ছোঁয়ার শিহরণ ২য় খন্ড পর্ব-১৪+১৫+১৬

0
1924

#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফাতিমা_আক্তার_অদ্রি
পর্ব-১৪

মেঘমুক্ত আকাশটা তারায় তারায় আলোকিত হয়ে আছে। উৎসবমুখর মনে হচ্ছে পুরো অন্তরীক্ষকে। মনে হচ্ছে যেন কোনো এক বিশেষ উৎসব পালন করা হচ্ছে। সমস্ত তারকারাজির মধ্যেখানে থালার মতো চাঁদটা যেন নিজের স্বতন্ত্রতার প্রমাণ দিচ্ছে। বহ্নি ছাদের কার্ণিশে দাঁড়িয়ে আকাশপানে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছিল। আজ এতগুলো বছর পরে অতলের সাথে দেখা হওয়াতে তার ভীষণ ভালো লাগছে। মনের মধ্যে ভালোলাগার প্রজাপতিরা উড়ে বেড়াচ্ছে ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে। হাতের মোবাইলটার দিকে বারংবার তাকাচ্ছে সে। ভাগ্যিস মোবাইল নাম্বারটা নিয়েছে সে। এবার আর খুঁজে পেতে কোনো সমস্যা হবে না। যখন ইচ্ছে তখন কথা বলতে পারবে। এটা ভাবতেই তার মনের মধ্যে এক ধরনের দুর্জ্ঞেয় ভালো লাগা কাজ করছে। অতলকে কল করার ইচ্ছেটাকে দমন করার সর্বাত্মক চেষ্টা করছে সে। কিন্তু বহ্নি সব থেকে বেশি অবাক হয়েছে অতলের পরিবর্তন দেখে! আর চোখের চশমাটা দেখেও বেশ অবাক হয়েছে। চাশমিশ বলাতে খ্যাপে গিয়েছিল খানিকটা। বহ্নির তখন বেশ মজা লাগছিল। অন্ধকার ঘামটি মেরে বসেছে ছাদের চারপাশে গাছপালার ঝোপের মধ্যে। চাঁদের আলো সমস্ত অন্ধকারকে দূর করতে ব্যর্থ হয়েছে। বহ্নি ঝোপের মধ্যে থাকা চড়ুই পাখির বাসাটার দিকেও কয়েকবার তাকাল। বিশেষ সুবিধা হলো না। মনে হচ্ছে পাখির বাচ্চাগুলো ঘুমিয়ে পড়েছে। টুন আর মুনের সাথে কথা বলতে না পেরে তার ভীষণ খারাপ লাগল। তবে নিজেকে সামলে নিল।

‘কী হয়েছে কাপকেক?’ শিহরণের প্রশ্নে বহ্নি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। বলল, ‘দেখ, ভাইয়া! আজ আকাশে কতগুলো তারা। যেন মেলা বসেছে।’

বহ্নির কথা শুনে শিহরণ তাকাশ আকাশের দিকে। শান্ত কণ্ঠে বলল, ‘হুম। ঠিক বলেছিস। খুব সুন্দর লাগছে।’

‘ভাইয়া! গিটার তো সাথেই এনেছ। একটা গান তো হতেই পারে। কী বলো?’

‘হুম, হতে পারে। আমার বোনের জন্য একটা কেন শত শত গান হতে পারে।’ শিহরণ বহ্নির পাশে দাঁড়িয়ে বলল।

‘শত শত গান দরকার নেই। একটা হলেই চলবে।’ বহ্নি সহাস্যে বলল।

‘ওকে, ডিয়ার সিস্টার। বাই দ্যা ওয়ে, টুন আর মুন কই? ওরা কি ঘুমিয়ে পড়েছে?’

‘হুম।’ মলিন মুখে বলল, বহ্নি, ‘গান শুরু করো। হয়তো গানের সুরে ওরা জেগেও যেতে পারে।আর একবার জাগলে তো ওরাও মন দিয়ে শুনবে।’

‘ওকে, ডিয়ার সিস্টার।’

শিহরণ চোখ বুজে ধীরে ধীরে গিটারে সুর তুলছে। আর গাইছে তার প্রিয় শিল্পীর একটা গান।

Almost heaven, West Virginia
Blue Ridge Mountains, Shenandoah River
Life is old there, older than the trees
Younger than the mountains, growin’ like a breeze

Country roads, take me home
To the place I belong
West Virginia, mountain mama
Take me home, country roads

All my memories gather ’round her
Miner’s lady, stranger to blue water
Dark and dusty, painted on the sky
Misty taste of moonshine, teardrop in my eye

Country roads, take me home
To the place I belong
West Virginia, mountain mama
Take me home, country roads

I hear her voice in the mornin’ hour, she calls me
The radio reminds me of my home far away
Drivin’ down the road, I get a feelin’
That I should’ve been home yesterday, yesterday

Country roads, take me home
To the place I belong
West Virginia, mountain mama
Take me home, country roads

Country roads, take me home
To the place I belong
West Virginia, mountain mama
Take me home, country roads

Take me home, down country roads
Take me home, down country roads

_____by John Denver

‘বাহ্! দারুণ গেয়েছ ভাইয়া।’

‘সত্যি বলছিস?’

‘মিথ্যে বলব কেন ভাইয়া? ইউ আর রিয়েলি আ স্টার।’

‘এবার কিন্তু একটু বেশিই বলে ফেলছিস।’

‘ভাইয়া, একদম বেশি বলিনি।’

‘আচ্ছা, ভাইয়া। আমার কেন যেন মনে হচ্ছে আম্মু তোমার বিয়ে ঠিক করছে মান্নাত আপুর সাথে।’

শিহরণ চমকাল প্রচণ্ডরকমভাবে। আশ্চর্যান্বিত হয়ে প্রশ্ন করল, ‘কী বলছিস এসব?’

‘হ্যাঁ, ভাইয়া। আড়িপেতে শোনা খুবই খারাপ অভ্যাস। তবুও তোমার নামটা শুনে নিজেকে আটকে রাখতে পারলাম না। শুনেই ফেললাম আম্মুর কথা ‘

‘এটা সম্ভব নয়। মান্নাত আমার কাজিন। দ্যাটস ইট। এর থেকে বেশি কখনোই সম্ভব নয়।’

‘আচ্ছা, কেন সম্ভব নয়?’ বহ্নির কণ্ঠে কৌতুহল ।

শিহরণ অদ্ভুতভাবে তাকাল। বহ্নি পুনরায় বলল, ‘না, মানে তুমি তো কাউকে পছন্দ করো না। আম্মু যেহেতু মান্নাত আপুকে পছন্দ করেছে তোমার জন্য তাহলে সমস্যা কোথায়?’

‘সমস্যা আছে। আমি মান্নাতকে ওভাবে কোনোদিন দেখিনি। তাছাড়া তার পছন্দ-অপছন্দের ব্যাপারটা আমার সাথে যায় না।’

‘আচ্ছা, ভাইয়া। সত্যি করে বলো তো তুমি সত্যিই কি এখন কাউকে পছন্দ করো না।’ সন্দিগ্ধ কণ্ঠে জানতে চাইল, বহ্নি।

‘মিথ্যে বলার কি আছে এটা নিয়ে?’

‘না, মানে আমি স্কুলে থাকতে শুনতাম ছোঁয়া নামের মেয়েটা তোমাকে পছন্দ করে। সবাই বল তো না। কেউ কেউ বলতো। এই যেমন অহনার কাছে শুনেছিলাম।’

শিহরণ মুখটা ফিরিয়ে নিল। বলল, ‘অহনা বলেছে?’ কৌতুহল যেন পেয়ে বসেছে তাকে,’ আর কি কি বলেছে?’

‘বলেছিল তো অনেককিছুই। আমি খুব একটা পাত্তা দিইনি। আমি জানি তুমি আমাকে বলবে। আগে হোক বা পরে বলবে এটাতে আমি নিশ্চিত ছিলাম। এই যেমন ধরো তুমি ওদের বাসায় গিয়েছ বেশ কয়েকবার এটাও বলেছে।’

শিহরণ একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। বলল, ‘বলার মতো কিছু নেই। থাকলে তো তোকে বলতাম আমি।’

___________________________

বাসায় পৌঁছে অতল সোজা নিজের বেডরুমে চলে গেল। কাঁধ থেকে ব্যাকপ্যাকটা রাখল বেডের উপরেই। জুতো জোড়া ছুড়ে ফেলল। কোথায় গিয়ে পড়েছে কে জানে! সোজা হয়ে শুয়ে পড়ল বিছানায়। বড্ড ক্লান্ত লাগছে তার। সমস্ত কিছু বিক্ষিপ্ত, ছড়ানো-ছিটানো, এলোমেলো। সে নিজেও বিক্ষিপ্ত, তার চিন্তা-ভাবনাও। কৈশরের ঘটনাটা তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে অনেকখানি। তাকে পরিণত করেছে অন্য এক মানুষে। প্রচণ্ড বিতৃষ্ণা তৈরী হয়েছে তার এক সময়কার প্রাণের বন্ধু শিহরণের প্রতি। শান্ত ছেলেটা কেমন যেন অশান্ত হয়ে পড়েছে। এখন আর কাউকে বিশ্বাস করতে মন চায় না। কোনো বন্ধুকে আপন ভাইয়ের মতো মনে করতে ইচ্ছে করে না। অবশ্যই ভাইয়ের মতো ভালোবাসতো কেবল একজনকে আর সে হচ্ছে কেবল এবং কেবলই শিহরণ। আর সেই মানুষটাকে এখন সবচাইতে বেশি ঘৃণা করে। হুম, ঘৃণা! খুব ভারী শব্দটা, তবুও এখন সে সত্যিই ঘৃণা করে তাকে। তাকে অযথাই দোষারোপ করেছিল সে। তার গায়ে হাত তুলেছিল, করেছিল রক্তাক্ত তার শরীর। শরীরের আঘাতটা তো সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে সেরে গেছে। কিন্তু মনের ক্ষতটা? ওটা হয়তো কখনোই সারবার নয়। ওটা এখনও জ্বলন্ত, রক্তাক্ত। এমন বিক্ষিপ্ত চিন্তারা ভিড় করেছে অতলের চিন্তা রাজ্যে। আর প্রচণ্ড ক্লান্তিতে সে তলিয়ে গেল ঘুমের রাজ্যে। কতক্ষণ ঘুমিয়েছে কে জানে! চেতনা ফিরে পেল তানিয়ার ডাকে।

‘অতল ভাইয়া! আম্মু ডাকছে তো।”

অতল চোখ না খুলেই প্রচণ্ড বিরক্তি মাখা কণ্ঠে বলল, ‘যা তো এখান থেকে। ঘুমোতে দে আমাকে।’

‘সেই সন্ধ্যেবেলা ঘুমিয়ে পড়েছে। এখনও কি ঘুম পূর্ণ হয়নি?’

‘যেতে বললাম তো তোকে।’ ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বলতে বলতে সে বালিশে ভাল করে মুখ গুঁজল।

তানিয়া ও কম যায় না। সে সুন্দর করে অতলের মাথার নিচ থেকে বালিশটাই কেড়ে নিল। তারপর গলার স্বর যথাসম্ভব উঁচু করে বলল, ‘আব্বু ডাকছে ভাত খেতে।’

অতল রাগী চোখে তাকাল তানিয়ার দিকে। কিন্তু তানিয়া কী বলেছে বুঝতে পেরে এক লাফে বিছানা থেকে উঠে গেল। তারপর বাথরুমে ঢুকতে ঢুকতে বলল, ‘একটু পরে আসছি।’

‘পরে টরে হবে না। আব্বু বসে আছে ডাইনিং টেবিলে। সবাইকে একসাথে ডিনার করতে হবে।’

‘আব্বু বসে আছে? আতিক ভাইয়া এসেছে?’ বাথরুম থেকেই চেঁচিয়ে বলল, অতল।

‘হ্যাঁ, ভাইয়া তো সন্ধ্যায় চলে এসেছে।’

‘আচ্ছা, টমেটো সস! আমি এখনই আসছি।’

তানিয়া আর বেশি বকবক করল না। অতলকে শেষবারের মতো সতর্ক করে বলল, ‘অতল ভাইয়া! পাঁচ মিনিটের মধ্যে ফ্রেশ হয়েই আসো।’

রাতের খাবার শেষে অতল আতিকের রুমে গেল। আতিক তখন ল্যাপটপে কাজ করছিল। অতলকে দেখে বলল, ‘কী রে! কিছু বলবি?’

অতল আমতা আমতা করে বলল, ‘নাহ্! তেমন কিছু বলার নেই। এই তো তোমার খোঁজ নিতে এলাম।’

অতলের মনে চলছে তখন অন্য কথা। কিন্তু নানান কথা ভাবতে ভাবতে তার চিন্তার জন্য নিজেকেই মনে মনে একটা ধমক দিল। পরক্ষণেই বলল, ‘কেমন আছ, ভাইয়া?’

আতিক ভ্যাবলার মতো কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিল অতলের দিকে। বলল, ‘ভালো আছি। তুই কেমন আছিস?’

‘আমি তো বেশ আছি।’ বিছানার উপর বসে বলল, অতল।

‘পড়াশোনার কী খবর?’ ল্যাপটপে চোখ রেখেই প্রশ্ন করল, আতিক।

‘খুব ভালো।’ অতল চোখের চশমাটা ঠিক করে বলল।

অতলের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে জানতে চাইল আতিক, ‘তোর ভাইভার ডেইট কবে?’

‘এখনও দেয়নি। আশা করছি শীঘ্রই দিয়ে দেবে।’

‘এখন কিন্তু সিরিয়াসলি পড়তে হবে। নো হেলা ফেলা। ইটস্ আ ভেরি ইমপর্ট্যন্ট স্টেজ ইনডিড।’

‘সো ট্রু।’ মাথা চুলকে বলল অতল।

‘আর কিছু বলবি?’ ব্যস্ত দেখাল আতিককে।

‘তোমার কাজ আছে?’ সরু চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন করল অতল।

‘কাজ তো আছেই।’ সহাস্যে বলল আতিক ।

‘ঠিক আছে তাহলে। কাজ করো।’ বিছানা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল অতল।

‘কিছু বলার থাকলে বলতে পারিস।’ কী-প্যাডে আঙ্গুল চালাতে চালাতে বলল, আতিক।

‘না, ভাইয়া! এমনিতেই বলছিলাম। আড্ডা দিতে ইচ্ছে করছিল।’

‘ওহ্, আচ্ছা। তাহলে একটু অপেক্ষা কর। আমি কাজ শেষ করেই আসব তোর রুমে।’

‘আমাকে ফেলে তোমরা দুইভাই মিলে কি প্ল্যান করছ?’ আতিকের দরজায় দাঁড়িয়ে তানিয়া বলল, কপট রাগ দেখিয়ে ।

‘টমেটো সসকে কোনো পরিকল্পনায় রাখা উচিত বলে মনে হয় না।’ ঠাট্টার সুরে বলল অতল।

‘অতল ভাইয়া! তুমি সবসময় এমন করো। আতিক ভাইয়া তুমি অতল ভাইয়ার কান মলে দাও। একদম উচিত শিক্ষা হবে তখন।’

আতিক তানিয়ার দিকে এক নজর তাকিয়ে বলল,
‘আচ্ছা, দিব। আমি কাজ শেষ করেই আচ্ছামতো কান মলে দিব।’

অতল তানিয়াকে টানতে টানতে আতিকের রুম থেকে নিয়ে গেল। বলল, ‘আমাকে কান মলা খাওয়াতে তোর খুব মজা লাগে। তাই না?’

‘লাগেই তো। তুমি যেমন মজা পাও আমাকে টমেচো সস বলে ডাকতে।’

অতল নিজের ব্যালকনিতে বসে ছিল অনেকক্ষণ। আতিক এলো না। তানিয়া কফি করে নিয়ে এলো দুজনের জন্য। দুজনে মিলে বেশ অনেকক্ষণ গল্প করল। পড়াশোনা, ভবিষ্যতের কার কী লক্ষ্য এইসবই ছিল আলোচনার বিষয়বস্তু। আতিককে আসতে না দেখে তানিয়া আতিকের রুমে গিয়ে দেখল সে ঘুমিয়ে পড়েছে। মুখ গোমড়া করে অতলকে বলল, ‘ভাইয়া তো ঘুমিয়ে পড়েছে।’

অতল খানিক ভাবল। পরক্ষণেই বলল, ‘ক্লান্ত ছিল বোধহয়। অন্য কোনোদিন তিন ভাইবোন ভিলে আড্ডা দেয়া যাবে। ঠিক আছে টমেটো সস?’

‘ঠিক আছে।’

‘বাহ্! শেষমেশ মেনে নিলি তাহলে?’

‘কী মেনে নিয়েছি?’ তানিয়াকে বিভ্রান্ত দেখাল,’ ভাইয়া ভালো হচ্ছে না কিন্ত…!’

‘আচ্ছা, আজকের মতো আড্ডা টপিক শেষ। আমার ঘুম আসছে খুব। তুই ঘুমোতে যা। আব্বু দেখলে আমাকে এক প্রস্থ বকাঝকা করবে। তোকে তো কেবল আদুরে বকা দিবে।’

‘হুম, বলেছে তোমাকে।’ কফির মগ দুটো হাতে নিতে নিতে বলল, তানিয়া।

‘বলতে হবে কেন? তোর ভাই সব বুঝে।’ শার্টের কলার উঁচু করে দাপটের সাথে বলল অতল।

‘হুহ্! মা তো তোমাকে আদুরে বকাও দেয় না। তুমি তো আম্মুর জান।’ তানিয়া ভেংচি কেটে বলল।

‘আম্মুর জন্য আমরা তিনজনই সমান। আম্মু আমাদের তিনজনকেই সমান ভালোবাসে। এতে কোনো দ্বিধা নেই।’ অতল দৃঢ়তার সাথে বলল।

‘নাহ্! তোমাকে বেশি।’

‘একদম না।’

‘একদম।’

‘আর কোনো কথা না।’ অতল বিছানায় ধপাস করে শব্দ করে শুয়ে পড়ল।

‘এখনও রাত বারোটাও বাজেনি, ভাইয়া। তুমি এত তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ছ?’

অতল বালিশে মুখ গুঁজতে গুঁজতে বলল, ‘সকালে আমাকে লাইব্রেরিতে যেতে হবে রে বোন। আর বিরক্ত করিস না।’

তানিয়া মন খারাপ করে নিজের রুমে চলে গেল। দরজায় দাঁড়িয়ে আবারও দেখল অতলের দিকে। এরই মধ্যে ঘুমিয়ে পড়েছে সে। তানিয়া ভাবল, এত তাড়াতাড়ি কীভাবে সম্ভব!
___________________________

ছোঁয়া নিজের রুমের ব্যালকনিতে টবে লাগানো গাছে পানি দিচ্ছিল। হঠাৎ করেই তার নাম্বারে রিং বাজতে লাগল। ছোঁয়া তৎক্ষনাৎ কল রিসিভ করার প্রয়োজন বোধ করল না। সে অর্কিড আর গোলাপ গাছগুলোর বিশেষ যত্ন নেয়। গোলাপ তার প্রিয় ফুল, অর্কিডের অবস্থান তার পরেই। গোলাপ গাছে ফুটন্ত লাল গোলাপ ফুলগুলোতে স্প্রে করার সময় তার মোবাইলটা আবার বেজে উঠল। ছোঁয়া এক প্রকার বিরক্ত হয়েই বেডরুমে ঢুকল। মোবাইল হাতে নিতেই দেখল সাইফ কল করেছে। প্রচণ্ড বিরক্ত হলো সে। তবুও কল রিসিভ করল। বলল, ‘কী রে! এই সময়ে কল করছিস কেন?’

‘তোকে কল করার জন্য এখন আমাকে টাইম দেখতে হবে না-কি?’ সাইফ ও দ্বিগুণ তেজ দেখিয়ে প্রশ্ন করল।

‘পয়েন্টে আয়।’ ছোঁয়া ভীষণ ব্যস্ত গলায় বলল।

‘কিসের পয়েন্ট?’ ইচ্ছে করেই বোকা সাজার চেষ্টা করল সাইফ।

‘আরে বাপ! তুই কেন কল করেছিস বল তো? আমি গাছে পানি দেব।’ বিরক্ত হয়ে বলল, ছোঁয়া।

‘কেমন আছিস?’ সাইফ মুখ টিপে হাসতে হাসতে প্রশ্ন করল।

ছোঁয়া বুঝতে পারল সাইফের কুটনামি। তাই সেও বাধ্য মেয়ের মতো বলল, ‘ভালো আছি। এখন রাখছি।’

‘আরে শোন…!’ ছোঁয়া সাইফকে কিছু বলতে না দিয়ে কলটা কেটে দিল। তারপর আবার বারান্দায় গেল গাছে স্প্রে করার জন্য।

কিন্তু আবারও মোবাইলটা বেজে উঠল। বাজতে বাজতেই প্রথম কলটা গেল। ছোঁয়া স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। কিন্তু পাঁচ মিনিট পরে আবার মোবাইলটা বেজে উঠল। ছোঁয়া ভাবল এবারও সাইফ কল করেছে। তাই এবার সাইফকে কিছু কড়া কথা বলার মানসে মোবাইলটা পিক করেই বলল, ‘এই তোর সমস্যা কী রে? বললাম না আমি গাছে পানি দিচ্ছি। কানে যায় না কথা?’

এক নিঃশ্বাসে বলে ফেলল সমস্ত কথা। ফোনের ওপাশে পিনপতন নীরবতা। ছোঁয়া আবারও বলল, ‘কী রে ? কথা বলছিস না কেন?’

‘আমি শিহরণ বলছি।’ ভীষণরকম গম্ভীর শোনালো সেই কণ্ঠটা।

এটুকুই যথেষ্ট ছিল ছোঁয়ার অনুভূতি জাগ্রত করতে। বুকের মধ্যে দ্রিম দ্রিম শব্দ হচ্ছে। একটা নামই সমস্ত অনুভূতির শহরটা মুহূর্তেই পরিবর্তন করে দিল। এরই নাম কি ভালোবাসা? ছোঁয়ার মন প্রশ্ন করল তার অজান্তেই, অগোচরে।

‘হ্যালো! আর ইউ দেয়ার?’ শিহরণ দ্বিধান্বিত কণ্ঠে প্রশ্ন করল।

‘ইয়েস। শুনছি বলুন।’ ছোঁয়া বলল, কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে।

এরপর কিছুক্ষণ দুজনেই নীরব। কেউ কিছু বলছে না। যেন শব্দেরা চুক্তি করে পালিয়েছে দুজনের মনের অভিধান থেকেই। নীরবতা থেকেই যেন দুজন দুজনের
মনের ভাবটা বুঝে নিচ্ছে!

‘কোনো প্রয়োজন ছিল স্যার?’ ছোঁয়াই প্রশ্নটা করল প্রথমে।

‘ইয়েস। আপনাকে আজ যে প্রেজেন্টেশনের কাজ দিয়েছি তাতে কি কোনো সমস্যা হয়েছে?’ কোনো কথা ভেবে না পেয়ে বলল, শিহরণ।

‘আসলে স্যার আমি তো কাজটা শুরুই করিনি এখনও।’ ছোঁয়া আক্ষেপের সুরে বলল।

‘প্রেজেন্টেশন স্লাইডগুলো কালকের মধ্যেই দরকার।’ কি বলতে ফোন করেছে সে আর কী বলছে! শিহরণ নিজের মাথায় নিজেই চাটা মারল।

‘জি, স্যার। আপনি কালকের মধ্যেই পেয়ে যাবেন।’ ছোঁয়া আশ্বস্ত করল।

‘ওকে, তাহলে রাখছি।’ আর কোনো কথা খুঁজে পাচ্ছে না শিহরণ।

‘জি।’ ছোট্ট করে বলল ছোঁয়া।

শিহরণ তারপরেও কলটা কাটছে না। কিছু বলতে চায়। কিন্তু পারছে না। কেন এই দ্বিধা, কেন এই দ্বিচারিতা শিহরণ বুঝতে পারছে না। শিহরণ এইসব প্রফেশনাল আলোচনা করার জন্য কল করেনি। অথচ, সে বলছে কী! নিজের উপর প্রচণ্ড বিরক্ত হচ্ছে সে। এই রকম ভ্যাবলাকান্ত কবে থেকে হলো সে ভেবে পেল না। হঠাৎ করেই ছোঁয়ার কণ্ঠটা শুনতে মন চাইল তাই শেষমেশ কল করে বসেছে সে। অথচ, কল করে কী সব আবোলতাবোল কথা বলছে সে!

‘স্যার, আর কিছু বলবেন?’ ভীষণ প্রফেশনাল শোনাল ছোঁয়ার কণ্ঠটা।

‘না। রাখছি।’ বিরক্তির ছোঁয়া বোঝা গেল, শিহরণের কণ্ঠে।

_______________________________

#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফাতিমা_আক্তার_অদ্রি
পর্ব-১৫

অতল লাইব্রেরিতে বসে বেশ মনোযোগ দিয়ে পড়ছিল। আয়মান কেবল বইয়ের পৃষ্টা গুনছে। এটা তার পুরনো অভ্যাস। একটা বই; তা যেই আকারেরই হোক না কেন আয়মান প্রথমেই চলে যাবে শেষ পৃষ্ঠায়; পৃষ্ঠার সংখ্যা দেখার জন্য। পৃষ্ঠা সংখ্যা দেখার পরেও তার পৃষ্ঠা গোনার অভ্যাসের কোনো হেরফের হয় না। এক পেইজের পড়া পড়তে পড়তেই পৃষ্ঠা গোনার কাজ চালু থাকে।

অতল আড়চোখে দেখছিল আয়মানের কাণ্ড। ঝাড়ি দিয়ে বলল, ‘তোর এই অভ্যাস আর গেলো না।’

আয়মান বইয়ের পাতার ভাজ থেকে চোখ তুলে তাকাল অতলের দিকে। দাঁত বের করা হাসি দিয়ে অতলের কথায় সম্মতি জানাল। খুশিতে গদগদ হয়ে বলল, ‘বইয়ের পাতা না গুনলে আমার শান্তি লাগে না। তুই তো জানিস, পড়তে আমার ভীষণ বিরক্ত লাগে। এর থেকে কষ্টকর কাজ বোধহয় এই পৃথিবীতে আর নেই।’

‘পৃষ্ঠা গুনে কি সেই কষ্ট কম হয়?’ স্থির চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন করল অতল।

‘কষ্ট কম হয় না তবে পড়ার সময় কষ্টের অনুভূতি কম হয়।’ আয়মান বলল, বিজ্ঞের মতো করে।

‘বাহ্! দারুণ তো।’ অতল অবাক হবার ভান করল। পরক্ষণেই বলল, ‘যত্তসব ফালতু নিয়ম তোর।’

‘তোর কাছে ফালতু মনে হলো?’ আয়মান ভীষণ অবাক হয়ে জানতে চাইল।

‘নয়তো কী?’ ভ্রু কুঁচকে বলল, অতল।

‘এটা সত্যিই কাজে দেয়।’ আয়মান জোর গলায় বলল, ‘তোর তো আর এই পদ্ধতির প্রয়োজন নেই। তুই তো রোবট মানব। পড়তে কোনো ক্লান্তি নেই তোর।’ গলার স্বর খাদে নামিয়ে প্রচণ্ড আক্ষেপ নিয়ে আয়মান বলল,’আহা! আমারও যদি পড়তে কষ্ট না হতো তোর মতো!’

অতল নির্বিকার। এবার সে মানসিক দক্ষতার প্রবলেম সলভ করতে মনোযোগী । আয়মান চুপ হয়ে গেল। ভাবল, আর কথা চালিয়ে কোনো লাভ হবে না। রোবট মানব আর কোনোভাবেই উত্তর দেবেন না। তা সে শতভাগ নিশ্চিত। তাই সেও এক পলক এদিক সেদিক তাকিয়ে পৃষ্ঠা গুনতে গুনতে পড়ার কার্যক্রম চালু রাখল।

___________________

ফাইজা বেগমের শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। নীলা সেবাযত্ন করতে কোনো কার্পণ্য করছে না। কিন্তু ডাক্তারের কাছে যেতে বললেই তিনি বেঁকে বসেন। ব্যাকপেইন, হাঁটু ব্যথাসহ নানান ধরনের শারীরিক সমস্যা দেখা দিয়েছে তার। তার উপর মরার উপর খাড়ার ঘার মতো জ্বর উঠেছে গতকাল রাত থেকে। সারারাত কেবল কেঁপেছেন প্রচণ্ড ঠান্ডায়। তারপরেও বড়ো খোকাকে কল করেননি একটিবারের জন্য। তিনি জানেন, তার ছেলেটা মায়ের কষ্টের কথা শুনতে পেলেই সবকিছু ছেড়ে উনার কাছে চলে আসবে। নীলা বারকয়েক চেয়েছিল রাদিদকে জানাতে । কিন্তু ফাইজা বেগমের কঠোর নির্দেশ অমান্য করার সাহস তার আর হয়ে উঠেনি। যতটুকু সম্ভব হয়েছে নিজে, একা হাতে মায়ের সেবা করেছে।

রাদিদ বাসায় পৌঁছেই মায়ের রুমে গেল। মায়ের গায়ে হাত দিতেই আঁতকে উঠল সে। শরীর জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। তার মনটা সাথে সাথেই খুবই খারাপ হয়ে গেল। খুব আক্ষেপ হচ্ছে তার। মাকে একলা রেখে এভাবে ফুফুর বাসায় থাকাটা একদম উচিত হয়নি তার। মায়ের কথা মাথায় রাখা উচিত ছিল তার। এখন অন্তর্দহনে পুড়ছে সে। কী নিদারুণ কষ্ট এই অন্তর্দাহ! রাদিদ জানে খুব ভালো করে।

মায়ের শিয়রের পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে মৃদু স্বরে প্রশ্ন করল, ‘মা! তোমার কি খুব কষ্ট হচ্ছে?’

প্যান্টের পকেট থেকে মোবাইলটা নিয়ে স্থানীয় এক ডাক্তারকে কল করল। ডাক্তারের সাথে পরিচয় থাকার সুবাদে তিনি না করলেন না। ডাক্তার আসার পরেই চেকআপ করে বললেন, ‘কোনোভাবেই যাতে রোগীকে মানসিক প্রেশার দেয়া না হয়। অতিরিক্ত মানসিক চাপ নিলে তিনি খুবই অসুস্থ হয়ে পড়বেন।’ একটু বিরতি নিয়ে ডাক্তার আবার বললেন, ‘প্রেসক্রিপশনে প্রয়োজনীয় ওষুধ লিখে দিয়েছি। ওগুলো খাইয়ে দেবেন। আর সবগুলো ওষুধ ভরা পেটে খাওয়াবেন।’

রাদিদ আবিরকে ডেকে বলল ডাক্তার সাহেবকে এগিয়ে দিতে। আবির অনিচ্ছাসত্ত্বেও ডাক্তার সাহেবকে এগিয়ে দিতে গেল। রাদিদ মায়ের পাশ থেকে নড়ল না পর্যন্ত। ফাইজা বেগম বললেন, ‘বড়ো খোকা! তুই কতটা পথ জার্নি করে এসেছিস। নিশ্চয়ই খুব কষ্ট হচ্ছে । যা তো গোসল করে ফ্রেশ হয়ে নে।’

‘না মা আমার একদম কষ্ট হচ্ছে না। তুমি সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত আমার কোনো বিশ্রাম নিতে হবে না।’ রাদিদ মায়ের কপালে জলপট্টি দিতে দিতে বলল।

‘আহা! আমি এখন ভালো আছি তো। তুই এসেছিস এখন সমস্ত অসুখকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করব।’ ফাইজা বেগম হাসার চেষ্টা করলেন।

‘মা! তুমি এই জ্বরের মধ্যেও এসব বলছ?’

‘তুই তো আমার আসল ওষুধ রে খোকা।’ একুট থেমে নীলাকে ডেকে বললেন, ‘যা তো তোর ভাইয়ের জন্য এক কাপ চা করে নিয়ে আয়।’

নীলা তৎক্ষনাৎ রান্নাঘরে চলে গেল। পিউ হুট করে এসেই ঝাঁপিয়ে পড়ল রাদিদের কোলে। ঠোঁট উল্টে বলল, ‘বড়ো মামা! তুমি এসে আমার সাথে দেখা করোনি কেন?’

‘মাই লিটল চ্যাম্প। তাই আমি জানতাম আমার চ্যাম্প ঠিকই আমাকে খুঁজে নিবে।’

‘বড়ো মামা! আমার জন্য কী এনেছ?’

‘তোমার জন্য যা এনেছি তা সিক্রেট। এখন বলা যাবে না।’

‘সিক্রেট?’ টেনে টেনে বলল পিউ।

‘হুম, সিক্রেট। আমি সময়মতো তোমাকে দেব। ঠিক আছে?’

‘ঠিক আছে, বড়ো মামা।’

‘তাহলে এখন খেলতে যাও। বিকেলে আমরা একসাথে খেলব। ওকে চ্যাম্প?’

‘ওকে।’ উৎফুল্ল গলায় বলল, পিউ।

নীলা চা এনে রাদিদের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, ‘ভাই, চা-টা গরম গরম খেয়ে নে। ভালো লাগবে।’

রাদিদ মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। মাকে ঘুম পাড়িয়ে নিজের রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিল সে। মাকে অসুস্থ দেখে তার নিজের অতিরিক্ত খারাপ লাগছে। নিজের উপর রাগও লাগছে। একদিন আগে আসলে তার মা এমন কষ্ট পেত না। আফসোস হচ্ছে তার। ভীষণ আফসোস!

_____________________

‘আচ্ছা, বহ্নি মেয়েটা কে রে? তুই সেদিনও তার সম্পর্কে তেমন কিছুই বললি না।’ আয়মানের কণ্ঠের কৌতুহল ছাপিয়ে দেখা দিল গভীর আক্ষেপ।

‘কেউ না।’ অতলের একগুঁয়ে উত্তর ।

‘কে হয় বল না দোস্ত?’ আয়মানের কণ্ঠে আবারও আক্ষেপ দেখা দিল, ‘আশ্চর্য তো ও সায়মার বান্ধবী কিন্তু সায়মা তার বান্ধবীর ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে আমাকে একটা শব্দ পর্যন্ত বলেনি। সেও মাঝেমধ্যে জ্ঞানগর্ভ ভাষণ দেয়। বিশেষ করে বন্ধুত্বে প্রাইভেসির ক্ষেত্রে।’

‘বললাম তো কেউ হয় না আমার।’ জোর দিয়ে বলল, অতল।

‘তাহলে সে তোর সাথে ওভাবে কথা বলছিল কেন?’ আয়মান যেন প্রশ্নের উত্তর না পেয়ে ক্ষান্ত হবে না।

‘ইচ্ছে হয়েছে বলেছে। আমি অতীত নিয়ে কোনো কথা বলতে চাইছি না আয়মান। তোকে এই শেষবার ওয়ার্ন করলাম।’

‘আমার মনে হয় মেয়েটা তোকে পছন্দ করে।’

‘করতেই পারে।’

‘তেমন পছন্দ নয় যেমনটা তুই ভাবছিস। আই থিঙ্ক সি ইজ সো মাচ ইনটু ইউ।’

অতল তখন রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে আয়মানের কলার ধরে ওকে দেয়ালের সাথে চেপে ধরল। প্রচণ্ড শক্তি নিয়ে ওর মুখে একটা ঘুষি মারল। আয়মান ব্যথায় কঁকিয়ে উঠল। বলল, ‘আর ইউ ম্যাড, অতল? আমি কি এমন বলেছি যে তুই আমার গায়ে হাত তুললি?’

অতল তৎক্ষনাৎ চোখ দুটো বুজে ফেলল। ঘন ঘন শ্বাস ফেলছে সে। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। ভুলতে চাওয়া অতীতটা আবারও তার বিদখুটে পাতা তার চোখের সামনে তুলে ধরেছে। নাহ্! অতল দেখবে না এটা। কোনোভাবেই না। কোনোভাবেই না।

অতল দু’হাত দিয়ে তার মাথাটা চেপে ধরেছে। ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছে মাথার ভেতরে। আয়মানের চোয়াল শক্ত হয়ে গেছে। অতলের মারটা লেগেছে খুব। কিন্তু অতলকে এভাবে ছটফট করতে দেখে সে নিজের ব্যথা ভুলে গেল। অতলের কাঁধ ঝাঁকিয়ে প্রশ্ন করল,’কী হয়েছে তোর? খারাপ লাগছে?’

আয়মান দিশেহারা হয়ে পড়েছে। কী করবে বুঝতে পারছে না! অতল হুট করে মেঝেতে বসে পড়ল। নিজেকে শান্ত করছে সে। প্রাণপণ চেষ্টা করছে নিজের কষ্টকর অনুভূতি থেকে রেহাই পেতে। বেশ কিছুক্ষণ পর চোখ দুটো মেলল সে। আয়মানকে বিচলিত হতে দেখে বলল, ‘আমি ঠিক আছি। আমার কিছু হয়নি।’

আয়মানের গালের একপাশে ফুলে গেছে। অতলের এবার খুব খারাপ লাগছে। সমব্যথী গলায় বলল, ‘খুব ব্যথা পেয়েছিস তাই না? অয়েন্টমেন্ট লাগিয়ে নিস। ব্যথা কমে যাবে।’

‘আরেহ্ ! ও কিছু না। সেরে যাবে।’ নিজের গালে হাত রাখল আয়মান। ব্যথায় ছোট্ট একটা শব্দ ‘আহ্’ তার নিজের অজান্তেই বেরিয়ে আসল।

‘চল তোকে ডিসপেন্সারিতে নিয়ে যাই।’

‘লাগবে না দোস্ত। আমি বাসায় গিয়ে লাগাব। এরকম মার তো তুই আমাকে প্রথম মারিসনি।’ হাসতে হাসতে বলল সে, ‘তবে এবারেরটা জব্বর মেরেছিস। আল্লাহ জানে রাতের খাবার খেতে পারব কি না! চোয়াল তো দারুণ ব্যথা হয়ে গেছে।’

‘আর কখনও ওই কথাটা মুখ দিয়ে বের করবি না।’

আয়মান প্রথমে বুঝতে না পেরে সবিস্ময়ে তাকিয়ে ছিল অতলের দিকে। পরক্ষণেই মাথায় আসলো ব্যাপারটা। জবাবে কিছুই বলল না সে। মনে মনে বলল, ‘কী এমন ভুল বলেছি আমি! সত্য কথা বললেই মার খেতে হয়। ভালোমানুষির দাম নাই।’

‘স্যরি দোস্ত। রাগের মাথায় তোকে আঘাত করে ফেললাম। খুব স্যরি।’

‘আরেহ্ সমস্যা নাই। মাফ করে দিলাম এবারের মতো।’

অতল আয়মানের কাঁধে হাতটা রেখে বলল, ‘থ্যাঙ্কস দোস্ত। ইউ আর রিয়েলি গ্রেট।’

‘সম্বোধনটা তোর মুখ থেকে ঠিক মানাল না।’ মুখ বেঁকিয়ে বলল আয়মান।

‘মার খাওয়ার পরেও তোর অভ্যাস গেল না।’ অতল মৃদু হাসতে হাসতে বলল।

‘বদলাবেও না। অন্তত তোর ক্ষেত্রে না।’ অতলের কাঁধে একটা হাত রেখে বলল, আয়মান ।

‘হয়তো।’ অতল বলল অন্যমনস্কভাবে ।

___________________

#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফাতিমা_আক্তার_অদ্রি
পর্ব-১৬

এ যেন কোনো এক শুভ্রতার রাজ্য! পেজা তুলো শুভ্র নীরদ আকাশের বুকে ভেলার ন্যায় ভেসে বেড়াচ্ছে ।ছোঁয়া নিজেকে সেই শুভ্রতার রাজ্যে আবিষ্কার করল। চারিদিকে শুভ্র কাশফুল ছেয়ে রয়েছে। শীতলতা প্রদানকারী হাওয়ায় দোল খাচ্ছে কাশফুলগুলো। একটু আলতো পরশ বুলিয়ে দিলো আদুরে ভঙ্গিতে দুলতে থাকা শুভ্র ফুলগুলোকে। বিকেলের মিষ্টি রোদ মরে শেষ বিকেলের ছায়া পড়তে শুরু করেছে। ছোঁয়া এমন এক অপার্থিব সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়ে মোহাবিষ্ট হয়ে গেছে। পিটপিট করে চোখ মেলে দূর থেকেই দেখতে পেলো সাদা শার্ট পরিহিত একটা ছেলেকে। আনমনে চেয়ে আছে সে স্রোতস্বিনীর নীল রঙা জলের পানে। গোধূলি লগ্নের লালিমা আবির্ভূত হতে হতে এক রহস্যাবৃত সৌন্দর্যের চাদর জড়িয়ে দিচ্ছে একটু একটু করে।

ছেলেটা কে তা জানার জন্য মনের মধ্যে এক তীব্র আকাঙ্ক্ষা অনুভব করল ছোঁয়া। মনটা ভীষণ উদগ্রীব হয়ে আছে তার। হাঁটতে লাগল ছেলেটার উদ্দেশে, তাকে দেখার তীব্র আকাঙ্ক্ষা নিবারণের নিমিত্তে। যতই কাছে যাচ্ছে মনে হচ্ছে দূরত্ব ততই বাড়ছে। অথচ স্থির, মোহগ্রস্তের মতোই দাঁড়িয়ে আছে ছেলেটি। তার অন্য কোনো দিকে মনোযোগ নেই। রংহীন জলের উপর আকাশের নীল রাজত্ব করছে। আর সেই নীলেই যেন হারিয়ে গেছে শুভ্রতার আবেশে মোড়ানো ছেলেটা। ছোঁয়াও নিজেকে এক মোহাবিষ্ট মানবীরূপেই আবিষ্কার করল।

হঠাৎ ছেলেটার পাশে পৌঁছাতেই ছোঁয়া নিজের মধ্যে এক অন্য রকম অনুভূতি খুঁজে পেল। পেছন থেকে সে দারুণভাবে উপলব্ধি করতে পারছে, এই ছেলেটা তার ভীষণ আপন, ভীষণ চেনা, যেন জন্ম-জন্মান্তরের পরিচয় তার সাথে। আচমকা ছেলেটা তার দিকে ফিরে তাকাল, স্মিত হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে, চোখে মুখে মুগ্ধতার রেশ নিয়ে। হাওয়া যেন থমকে দাঁড়াল ঠিক তখনই । বাতাসের গুনগুন শব্দটা প্রকট আকার ধারণ করল আচমকা। যেন কোনো এক বাদ্যমানব ভীষণ ভালোবেসে বাদ্য বাজাচ্ছে আপনমনে। এক অবর্ণনীয় স্নিগ্ধ অনুভূতি ছড়িয়ে দিলো দুটো হৃদয়ে, একই সাথে, একই সময়ে। দু’জন হারিয়ে গেল দু’জনার চোখের তারায়। দু’জোড়া চোখ এক হলো মুহূর্তেই। ধূসর চোখ জোড়া ডুবে গেল হালকা সবুজাভ চোখের মধ্যে নিমিষেই। আচমকা সেই সবুজাভ চোখের অধিকারী ছেলেটি একটা হাত বাড়িয়ে দিল ছোঁয়ার দিকে। আলতো স্পর্শে তার একটা হাত নিলো নিজের হাতের মুঠোয়। ছোঁয়া মোহাবিষ্টের মতো নিজের হাতটা তার সেই হাতের মুঠোয় আবদ্ধ হতে দেখতে থাকল। তারপর কিছুক্ষণের নীরবতা। মনে হলো যেন নীরবতা কথা বলছে। সবুজাভ চোখের অধিকারী ছেলেটা মৃদু ঠোঁট নেড়ে কিছু একটা বলতে শুরু করেছে, ‘আর একটু অপেক্ষা করতে পারবে না?’ ভ্রু জোড়া কুঁচকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়েই রইল তার দিকে, উত্তরের অপেক্ষায়

ছোঁয়া ছলছল চোখে মাথা দুলাল উপর নিচে। চোখের কোণে মুক্তোর কণা সগর্বে স্থান করে নিয়েছে। কেবল গড়িয়ে পড়ার অপেক্ষা। সহসা ছেলেটি নিজ হাতে মুছে নিলো সেই মুক্তো কণা। গম্ভীর স্বরে বলল, ‘ওই চোখের তারায় কেবল আমারই বসবাস।’ একটা মুক্তো কণা হাতের তর্জনীর মাথায় নিয়ে বলল,’ওতে এদের আনাগোনা নিষিদ্ধ। ফের যেন না দেখি এদের এই দৃষ্টিতে!’

চকিতে অভিযোগ দেখা দিলো ছোঁয়ার কণ্ঠে, ‘আর কত অপেক্ষা করতে হবে আমায়?’

সবুজাভ চোখ জোড়ায় দেখা দিলো স্মিত হাসি। আশ্বস্ত করার সুরে বলল, ‘অপেক্ষার ফল যে বড্ড মিষ্টি হয় ।’

এবার ছোঁয়া যেন নিজেকে আর ধরে রাখতে পারল না। কান্নার সুরে বলল ছোঁয়া, ‘আর অপেক্ষা করতে চাই না। এখনই চাই। একটু তেতো হলেও চলবে।’

জবাবে ছেলেটা মুষ্টিবদ্ধ হাতের বাঁধন আরও শক্ত করল। দিলো ভরসা, বিশ্বাস আর ভালোবাসার প্রতিশ্রুতি। ছোঁয়া আবারও অধর জোড়া ফাঁক করল কিছু একটা বলতে কিন্তু ততক্ষণে শুভ্র ছেলেটা ক্রমেই অস্পষ্ট হচ্ছে চোখের দৃশ্যপট থেকে। ছোঁয়ার ভীষণ খারাপ লাগছে। এবারও কি ছেড়ে চলে যাবে? এমন কেন করে বারবার! কেন বুঝে না এই ছেলেটা তার মনের আকুতি, আক্ষেপ আর অপেক্ষায় অন্তর্দহনের ব্যথা। ব্যথাতুর কণ্ঠে আর্তনাদ করে চিৎকার করে বলল ছোঁয়া, ‘যেও না। এবার অন্তত যেও না আমাকে ছেড়ে। প্লিজ, যেও না।’

শুভ্র ধোঁয়ার আড়ালে হারিয়ে যাচ্ছে ছেলেটা। তার অবয়ব ক্রমশ অস্পষ্ট হচ্ছে। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তার। ছোঁয়া সবুজ ঘাসের উপর ধপাস করে শব্দ করে বসে পড়ল। বিড়বিড় করে বলতে লাগল, ‘শিহরণ! যেও না। প্লিজ, আমাকে ছেড়ে যেও না।’

‘ছোঁয়া! এই ছোঁয়া! আজকে কি সকাল হবে না তোর? কাকে যেতে নিষেধ করছিস?’

ছোঁয়া লাফ দিয়ে উঠে বসল বিছানায়। ভূতগ্রস্তের মতো দেখাচ্ছে তাকে। ঘেমেনেয়ে একাকার সে। চোখের পলক ফেলছে নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে। ফাহমিদা বেগম তার পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘কী হয়েছে মামণি? স্বপ্ন দেখেছিস না-কি?’

ছোঁয়া জবাবে কিছুই বলছে না। যেন সে নিজেকে এখনও ধাতস্থ করতে পারেনি। আবার স্বপ্ন দেখাটা শুরু হয়ে গেল। একটু ভাবনা, একটু দর্শন দীর্ঘ সময়ের স্বপ্নরূপে ধরা দেয় স্বপ্নরাজ্যে। কেন এমন হয় তার ব্যাখ্যা আছে। এই ব্যাখ্যাটা পৃথিবীর সহজ বিষয়গুলোর মধ্যে সহজতর। এই বিষয়টা বুঝার জন্য সাইকোলজিক্যাল ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই।

ফাহমিদা বেগম সাইড টেবিলের উপর রাখা জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে এগিয়ে দিলেন ছোঁয়ার দিকে। বললেন, ‘পানিটা খেয়ে নে। ভাল লাগবে।’

ছোঁয়া পানির গ্লাসটা কাঁপা কাঁপা হাতে নিয়ে ঢকঢক করে সবটা পানি খেয়ে ফেলল একসাথে। ফাহমিদা বেগম চিন্তিত সুরে বললেন, ‘ভয়ংকর কিছু দেখেছিস? এত ভয় পেয়েছিস কেন? কাকে দেখেছিস স্বপ্নে?’

ছোঁয়া একটু ধাতস্থ হয়ে দেওয়াল ঘড়িটার দিকে একপলক তাকিয়ে দেখতেই তার টনক নড়ল। আটটা বেজে গেছে। তার অফিসে যেতে হবে। শপে যাওয়ার দরকার। অথচ সে আজ ঘুম থেকে উঠতেই খুব দেরি করে ফেলেছে। সব শিহরণের দোষ। ঘুমের মধ্যে এসেও তাকে কষ্ট দেয় । একটা স্টুপিড সে। তাকে সবসময় অপেক্ষা করায়। অপেক্ষা করাতেই যেন তার ভীষণ আনন্দ। ব্যস্ত গলায় বলল, ‘মা! তেমন কিছু না। আমি ফ্রেশ হয়ে নিচ্ছি। তুমি নাস্তা দাও। আজ ঘুম থেকে উঠতে খুব দেরি হয়ে গেল।’

ওয়াশরুমে ঢুকতে ঢুকতে অভিযোগের সুরে বলল, ‘এত বেলা হয়ে গেছে তুমি আমাকে ডাকোনি কেন মা?’

‘কী বলছিস এসব?’ ভীষণ আবাক হয়ে বললেন, ফাহমিদা বেগম, ‘হিয়া ডেকে গেল। তারপর আমি ডাকলাম। অথচ আজ তোর কোনো খবরই হলো না।’

মায়ের কথা শুনে ছোঁয়ার পিলে চমকানোর মতো অবস্থা। সে বুঝতে পারছে রাইয়ান আহমেদ শিহরণের জন্য তার আজকের এই অবস্থা। শাওয়ার ছেড়ে দিয়ে মনে মনে ভাবল সে, ‘জনাব শিহরণ, কাজটা আপনি ভালো করেননি। তমসাময় যামিনীতেও আপনি আমাকে একা ছাড়েন না। অথচ দিবসের রঙিন আলোয় বড্ড অপরিচিত। হুহ্! এটা তো অন্যায় জনাব।’

নিজের ভাবনাতে নিজেই চমকাল। ভাবল, ‘তুমি আমার কে বলতো? কেউ না, কিচ্ছু না।’ আনমনেই ভেতর থেকে একটা বলিষ্ঠ ও দৃঢ় আওয়াজ বেরিয়ে এলো, ‘অথচ সবকিছু । কেন এমন বল তো?’

হিয়া এসে ধুপধাপ করে ওয়াশরুমের দরজা ধাক্কাচ্ছে আর বলছে, ‘ছোঁয়াপু! তাড়াতাড়ি বের হও। সাইফ ভাইয়া এসেছে।’

ছোঁয়া তার ভাবনার জগত থেকে বেরিয়ে এসে বলল, ‘আসছি। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই আসছি।’

আজ আবহাওয়া দারুণ। বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে একটা মিষ্টি ফুলের ঘ্রাণ। বাইকের পেছনে বসে সেই মিষ্টি ঘ্রাণে প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিচ্ছিল সে। বাতাসে কীসের যেন একটা সুর ভেসে বেড়াচ্ছিল। ছোঁয়ার মনে হলো সেই সুর ওকে কিছু একটা বলছে কানে কানে, চুপিসারে, খুব গোপনে। ছোঁয়ার অফিসের সামনে যেতেই সাইফ বাইক থামাল। ছোঁয়া নেমে গেল। সাইফ তার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, ‘আজ কিন্তু তোকে শপে আসতেই হবে। মাস শেষ হতে চলেছে। কিছু হিসাব নিকাশ না দেখালেই নয়। কর্মচারীদের পেমেন্ট আর আগামী মাসের ইনগ্রেডিয়েন্টস কেনার ব্যাপারটাও তো দেখতে হবে। তাই না?’

‘ওকে সাইফু! তোকে এসব নিয়ে ভাবতে হবে না একদম। আমি ঠিক সময়েই হাজির হয়ে যাব।’ ছোঁয়া আশ্বস্ত করল।

‘তাহলে কি আমি এখন যেতে পারি রাজকন্যা?’ সাইফ বিশেষ কায়দায় বলল।

ছোঁয়া প্রত্যুত্তরে হাসল। কোনো জবাব দিল না। সাইফ বাইকে স্টার্ট দিয়ে সহাস্যে পুনরায় বলল, ‘তো বিকেলে দেখা হচ্ছে। এখন গেলাম।’

কাচের জানালা ভেদ করে এক জোড়া চোখ ওদের দেখছিল। ভীষণ রেগে যাচ্ছিল সে। হাতটা মুষ্টিবদ্ধ করে নিল। রাগ উঠছে তার। ছোঁয়ার ব্যাপারে এতটা পজেজিভ কেন সে নিজেই বলতে পারে না। একটা মাত্র মেয়ের জন্য সে তার নিজের মধ্যের সমস্ত নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে মুহূর্তেই। অন্য কারো সাথে এই মেয়েটাকে সে সহ্য করতে পারে না। বিশেষ করে সেই মানুষটা যদি এই বিশেষ মেয়েটার প্রতি আগ্রহী হয়ে থাকে তো আর কোনো কথাই নেই। তার রাগের মাত্রা আগ্রহের সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়ে যায়। নিজেকে শান্ত করল এই বলে যে, ‘আর মাত্র কিছুদিন! তার পরেই ছোঁয়া তোর, সারাজীবনের জন্য। তখন তার উপর সমস্ত অধিকার কেবল এবং কেবলই তোর, শিহরণ।’

এই কথাগুলো ম্যাজিকের মতো কাজ করল। তার রাগ উবে গেল। পেশীগুলো রিল্যাক্সড হয়ে গেল তৎক্ষনাৎ। মেজাজের সাথে পাল্লা দিয়ে মনটাও ফুরফুরে হয়ে গেল মুহূর্তেই। দারুণ একটা ট্রিক পেয়ে নিজেকে নিজেই বাহবা দিলো সে।
_______________________

অফিসে ঢুকতেই সোজা নিজের ডেস্কে চলে গেল ছোঁয়া। প্রয়োজনীয় ফাইল হাতে নিয়ে শিহরণের কেবিনের দিকে এগিয়ে গেল। হঠাৎ সে উপলব্ধি করল, তার বুকটা ধুকুপুক করছে, দ্রিম দ্রিম আওয়াজ বেরিয়ে আসছে নির্নিমেষ। এটা কি তবে স্বপ্নের ফল। এতটা নার্ভাস তো সে এত বছর পরে শিহরণের সাথে দেখা হওয়ার সময়েও ছিল না। তবে আজ এতটা নার্ভাস কেন? দরজার নবে হাত রাখতেই হঠাৎ তার মনে হলো সে কাঁপছে। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কয়েকবার লম্বা লম্বা শ্বাস নিলো সে। তারপর দরজায় নক করতেই ভেতর থেকে গম্ভীর অথচ বলিষ্ঠ ঝংকারের ন্যায় একটা শব্দ ভেসে এলো, ‘কাম ইন।’

ছোঁয়া ভেতরে ঢুকেই শিহরণের টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। হাতের ফাইলগুলো তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘এতে আপনার প্রয়োজনীয় সব তথ্য আছে।’

শিহরণ ল্যাপটপে কাজ করছিল তখন। ছোঁয়ার দিকে না তাকিয়েই ফাইলগুলো হাতে নিল। তারপর কয়েক মুহূর্ত অতিক্রম হয়ে গেল। ছোঁয়ার রীতিমতো আপমানজনক মনে হচ্ছে। তাকে বসতেও বলছে না আবার যেতেও বলছে না। তাই সে একটু কঠিন গলায় বলল, ‘স্যার আমি কি চলে যাব?’

শিহরণ এবার চোখ তুলে তাকাল। গলায় কাঠিন্য এনে বলল, ‘না!’ পরক্ষণেই কিছুটা কৌতুক মেশানো কণ্ঠে বলল, ‘আরে আপনি দাঁড়িয়ে কেন? বসুন।’

ছোঁয়া গভীর আক্ষেপ নিয়ে মনে মনে বলল, ‘আহা! কী পরিমাণ ফরমাল! আমরা তো পরিচিত না-কি এত ফরমালিটির কী আছে বুঝতে পারছি না।’

ভেতরের আক্ষেপ লুকিয়ে মুখে বলল, ‘আপনিই তো বসতে বলেনি।’ কণ্ঠে নিজের ভেতরের সমস্ত বিরক্তি ঢেলে দিয়ে বলল, ‘বসতেও বলছেন না আবার যেতেও বলছেন না। অফিসের বস হওয়ার এই এক সুবিধা। আর এমপ্লয়ি হওয়ার এটা একটা অসুবিধা।’

‘আপনি রেগে যাচ্ছেন! রাগতেও পারেন? জানা ছিল না।’ শিহরণ ঠোঁট টিপে হেসে বলল। এটা ছোঁয়ার চোখ এড়াল না। সে দ্বিগুণ রেগে গেল। বলল, ‘আমার মনে হয় ফাইলগুলোই আপনার কাজের জন্য যথেষ্ট। আমার কোনো প্রয়োজন নেই। তাহলে আমি আজ উঠছি।’

‘আপনাকেই তো সবথেকে বেশি প্রয়োজন আমার।’ শিহরণ নিজেকে সংশোধন করে আবার বলল, ‘ফাইলের তথ্যের ক্লারিফিকেশনের জন্য।’

ছোঁয়া একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করল কেন সে আগে আগে সব ভেবে নেয়। কেন সে এমন একজন মানুষকে পছন্দ করে যে তার একদম পরোয়া করে না। কেন নির্বিকার, এই ছেলেটা। আর সমস্ত নির্বিকারহীনতা পুরস্কার স্বরূপ সেই যেন বিধাতার নিকট থেকে পেলো!

শিহরণ বুঝতে পারছে ছোঁয়ার মানসিক দ্বন্দ্ব। ছোঁয়াকে অবাক করে দিয়ে সে বলল, ‘কাউকে বকছেন?’

ছোঁয়া থতমত খেয়ে গেল। বলল, ‘না! কী যে বলেন? কাকে বকতে যাব আমি?’

‘এই ধরুন আমাকে।’ শিহরণ হাসল, সাথে তার চোখ দুটোও হেসে উঠল।

এই দৃশ্যটা ছোঁয়াকে প্রশান্তি দিলো। ভীষণ ভালো লাগল তার। কতদিন পর! ধুর! কত বছর পর হাসতে দেখল তার প্রিয় মানুষটিকে। হাসলে কত সুন্দর দেখায় তাকে অথচ সবসময় রোবটের মতো ফেসিয়াল এক্সপ্রেশন করে রাখে। যেন হাসলে ট্যাক্স গুণতে হব!

ছোঁয়া বলেই ফেলল, ‘হাসবেন সবসময়। হাসলে আপনাকে ভাল লাগে। তাছাড়া হাসতে কোনো প্রকার ট্যাক্স গুনতে হয় না কিন্তু!’

শিহরণ চমকাল খানিক। কেশে উঠল সে। ছোঁয়া হন্তদন্ত হয়ে পানির গ্লাসটা এগিয়ে দিলো তার দিকে। শিহরণ এক চুমুক পানি খেল। ছোঁয়া খানিক ব্যঙ্গ করে বলল, ‘সত্য কথা শুনলেই আপনি এত চমকে যান কেন সবসময় ? সত্যকে স্বাভাবিকভাবেই গ্রহণ করতে শিখুন।’
___________________

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে