যে পরিণত ভাব এসেছে তাতে সে অবাক হয় ক্ষণে ক্ষণে যদিও তার অবাক হওয়ার কথা নয়। এই পরিণত ভাব আর পক্বতার জন্য সে অপেক্ষা করেছে, একটা দীর্ঘ সময় ধরে, নিজেকে বানিয়েছে এক প্রতীক্ষা মানব। যার জন্য সে প্রতীক্ষা করছে সেই মানুষটিও যখন তার জন্য অপেক্ষা করছে এই শাশ্বত সত্যটা উন্মুখ হয়ে তার কাছে ধরা দেবার পর, তার পক্ষে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন বই সহজ কিছু ছিল না। তবে সে চেয়েছিল ছোঁয়া পরিণত হোক, কারও উপরেই নির্ভরশীল না হোক এমনকি তার নিজের উপরেও না। তাই এত বছরের অপেক্ষা, একাকীত্ব আর আত্মগ্লানিতে নিমগ্ন থাকার অভিপ্রায়, অভিসন্ধিতে নিমজ্জিত ছিল সে। তার অপেক্ষা বিফলে যাচ্ছে না, এই আশ্বস্ত বাণী প্রশান্তি প্রদানকারী বার্তাবাহকরূপে কাজ করেছে প্রতি দুঃসহ আর যন্ত্রণাদায়ক ক্ষণে। প্রতিটি পদে পদে সে প্রমাণ পেয়েছে, ছোঁয়ার আত্মনির্ভরশীল হয়ে গড়ে উঠার, নিজের মধ্যে পুঞ্জীভূত হয়ে থাকা আকাশসম আবেগে গা না ভাসিয়ে লক্ষ্য পূরণের দৃঢ় অঙ্গীকারের । আজ তার ভীষণ ভালো লাগছে। এক অন্যরকম আত্মতৃপ্তিতে ছেয়ে গেছে তার মন আর মস্তিষ্ক। ছোঁয়ার জীবনের প্রতিটি অর্জন, প্রতিটি পদের ইউ টার্ন এ শিহরণ ছিল অগোচরে। সামনে না এসেই সে তাকে সাহস জুগিয়েছে এক ভিন্ন উপায়ে, ভিন্ন পদ্ধতিতে, ভিন্নতর মাত্রায়।
ছোঁয়ার কথা ভাবতে ভাবতেই শিহরণের ঠোঁটের কোণে এক মৃদু হাসির রেখা ফুটে উঠল। তার মনে পড়ে গেল আজ সকালে ছোঁয়ার বলা শেষ কথাটা, ‘হাসবেন সবসময়। হাসলে আপনাকে ভাল লাগে। তাছাড়া হাসতে কোনো প্রকার ট্যাক্স গুনতে হয় না কিন্তু!’ কথাটা মনে পড়তেই সে প্রাণখুলে হাসতে লাগল। ঝুম বৃষ্টির শব্দ ছাপিয়ে শোনা যাচ্ছে শিহরণের হাসির শব্দ। আর সেই জোরালো ঝংকার সৃষ্টিকারী হাসির শব্দের আওয়াজ বর্ষার ঝুম বৃষ্টিকে ছাপিয়ে অন্য একজনের কানে কোনো এক বাদ্যযন্ত্রের সুরেলা কণ্ঠের ন্যায় প্রতীয়মাণ হলো। মুহূর্তেই সেই সুরেলা কণ্ঠ তার জাদুকরী ক্ষমতায় তার নিজের অধরদ্বয়ে সংক্রমিত হয়ে পড়ল। সাথে সাথেই এক সুপ্ত আকাঙ্ক্ষা জাগ্রত হলো অবাধ্য, অনিয়ন্ত্রিত মনের কোণে। ছোঁয়া মন্ত্রমুগ্ধের মতো হেঁটে এগিয়ে এলো শিহরণের কেবিনের দিকে। দরজা ভেজানো ছিল। ছোঁয়া দরজার কাছে দাঁড়িয়েই বিমুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে, কোনোরকম শব্দ করা ব্যতিরেকেই, তার চোখে মুখে খেলল মুগ্ধতার রেশ। অবচেতন মনেই নিজের পেছনে কারও উপস্থিতি টের পেয়ে শিহরণ আচমকা হাসি থামাল। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল ছোঁয়াকে। তার অবাক, বিমোহিত, আশ্চর্যান্বিত দৃষ্টি দেখে শিহরণ প্রচণ্ড লজ্জা পেল। এভাবে একা একা হাসতে দেখে কী ভাবছে কে জানে! সমস্ত সঙ্কোচ আর দ্বিধা লুকিয়ে শিহরণ স্বাভাবিক গলায় প্রশ্ন করল, ‘ওখানে দাঁড়িয়ে কেন?’ কিছুটা অবাক হয়ে পুনরায় বলল, ‘একি! আপনি এখনও যাননি কেন?’
ছোঁয়া নিজের মুগ্ধতা লুকিয়ে কাটাকাটা গলায় জবাব দিল, ‘হাসির আওয়াজ পেয়ে দেখতে এলাম কে হাসছে! কিন্তু…!’
ছোঁয়া নিজের কথাটা পূর্ণ করতে পারল না। শিহরণ বলিষ্ঠ পায়ে হেঁটে তার কাছে চলে এলো। ছোঁয়ার থেকে এক হাত পরিমাণ দূরত্বে দাঁড়িয়ে ঘোর ধরা গলায় বলল, ‘কিন্তু কী?’
‘কিন্তু…কিছু না। বাইরে যে বৃষ্টি হচ্ছে এতে কী করে বের হব সেটাই ভাবছিলাম।’ শিহরণের কথাটা এড়িয়ে গেল ছোঁয়া।
শিহরণ ঘাড় ঘুরিয়ে আর একবার দেখল জানালার বাইরে। প্রবল বর্ষণ। এই অবস্থায় ওকে একা ছাড়াটা ঠিক হবে না। কণ্ঠে গাম্ভীর্য এনে বলল, ‘কিছুক্ষণ অপেক্ষা করুন। আমার কিছু কাজ আছে তা শেষ করেই আমি বের হব। আপনাকে ড্রপ করে দিব। নো প্রবলেম।’
‘আমি একাই যেতে পারব। আপনাকে চিন্তা করতে হবে না। বৃষ্টি কমলেই বেরিয়ে পড়ব।’ ছোঁয়া বলল, দায়সারাভাবে।
‘ইটস্ নট অ্যা রিকুয়েস্ট। ইটস্ এন অর্ডার। জাস্ট ওয়েট ফাইভ মিনিটস্। আই উইল ড্রপ ইউ।’ শিহরণ ছোঁয়ার কথা সম্পূর্ণরূপে অগ্রাহ্য করে বলল।
ছোঁয়া নিজের ডেস্কে গিয়ে বসল। তার রাগ হচ্ছে শিহরণের উপর। সবসময় ধমকানোর সুরে কথা বলে কেন? সুযোগ পেলে সেও ছাড়বে না! এটা ভাবতেই তার রাগ উবে গেল। দ্রুত নিজের ফাইলসহ সমস্ত কিছু গুছিয়ে নিয়ে শিহরণের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল।
অফিসের দরজায় নক করার শব্দ শুনে শিহরণ ফাইল থেকে চোখ তুলে তাকাল। ফরিদ দাঁড়িয়ে আছে হাসি হাসি মুখ করে। ফরিদ তাদের বাড়ির ড্রাইভার মোতালেব চাচার ছেলে। মোতালেব চাচার পরে ফরিদই ড্রাইভার হিসেবে কাজ করছে তাদের বাড়িতে। ফরিদকে দেখে শিহরণ বলল, ‘কী ব্যাপার! ফরিদ ভাই! তুমি এখানে?’
ফরিদ মুখে হাসি ঝুলিয়ে রেখেই বলল, ‘স্যার! আজকে বাসায় যাবেন না? বড়ো স্যার বলেছেন, আপনাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য।’
শিহরণ কিছুটা অপ্রতিভ হয়ে বলল, ‘ফরিদ ভাই! তুমি কেন এসেছ আবার?আমি নিজেই তো ড্রাইভ করতে পারি। তাই না?’
ফরিদ আবারও একগাল হেসে বলল, ‘স্যার পাঠাতে চাননি আসলে ম্যামের জোরাজুরিতে স্যার আসতে বলেছেন। বৃষ্টি বেশি হচ্ছে তাই আপনাকে গাড়ি চালাতে নিষেধ করেছে।’
‘আম্মুটাও যে কি না! এই সামান্য বৃষ্টি দেখেই তোমাকে পাঠিয়ে দিল।’
‘আসলে ম্যাম খুব চিন্তা করছেন আপনার জন্য। বাইরের আবহাওয়া তেমন ভাল নয়। তাই দ্রুত বাসায় যেতে বলেছেন। আপনাকে কয়েকবার কল করেছেন কীন্তু আপনি ফোন রিসিভ করছেন না দেখে তিনি আরও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন।’ ফরিদ বলল আড়ষ্ট গলায়।
শিহরণ তার টেবিলের উপর থেকে নিজের সেল ফোনটা হাতে নিয়ে দেখল মায়ের পনেরটা মিসডকল। দেরি না করেই দ্রুত ব্যাক করল সে। ওপাশ থেকে ধমকের সুরে সাবিহা সাবরিন বললেন, ‘এখন কি মায়ের কলটাও রিসিভ করার সময় নেই তোমার?’
শিহরণ অপরাধীর সুরে বলল,’আম্মু আসলে মোবাইল সাইলেন্ট করা ছিল। তাই দেখতে পাইনি। ইদানিং প্রচণ্ড কাজের চাপ আম্মু।’
‘এত কীসের কাজ বলো তো? এই খারাপ আবহাওয়া দেখেও তোমার বাসায় আসতে মন চাইছে না।’
‘আম্মু! এখনই রওনা দেব। কিন্তু ফরিদ ভাইকে কেন পাঠালেন?’
‘দরকার আছে তাই পাঠিয়েছি। তুমি তো আমার কলটাই রিসিভ করছিলে না। এবার ঝটপট বাসায় চলে আসো।’
‘জি, আম্মু! আসছি।’
শিহরণ ফরিদকে ইশারা করতেই সে গাড়ি বের করতে বেরিয়ে পড়ল। শিহরণ ছোঁয়ার ডেস্কের সামনে দাঁড়িয়ে নক করে বলল, ‘মিস ছোঁয়া! কাম ফাস্ট।’ এটুকু বলেই বলিষ্ঠ পাদদেশ ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে।
ছোঁয়া নিজের ব্যাগ হাতে নিয়ে দ্রুত হাঁটা দিল শিহরণের পিছু পিছু। অফিস থেকে বেরিয়ে দেখল, বৃষ্টির বেগ দ্বিগুণ হয়েছে। গাড়িতে ঢুকতে গিয়েই তারা দুজন এক প্রস্থ ভিজে গেল। শিহরণ গমগমে গলায় ফরিদকে বলল, ‘ফরিদ ভাই! আগে মিস ছোঁয়াকে নামিয়ে দিবেন।’
ফরিদ মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। জানালার কাচ তুলে দেওয়া। গাড়ির ভেতরটা গুমোট হয়ে আছে। গ্রীষ্মের শেষে ধরণী বৃষ্টির ছোঁয়া পেয়েছে। তাই এই বৃষ্টি বাইরে যতটা শীতলতা প্রদান করছে বদ্ধ গাড়ির ভেতর ঠিক ততটাই গুমোট পরিবেশ তৈরী করেছে। ছোঁয়ার ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে। সে একদৃষ্টিতে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। শিহরণ আড়চোখে ছোঁয়ার দিকে তাকিয়েই বুঝতে পারল, মেয়েটার অস্বস্তি হচ্ছে। গাড়ির সামনের ওয়াইপার দুটো যেন ক্লান্ত হয়ে পড়ছে বৃষ্টির পানি সরাতে সরাতে। জানালা খুলে দিলেই তো বৃষ্টির ছাঁট এসে পড়বে গাড়ির ভেতর। তাই শিহরণ অপেক্ষা করতে লাগল বৃষ্টি কমার জন্য। বৃষ্টির বেগ কমতেই সে কোনো প্রকার সময়ক্ষেপণ না করেই জানালার কাচ নামিয়ে দিল।
তারপর বেশ কিছুক্ষণের নিস্তব্ধতা। কেউ কোনো কথা বলছে না। শব্দরা যেন ছুটিতে গিয়েছে। ছোঁয়া মুগ্ধ হয়ে একদৃষ্টিতে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। গাড়ির ভেতরটা অন্ধকার। কেউ কারো মুখ দেখছে না।
কেবল বাতাসের শো শো শব্দ কানে বাজছে। আর দুজনের হৃদয়ে তুলছে এক অন্যরকম বাজনার সুর। শিহরণ গাড়ির সিটে হেলান দিয়ে চোখ বুজে আছে। মোবাইলের ভাইব্রেশনের কারণে নিস্তব্ধতার রেশ কাটিয়ে উঠল কিছুটা, শিহরণ নড়েচড়ে বসল। সে খেয়াল করে দেখল, তার মোবাইল ভাইব্রেট হচ্ছে না। সে এবার ছোঁয়ার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখল সে অন্যমনস্ক হয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। বৃষ্টিস্নাত হাওয়া মোহনীয়ভাবে তার ঘনকালো কেশ ছুঁয়ে দিচ্ছে, স্পর্ধিত হয়ে আঁচড় কাটছে তার শরীরে। আবছা অন্ধকারে এই দিব্য দৃশ্য মোহাচ্ছন্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছিল শিহরণ। আচমকা ফরিদের হাঁচির শব্দে শিহরণের ঘোর কাটল। তার ভাবনার সুতো ছিঁড়ে গেল মুহূর্তেই। ছোঁয়ার মোবাইলটা তখনও ভাইব্রেট হচ্ছিল। শিহরণ ভাবল, এমনকি ভাবছে মেয়েটা! মোবাইলে ভাইব্রেশন হচ্ছে অথচ তার কোনো খবর নেই। শিহরণ তার ঝংকার ছড়ানো কণ্ঠে বলে উঠল, ‘কলটা রিসিভ করুন।’
ছোঁয়া মুহূর্তেই তার দিকে ড্যাবড্যাব চোখে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল। শিহরণ ভ্রু উঁচিয়ে পুনরায় বলল, ‘ইওর কল, মিস ছোঁয়া।’
ছোঁয়া তৎক্ষনাৎ মোবাইল হাতে নিয়ে দেখল ফাহমিদা বেগম বেশ কয়েকবার কল করেছে। আবার কল এলো। ছোঁয়া একবার শিহরণের দিকে তাকিয়েই কলটা রিসিভ করল। ওপাশ থেকে চিন্তিত সুরে ফাহমিদা বেগম বলে উঠলেন,’কবে আসার সময় হবে তোর? বাইরের অবস্থা এতো খারাপ। কীভাবে আসবি? সাইফকে কি যেতে বলব?’
ছোঁয়া আশ্বস্ত করে বলল, ‘না, মা। আমি বাড়ির পথেই। বৃষ্টি তো কমে এসেছে। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে যাব।’
_______________________
#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফাতিমা_আক্তার_অদ্রি
পর্ব-১৮
ছোঁয়া বাসায় ফিরল একেবারে কাকভেজা হয়ে। শিহরণের গাড়ি থেকে নামার পরেই আবার ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। তখন ওই ঝুম বৃষ্টি ভিজিয়ে দিলো তাকে। আঙিনার অংশটুকু দৌড়েই পার হলো সে। তবুও শেষ রক্ষে হলো না।
ছোঁয়া চলে যেতেই শিহরণ বিরক্তি নিয়ে বলল, ‘ফরিদ ভাই! তুমি ছাতা নিয়ে আসোনি কেন?’
ফরিদ খানিক ইতস্তত করে বলল, ‘স্যরি স্যার! আসলে ম্যাম বলেছিল কিন্তু তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে ভুলে গিয়েছি।’
বাসায় পৌঁছতেই ফাহমিদা বেগম বললেন, ‘একি! তুই তো ভিজে একসা হয়ে গিয়েছিস। দ্রুত গিয়ে কাপড় পাল্টে নে। নয়তো ঠান্ডা লেগে যাবে। আমি তোর জন্য গরম চা নিয়ে আসছি।’
ছোঁয়া নিজের রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলো। তোয়ালে দিয়ে চুল মুছতে মুছতে আজকের সমস্ত ঘটনা মনে পড়ে যাচ্ছে তার। সাথে ঠোঁটের কোণে দেখা দিচ্ছে মৃদু হাসির রেখা। হৃদয়ের প্রতিটি কোণায় কোণায় এক ঝাঁক প্রজাপতি ভালোবাসার গান গাইতে গাইতে ডানা ঝাপটে উড়ে বেড়াচ্ছে। ছোঁয়া শুনতে পাচ্ছে তাদের গুনগুন শব্দ। কী ভীষণ ভালো লাগার অনুভূতি ছড়িয়ে দিচ্ছে মনেপ্রাণে! কেমন যেন সুখ সুখ অনুভূতি হচ্ছে তার। যার কোনো ব্যাখ্যা নেই, নেই কোনো প্রকাশ। তবুও আছে অনুভূতি আর অনুভবের রীতি।
ফাহমিদা বেগম চায়ের কাপ হাতে করে হেঁটে এসেই ছোঁয়াকে মিটিমিটি হাসতে দেখে একটু অবাক হলেন। আশ্চর্যান্বিত হয়ে বললেন, ‘কী ব্যাপার! আজ আমার মেয়েটার মন কি খুব বেশি ভাল?’
ছোঁয়া হাসি চেপে রাখার এক ব্যর্থ প্রচেষ্টা করল। ফাহমিদা বেগমের দিকে অস্থির চোখে তাকিয়ে শান্ত গলায় বলল, ‘না, মা। তেমন কিছু হয়নি।’
‘ছেলেটা কে?’ ফাহমিদা বেগমের প্রশ্ন।
‘কোন ছেলে?’ ছোঁয়া বুঝেও যেন না বোঝার ভান করল।
‘যার জন্য তোর ঠোঁটের কোণে হাসি।’ ফাহমিদা বেগম উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বললেন।
‘মা! তুমি কিসব বলছ, আমি একদম বুঝতে পারছি না।’ ছোঁয়া তোতলাতে তোতলাতে বলল।
‘তোর কোনো পছন্দ নেই তাহলে?’
ছোঁয়া ভাবল খানিক। পরক্ষণেই মুখটা থমথমে হয়ে গেল। তার ঠিক কি বলা উচিত সে ভেবে পেল না। ফাহমিদা বেগম হয়তো বুঝতে পারলেন, ছোঁয়ার দ্বিধান্বিত অবস্থা। তিনি আর কথা বাড়ালেন না। চায়ের কাপটা ছোঁয়ার হাতে ধরিয়ে দিয়ে চলে যেতে উদ্যত হলেন। দরজার কাছে গিয়ে আবার কী মনে করে ঘুরে দাঁড়িয়ে ভরাসা দেবার সুরে বললেন, ‘যখন ইচ্ছে হবে তখন বলিস।’ পরক্ষণেই আবার চোখে মুখে চিন্তার রেশ ফুটিয়ে বললেন, ‘কিন্তু খুব বেশি দেরি করিস না। সময়ের কাজ সময়ে না করলে তার জন্য বিরাট খেসারত দিতে হয়। আমি চাই না তোর ক্ষেত্রে এমন কিছু হোক। তাই আগে থেকেই সাবধান করলাম।’
ছোঁয়া চায়ের কাপ হাতে নিয়ে ব্যালকনিতে এসে বসল। চুল থেকে তোয়ালেটা খুলে নিয়ে পাশেই রাখল। তার দৃষ্টি এখন অসীমের কোনো কিছু দেখার প্রয়াসে বদ্ধপরিকর। কিন্তু চোখের দেয়াল তখন ঝাপসা থেকে ঝাপসাতর হচ্ছে। বৃষ্টির বড়ো বড়ো বিন্দুগুলোও এখন সেই ঝাপসা পর্দায় পৃথক করা সম্ভব হচ্ছে না তার পক্ষে। মনটা হঠাৎ করেই খারাপ হয়ে গেল তার। কী করবে সে? কীভাবে করবে? কিছুই তার ভাবনার জগতের মধ্যে স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান হচ্ছে না। অবশেষে সিদ্ধান্ত নিলো, আবেগে ভেসে যাবে না সে কোনোভাবেই।
এই ভাবনাটা মনের গহীনে একটা সূক্ষ্ম ব্যথা তৈরী করল। তবুও ভালোলাগার প্রজাপতিগুলোকে এভাবে ডানা মেলে উড়তে দেয়া যাবে না। ছোঁয়া এই কাজটি করবে না বলেই মনে মনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলো। মানসিক দ্বন্দ্বে পড়ে ভাবনায় মশগুল হওয়ার কারণে ছোঁয়ার গরম চা ঠান্ডা হয়ে গেল সেদিকে অবশ্য তার কোনো খেয়াল নেই। নিজেকে ধাতস্থ করেই সে চায়ের কাপের সবুটুকু চা এক চুমুকে শেষ করে ফেলল।
__________________________
‘তোমাকে যা বললাম বুঝেছ?’ অহনা বলল সতর্ক গলায় ।
‘জি, ম্যাডাম। আপনার কাজ হয়ে যাবে। আপনি টেনশন নিবেন না। খালি আমাদের পেমেন্টটা ঠিকমতো করে দিলেই হবে।’
‘আজ বিকেলে অর্ধেক পেমেন্ট করে দেব। টাকা দেবার ঠিকানা মেসেজ করে পাঠিয়ে দেব। বাকিটা কাজ শেষ হওয়ার পর।’ অহনা যথেষ্ঠ সাবধানী গলায় বলল, ফোনের ওপাশে থাকা ব্যক্তিটিকে।
‘ঠিক আছে, ম্যাডাম। আমার হাতে কাজ আসা মনেই হলো আপনার চিন্তার অবসান হওয়া।’ তোষামুদে গলায় বলল, ব্যক্তিটি।
‘এতো তোষামোদ করার দরকার নেই।’ অহনা তার কণ্ঠের মৃদু তিরস্কার ছাপিয়ে সাবধানবাণী দেবার সুরে পুনরায় বলল, ‘আমার কাজ হলেই হলো। তবে মনে রাখবে কোনোভাবেই যাতে আমার নাম না আসে।আর কাজে কোনো ত্রুটি করলে বাকি টাকা পেমেন্ট করা হবে না। কথাটা মনে থাকে যেন।’
‘ম্যাডাম, আমাদের কাজে এখনও পর্যন্ত কোনো গণ্ডগোল হয়নি । ভবিষ্যতেও হবে না। আপনি টাকা রেডি রাখবেন।’ ওপাশের ব্যক্তিটি হুমকি দিয়ে বলল, ‘আর মনে রাখবেন আমাদের সাথে কোনো চালাকি করবেন না। চালাকির ফল কিন্তু ভালো হবে না। বলে রাখলাম।’
‘আপনি বেশি কথা বলেন!’ অহনা চিবিয়ে চিবিয়ে বলল। পরক্ষণেই নিজের গলার স্বর খাদে নামিয়ে বলল, ‘কাজে কোনো প্রকার ত্রুটি যেন না হয়। আই ওয়ান্ট হার টু সাফার ব্যডলি।’
ঠিক তখনই হিয়া চায়ের কাপ হাতে অহনার রুমে ঢুকল। বলল, ‘কাকে সাফার করতে দেখতে চাও?’
অহনা দ্রুত কলটা কেটে দিলো। জোরপূর্বক মুখে হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলে বলল, ‘কেউ না। তামিমের সাথে কথা বলছিলাম শ্রেয়াকে নিয়ে। তামিম এবারও শ্রেয়াকে উইশ করতে ভুলে গেছে। তাই সে সাফার করছে, নিজের করা ভুলের জন্য।’
‘কিন্তু তুমি আমাকে দেখে এভাবে ভয় পেয়ে গেলে কেন?’ হিয়া সন্দিহান দৃষ্টিতে চাইল অহনার দিকে।
পূর্বের জোরপূর্বক হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে অহনা বলল,’আমি ভয় পাব কেন? তোকে ভয় পাওয়ার কি আছে?’
হিয়া চায়ের কাপটা অহনার হাতে দিয়ে সহাস্যে বলল, ‘ওকে। আই ডোন্ট নিড এনি মোর ক্লারিফিকেশন সিস্টার। আম্মু ডাকছিল তোমাকে চা খেতে কিন্তু তুমি তো শুনতেই পাচ্ছিলে না তাই আমাকে পাঠাল।’
হিয়া চলে যেতেই অহনা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। চায়ের কাপটা বেড সাইড টেবিলের উপর রেখে হাতের মোবাইলটা নিয়ে কল লিস্ট থেকে নাম্বারটা ডিলিট করে দিলো। ব্যস! এবার কাজটা হয়ে গেলেই শান্তি। তখন আর এইসব নিত্য প্যারা নিতে হবে না অহনাকে।
আজ শিহরণের সাথে ছোঁয়াকে দেখে অহনার মেজাজটা পুরোই বিগড়ে গেল। প্রচণ্ড ক্রোধে ফেটে পড়ল সে। ছোঁয়াকে তার সহ্য হয় না, এ কথা সত্য, তবুও কষ্ট করে বহুদিন সহ্য করেছে। কিন্তু সবখানেই এই মেয়েটাকে প্রাধান্য পেতে হবে কেন? কেন সবার কাছেই এই মেয়েটাকে মহীয়সী সাজতে হয়? এবার দেখা যাক, কী করে সবার কাছে প্রাধান্য পায় সে! অহনা আর কোনোভাবেই এই মেয়েটাকে সহ্য করতে পারছে না, পারছে না এ ধরনের বাড়াবাড়ি মেনে নিতে। তাই শেষমেশ এক কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে।
_______________
আজ দোকান বন্ধ করতে দেরি হয়ে গেল অনেক। এতোদিন ফুফুর বাসায় থাকার কারণে দোকানের কাজ জমেছিল। অনেক হিসাব-নিকাশ করতে হলো রাদিদকে। দেনাদার-পাওনাদারের হিসাবনিকাশ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে সে। সৎ ও নিষ্ঠাবান ব্যবসায়ী হিসেবে তার সুনাম আছে এলাকায়। তবে এতোদিন এখানে উপস্থিত না থাকায় দোকানের যাচ্ছেতাই অবস্থা। দোকানের ছেলেটা কোনো ডেলিভারি ঠিকঠাক মতো দেয়নি। একে একে সবাই তাকে ফোন করে নালিশ জানিয়েছে। প্রচণ্ড বিরক্ত হলো সে। নিজের ভাইটাই যখন দোকানের কাজ ঠিকমতো করেনি তখন বাইরের ছেলেগুলোকে সে কী দোষ দিতে পারে! তাই সমস্ত রাগ, সমস্ত ক্ষোভ ঢোক গিলে নিজের ভেতরেই ঢুকিয়ে নিলো। সব ডেলিভারি দিতে দিতেই তার এতো দেরি হয়ে গেল। তাছাড়া বৃষ্টির কারণে সবাইকে ডেলিভারি দিতে পারেনি গতকাল। আজও যাচ্ছেতাই অবস্থা। তাদের কাছে ফোন করে বিনয়ের সাথে ক্ষমা চেয়ে নিলো। যাদের কাছ থেকে সময় চেয়েছিল তাদের সকলকে আজকে ডেলিভারি দেওয়া শেষ। আর তাই নিজেকে নির্ভার মনে হলো তার। কেমন হালকা হালকা অনুভব হচ্ছে। সমস্ত হিসাবনিকাশ করা শেষে দোকান বন্ধ করল সে। কিন্তু প্রচণ্ড বৃষ্টি পড়ছে। দোকানের ছেলে দুটো অনেক আগেই বেরিয়ে গেছে। সে-ই অবশ্য যেতে বলেছে। তাদের বাসা একটু দূরে, তাই এই খারাপ আবহাওয়ার রিস্কটা সে নিলো না।
বৃষ্টি মাথায় নিয়েই বের হতে হলো রাদিদকে। ছাতা অবশ্য সাথে আছে। কিন্তু বৃষ্টির তোড়ের কাছে এই ছাতাটা একেবারেই নস্যি। বৃষ্টিতে ভিজে অবস্থা খারাপ। তাও ভাল যে শেষমেশ বাসায় পৌঁছাতে পেরেছে। বাসায় পৌঁছতেই ভেজা পরিচ্ছদ পাল্টে নিলো রাদিদ। তারপর মায়ের রুমে গিয়ে দেখল, তার মা বাচ্চাদের মতো করে নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছেন। মায়ের ঘুমন্ত মুখটা দেখতেই তার মন প্রশান্তিতে ভরে উঠল। মায়ের কাছে গিয়ে বসে থাকল কিছুক্ষণ, নীরবে। বেশ কিছুক্ষণ নিষ্পলক তাকিয়ে থেকে মায়ের কপালে একটা চুমু এঁকে দিলো। তারপর নিঃশব্দে বেরিয়ে পড়ল। ডাইনিং স্পেসে আসতেই দেখল নীলা পিউকে খাবার খাওয়াতে ব্যস্ত। রাদিদকে দেখে নীলা বলল, ‘হাত মুখ ধুয়েছিস, ভাই? খেতে বস। আমি খাবার দিচ্ছি।’
রাদিদ একটা চেয়ার টেনে বসতেই পিউ অনুযোগের সুরে বলল, ‘বড়ো মামা! আজ এত দেরি করেছ কেন?’
রাদিদ প্রশস্ত হেসে উত্তর দিলো, ‘আজ অনেক কাজ ছিল চ্যাম্প। তাই আসতে দেরি হয়ে গেল।’
পিউ বিজ্ঞের মতো করে বলল, ‘বড়ো মামা! ছোট মামাকেও কাজে নিতে পারো তো। দুজন একসাথে কাজ করলে তাড়াতাড়ি কাজ শেষ হয়ে যাবে।’
রাদিদ জবাবে হাসল কেবল। পিউ আবারও বলল, ‘বড়ো মামা! কিছু বলছ না কেন?’ কপালে একটা আঙ্গুল ঠেকিয়ে একটু চিন্তা করে বলে,’হুম, ছোটো মামা কি কাজ করতে চায় না? সারাদিন তো ঘরে এমনিতেই বসে থাকে। তার চাইতে কাজ করলেই ভাল। তাই না বড়ো মামা?’
নীলা ধমকে উঠল, ‘এতো কথা কিসের পিউ? বড়োদের নিয়ে এরকম কথা বলতে নেই। তাড়াতাড়ি পানি খেয়ে উঠে পড়।’
মায়ের ধমক খেয়ে পিউ গাল ফুলিয়ে বসে থাকল। রাদিদ তাই দেখে হেসে ফেলল। ঠোঁটে স্মিত হাসি ঝুলিয়ে রেখে বলল, ‘লিটল চ্যাম্প কাল স্কুলে যেতে হবে তো। তাড়াতাড়ি ঘুমোতে যাও।’
রাদিদের কথা শুনে পিউ বাধ্য বাচ্চার মতো পানি খেয়ে রুমে চলে গেল ঘুমোতে। রাদিদকে খাবার বেড়ে দিয়ে নীরা তার পাশেই একটা চেয়ারে বসে পড়ল। তার চোখে মুখে উৎকণ্ঠা, কোনো একটা প্রতীক্ষিত সংবাদ শোনার আকাঙ্ক্ষা স্পষ্ট দৃশ্যমান। রাদিদ হাত দিয়ে ভাত মাখতে মাখতেই বলল, ‘আম্মু খেয়েছে?’
নীলা মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল। তারপর চেহারায় উদ্বিগ্ন ভাব এনে বলল, ‘কোনো খবর পেয়েছিস?’
রাদিদ ব্যাথাতুর চোখে তাকাল বোনের দিকে। সাথে সাথেই মাথা নিচু করে ফেলল। এই এক ‘না’ সে আর কতোবার বলবে তা সে নিজেও বুঝতে পারছে না! খাবার মুখে পুরলেও বোনের এই প্রশ্ন শুনে খাবার আর গলা দিয়ে নামছে না। তার মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল মুহূর্তেই।
নীলা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘তুই কেন মন খারাপ করছিস? এতে তো তোর কোনো দোষ নেই, ভাই।’ চাপা আর্তনাদ করে সে বলল, ‘আমার ভাগ্যটাই খারাপ। বাবা থাকতেও আমার মেয়েটাকে বাবা ছাড়াই বড়ো হতে হচ্ছে। এমন কোনোদিন যায় না যখন পিউ তার বাবার কথা জানতে চায় না।’ নীলা কাঁদতে কাঁদতে নিজের রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো।
রাদিদের চোখের কোণেও কোথা থেকে যেন অশ্রুবিন্দু জমা হলো, তার নিজের অজান্তেই। খাবার তার গলা দিয়ে আর নামল না। বেসিনে হাত ধুয়ে সে নিজের রুমে গিয়ে লাইট অফ করে শুয়ে পড়ল। বাবা মারা যাওয়ার পর হঠাৎ করে আসা কোনো ঝড়ের মতো করেই সবকিছু তছনছ করে দিয়ে গেল। ঘর বাঁধার আগেই বোনের ঘরটা ভেঙে গেল। তার বোনের সাথে কেন এমন হলো! ঢাকায় যাওয়ার পেছনে তার অন্য একটি কারণ হলো তার বোনের স্বামীকে খুঁজে বের করা। রাদিদ বারবার বলেছে যে পিউ’র বাবা তাদের ইচ্ছাকৃতভাবে ছেড়ে চলে গেছে। কিন্তু নীলা তা কোনোভাবেই মানতে রাজি নয়। তার এক কথা নিশ্চয়ই পিউ’র বাবা কোনো বিপদে পড়েছে, তাই তাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারছে না। আজ পাঁচটা বছর যাবৎ সে খুঁজে বেড়াচ্ছে তার বোনের স্বামীকে। কিন্তু প্রতিবারই তাকে হতাশ হয়ে ফিরতে হয়েছে।
চোখ দুটো প্রায় লেগে এসেছিল রাদিদের। কিন্তু ফোনের তারস্বরে বেজে ওঠাতে সেটাও চটে গেল। প্রথমবার অলসভাবেই শুয়েছিল সে, ইচ্ছে করল না কে কল করেছে তা দেখার। কিন্তু কলকারী বড্ড হঠকারিতার পরিচয় দিলো। পুনরায় কল করে বসল। রাদিদ এবার মাথার উপর বালিশ চাপা দিলো। কোনোভাবেই শোয়া থেকে উঠে ওয়্যারড্রবের উপর থেকে মোবাইলটা নিতে ইচ্ছে করছে না তার। বড্ড ক্লান্ত সে, সবকিছুর জন্য, মানসিক আর শারীরিক উভয় দিক থেকেই। কিন্তু মোবাইলটা বেজেই চলেছে। শেষমেশ মাথার উপর থেকে বালিশটা সরিয়ে নিয়ে বিছানা থেকে উঠে পড়ল। মোবাইল হাতে নিয়ে দেখতে পেল নীরার নামটা স্ক্রিনে ভেসে উঠেছে। তার মেজাজটা মুহূর্তেই খারাপ হয়ে গেল। সে কলটা রিসিভ করেই তিরিক্ষি মেজাজে বলল, ‘এই তোর কোনো কমন সেন্স নাই? এতো রাতে কল করছিস কেন? কাল সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারিস নাই?’
নীরা উল্টে বিরক্ত হলো রাদিদের উপর। সে তার সমস্ত রাগ কণ্ঠে ঢেলে চেঁচিয়ে বলল, ‘তোমাকে কল করার আমার কোনো ইচ্ছে নেই। আমার আম্মাজান আদরের ভাইপোর খবর নিতেই আমাকে বারবার তাগাদা দেবার কারণেই বাধ্য হয়ে কল করেছি।’
রাদিদ নিভল। বলল, ‘ফুফু কল দিতে বলেছে? আগে বলবি না।’ একটু হাসার চেষ্টা করল সে।
নীরা এবার তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠল। তেজী গলায় বলল, ‘বলার সুযোগ দিলে তো বলব!’
‘আচ্ছা, ফুফু কই ? ফুফুকে দে। তোর সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।’
‘ইচ্ছে করবে না তো। প্রয়োজন ফুরালে এই নীরাকে আর কারও গুরুত্ব দিতে ইচ্ছে করে না।’ ব্যথাতুর গলায় বলল, নীরা।
নওশীন হক দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাদের ঝগড়া শুনছিলেন। ফোন হাতে নিয়ে বললেন, ‘রাদিদ! ঘুমিয়ে পড়েছিলি না-কি?’
‘ওই একটু চোখ লেগে এসেছিল। আজ কাজের চাপ একটু বেশি ছিল তাই।’
‘তুই কেমন আছিস? ভাবির শরীর কেমন এখন? নীরার কাছে শুনলাম জ্বর উঠেছিল।’
‘হ্যাঁ, ফুফু। এখন সুস্থ আছে। চিন্তার কোনো কারণ নেই। তুমি টেনশন নিও না। আমি ভালো আছি, আলহামদুলিল্লাহ। তুমি কেমন আছ?’
‘আমিও ভালোই আছি, আলহামদুলিল্লাহ। বাসায় যাওয়ার পর মাকে পেলে তো আর ফুফুর কথা মনে পড়ে না তোর। একদম ভুলে যাস।’
রাদিদ ক্ষীণ প্রতিবাদের সুরে বলল, ‘একদম না ফুফু। এই কয়দিন কাজে ব্যস্ত ছিলাম। তাই কল করার সুযোগ হয়ে উঠেনি।’
‘আচ্ছা, ঠিক আছে। এবার ঘুমিয়ে পড়।’
নীরা মায়ের হাত থেকে ফোনটা নিয়ে নিল। কঠিন গলায় বলল, ‘দেখি কারও আমাকে আর প্রয়োজন হয় কি না!’ খানিক থেমে রহস্যময় কণ্ঠে বলল, ‘আমি তো খুব শিগগিরই আমার প্ল্যান এক্সিকিউট করা শুরু করে দিব। তখন দেখব কেউ আমার কাছে কিছু জানতে চায় কি না। যদি জানতে চায় তবে আমি আগে থেকেই বলে দিচ্ছি তাকে আমি কোনো তথ্যই দেব না। এভাবে ফ্রি কোনো কাজ এই নীরা করে না। মনে থাকে যেন।’ এটুকু বলেই নীরা কলটা কেটে দিলো।
রাদিদ হাসতে থাকল। নীরাটা একদম পাগল। বাচ্চাদের মতোই এখনও বায়না ধরে বসে যখন তখন। তার এই বোনটা তার নিকট ভীষণ প্রিয় কিন্তু সবসময় তা প্রকাশ হয়ে উঠে না। বলা যায়, সে কিঞ্চিতই প্রকাশ করে। অবশ্য বেশি প্রকাশ করলে সে বাঁদরামি শুরু করে দিবে, এটা রাদিদ শতভাগ নিশ্চিত । তখন সামলাবে কী করে! এই যেমন এখনও এমন কিছু কথা বলল যা কখনোই হবার নয়। পাগলি মেয়েটা! বুঝতেই পারছে না সে কী বলছে! রাদিদ হাসছে। এই নীরার সাথে কথা বলা এড়িয়ে যেতে চায় সে ইদানিং, কারণ কথা বললেই তার কথার ওয়ান এন্ড অনলি টপিক বহ্নি। তখন রাদিদের মাথা ধরে যায়, কাজে মন বসতে চায় না, মন তখন রঙিন কোনো এক স্বপ্নময় রাজ্যে তার স্বপ্নের রাজকন্যাকে নিয়ে বিচরণ করতে চায় শহরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত। তাই সে ইদানিং নীরাকে ধমকের উপর রেখেছে। কিন্তু কিছু বলেও কাজ হয় না। নীরাকে বোঝানো তার সাধ্যে নেই। সে একবার যা বুঝে, তাই ঠিক ভাবে।
____________________
#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফতিমা_আক্তার_অদ্রি
পর্ব-১৯
সাব্বির আহমেদ বিশেষ তলব করেছেন পরিবারের সকলকেই। তাদের অরফানেজের বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে। এই ব্যাপারে সকলের মতামত জানাটা আবশ্যক বলে মনে করেন তিনি যদিও তার কথার ব্যতিক্রম কেউ করবে না। আয়োজনটা নিজেদের হাতে সম্পন্ন করতে পারলে বেশ হবে। তাই কীভাবে, কোথায় সমস্তকিছু আয়োজন করলে আশ্রমের সকলের জন্য ভাল হবে সেই বিষয়টাতে সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার। এই বিশেষ কারণেই আজকের এই বিশেষ তলব।
সাব্বির আহমেদ নিজেই চাইছেন এবারের অনুষ্ঠানটা ব্যতিক্রমী ও বেশ বড়ো আকারে আয়োজন করতে। কারণ আশ্রম থেকে এবার বেশ কয়েকজন ছেলে মেয়ে পড়াশোনা শেষে ভাল চাকরি পেয়েছে, যোগদান করেছে নিজেদের কর্মক্ষেত্রে, কয়েকজন আবার এসবিএ এন্টারপ্রাইজেও নিজেদের যোগ্যতাগুণে চাকরি পেয়েছে। তাই আশ্রমের বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠান পালনের পাশাপাশি তাদের সংবর্ধনা দেবার অনুষ্ঠানটাও আয়োজন করা হবে। এটা একটা বিশাল অর্জন। তাই নিউজ কাভারেজ হবে। এটা নিয়ে নিউজ ছাপা হবে বেশ কয়েকটি দৈনিক পত্রিকাতেও। বেশ কয়েকজন সুশীল সমাজের মানুষসহ রাজনৈতিক কর্মকর্তাকেও আমন্ত্রণ জানানো হবে। যার কারণে বিশাল আয়োজনে কোনো প্রকার ত্রুটি থাকা যাবে না। আর সাব্বির আহমেদ চান এই অনুষ্ঠানটা পরিবারের সদস্যরা মিলেই সম্পন্ন করুক। আশ্রমের ছেলে মেয়েগুলো এক একজন এক এক কাজে দক্ষ, এবার তাদের দক্ষতার প্রমাণ দেখানোর সময় এসেছে।
ড্রইং রুমে সবাই চাতক পাখির ন্যায় তাকিয়ে আছে সাব্বির আহমেদের দিকে। সাব্বির আহমেদ কেশে গলা পরিষ্কার করে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, ‘এবারের বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠান আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর পেছনে অবশ্য বেশ কয়েকটি কারণ আছে।’
সবাই তন্ময় হয়ে শুনছিল সাব্বির আহমেদের কথা। কিন্তু রাফি বোকার মতো জিজ্ঞেস করল, ‘কী কারণ চাচ্চু?’
রাফির প্রশ্ন শুনে সবাই সাব্বির আহমেদের উপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে রাফির দিকে তীর্যক দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। শিহরণ ভীষণ আশ্চর্যান্বিত কণ্ঠে বলল, ‘তোমার তো জানার কথা। তাই না?’
রাফি আশ্রমের বিভিন্ন কাজ করে থাকে। আশ্রমের তদারকির কাজটা মাঝেমধ্যেই ওকে দিয়ে সম্পন্ন করানো হয়। কিন্তু কাজের প্রতি তার ভীষণ অনীহা। ভুলে যাওয়াটা তার জন্য অস্বাভাবিক কোনো ব্যাপার নয়। সকলের হতবিহ্বল দৃষ্টির তোপের মুখে পড়ে বোধহয় তার মস্তিষ্ক দ্রুত কাজ করা শুরু করেছে । সে তাৎক্ষণিক কাঁচুমাচু হয়ে বলল, ‘ওহ্! মনে পড়েছে।’ এটুকু বলেই সে হাসার চেষ্টা করল।
সাব্বির আহমেদ ভারিক্কি গলায় শিহরণকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘যেহেতু এই অনুষ্ঠানটা আমাদের জন্য বিশেষ ও গুরুত্বপূর্ণ। তাই এই আয়োজনের সম্পূর্ণ দায়িত্ব তোমাকে দিলাম। ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকবে তুমি। বাকি সব কাজ তুমি অন্যদের উপর অর্পণ করবে।’ শিহরণ কাঁধে ভরসা দেবার ভঙ্গিতে একটা হাত রেখে বললেন,’তোমার উপর আমার পূর্ণ আস্থা আছে। আমি জানি তুমি অপাত্রে দায়িত্ব অর্পণ করবে না।’
নিজের উপর বাবার এমন অগাধ বিশ্বাস শিহরণকে বারংবার বিমোহিত করে। যখনই তার বাবা তাকে এমন আশ্বস্ত করেন তখনই সে বুঝতে পারে তার আত্মবিশ্বাস আর কাজ করার প্রবণতা দ্বিগুণ বেড়ে গেছে। তার বাবার মুখ নিঃসৃত প্রতিটি কথাতেই সে নিজের মধ্যের সত্তাটির দ্বিগুণ স্পিডে কাজ করার উদ্দীপনা খুঁজে পেতে দেখেছে। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। মাঝেমধ্যে সে খুব করে প্রশ্ন করতে চায় তার বাবাকে ‘কেন তিনি শিহরণকে এত ভরসা করেন? কেনই বা তাকে এতটা যোগ্য মনে করেন?’ এই প্রশ্নগুলো তার নিজের মনে উদ্রেক হয় আর নিজের মনের মধ্যেই নিস্তেজ হয়ে হৃদয়ের কোনো এক ক্ষুদ্র কোণে চুপটি মেরে আত্মগোপন করে। প্রশ্ন আর করা হয় না তার। তবুও সে গর্বিত এমন একজন বাবা পেয়ে, যে বাবা তাকে বিশ্বাস করে, ভরসা করে, তাকে নতুন উদ্যমে চলতে সাহায্য করে, ঠিক যেমনি কোনো শিশুকে আঙ্গুল ধরে পথ চলা শেখায় তার পিতা-মাতা এখনও ঠিক তেমনি আছে তার বাবা। সে নিজে জানে তার বাবা তার জন্য কী! ‘প্রত্যেক সন্তানের জন্য তার বাবা সুপারম্যান’ এমন একটা কথা সে শুনেছিল কোথাও। বাস্তবিক অর্থে নিজের জীবন দিয়ে অনুভব করেছে যে, সে এমন একজন সুপারম্যানকে বাবা হিসেবে পেয়েছে। একজন বন্ধু হিসেবেও সে বাবাকে পাশে পেয়েছে। তার এখনও মনে পড়ে যখন অতলের সাথে ছোঁয়াকে শেষবার দেখেছিল আলিঙ্গনরত অবস্থায়। শিহরণের মাথা তখন কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছিল। তার মস্তিষ্ক ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল। কোনো কিছুই সে ভাবতে পারছিল না, শুধুই মনে হচ্ছিল এক বিশ্বাসঘাতককে সে তার বন্ধু ভেবেছিল। যে বিশ্বাঘাতক একই সাথে তার দুজন প্রিয় ও খুব কাছের মানুষের সাথে অভিনয় করে বেড়াচ্ছে। ছোঁয়ার উপরও সেদিন পাহাড়সম অভিমান জমেছিল। ভেতর থেকে একটা সত্তা বারবার ধিক্কার দিচ্ছিল–এমন একজনকে ভালোবাসার জন্য। সেই প্রলয়ঙ্কারী কণ্ঠস্বর শুনে নিজের মধ্যের সমস্ত নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিল। নিজেকে আঘাত করতেও পিছপা হয়নি সে। প্রচণ্ড ভেঙে পড়েছিল। ঠিক সেই মুহূর্তে ঠিক কোনো এক এঞ্জেলের মতো তার বাবা তাকে বুঝিয়ে দিয়েছিল চোখের সামনে যা কিছু দৃশ্যমান হয় সবসময় তা সত্যি হয় না। প্রতিটি মুদ্রার যেমন এপিঠ ওপিঠ, দুটো পিঠ থাকে। ঠিক তেমনি প্রতিটি ঘটনার ক্ষেত্রেও দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতা থাকে। দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতার কারণে একজন নেতিবাচক মানুষ যেমন ইতিবাচক বিষয়কে নেতিবাচকভাবে নিতে পারে, তেমনি একজন ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির মানুষও নেতিবাচক বিষয়ের মধ্য থেকে ইতিবাচক বিষয়টি অনুধাবন করতে পারে।
পরবর্তীতে অবশ্য সে তার বাবার বলা প্রতিটি কথার সত্যতার প্রমাণ পেয়েছে। তাই সে বরাবরই তার বাবাকে নিয়ে গর্বিত। তার নিজের যোগ্যতা কতটুকু সে কখনোই পরিমাপ করতে পারবে না। তবে তার উপর তার বাবার বিশ্বাস, ভরসা, বাবার দেয়া অনুপ্রেরণার বদৌলতে সে অসম্ভব কাজও করে ফেলতে পারবে বলে মনে মনে বিশ্বাস করে। আজ সে যা কিছু সমস্তই তার বাবার জন্য। সন্তানের প্রতি পিতামাতার আস্থা এক অনন্য থেরাপি অর্থাৎ প্যানেসিয়ার ন্যায় কাজ করে। যা সন্তানের জীবনকে এক উচ্চতর পর্যায়ে নিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর করতে সাহায্য করে।
‘কী হয়েছে? পারবে না তুমি?’ সাব্বির আহমেদের সন্দিগ্ধ কণ্ঠে করা প্রশ্নে শিহরণের ভাবনার জাল মুহূর্তেই ছিন্ন হলো।
শিহরণ জবাবে হাসল। একটা গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, ‘আমার আব্বু সাথে থাকলে আমি সবকিছু করতে পারব এতে আমার কোনো সন্দেহ নেই।’
সাব্বির আহমেদ ছেলের কাঁধে বারকয়েক চাপড়ালেন। বললেন, ‘ইম্প্রেসিভ মাই চাইল্ড।’
বহ্নি কপট রাগ দেখিয়ে বলল, ‘সব ভালোবাসা কেবল ভাইয়ার জন্য বরাদ্দ আমার জন্য কিচ্ছু নেই।’
শিহরণ হেসে সাথে সাথেই বলল, ‘প্রজাদের সামনে রাজকন্যার প্রতি ভালোবাসা দেখাতে নেই । তাই অনুগ্রহ পূর্বক এই প্রজাকে ইর্ষা করবেন না রাজকুমারী।’ শেষ বাক্যটি শিহরণ বাউ করার ভঙ্গিতে বলল।
বহ্নি সোফা থেকে উঠে দাঁড়াল। শিহরণের দিকে তেড়ে এসে বলল, ‘ভাইয়া! তুমি সবসময় এমন করো।’ সাব্বির আহমেদের দিকে তাকিয়ে নালিশ দেবার মতো করে বলল, ‘আব্বু ! ভাইয়াকে কিছু বলছ না কেন?’
সাব্বির আহমেদ সোফা থেকে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘শিহরণ একদম ভুল বলেনি। তুমি তো আমার প্রিন্সেস। একদম ঠিক বলেছে, শিহরণ।’
‘আব্বু, তুমিও?’ অনুযোগের দৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকাল বহ্নি। শিহরণের দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘দাঁড়াও আম্মুকে বিচার দিচ্ছি।’
সাবিহা সাবরিন নাস্তার ট্রে হাতে ডাইনিং স্পেস দিয়ে হেঁটে আসছিলেন। বহ্নির কথা শুনতে পেয়ে বললেন, ‘এবার আমিও সবার সাথে একমত, প্রিন্সেস।’
বহ্নি এবার গাল ফুলিয়ে বুকের উপর দুহাত ভাজ করে বলল, ‘ঠিক হচ্ছে না কিন্তু। কেউ আমার পক্ষে নেই। সবাই ভাইয়ার পক্ষে। আমি এহেন অন্যায় কক্ষনো মানব না।’
রাফি ভেতরে ভেতরে রাগে গজগজ করছিল। সে আজকে আসতেও চাইনি। তার বাবা তাকে এক প্রকার জোর করে পাঠিয়েছে তিনি আসতে পারবেন না বলে। সে অতিষ্ট হয়ে মনে মনে বলল, ‘এত্ত ঢং এদের। প্রত্যেকটা মানুষ চরম বিরক্তিকর।’ কিন্তু মুখে কৃত্রিমতায় ছোঁয়ানো হাসি হেসে বলল, ‘বহ্নি! আমি আছি তো তোমার পক্ষে।’
বহ্নি অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করল রাফির উপর।বলল, ‘তোমাকে আমার পক্ষে থাকতে হবে না। তুমি এমনিতেও কারও পক্ষেই থাকো না। তুমি কেবল নিজের পক্ষে থাকো।’
সাবিহা সাবরিন চোখ রাঙিয়ে বললেন, ‘বহ্নি! এসব কী ধরনের কথা?’
বহ্নি নিভল খানিক। মাকে সে বরাবরের মতোই ভয় পায়। রাফি বলল, ‘চাচি! ও দুষ্টামি করে বলেছে। আমি একদম কিছু মনে করিনি। ও তো প্রায়ই এমন দুষ্টামি করে।’
বহ্নি তখন চুপ করে ছিল। তার খুব করে বলতে ইচ্ছে করছিল, ‘মোটেও দুষ্টামি করিনি রাফি ভাই। আমি একদম মনের কথাটাই বলেছি।’
ঠিক তখন সাব্বির আহমেদের মোবাইলটা বেজে উঠল। কথা শেষ করে তিনি শিহরণকে উদ্দেশ্য করে উপদেশ দেবার ভঙ্গিতে বললেন, ‘আয়োজন শুরু করে দাও। হাতে সময় কম তবে কাজ বেশি। কোনো ভুল করলে চলবে না এবার। সিকিউরিটির বিষয়টি মাথায় রাখবে। ঠিক আছে?’
শিহরণ দৃঢ়তার সাথে বলল, ‘ঠিক আছে আব্বু। আমি সব সামলে নিব।’
কথা শেষ করেই সাব্বির আহমেদ বেরিয়ে পড়লেন। সকালের নাস্তা সেরে শিহরণও অফিসের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়ল। মায়ের আদেশে নিতান্ত অনিচ্ছাসত্ত্বেও বহ্নি রাফিকে সাথে নিয়ে চলে গেল তার ভার্সিটিতে।
____________________
অফিসে ঢুকেই শিহরণ প্রথমে আড়চোখে ছোঁয়াকে দেখল। মনোযোগ দিয়ে কাজ করছে মেয়েটা। নিজের কেবিনে গিয়ে প্রথমেই পেন্ডিং কাজগুলো সেরে নিলো শিহরণ। তারপর বেশ কিছুক্ষণ সময় নিয়ে ভাবল অনুষ্ঠানের আয়োজনের ব্যাপারে। ছোঁয়াকে তার প্রয়োজন হবে এই কাজে–তার অবচেতন মন এটাই বারংবার বলছে। মনের কথা অগ্রাহ্য করার সময় ও ইচ্ছে দুটোই শেষ হয়ে গেছে। এখন তার মনকুঠুরীর সমস্ত বাসনা পূরণের সময় হয়েছে। মনোরাজ্যে আজ হরেক রঙের ঝলকানি।
সকালের মিষ্টি কোমল রোদ জানালার পর্দা ভেদ করে শিহরণের কেবিনে প্রবেশ করেছে। তাই রোদ্দুরের তীব্রতা অনুধাবন করা যাচ্ছে না। শিহরণ জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়াল পর্দাটা না সরিয়েই। কেবিনের সাথে লাগোয়া ব্যালকনিতে লাগানো গোলাপের গাছটাতে পাঁচটা কলির সাথে একটা মাত্র ফুটন্ত লাল গোলাপ আছে। তাছাড়া অন্যান্য ফুলের গাছ ও ক্যাকটাস জাতীয় গাছও লাগানো হয়েছে এই ছোট্ট ব্যালকনিটাতে। ফরিদই এনে লাগিয়েছে গাছগুলো। শিহরণ এই অফিসের ছোট্ট ব্যালকনিতে গাছগুলো লাগানোর কারণ জানতে চেয়েছিল। প্রত্যুত্তরে সে বলেছিল, ‘ফুলের গাছ আশেপাশে থাকলে কাজ করতে বেশ আরাম লাগে। মন ফ্রেশ থাকে। মাথা কাজ করে বেশি। আর ফুলের মিষ্টি ঘ্রাণ বাতাসে ভেসে আসলে তো কাজ করার স্পৃহা দ্বিগুণ বেড়ে যায়।’
শিহরণ ফরিদের কথায় হেসেছিল সেদিন। তার ফুল, পাখি, গাছপালা ভীষণ পছন্দের। এটা সে কাউকেই খুব একটা বলে না, ভালোলাগার বিষয়গুলো প্রকাশ করতে তার ভীষণ রকমের কুণ্ঠা, দ্বিধা। তবে একজনকে বলেছিল, তার ফুল ভীষণ পছন্দের বিশেষ করে লাল গোলাপ।
সকালের রোদ্দুর কোমল স্পর্শ বুলিয়ে দিচ্ছে গোলাপ গাছটাতে ফুটন্ত লাল গোলাপটাতে। কী সুন্দর না দেখাচ্ছে ফুলটাকে! এই মনোহারিনী দৃশ্যটা তার ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি এনে দিলো। মনে মনে ফরিদের প্রতি কৃতজ্ঞ হলো সে।
পরক্ষণেই মনোরাজ্যের সমস্ত জ্বল্পনা, কল্পনা এক পাশে রেখে সে ছোঁয়াকে ডাকল। সাথে সাথে হাজির হলো ছোঁয়া। শিহরণ সাবলীল কণ্ঠে বলল, ‘আই নিড ইওর হেল্প, মিস ছোঁয়া। কুড ইউ?’
‘হোয়াই নট?’ ছোঁয়া প্রগাঢ় কণ্ঠে বলল, ‘এটাই তো আমার কাজ। কিন্তু কোন কাজে সাহায্য লাগবে স্যার?’
শিহরণ নিজের চেয়ারে বসে পেপার ওয়েটটা হাত দিয়ে ঘুরাতে ঘুরাতে বলল, ‘আসলে এটা অফিসের কাজ নয়। তাই আপনি ভেবে নিন, আপনি আসলে পারবেন কি না।’
‘আমাকে কী করতে হবে সেটা বলুন স্যার?’
‘ডেকোরেশন ও এরেঞ্জমেন্টে সাহায্য লাগবে। ঠিক সাহায্যও নয় সহযোগিতা চাই আপনার। আমাদের অরফানেজের বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হবে। সেখানে আমরা সবাই মিলে কাজ করি, এটা আমার আব্বু চাইছে। তাই এই কাজে আপনার সহযোগিতা চাইছি।’ শিহরণ বলল, এক নিঃশ্বাসে।
টেবিলের উপর রাখা পানির গ্লাসটা দ্রুত তার দিকে এগিয়ে দিলো ছোঁয়া। শান্ত কণ্ঠে বলল, ‘স্যার! পানি খেয়ে তারপর ধীরে ধীরে বলুন। অফিস টাইম তো এখনও শেষ হয়নি। অযথা তাড়াহুড়োর কি আছে?’
শিহরণ পানি খেল এক নিঃশ্বাসে ঠিক যেমনি এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলেছিল তেমনি। তারপর বলল, ‘রাজী?’
‘অবশ্যই স্যার।’ উত্তর যেন তৈরী ছিল ছোঁয়ার জিহ্বার ডগাতে। তারপর হেসে বলল, ‘কবে থেকে আয়োজন শুরু করবেন স্যার?’
‘এই তো কিছু দিনের মধ্যেই।’ শিহরণ বলল, কণ্ঠে জোর দিয়ে।
‘ওকে স্যার। আমাকে জানালেই হবে কেবল।’ ছোঁয়া শিহরণের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, ‘এবার কি আমি যেতে পারি?’
‘সিউর। ইউ ক্যান।’ শিহরণ হাত নেড়ে দরজা দেখিয়ে বলল।
______________________
ইদানিং শপে সময় দিতে হচ্ছে ছোঁয়াকে । সাইফ তার বাড়িতে যাবার কারণেই ছোঁয়াকে বেশ ভালো রকমের ধকল পোহাতে হচ্ছে। অফিস করে এসে দোকানে যেতে হচ্ছে। কষ্ট হলেও যেতে হচ্ছে। নয়তো দোকানের সমস্ত কাজ এলোমেলো হয়ে যাবে। দোকানের মেয়ে দুটো সন্ধ্যার পর পরই চলে যায়। সন্ধ্যার পর থেকে সাইফ আর ছোঁয়া দুজন মিলে দোকান সামলে নেয়। কিন্তু সাইফ না থাকাতে পুরোটা সময় ছোঁয়াকেই দেখতে হচ্ছে সমস্ত কাজ। চাইলে দোকান বন্ধও রাখতে পারে সে। তবে হিয়ার পড়াশুনার খরচ, তাদের বাড়িটার বন্ধক ছাড়ানোসহ বেশ কিছু খরচ এখনও বাকি আছে। তাই সে কোনো রিস্ক নিতে চাইছে না। আর্থিক টানাপোড়েন যে কী পরিমাণ অসহনীয় তা ছোঁয়া খুব ভাল করেই জানে!
কিন্তু রাতে বাসায় ফেরার পথে তার মনে হলো কেউ তাকে ফলো করছে। পেছনে ফিরলেই আর কাউকে দেখতে পায় না। দুদিন ধরেই এমনটা মনে হচ্ছে তার। বেশ অস্বস্তিকর অবস্থা। আজও ফিরতে বেশ দেরি হয়ে গেল। তবে কেন যেন মনে হচ্ছে আজও তাকে কেউ ফলো করছে। পেছনে ফিরতেই তার থেকে বেশ দূরত্বে দুটো বাইক দেখতে পেল। বাইক দুটোতেই আরোহী দুজন করে মোট চারজন। ছোঁয়া ভাবল, এমনিতেই সাধারণ কেউ হয়তো। তারপর আবার হাঁটা শুরু করল। কিন্তু পরক্ষণেই একটা কার এসে থামল তার পাশে। ছোঁয়া দেখল, গাড়িটা শিহরণের। মনে মনে একটা ধাক্কা খেল প্রথমেই, শিহরণ এখানে কী করছে? প্রথমেই তার মাথাতে এই প্রশ্নটা এলো। তাকে অবাক করে দিয়ে শিহরণ বলল, ‘আমি ড্রাইভ করছিলাম তোমাকে দেখে মনে হলো তোমার লিফ্ট দরকার তাই চলে এলাম লিফ্ট দিতে।’
‘তোমাকে।’ এই শব্দটাই প্রথমে তার মস্তিষ্ক ধারণ করল। বাকি সব কথা কর্পূরের ন্যায় ভ্যানিশ হয়ে গেল। তার কোনোকিছুই সে ধরতে পারেনি, পারেনি উপলব্ধি করতে। সে ভুলে গেল কেউ তার পিছু নিচ্ছিল।
শিহরণ তাড়া দিয়ে শব্দ করে বলল, ‘জলদি উঠে এসো।’
ছোঁয়া সম্বিৎ ফিরে পেতেই কোনো প্রকার বাক্যব্যয় না করে সম্মোহিত মানুষের মতো উঠে পড়ল শিহরণের গাড়িতে। শিহরণ ফ্রন্ট মিররে দেখল বাইক দুটো এখন আর নেই। সে বলল, ‘এত রাত অবধি বাইরে থাকার কী দরকার?’
ছোঁয়ার কর্ণকুহরে যেন কিছুই প্রবেশ করছে না। সে সম্মোহিত মানবীর ন্যায় বসে আছে।
____________________________