ছোঁয়ার শিহরণ ২য় খন্ড পর্ব-১০+১১

1
1991

#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফাতিমা_আক্তার_অদ্রি
পর্ব-১০

বহ্নি জাফরানি রঙের শাড়ি পরেছে। একদম পুতুলের মতো আদুরে লাগছে তাকে। সাবিহা সাবরিন মেয়ের রুমে ঢুকে তাকে দেখেই মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে উৎফুল্ল কণ্ঠে বললেন, ‘আমার পরীটাকে তো একদম সত্যিকারের পরীর মতো লাগছে।’

‘আম্মু!’ বহ্নি ভ্রু উঁচিয়ে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, ‘সত্যি বলছ?’

তিনি মুহূর্তেই চোখের কোণা থেকে কাজল নিয়ে বহ্নির কানের পেছনে লাগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘কারো যেন নজর না লাগে আমার মেয়েটার উপর।’ খানিক সময় মুগ্ধ চোখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে থেকে তারপর বললেন, ‘মিথ্যে বলব কেন? মিথ্যে বলার তো কোনো প্রয়োজন নেই। আমার মেয়েটা হচ্ছে ডানাহীনা পরী।’

শিহরণ ঠিক তখনই বহ্নির রুমে আসলো। এসেই বুকের উপর দু’হাত ভাজ করে চুপ করে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল। বহ্নি তাকে দেখেই বলল, ‘কী রে ভাইয়া! তুমি এভাবে স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছ কেন?’

শিহরণ ড্রেসিং টেবিলের উপরে রাখা বেলি ফুলের মালাটা খুব সন্তর্পণে নিয়ে বহ্নির চুলে লাগিয়ে দিল। তারপর সহাস্যে বলল, ‘এখন সত্যিকারের পরীর মতো লাগছে আমার পিচ্চি বোনটাকে।’ তারপর ভ্রু কুঁচকে কপট হতাশ গলায় বলল, ‘কেবল ডানার অভাব। সমস্যা নেই। ওটারও ব্যবস্থাও করে ফেলব।’

‘ভাইয়া?’ বহ্নি চোখ বড়ো বড়ো করে বলল, ‘তুমি সুযোগ পাওয়া মাত্রই শুরু করে দাও। এটা কিন্তু একদম ঠিক না। আম্মু ভাইয়াকে কিছু বলো।’

সাবিহা সাবরিন শব্দ করে হাসলেন। শিহরণের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, ‘আমার আব্বুটা ভুল কিছু তো বলেনি।’

‘আচ্ছা চল তোকে ভার্সিটিতে নামিয়ে দিই। আমি তো অফিসে যাচ্ছি। তোকে নামিয়ে দিয়ে তারপর অফিসে যাব।’

‘ঠিক আছে ভাইয়া।’ বহ্নি সম্মতি জানাল।

সাবিহা সাবরিন, শিহরণ আর বহ্নি ড্রইংরুমে আসতেই মিষ্টি মৃদু চিৎকার করে বলল, ‘ও আল্লাহ্! আপু গো তোমাকে কী যে সুন্দর লাগতেছে! আমি ভাষা হারিয়ে ফেললাম।’

‘তোকে ভাষা হারানো অবস্থাতেই ভালো লাগে। দোয়া করি তুই যেন তোর ভাষা কখনো খুঁজে না পাস।’ বহ্নি বলল, মৃদু কৌতুকের স্বরে।

ঠিক তখনই কলিং বেল বেজে উঠল। সাবিহা সাবরিন মিষ্টিকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘মিষ্টি দেখ তো কে এসেছে।’

মিষ্টি পা বাড়ায় দরজা খোলার জন্য। দরজা খুলতেই মান্নাতকে দেখতে পেল। মান্নাত মিষ্টিকে ধমকে বলল, ‘এত দেরি করিস কেন দরজা খুলতে? যত্তসব গেঁয়ো ক্ষ্যাত।’

মিষ্টিকে পাশ কাটিয়ে মান্নাত ভিতরে ঢুকে পড়ল। মিষ্টি দরজায় দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করে বলতে লাগল, ‘দরজা খুলতে দেরি করলাম কখন? বেল বাজার সাথে সাথেই তো দরজা খুললাম।’

সাবিহা সাবরিন মান্নাতকে দেখে খুব খুশি হলেন। মৃদু হেসে বললেন, ‘আরেহ্! মান্নাত মামণি তুমি এসেছ? অনেকদিন পরে এলে। এসো, নাস্তা করতে বসো।’

‘জি, আন্টি। একটু ব্যস্ত ছিলাম তাই আসা হয়নি।’ মান্নাত একটা চেয়ার টেনে বসতে বসতে শিহরণ ও বহ্নির দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,
‘কোথায় যাচ্ছ তোমরা?’।

বহ্নি বলল, ‘আমার ভার্সিটিতে আজ নবীনবরণ অনুষ্ঠান। নবীনদের বরণ করার দায়িত্ব পড়েছে আমাদের উপর। তাই সেখানেই যাচ্ছি।’

‘বাহ্! দারুণ তো।’ প্রচণ্ড উৎসাহ ভরা কণ্ঠে বলল মান্নাত।

‘আম্মু!’ শিহরণ মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আব্বুকে দেখছি না যে?’

সাবিহা সাবরিন আলুর পরোটা ছিঁড়তে ছিঁড়তে বললেন, ‘তোর আব্বু নাস্তা করে অফিসে চলে গেছে। তোকে নতুন অফিসে যেতে বলেছে।’

‘জি, আম্মু।’ শিহরণ কফির মগে শেষ চুমুক দিয়ে বলল, ‘আমি ওখানেই যাব।’

নাস্তা খাওয়া শেষে শিহরণ আর বহ্নি উঠে দাঁড়াল। সাথে সাথেই মান্নাত বলল, ‘আমিও যাব তোমাদের সাথে।’

শিহরণ প্রচণ্ড বিরক্তবোধ করল। মৃদু তিরস্কারের সুরে বলল, ‘আমরা তো ওখানে বেড়াতে যাচ্ছি না। আমি যাব অফিসে আর বহ্নি ওর ভার্সিটিতে।’

সাবিহা সাবরিন আদেশের সুরে বললেন, ‘নিয়ে যা না ওকে তোদের সাথে। নিয়ে গেলে তো আর কোনো সমস্যা নেই।’

শিহরণ চুপসে গেল। মৃদু স্বরে বলল, ‘ঠিক আছে আম্মু।’

শিহরণ ড্রাইভিং সিটে বসল। মান্নাত ওর পাশে বসতে চাইতেই বলল, ‘এখানে বহ্নি বসবে।’ বহ্নিকে ডেকে বলল, ‘কাপকেক! তুই আমার পাশে বসবি।’

বহ্নি ঝামেলা এড়াতে বলল, ‘থাক না ভাইয়া। মান্নাত আপু যখন বসতে চাইছে বসুক না।’

‘বহ্নি!’ শিহরণের গলা খানিক চড়ে গেল। নিজেকে সংযত করে ঠান্ডা গলায় বলল, ‘বসতে বলেছি যখন বসতেই হবে।’

অগত্যা বহ্নিকে সামনের সিটে বহতেই হলো। মান্নাত পেছনের সিটে বসে প্রচণ্ড শব্দ করে গাড়ির দরজা বন্ধ করল। বিড়বিড় করে বলল, ‘ভাই-বোনের এত ঢং দেখে আর বাঁচা যায় না। তোমার সাথে আমার বিয়ে হলে তখন কী করো দেখব! তারপর তো তোমার পাশের সিটেই আমাকে বসাতে হবে। এই সবকিছুর শোধ নেব তখন।’

মান্নাতের এরকম জেদ পূর্বক গাড়ির দরজা আটকানোর কারণ শিহরণের কাছে অস্পষ্ট নয়। সে মনে মনে বলল, ‘ তোমার ইচ্ছে অপূর্ণই থাকবে মান্নাত। কিছু ইচ্ছে কখনোই পূর্ণ হবার নয়। তা পূরণ করার স্বার্থে তুমি যাই করো না কেন সবকিছুই ভেস্তে যাবে।’

_____________________________

আফরিনের মেজাজটা প্রচণ্ড খারাপ হয়ে গেছে। তার মা তার সাথে এসব কী শুরু করেছে, সে নিজেই বুঝতে পারছে না। ঘরের মধ্যে সে পায়চারি করছে আধ ঘণ্টা যাবৎ। মোবাইলটা ক্রমাগত বেজে চলেছে । কিন্তু সে রিসিভ করছে না। নীলাভ্র কল করছে। কিন্তু আজ তার মেজাজের সাথে সাথে মনটাও খারাপ হয়ে গেছে। আধ ঘন্টা ধরেই কল করছে নীলাভ্র। শেষমেশ বিরক্ত হয়ে কল রিসিভ করল। ওপাশ থেকে উৎকণ্ঠা মিশ্রিত কণ্ঠে নীলাভ্র বলল, ‘কী হলো আফরিন? তুমি কল রিসিভ করছ না কেন?’

‘ইচ্ছে হয়নি আমার তাই করছি না।’ দায়সারাভাবে বলল, আফরিন।

‘ইচ্ছে হয়নি মানে কি?’ নীলাভ্র জেদী কণ্ঠে জানতে চাইল।

‘ইচ্ছে হয়নি মানে, হয়নি। তোমাকে যখন বলি আমাদের ব্যাপারে তোমার বাবা-মাকে বলতে তখন তো তুমি ভাজা মাছটাও উল্টে খেতে পারো না। তখন তোমার তাদের কিছুই জানাতে ইচ্ছে করে না। তোমার বাবাকে তুমি বাঘের মতো ভয় পাও। আমিও খুঁজে খুঁজে একটা ভীতুর ডিমের সাথে প্রেম করে বসলাম।’ আফরিন একসাথে এত কথা বলে হাঁপাতে লাগল।

‘আশ্চর্য ব্যাপার! তুমি কোথা থেকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ ব্যাপারটা? কি হয়েছে তা তো বলো?’ নীলাভ্র উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলল।

‘কী আবার হবে? আমার কি কিছু হতে পারে?’ আফরিনের একগুঁয়ে উত্তর।

‘কী আশ্চর্য! বলো তো কী হয়েছে?’

‘মা আমাকে বিয়ে দিবে বলছে।’

‘বিয়ে? এত তাড়াতাড়ি! কেন?’

‘তা তুমি আমার মায়ের কাছ থেকে জেনে নিও।’ আফরিন দাঁতে দাঁত চেপে বলল।

‘আশ্চর্য!’ নীলাভ্র ভ্যাবলাকান্তের মতো করে গলার স্বর খাদে নামিয়ে প্রশ্ন করল, ‘আমি কি তোমার আম্মুর সাথে কথা বলি যে জানতে চাইব?’

‘এখন কথা বলো না তো কী হয়েছে? কথা কি বলবে না?’ আফরিনের গলা চড়ে যাচ্ছিল।

‘বলব। সময় হলেই বলব।’ প্রশান্ত কণ্ঠে বলল, নীলাভ্র।

‘কখন সময় হবে তোমার?’ চেঁচিয়ে প্রশ্ন করল, আফরিন।

নীলাভ্র চুপ। কোনো কথাই বলছে না। তার মনে হাজারো শঙ্কা। সে বাইরের কারো সাথে যতই কথা বলুক না কেন। বাবাকে তো প্রচণ্ড ভয় পায়। বাবার সামনে গেলেই তার অন্তরাত্মা শুকিয়ে যায়। মুখ দিয়ে কোনো কথাই বেরোতে চায় না। এতে সে কী করবে! সে তো আসহায়। একমাত্র বোনটাই কিছুটা কম ভয় পায় বাবাকে। নয়তো তারা দু’ভাই বাবাকে প্রচণ্ড ভয় পায়।

‘আচ্ছা, তুমি কি আমাদের কথা বলবে না বাসায়? নাহলে আমি বিয়েতে রাজী হয়ে যাব। এটাই তোমার জন্য লাস্ট ওয়ার্নিং, নীল।’ আফরিন কঠিন গলায় বলল।

‘আচ্ছা, বলব। আমি আব্বুর সাথে আজই কথা বলব।’ পরক্ষণেই কাঁচুমাচু হয়ে বলল,’আজ কি দেখা হবে, আফরু?’

আফরিনের রাগ তখনো পড়েনি। কিন্তু নীলাভ্র তাকে আফরু বলে ডাকলে সে ভেতর থেকে প্রচণ্ড রকমের দুর্বল হয়ে পড়ে। নীলাভ্রের মিষ্টি কথার জালে আটকে যায় মুহূর্তেই । সে জানে ছেলেটা ভীতু হলেও তাকে প্রচণ্ড ভালোবাসে। তাকে না করা তার জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। তাই আফরিন কিছুক্ষণ ভাবল। তারপর বলল, ‘দেখা হবে। মা যদিও আমাকে যেতে নিষেধ করেছে। তবুও আব্বুকে বলে ম্যানেজ করে নেব।’

নওশীন হকের কাছে গিয়ে দেখল তিনি চুলায় চা চড়িয়েছেন। রান্নাঘরের দরজায় বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল সে। তারপর মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে এটা ওটা এগিয়ে দিল সে। নওশীন হক বললেন, ‘এত খাতির কিসের জন্য সেটা বলে ফেল।”

‘আম্মু! এমনিতে কি আমি কোনো কাজ করি না?’

‘প্রশ্নটা বোধহয় নিজেকে করলেই বেশ ভালো একটা সাজানো গোছানো উত্তর পাওয়া যাবে।’ সোজাসাপ্টা উত্তর দিলেন নওশীন হক।

‘আম্মু….!’

‘কী বলতে এসেছ বলে ফেল।’

‘আমি একটু বাইরে যাব।’

‘বাইরে কোথায়?’ নওশীন হক অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে তাকালেন মেয়ের দিকে।

আফরিন গতকাল শুনেছিল নীরার ভার্সিটির নবীনবরণের কথা । তাই ঝটপট বলল, ‘নীরার ভার্সিটিতে যেতে চাইছি আম্মু। শুনেছি বেশ ভালো আয়োজন করবে এবার। তাই ওদের অনুষ্ঠান দেখতে ইচ্ছে করছে।’

নওশীন হক কী যেন ভেবে বললেন, ‘যেতে পারবে তবে একটা শর্ত আছে।’

‘কি শর্ত, আম্মু?’

‘তোমাকে সারাক্ষণ রাদিদ আর নীরার সাথে থাকতে হবে।’

আফরিন তৎক্ষনাত বলল, ‘ঠিক আছে।’
মনে মনে এই ভেবে খুশি হলো যে তার মা খুব সহজেই রাজী হয়ে গেল

____________________

নীরা রেডি হচ্ছিল ভার্সিটিতে যাওয়ার জন্য । লাল পাড়ের হলুদ জমিনের একটা শাড়ি পড়েছে সে। চুলে খুব সুন্দর করে খোপা করেছে। তাতে পেঁচিয়েছে রজনী ও গোলাপ ফুল দিয়ে তৈরী করা একটা সুন্দর গাজরা । শাড়ি পরা আর সাজগোজ শেষ হতেই সে রাদিদের রুমে হানা দিল। সকাল সকাল তাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলেছে সে। রাদিদকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘ভাইয়া! কেমন লাগছে বলো তো?’

‘সুন্দর লাগছে।’ হামি তুলতে তুলতে রাদিদ নির্বিকার উত্তর দিল।

‘এটা কি রকম কথা হলো? প্রশংসা করার ক্ষেত্রেও কিপ্টেমি! প্রশংসা করতে তো আর টাকা পয়সা খরচ করতে হয় না। একটু ঠিকমতো প্রশংসা করতেই পারো তোমার এই আদরের বোনটার।’ অভিযোগের সুরে বলল, নীরা।

‘খুব সুন্দর লাগছে। এবার ঠিক আছে?’ দায়সারাভাবে বলল, রাদিদ।

‘মনে হলো তোমার মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে আমি নিজের প্রশংসা শুনছি।’ নীরা হতাশ গলায় বলল।

‘আর কীভাবে প্রশংসা করব বল তো?’ অসহায় দৃষ্টিতে নীরার দিকে তাকাল রাদিদ।

‘এখন আমার জায়গায় যদি বহ্নি আপু হতো তাহলে তো ঠিকই কাব্যিক ভাষায় প্রশংসা করতে। হয়তো কয়েকখানা কবিতাও রচনা করে ফেলতে। আজ আমি তোমার বোন বলে…!’ নীরার কণ্ঠে গভীর আক্ষেপ।

প্রসঙ্গ পাল্টাতে রাদিদ ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলল, ‘ভার্সিটিতে যাবি তো না-কি? না গেলে আমি আজই বাসায় চলে যাব।’

‘না যাওয়ার কথা একদম ভাববে না।’ হুমকি দেবার ভঙ্গিতে বলল নীরা, ‘আমার সাথে তোমাকে যেতেই হবে।’

নীরা মনে মনে বলল, ‘দেখি আজ বহ্নি আপুকে দেখে তোমার রিয়েকশন কেমন থাকে!’

আফরিন হন্তদন্ত হয়ে এসে বলল, ‘এই তোরা যাওয়ার সময় আমাকে বলিস। আমিও যাব তোদের সাথে।’

রাদিদ ও নীরা কিছুটা অবাক হলো। নীরা অবাক হয়ে প্রশ্ন করল, ‘মা তো আজ তোমাকে ভার্সিটি যেতে নিষেধ করেছিল? এখন যেতে চাইছ যে? মা জানে তো তুমি যে যেতে চাইছ?’

‘তোকে আমি সবকিছু বলতে আমি বাধ্য নই। আর তুই এর প্রশ্ন করছিস কেন? তোকে কি সবকিছু বলতে হবে না-কি?’ গলার স্বর উঁচু করে বলল, ‘আমার যা ইচ্ছা তাই করব। তুই কে এসব জানতে চাওয়ার?’

আফরিনের এরকম আচরণে নীরা একদম অবাক হয়ে গেল। অবশ্য এরকম অবাক সে সবসময় হয়ে থাকে। একদম ঠান্ডা গলায় সে বলল, ‘আমি কেউ না?’

‘না!’ আফরিন অবিচলিত কণ্ঠে বলল, ‘আমাকে প্রশ্ন করার অধিকার আমি কাউকেই দিইনি।’

রাদিদের ভালো লাগছে না এসব। ঝামেলা দেখলে তার ভিতরে প্রচণ্ড রকমের অশান্তি শুরু হয়ে যায়। নিজের ভিতরে এক ধরনের শূন্যতা অনুভব করে সে। সে শূন্যতায় কেবল এবং কেবলই এক ধূ ধূ মরুভূমির উত্তপ্ত প্রান্তরের ন্যায় খা খা করে। সে প্রচণ্ড হতাশ হয়ে বলল, ‘আচ্ছা ঠিক আছে ডাকব।’

আফরিন আর দাঁড়াল না। ধুপ ধাপ করে যেমন হেঁটে এসেছিল তেমনি পায়ে হেঁটে চলে গেল।

নীরা, আফরিন আর রাদিদ বাসা থেকে বের হওয়ার সময় নওশীন হক বললেন, ‘রাদিদ , তোর বোনদের দেখে রাখিস। এমনিতেই দিনকাল খুব খারাপ যাচ্ছে। মেয়েরা ঘরের বাইরে থাকলেই মনটা আনচান করে। চিন্তার কারণে কোনো কাজে মন বসাতে পারি না।’

রাদিদ তার ফুফুকে আশ্বস্ত করতে বলল, ‘ঠিক আছে ফুফু। দেখে রাখব।’

ঠিক তখনই রাদিদের মোবাইলটা বেজে উঠল। স্ক্রিনের দিকৈ তাকাতেই নীলার নামটা ভেসে উঠল। রাদিদ ইশারায় আফরিন আর নীরাকে একটু অপেক্ষা করতে বলে কলটা রিসিভ করল। ফোনের ওপাশ থেকে উৎকণ্ঠা মিশ্রিত কণ্ঠ ভেসে এলো।

‘কেমন আছে আমার খোকাটা?’

‘আমি ভালো আছি আম্মু। তুমি কেমন আছ?’

‘আমিও ভালো আছি । আজ দুদিন ধরে কল করিসনি কেন? নাম্বারটাও অফ করে রেখেছিস। সত্যি করে বল তো কোনো অসুখ করেনি তো তোর ?’ খুব দুশ্চিন্তাগ্রস্ত শোনাল ফাইজা বেগমের কণ্ঠ।

‘না, আম্মু। আমি একদম ভালো আছি।’ মাকে আশ্বস্ত করতে দৃঢ় কণ্ঠে বলল রাদিদ। জ্বরের কথাটা ইচ্ছে করেই জানায়নি সে। জানালে প্রচণ্ড টেনশন করবে তার মা। সেটা তার কাছে অজানা নয়। তাই জ্বরের বিষয়টা চেপে গেল।

ফাইজা বেগমের কাছ থেকে নীলা মোবাইলটা নিয়ে বলল, ‘ফুফুর বাসায় গেলে তো আমাদের একদম ভুলেই যাস। পিউ তো তোর কথা বলতে বলতে আমাকে জ্বালিয়ে মারছে।’

রাদিদ মৃদু হাসল। বলল, ‘আমার লিটল চ্যাম্পকে দাও তো আপা।’

‘দিচ্ছি। না দিলে তো আজ সারাদিন আমার মাথা চিবিয়ে খাবে।’

পিউ পিচ্চি পিচ্চি হাতে মোবাইলটা ধরেই আদুরে গলায় বলল, ‘বড়ো মামা! কেমন আছ তুমি?’

‘আমি ভালো আছি, লিটল চ্যাম্প। তুমি কেমন আছ?’

‘বড়ো মামা! তোমাকে ছাড়া ভালো লাগছে না। তুমি কোথায় গিয়েছ? তাড়াতাড়ি চলে আসো না আমাদের কাছে।’

‘আমি খুব তাড়াতাড়ি চলে আসব, পিউ। তোমার জন্য কি আনব বলো তো?’

‘আমার জন্য…? বেশি করে চকলেট এনো। ঠিক আছে মামা?’

‘হ্যাঁ, একদম ঠিক আছে পাকনা বুড়ি।’ রাদিদ শব্দ করে হাসতে হাসতে বলল।

‘মামা! আমাকে বুড়ি বলবে না একদম। আমি এখনও ছোট্ট। ছোট্ট পিউ।’

দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে আফরিন বিরক্ত হয়ে যাচ্ছে। প্রচণ্ড বিরক্তি নিয়ে সে বলল, ‘এত কথা বললে তো আজ আমাদের যাওয়া হবে না। তাড়াতাড়ি কথা শেষ করো তো।’

রাদিদ তখন তাড়া দিয়ে পিউকে বলল,
‘আচ্ছা ছোট্ট রানি, এবার আপাকে দাও তো ফোনটা।’

‘আচ্ছা, দিচ্ছি।’

নীলা ফোন নিতেই বলল, ‘হ্যাঁ, ভাই বল।’

‘আপা, মাকে দেখে রেখো। সময়মতো ওষুধ খাইয়ে দিও। আর বাসার সবার খেয়াল রেখো।’

‘ঠিক আছে, ভাই। তোর এসব নিয়ে চিন্তা করতে হবে না।’

‘আচ্ছা, আপা। এখন রাখছি। পরে আবার কথা হবে। আম্মাকে টেনশন নিতে নিষেধ করিও।’

এটুকু বলেই রাদিদ কলটা কেটে দিল। তারপর আফরিন, নীরাকে নিয়ে ভার্সিটির উদ্দেশ্য রওনা হলো।

___________________________

শিহরণের গাড়িটা ভার্সিটির গেইটে পৌঁছাল। বহ্নি নেমে গেল সাথে সাথে। মান্নাত নামছে না দেখে শিহরণ প্রশ্ন করল, ‘কী ব্যাপার! তুমি নামবে না?’

মান্নাত বলল, ‘না। আমি তোমার সাথে যাব।’

‘আশ্চর্য!’ প্রচণ্ড বিরক্তিতে শিহরণের চোয়াল শক্ত হয়ে আসছিল। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,’আমি তো অফিসে যাব।’

‘আমিও তোমার সাথে তোমার অফিসেই যাব।’

‘ওটা কি ঘুরে বেড়ানোর জায়গা? এখানেই তো থাকতে পারো তুমি।’

বহ্নি বলল, ‘ভাইয়া। নিয়ে যাও তোমার সাথে।’

সায়মা, রিয়া আর তূর্ণ এসে দাঁড়ালো বহ্নির পাশে। রিয়া বলল, ‘হেই ক্রাশ ব্রো! হাউ আর ইউ?’

শিহরণ রিয়ার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল। বলল, ‘ফাইন। ইউ?’

রিয়া সে কথার উত্তর না দিয়ে বলল, ‘ভাইয়া! আজ এখানেই থাক না। খুব মজা হব। প্লিজ ভাইয়া।’

সায়মা রিয়ার একটা হাত খামচে ধরল। রিয়া উফ করে শব্দ করে উঠল। সায়মার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আপু! খামচি দিচ্ছিস কেন?’

সায়মা ইশারায় রিয়াকে থামতে বলল। রিয়া তা বুঝলই না। বরং শিহরণকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘ভাইয়া, গাড়িটা পার্ক করে এসো। আজ আমি তোমাকে আমাদের পুরো ক্যাম্পাস ঘুরিয়ে দেখাব।’

শিহরণ রিয়ার বাচ্চামি দেখে মনে মনে হাসল। বলল, ‘আপু, অন্যদিন দেখব । আজ একদম সময় নেই।’

শিহরণের না শুনে রিয়ার মন খারাপ হলো। খুব খারাপ হলো। মুখটা গোমড়া করে ফেলেছে সে মুহূর্তেই। তাই দেখে শিহরণ বলল, ‘সায়মা! রিয়াকে নিয়ে বাসায় এসো একদিন। এখন তো একদম বাসায় আসো না।’

সায়মা মৃদু হেসে বলল, ‘ঠিক আছে ভাইয়া। আসব আমরা।’

তূর্ণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল বহ্নির পাশে। শিহরণ তূর্ণকে আদেশের সুরে বলল, ‘হেই তূর্ণ! আমার বোনকে দেখে রাখবে। ওকে?’

বহ্নি কপট রাগ দেখিয়ে বলল, ‘ভাইয়া! আমি কি কোনো বাচ্চা মেয়ে যে আমাকে দেখে রাখতে হবে?’

শিহরণ একগাল হেসে বলল, ‘আমার কাছে তো আমার বোন এখনও পিচ্চি।’

পেছনে বসে বসে মান্নাত বিরক্ত হয়ে বিড়বিড় করে আবারো বলল, ‘একবার বিয়ে হোক তারপর দেখব এতো ভালোবাসা কীভাবে থাকে!’

তূর্ণ শিহরণকে আশ্বস্ত করে বলল, ‘ব্রো! নাউ ইটস্ মাই ডিউটি টু টেক কেয়ার অফ হার।’

শিহরণ প্রত্যুত্তরে হাসল। বহ্নি তাকে বিদায় দিল। শিহরণ আর দেরি না করে গাড়ি স্টার্ট দিল।

______________________

#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফাতিমা_আক্তার_অদ্রি

পর্ব-১১

অতলের জন্য সকালে বাবার সাথে নাস্তা করতে বসা মানে হলো অনুরোধে ঢেঁকি গেলার মতো ব্যাপার। বাবা খেতে খেতে হাজারো প্রশ্ন করে বসে তাকে। প্রতিদিন একই প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে সে ক্লান্ত, শ্রান্ত। তবুও উত্তর দিতে হয়। ভবিষ্যতেও দিতে হবে। না দেবার কোনো উপায় নেই। প্যান্টের পকেটে মোবাইলটা ক্রমাগত ভাইব্রেট হচ্ছে। ‘উম উম’ করে শব্দ হচ্ছে নিরবচ্ছিন্ন। সাইলেন্ট করেছিল সে কিন্তু সাইলেন্ট করতে গিয়ে ভাইব্রেশন চালু হয়ে গিয়েছে। তাড়াহুড়ো করলে যা হয় আরকি! সকালে নাস্তা করার সময় কল আসলে এক প্রস্থ বকাঝকা শুনতে হয় বাবার কাছ থেকে। সারা দুনিয়ার কাছে অতল খুবই সাহসী হলেও বাবার সামনে সে তো ভেজা বেড়াল। নাহ্! অতলের একদম ভালো লাগছে না নিজেকে বিড়ালের সাথে উপমা দিতে। কিন্তু সত্য তো সত্যই! অতল চাইলেও তা উপেক্ষা করতে পারবে না।

‘ভাইয়া! তোর কল আসছে মনে হয়।’ তানিয়া বলল, গলার স্বর খাদে নামিয়ে।

অতল বড়ো বড়ো চোখ করে তাকাল তার দিকে। যেন চোখ দিয়েই তাকে গিলে খাবে!

‘কী ব্যাপার!’ গমগমে গলায় বললেন আফজাল শেখ, ‘না খেয়ে বসে আছ কেন? খাবার খাওয়ার সময় এত ফিসফিসানি কিসের?’

অতল জানে এই সময় তাকে কেবল এক জনই কল দিতে পারে। আর সে হলো আয়মান। সে মনে মনে ইচ্ছেমতো গালাগাল করল আয়মানকে। তারপর একদম বাধ্য ছেলের মতো বাবার দিকে তাকিয়ে চোখের চশমাটা ঠিক করতে করতে সহাস্যে বলল, ‘খাচ্ছি আব্বু। তানিয়া ওর পরীক্ষার কথা বলছিল।’

অতলের মিথ্যা কথা শুনে তানিয়া অতলের হাতে খামচি দিল। অতল তা একদম গ্রাহ্য করল না।

‘খাবার খাওয়ার সময় এত কথা বলার দরকার নেই। চুপচাপ খাবার শেষ করো।’ আদেশের সুরে বললেন আফজাল শেখ।

আতিককে উদ্দেশ্য করে আফজাল শেখ আবারও বললেন, ‘তোমার বড়ো ভাইয়ের কাছ থেকে কিছু শিখ। দেখেছ কেমন চুপচাপ খাচ্ছে।’

আতিক অতলের দিকে তাকিয়ে চাপা হাসল। মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আম্মু! আর একটা পরোটা দাও তো।’

মেহেরুন নাহার আতিককে পরোটা এগিয়ে দিলেন। তারপর স্বামীকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘এবার একটু ঠিক মতো খেতে দেন তো আমার ছেলেটাকে।’

আফজাল শেখ আর কথা বাড়ালেন না। সবাই নীরবে খেতে লাগল। অতল মায়ের প্রতি মনে মনে ভীষণ কৃতজ্ঞ হলো।

নাস্তা শেষ করেই লাইব্রেরিতে চলে গেল অতল। আয়মানকে দেখতেই ক্ষেপে গেল। খ্যাপাটে গলায় বলল, ‘শালা! তুই কল করার আর টাইম পাস না। প্রতিদিন আমি নাস্তা করতে বসলেই তুই কল করিস। কোনোদিনই কি তোর আক্কেল হবে না।’

আয়মান ভারি অবাক হলো। তবে এটাও ঠিক যে অতল বেশ কয়েকবার তাকে নিষেধ করেছে সকালে নাস্তা খাওয়ার টাইমে কল না করতে। কিন্তু আয়মান সবসময় ভুলে যায়। সে কাঁচুমাচু হয়ে বলল, ‘স্যরি দোস্ত। দিস ওয়াজ দ্যা লাস্ট টাইম।’

অতল ঝাঁঝালো গলায় বলল, ‘এরকম লাস্ট টাইম তোর জীবনে ডেইলি আসে আর ডেইলি যায়।’

আয়মান অতলের হাত ধরে ফেলল। আকুতি ভরা কণ্ঠে বলল, ‘দোস্ত প্লিজ। তুই না আমার জিগরি দোস্ত। এবারের মতো ভুলে যা।’

অতলের অভিমানের পাহাড় গলতে শুরু করল। আয়মান বুঝতে পেরেই বলল, ‘দোস্ত চল আজকে মন রিফ্রেশ করার জন্য একটা জায়গায় নিয়ে যাব তোকে।’

অতলের শত নিষেধ সত্ত্বেও আয়মান তাকে জোর করে নিয়ে গেল তার সাথে। অতল তখন পইপই করে বলল যে তার পড়া আছে। সামনেই বিসিএসের ভাইভা দিতে হবে। প্রচুর খাটতে হবে তার জন্য। সব থেকে ভয়ংকর ব্যাপারটা হলো এবার যদি সে ভাইভাতে না টিকে তবে তাকে আরও বেশি পড়তে হবে। আর বাসায় তো আব্বুর বকাঝকা চলতেই থাকবে। এসবকিছু আয়মানকে শোনানোর পর সে আকুতি ভরা কণ্ঠে বলল, ‘দোস্ত! মনে কর না তোর গার্লেফ্রেন্ড এর সাথে সময় কাটাতে যাচ্ছিস।’

অতল ভারি অবাক হলো আয়মানের কথা শুনে। অনামিকা আঙ্গুল দিয়ে চোখের চশমাটা ঠিক করে বলল, ‘যখন ব্যাপারটা ঘটছেই না তখন আমি মনে করব কেন?’

আয়মান অনুরোধের স্বরে বলল, ‘আরেহ দোস্ত! এত প্যাঁচাল পারিস না তো। যেতে বলেছি মানে যেতে হবে।’

অতল তখন আশ্চর্য রকমের অবাক। সে অস্বাভাবিক রকমের ঠান্ডা গলায় বলল, ‘তোর গার্লেফ্রন্ড সায়মার সাথে দেখা করবি। এই তো?’

আয়মানের মাথায় যেন আকাশটা ক্রমাগত ভেঙে পড়ছিল। অমন পাংশুটে চেহারা নিয়ে সে বলল, ‘বুঝলি কি করে?’

‘খুব সহজ ছিল। তবে ব্যাপারটা তোর না জানলেও চলবে।’

‘আচ্ছা, এখন যাবি তো না-কি?’

‘হুম, চল। বেশিক্ষণ থাকতে পারব না আগে থেকেই বলে রাখলাম।’ ব্যস্ত গলায় বলল, অতল।

আয়মান আর অতল তখন সায়মার ভার্সিটির গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। চারদিকে প্রচণ্ড ভীড়। আয়মান ভীড়ের মধ্যে উঁকি ঝুঁকি দিয়ে খুঁজল সায়মাকে। না পেয়ে হতাশ হলো আয়মান। আর এদিকে অতল মহাবিরক্ত হচ্ছে। প্রচণ্ড ক্রোধ নিয়ে সে বলল, ‘আরে তুই ফোন দে না ওরে।’

আয়মান যেন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। সায়মা বলেছিল ভার্সিটির গেইটের সামনেই থাকবে। তাই সে এতক্ষণ খোঁজাখুঁজি করল। তবে অতল ঠিকই তো বলছে। এত খোঁজাখুঁজি না করে কল করলেই পারে সে। অথচ তার মনেই ছিল না। সে দ্রুত ডায়াল করল সায়মার নাম্বারে। সায়মা কল রিসিভ করতেই বলল ক্যাম্পাসে অপেক্ষা করতে। অনুষ্ঠান শেষ হলেই বেরোবে সে।

অতল আর আয়মান একটা নির্জন জায়গা বেছে নিল। চারপাশে সারি সারি গাছ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। ছায়া ফেলেছে সবুজ, সতেজ ঘাসে ছেয়ে ফেলা মাঠের উপর। মাথা উঁচু করে থাকা বৃক্ষের পাতার ফাঁকে ফাঁকে রোদ্দুর উঁকিঝুঁকি মারছে। আলো-ছায়ার এক মিষ্টি খেলা চলছে। বেশ ভালো লাগছে অতলের। আরও বেশি ভালো লাগছে
পুরো ক্যাম্পাস জুড়ে সবুজ আর সতেজ ঘাসের রাজত্ব দেখে। একটা জায়গা বেছে নিয়ে অতল বলল, ‘এখানেই বসে পড়।’

আয়মান দ্বিমত করল না। অতলের পাশে বসে পড়ল। তারপর তার ব্যাকপ্যাক থেকে একটা ম্যাগাজিনের বই এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘ধর, এটা পড়। আর কোনো বইখাতা নেই রে দোস্ত।’

অতল মুখটা বিরক্তিতে কুঞ্চিত করে বলল, ‘দোস্ত! আজ মেজাজটা যথেষ্ট খারাপ।’

আয়মান উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলল, ‘কেন কী হয়েছে? রিয়ানা আবার কিছু করেছে না-কি?’

‘নাহ্!’ দৃঢ়তার সাথে বলল অতল, ‘ও আমার কিছুই করতে পারবে না।’

‘তাহলে এত চিন্তিত দেখাচ্ছে কেন তোকে?’

‘জীবনটাই তো চিন্তার এক মহড়া। চিন্তা-ভাবনাহীন তো জীবন হয় না।’ অতল বলল, বিজ্ঞের মতো করে।

‘হুম। তারপরেও কিছু একটা খুব খারাপ হয়েছে বোধহয়।’

‘খারাপ কিছু হয়নি। আব্বু ভাইয়ার জন্য…!’

আয়মান অতলকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘দোস্ত সায়মা আসছে। তুই এখন চুপ থাক।’

অতল ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল সায়মাকে। এর আগে সামনাসামনি অবশ্য দেখা হয়নি। আয়মান ছবি দেখিয়েছে। সায়মা হচ্ছে আয়মানের কাজিন। তাই তাদের পরিবারে আয়মানের অবাধ বিচরণ। তাদের সম্পর্কের কথা তাদের পরিবারে মোটামুটি সবাই জানে।

তাকিয়ে থাকতে থাকতেই অতল থমকালো। স্তব্ধ হয়ে গেল। সায়মার পাশে ধীর পায়ে তাদের দিকে এগিয়ে আসা জাফরানি রঙের শাড়ি পরিহিত মেয়েটাকে দেখে। তার দুচোখ আটকেই থাকল মেয়েটার উপর। তার কাছে চেনা চেনা লাগছে মেয়েটাকে। যেন খুব চেনা কেউ। কিন্তু চিনতে কষ্ট হচ্ছে তার। দীর্ঘ সময় পর খুব পরিচিত কাউকে দেখলে এমনই হয়। মস্তিষ্ক বিভ্রান্তিতে পড়ে। কাজ করতে চায় না সাথে সাথে। অতলেরও তেমনই হচ্ছে।

বহ্নি আর সায়মা এগিয়ে আসছে তাদের দিকে। বহ্নি অতলকে দেখে প্রচণ্ড অবাক হলো। সাথে সাথেই ভীষণ রকমের বিস্ময় ভরা কণ্ঠে বলল, ‘অতল ভাইয়া!’

এই কণ্ঠটা অতলের পরিচিত। খুব পরিচিত। অতল বিস্মিত হলো এত বছর পরে বহ্নিকে দেখে। তৎক্ষনাৎ সে কোনো কথা বলতে পারল না। তার মনের সমস্ত কথা যেন ফুরিয়ে গেছে। যেন সমস্ত শব্দ একসাথে চুক্তি করে পালিয়ে গেছে তার মনের ডায়েরি থেকে। নিষ্পলক সে তাকিয়ে রইল। যেন অতল কোনো এক গহ্বরে হারিয়ে গেছে সে।

‘অতল ভাইয়া! চিনতে পারছ না আমাকে? আমি তোমার আগুনমণি।’ বহ্নি বলল, ভীষণ খুশিতে গদগদ হয়ে।

আগুনমণি শব্দটা যেন অতলের মস্তিষ্কে আগুনের ফুলকি ছড়িয়ে দিয়েছে। অতল সাথে সাথেই সম্বিৎ ফিরে পেল। শত কোটি আলোকবর্ষ দূর থেকে ভেসে আসা কোনো কণ্ঠের ন্যায় সে বলল, ‘চিনতে পেরেছি, আগুনমণি।’ একটু ধাতস্থ হয়েই পুনরায় বলল, ‘কেমন আছিস?’

‘এই তো ভালো আছি।’ বহ্নি অতলের পাশে বসতে বসতে বলল, ‘তুমি কেমন আছ?’

‘আমি?’ অতল যেন নিজেকেই প্রশ্ন করল। বিষণ্ন কণ্ঠে বলল, ‘ভালো আছি। খুব ভালো আছি।’

‘আমি তোমার সাথে খুব রাগ করেছি।’ আহ্লাদী গলায় বলল, বহ্নি।

অতল হাসল। কিছুই না বলে উপরের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। বহু বছর আগের একটা ঘটনা তার মনকে আবারও এত বছর পরে নাড়া দিয়ে উঠল। যেন কোনো এক আলো-ছায়ার খেলায় তাদের জীবন অবরুদ্ধ হয়ে আছে। বিশেষ করে তার জীবনটা। কেমন হয়ে গেল সে! তার নিজেরই ভাবতে অবাক লাগে। ক্লাসের ভীতু ছেলেটা আর ভীতু নেই। সবার ভালো চাইতে থাকা ছেলেটা আর কারও ভালো চায় না। ভীষণ রকমের পরিবর্তন হয়েছে তার মধ্যে। ভীষণ রকমের পরিবর্তন! আর সে কোনো বাধা দেয়নি। সমস্ত পরিবর্তনের জোয়ারে কেবল গা ভাসিয়ে দিয়েছে। সেই স্রোতে ভাসতে ভাসতেই আজকের এই অতল!

বহ্নি পুনরায় বলল,’ কেন রাগ করেছি জানতে চাইবে না?’

অতল প্রগাঢ় কণ্ঠে বলল, ‘নাহ্।’

‘না বলে চলে গিয়েছিলে কেন?’ বহ্নি আচমকা অতলের একটা হাত ধরে প্রশ্ন করল।

আয়মান আর সায়মা অবাক হয়ে দেখছিল ওদের। সায়মা জানে বহ্নি অতলকে পছন্দ করে ছোটবেলা থেকেই। কিন্তু এখনও কী পছন্দ করতে পারে! এতটা বছর পরেও। এটা কি আদৌ ভালোবাসা না-কি কেবলই ভ্রান্তি। সায়মা তা বুঝতে পারছে না। এমনিতেই এত জটিল চিন্তা তার জন্য না।

‘বলার সময় ছিল না। ইচ্ছে হয়নি তাও বলতে পারিস।’ কাটাকাটা গলায় উত্তর দিল অতল।

‘ইচ্ছে হবে না তো। আমি তোমার কে যে আমাকে বলতে যাবে।’ অভিমানী গলায় বলল, বহ্নি।

অতল হাসল তার দিকে তাকিয়ে । প্রসঙ্গ পাল্টে বলল, ‘সুন্দর লাগছে তোকে।’

‘হুম, আমি জানি আমাকে সুন্দর লাগছে।’

‘তুই তো অনেককিছুই জানিস। খুবই বুদ্ধিমতী তুই। তা আমার অজানা নয়।’ অতল বলল প্রগাঢ় কণ্ঠে।

___________________

সারপ্রাইজ ! কার কেমন লেগেছে জানাবেন।

আরও সারপ্রাইজ আছে আপনাদের জন্য। যারা গঠনমূলক মন্তব্য করবেন তাদের জন্যেও একটা বিশেষ সারপ্রাইজ আছে।

1 মন্তব্য

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে