#ছায়া_মানব
#সাথী_ইসলাম
২৩.
অনুজ অফিসের কিছু গুরুত্বপূর্ণ নথি উল্টে দেখছিল। নাজকে আসতে দেখে তা বন্ধ করে উঠে পড়ে। মাহতিম অনুজের অফিসে প্রবেশ করার সাথে সাথেই দেখতে পায় একজন বাংলাদেশ সিক্রেট এজেন্টকে। এই এজেন্টে পাঁচজনকে সিলেক্ট করা হয়েছিল। নিমো, আশিশ, অরোরা, অমৃতা এবং নাজ। এর মধ্যে নিমোকে কেউ সরিয়ে দিয়েছে। মাহতিম আশিশকে দেখতে পেয়ে তার কাছে ছুটে যায়। আশিশ ছিল তার সবচেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধু। আশিশ রাস্তা পার হচ্ছিল। পাশের একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকে পড়ে। মাহতিম তার পিছু পিছু যায়। সবার সামনে কথা বললে লোকে ভয় পেয়ে যাবে। তাই অপেক্ষা করতে থাকে কখন আশিশ বের হবে।
কিছুক্ষণ পরেই আশিশের গার্লফ্রেন্ড হিয়া আসে। তাদের বিয়ে কিছুদিনের মধ্যেই। আশিশ কোনো কারণে ওয়াশরুমে গেলেই মাহতিমের আবির্ভাব ঘটে,
‘ আশিশ, আমার বন্ধু!’
মাহতিমের কন্ঠ শুনে ভয় পেয়ে যায় আশিশ। মাটিতে লুটিয়ে পড়ে,’ কে কথা বললে?’
‘ আমি মাহতিম।’
‘ তুই বেঁচে আছিস?’
‘ সেটা পরে বলব। তুই উঠে পড়।’
আশিশ নিজেকে সামলে উঠে দাঁড়াল। মাহতিমকে দেখে তার খুশীর সীমা রইল না,
‘ ভাই আমার, তোকে দেখে আমি যে কতটা খুশি হয়েছি বলে বোঝাতে পারব না। এতদিন কোথায় ছিলি?’
‘ সে অনেক কথা। তোর সাহায্য লাগবে আমার।’
‘ তোর জন্য জীবন দিতেও প্রস্তুত আমি। শুধু কি করতে হবে সেটা বল।’
‘ আমাদের এজেন্টের সব খবর তোকে জোগাড় করে দিতে হবে। শুধু তোর আর নাজের ছাড়া। আমি জানি তোরা দুইজন কখনোই আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবি না।’
‘আমি জানি না। তারা কিভাবে তোকে দোষারোপ করল। আমি জানি তুই কখনো এমন কিছু করবি না যাতে মানুষের ক্ষতি হয়।’
মাহতিম আশিশকে জড়িয়ে ধরে, ‘আমার অনেক কষ্ট ভাই। তবুও ভুলতে পারছি তোর আর নাজের জন্য।’
আশিশ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মনে মনে বলল, নাজের কথা বললেও বিশ্বাস করবি না, তাই বলবোও না, প্রমাণ দেখাবো।
আশিশ বলল,’তোকে একটা কথা বলতে ভুলে গেছি।’
‘ কি কথা?’
‘বাইরে যাকে দেখেছিস। আমার উড বি ওয়াইফ। এখন সয়য় না উপযুক্ত, না হয় পরিচয় করিয়ে দিতাম।’
‘ অনেক সুন্দর। নাম কি?’
‘ হিয়া ঘোষাল। আমাদের রিলেশন ছিল চার মাস। এখন সেটা বিয়েতে রুপ নেবে।’
কথাটা শুনে মাহতিমের বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল। অহনার কথা মনে হলো তার। বুকের মধ্যে চিনচিন ব্যথা অনুভব করল। জীবনকে নিয়ে যেন ক্লান্ত হয়ে পড়ল সে। আশিশ বলল,’ হিয়াকে ড্রপ করে দিয়ে অফিসে যাব। তবে খুব সাবধানে। সবার আড়ালে। আমার মনে হচ্ছে সেখানে কোনো না কোনো সূত্র পাবই।’ মাহতিম সাঁয় দেয়।
নাজ অনুজের গলা জড়িয়ে ধরে বলে,’ একটা গোপন কথা বলব তোমাকে মাই সুইটহার্ট। যেটা শোনার পর তুমি আর স্থির থাকতে পারবে না।’
‘ কি এমন কথা? আমিতো তোমাকে কাছে দেখলেই আর স্থির থাকতে পারি না।’
‘ আগে বলো নিমো কোথায়?’
‘ জেনে কি করবে? আ’পদ বিদায় হয়েছে।’
‘ বলো না।’ নাজ দীর্ঘ চুম্বন করল অনুজকে। অনুজ বলল,’ তাকে আমি আমার লোক দিয়ে সরিয়ে দিয়েছি। কারণ সে সত্যিটা জেনে গিয়েছিল। আমি চাইনি আমার লক্ষ্যে অন্যকেউ হস্তক্ষেপ করুক। তাই তাকে শেষ করে দিয়েছি। বড্ড জ্বালিয়েছে ঐ মা*।’
‘ একদম ভালো করেছ।’ নাজ মনে করার ভঙ্গি করে বলে,’ যে কথাটা বলতে এসেছি, সেটাই বলিনি এখনো।’
‘ কি কথা?’
‘ মাহতিম এসে গেছে।’
অনুজ ছিটকে দূরে সরে যায়,
‘ মজা করছ?’
‘ এভাবে সরে গেলে কেন? এখনো কি তাকে ভয় পাও?’
‘ ভয় আর আমি সম্পূর্ণ ভিন্ন মেরুতে থাকি। আর মাহতিমের মতো একটা মাছিকে আমি ভয় পাইনি কখনো।’
‘ সে তোমার মুখ দেখেই বোঝা যায়।’
‘ এটা বলো, তুমি যা বলছ তা সত্যি?’
‘ একদম। মাহতিম আমার বন্ধু ছিল, সেটা নিশ্চয় জানো? সে এখনো আমাকে বিশ্বাস করে। আমি এটা বুঝতে পারছি না, ও বেঁচে গেল কি করে? নাকি কোনো আ’ত্মা?’
‘ ধ্যাত! কি বলো এসব। হয়তো বেঁচে গেছে কোনোভাবে। তবে এবার আর ছাড় পাবে না। তুমি জানো না কতবড় উপকার করলে। নেক্সট স্টেপ আমি নেব। তুমি শুধু দেখতে থাকো।’
‘ আমি তাহলে যাই। কিছু কাজ আছে।’
‘ সিউর মাই সুইটি।’
নাজ আরেকবার অনুজকে আলিঙ্গন করে চলে যায়।
অহনা খাটের এক কোণে বসে আছে। তার মনে হচ্ছে মাহতিম নিশ্চয় তাকে বাঁচাতে আসবেই। কিন্তু এতো দেরী করছে কেন? আগেতো করেনা। অপর দিকে মাহতিম চায় অহনা তার জন্য অপেক্ষা না করুক। খবর নিয়ে দেখেছে সে, আরিশ অনেক ভালো ছেলে। তার সাথে সুখেই থাকবে অহনা। অহনার জন্য একজন যোগ্য স্বামী হতে পারে আরিশ। তাই সে নিশ্চিন্তে নিজের কাজ করতেই ব্যস্ত।
অহনার ভাবনার ব্যাঘাত ঘটাতেই আগমন ঘটে মতির। সকাল শেষ হয়েছে অনেকক্ষণ হলো। খাবার নিয়ে এসেছে। অহনা কথা না বাড়িয়ে খেয়ে নেয়। এমনিতেও তার খুব ক্ষুদা লেগেছিল। মতি দাঁত দেখিয়ে হাসল,’ তোমাকে দেখলেই পরানটা জুড়িয়ে যায়। জাদু আছে তোমার মাঝে জানো? এমন জাদু যে আমি হার্ট অ্যা’টাক করে ফেলি। এতো সুন্দর তুমি, সারাজীবন প্রশংসা করলেও শেষ হবে না।’
‘ কথা শেষ হলে বন্ধ করুন।’
‘ রাগ করেনা সোনা বউ আমার।’
‘ মুখ সামলে। আমি আপনার বউ না।’
‘ একটু পরতো হবে। দাঁড়াও আমি আসছি।’
‘ আপনি না আসলেই আমি খুশী।’
মতি বেড়িয়ে যায়। ত্রিশ মিনিটের মাথায় ফিরে আসে। হাতে তার বেনারসী শাড়ি আর পাঞ্জাবি। অহনার দিকে তাকিয়ে বলল,’ শাড়িটা পরে নাও। কিছুক্ষণের মধ্যেই কাজী আসবে।’
‘ আমি পরবো না। আপনাকে বিয়ে করব না আমি।’
অহনার ভয় হতে থাকে। কিছুতেই পালাতে পারবে না। অনেক পাহারা লাগিয়েছে মতি। কেউ সাহায্য করতেও আসছে না। এই মুহূর্তে তার ভয় হচ্ছে এটা ভেবে যে, মতিকে বিয়ে করতে হবে। জ’ঘন্য মানসিকতার একটা মানুষ মতি। তাকে সে কিছুতেই মেনে নেবে না,
‘ আমি পরবো না শাড়ি। পরবো না, পরবো না, পরবো না।’
‘ না হয় বিয়ে হবে কি এই টিশার্ট গায়ে দিয়ে? যা বলছি শুনো।’
‘শুনবো না। শাড়ি আমি কিছুতেই পরবো না।’
‘ ঠিক আছে পরতে হবে না তোমাকে।’
অহনা খুশি হয়ে যায়। পরক্ষণেই মতি আবার বলল,’ তোমাকে পরতে হবে না, আমি পরিয়ে দেব। এদিকে আস।’
অহনা দু’কদম পিছিয়ে যায়,
‘ আমি পরবো। আমি নিজে নিজে পরতে পারি।’
‘ এইতো লক্ষী মেয়ের মতো কথা। তবে পরে নাও।’
মতি দাঁড়িয়ে থাকে। অহনা বিরক্তি ভাব ফুটিয়ে তুলে বলল,’ আপনি না গেলে আমি কিভাবে পরবো?’
মতি অদ্ভুত হাসে, ‘ ঠিক আছে। দেরী করো না।’
রোস্তম ঘরের চৌকাঠে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে। একটু পরেই মোড়ল বাড়ির লোকজন আসবে। খবর পেয়েছে তারা রওনা দিয়েছে। অথচ এখনো আসেনি মেয়ে। রোস্তমের কিছু আগের কথা মনে পড়ে যায়। দরজার সাথে হেলান দিয়ে মিনমিনে স্বরে বলে,কেন আমার মেয়ের কপালটাই বার বার এমন পুড়ে। কার অভিশাপে এমনটা হচ্ছে? দুই দুবার মেয়েটার সাথে এমনটা ঘটছে। বিয়ে কি আমার মেয়ের কপালে নেই? এ কোন মসিবতে আছি আমি….
চলবে…..
#ছায়া_মানব
#সাথী_ইসলাম
২৪.
আশিশ অফিসে যায়। সমস্ত ফাইল ঘেঁটে দেখে। সবকিছুই তার কাছে কেমন সন্দেহ লাগছে। গতবছরের কোনো এজেন্টের কথাই ঠিকভাবে লেখা হয়নি। আশিশের জানামতে সবকিছু লেখা থাকে। তার মানে কেউ সরিয়ে নিয়েছে। কিন্তু কে? সে কি জানতো আশিশ আসবে? এমন সন্দেহ হতেই আশিশ বেরিয়ে যায়। কখন কোথাও থেকে কে আসে বলা যায় না।
সময় গড়াতেই অহনা কেঁদে উঠে। বুকে ব্যথা অনুভব করে। মাহতিমকে মনে পড়ছে তার। এখনো তাকে বাঁচাতে আসছে না বলে রাগও করে মনে মনে। কি এমন মহাকাজ করতে গেছে, যার কারণে তাকে ভুলে গেছে? অহনা নিজেকে শান্ত করতে পারছে না। বাইরে থেকে আওয়াজ আসে, অহনা তৈরি হয়েছে কিনা জানতে চায় মতি। অহনা চোখ মুছে নেয়, বলল,’ আর একটু।’
অহনা কখনো শাড়ি পরেনি। আজ হঠাৎ শাড়িটাকে কিভাবে পরবে তা নিয়ে দ্বন্দে পড়ে। কয়েকবার পেছিয়েও কোনো উপায় হয়নি। কোনোভাবেই পারছে না। শেষে বিরক্ত হয়ে বসে পড়ে। বাইরে থেকে বার বার মতি জিজ্ঞেস করছে,’ তোমার কি শাড়ি পরা হলো? আমরা আসব?’
অহনা বার বার বলছে, ‘আর একটু, আর একটু।’
আবার চেষ্টা করল। কোনোমতে শাড়িটাকে কোমরে পেঁচিয়ে, আঁচল ঠিক করল। ভেতরে আসতে বলল মতিকে।
মতি অহনাকে দেখেই চমকে যায়, বলল,’ এটা শাড়ি পরেছ নাকি মশাড়ি টানিয়েছ?’
‘ কেন, হয়নি?’
‘ এদিকে আসো আমি ঠিক করে দিই।’
অহনা দূরে সরে যায়, ‘ খবর’দার! ওখানেই থাকুন। একদম সুযোগ নিতে আসবেন না।’
‘ কিন্তু, এটা পরা হয়নি।’
‘ কোনো সমস্যা নেই। আর লাগবে না।’
‘ তোমার যা মর্জি।’
রোস্তম চৌকাঠে বসে থাকা অবস্থায় মোড়ল বাড়ি থেকে লোকজন চলে আসে। উঠে সালাম জানায় রোস্তম। বুক তার দুরু দুরু। বসতে দেয় সবাইকে। আরিশ মতিকে বলেছিল আজকে যেন তার সাথে থাকে। কিন্তু মতি তার কথা শুনেনি, সে আসেনি। বলল গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছে, আসতে পারবে না।
আরিশ আরেকবার কল করে মতিতে। মতি কল ধরতেই ওপাশ থেকে বলল,’ দশ মিনিটের মধ্যে আয়, আমি আর অপেক্ষা করতে পারব না।’
মতি বলল,’ অপেক্ষা করতে হবে না ভাই, বাড়ি চলে যাও।’
ভাই শব্দটা অহনার কানে যায়। আরিশের কল ভেবে অহনা মতির কাছাকাছি আসে। চিৎকার করে বলে,’ কেউ আমাকে সাহায্য করো। আমাকে আটকে রাখা হয়েছে।’
কথাটা বলার সাথে সাথেই মতি তার মুখ চেপে ধরে। মোবাইলটা কেটে রেখে দেয়। এই পর্যায়ে মতি অহনার গায়ে হাত তুলতে যায়, কিন্তু তুলে না। কাজীকে বলল,’ তারাতাড়ি বিয়ে পড়ান, দ্রুত। আর এক মুহূর্তও দেরী করা যাবে না।’
আরিশ ফোনের ওপাশ থেকে মেয়েলি চিৎকার শুনে আচমকা চেয়ার ছেড়ে উঠে যায়। মোড়লকে বলল,’ বাবা, আমি একটু আসছি। একটা কাজ করার আছে।’
‘না, এখন তুই কোথাও যেতে পারবি না। বোধ-বুদ্ধি কি সব লোপ পেয়েছে নাকি? একটু পর মেয়ে নিয়ে আসা হবে। এখন কোথাও যাওয়ার দরকার নেই।’
আরিশ বাধ্য ছেলের মতো বসে পড়ে। কিন্তু তার মন থেকে গেল ফোনের ওপাশে থাকা মেয়েলি কন্ঠের দিকে। মনে হচ্ছে, তার ভাই কোনো মেয়েকে আটে রেখেছে বা এমন কিছু। আরিশ হাঁসফাঁস করছে। যদি ঠিক সময় যেতে না পারে তাহলে কি জানি হয়ে যায়।
রোস্তম আসে। ভয়ে ভয়ে মোড়লের সামনে এসে বলল,’ কর্তা একটা কথা বলার ছিল।’
মোড়ল হচ্ছে বলল,’ তা বলো বেহাই। কি কথা?’
‘ আসলে কর্তা…’
মোড়ল রোস্তমের কথা শুনে উঠে আসে,’ কি হয়েছে?’
রোস্তম কেঁদে বলল,’ মেয়েটাকে খুঁজে পাচ্ছি না।’
মোড়ল কথাটা শোনা মাত্রই রোস্তমকে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে। সব ঘটনা খুলে বলতে বলে।
মতি অহনাকে জোর করে বিয়ের জন্য। অহনা পালানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। মতি বলল,’ এই মুহূর্তে তুমি বিয়ে করতে না বসলে সব শেষ করে দেব। তোমার বাবাকেও মে’রে দেব। অহনা আঁতকে উঠে। বিয়ের জন্য বসে পড়ে।
আরিশ কিছুটা সমস্যা আগেই আন্দাজ করেছে। রোস্তমের ভোঁতা মুখ দেখে এটা সিউর ছিল যে কোনো না কোনো অঘটন ঘটেছে। আরিশ আর এক মুহূর্তও সময় নষ্ট না বেরিয়ে পড়ে। কারো চিৎকার এখনো তার কানে বাঁধছে। সবার আড়ালে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। কিন্তু মতি ঠিক কোথায় আছে সেটা তার জানা নেই। হঠাৎ তার মনে পড়ল, মতি সবসময় তার বাবার সেই সুখের বাংলোতে যায়। তার সব খারাপ এবং ভালো মুহূর্তেই সেখানে যায়। আপাতত যাওয়াও আর কোনো রাস্তা নেই। আরিশ ওখানেই রওনা দেয়। দশ মিনিটের মাথায় পৌঁছে যায়। কয়েকজন পাহাদার ছিল, কিন্তু তারা বাধা দিতে পারেনি, মোড়লের এই বাড়িতে তার ছেলেরা যেকোনো সময় আসতে পারে, কেউ বাধা দেওয়ার অধিকার রাখে না। আরিশ ভেতরে ঢুকে পড়ে। মতি এক নজর বাইরে তাকিয়েই আঁতকে উঠে। মাত্রই অহনা বিয়ের জন্য পুরোপুরি রাজি হলো আর এখনই আরিশ চলে এলো। মতি ভয়ে হজম হয়ে যায়। ভাইকে সে প্রচন্ড রকমের ভয় পায়। কি করবে ভেবে পায় না। এখান থেকে পালানোর কোনো রাস্তাও নেই। একটাই রাস্তা, যেটা দিয়ে আরিশ আসছে। মতি অহনার শাড়ির আঁচল টেনে মাথা ঢুকিয়ে নেয়। অহনা অবাক হয়। ফরিদ নামের একজন বলে,’ কিরে দোস্ত, এখনই কি বউয়ের আঁচল ধরার প্র্যাক্টিস করছিস নাকি?’
মতি কিছু বলে না। মুখ লুকিয়ে বসে থাকে। সে মনে করছে তাকে কেউ দেখবে না এভাবে।
আরিশ ঘরটিতে প্রবেশ করতেই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। মতিকে দেখতে পাচ্ছে না। কিন্তু অহনাকে দেখে তার চোখ স্থির। এতো মিষ্টি মুখের মেয়ে সে আগে কখনো দেখেনি। কেঁদে কেঁদে চোখ দুটো ফোলে একাকার। তবুও তাকে আবেদনময়ী লাগছে। আরিশ অহনাকে চিনতে পারেনা। কেননা আগে কখনো তাদের দেখা হয়নি। অহনাও চিনতে পারেনি। এই মুহূর্তে তাকে অসময়ে বর্ষণের মতো মনে হলো। আরিশ বলে উঠে,’ কি হচ্ছে এখানে?’
কেউ কোনো কথা বলেনা। মতি আঁচলটাকে নিজের দিকে টেনে আবৃত করে নেয় নিজেকে। আরিশ আবার বলল,’ কেউ কি আমাকে বলবে এখানে কি হচ্ছিল?’
অহনা মতিকে ফেলে রেখেই উঠে যায়,’ কাকু, এই লোকটা আমাকে জোর করে ধরে নিয়ে এসেছে। বিয়ে করতে চেয়েছিল।’
মতির এমন অবস্থা দেখে আরিশের মাথায় রাগ চেপে বসে। সে আগেই বুঝেছিল, ভাই তার কিছু সমস্যা নিশ্চয় করছে। আরিশ রেগেমেগে মতির দিকে এগিয়ে যায়। তার কলার চেপে ধরে একটা থা’প্পর দেয়। মতি মুখ থুবড়ে নিচে পড়ে যায়,
‘ ভাই, আমি তোমাকে সব বুঝিয়ে বলছি, একটু অপেক্ষা করো, আমাকে সুযোগ দাও।’
‘ কিসের সুযোগ দেব। আমি কি চোখে দেখি না? মেয়েটাকে জোর করে ধরে এনে বিয়ে করছিস? আগেই বলতে পারতি, বাবাই যা করার করতো। কিন্তু কারো মতের বিরুদ্ধে তাকে তুলে এনে বিয়ে করা আর ধ’র্ষ’ণ করা একই কথা। কবে তোর মাথায় বুদ্ধি হবে?’
‘ ভাই আমার ভুল হয়ে গেছে। কিন্তু এই মেয়েটাকে আমি ভালোবাসি।’
আরিশ অহনার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,’ এই মেয়ে, তুমি কি তাকে ভালোবাসো?’
‘ একদম না। উনি জোর করেছে আমার সাথে। আমারতো ইচ্ছে করছে তার গলাটা কে’টে দিই।’
আরিশ মতিকে বলল,’ শুনেছিস কি বলল? জোর করে আর যাই হোক, ভালোবাসা কখনো হয় না। বাড়ি চল তুই। তোর বিচার বাবাই করবে, আমি কিছু করব না।’
আরিশ দুইজন কর্মচারীকে বলল,’ মতিকে নিয়ে বাড়ি যাও। কোথাও যেন পালাতে না পারে।’
রোস্তমের কথা শুনে মোড়ল রেগে গিয়েও শান্ত থাকে। রোস্তমকে বলল,’ তোমার মেয়ে বিয়ে করতে চায়না। সেটা আগে বললেই হতো। আমরা কেউ জোর করিনি। যাই হোক, সম্মানের ব্যাপার এটা। আমরা চলে যাচ্ছি, তবে এই কথা যেন কেউ না জানে।’
মোড়লরা চলে যায়। মহিলারা বুঝতে পারেনা কেন চলে যাচ্ছে। মোড়ল কোনো উত্তর দেয়নি।
আরিশ অহনাকে গাড়িতে বসায়,’ কোথায় যাবে?’
অহনা অন্যমনস্ক ছিল। তার মনে পড়ছে মাহতিমের কথা। হঠাৎ আরিশ তুড়ি মেরে বলল,’ কোথায় যাবে?’
অহনার হুঁশ ফিরে,’ জ্বী কাকু, কিছু বললেন?’
আরিশের মাথা গরম হয়ে যায়। তাকে মোটেও বয়স্কদের মতো লাগছে না। তাহলে মেয়েটা তাকে কাকু বলছে কেন?
অহনা আবার বলল,’ কাকু, আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করেছিলেন?…..
চলবে…..
#ছায়া_মানব
#সাথী_ইসলাম
২৫.
আরিশ বিরক্ত হয়ে বলল,’ কোথায় যাবে, আই মিন তোমার বাড়ি কোথায়?’
‘বামে মোড় নিন, সামনেই আমার বাড়ি।’
আরিশ অহনাকে বাঁকা চোখে দেখছে। হঠাৎ কেন এতো ভালো লেগে গেল তার অহনাকে? বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে আসতেই অহনা বলল,’ গাড়ি থামান।’
‘ এখানেই তোমার বাড়ি?’
‘ না, আর একটু ভেতরে। এই জায়গাটা আমি হেঁটেই যেতে পারব।’
অহনা নেমে পড়ে। আরিশের ইচ্ছে করছিল আর কিছুক্ষণ অহনার সাথে কাটুক। কিন্তু অহনা উল্টো পথ নেয়। আরিশ গাড়ি ঘুরাতেই অহনা আবার ফিরে আসে। আরিশ অবাক হয়ে বলল,’ কি হলো?’
‘ আসলে আমার আপনাকে ধন্যবাদ দিতেই ভুলে গেছি।’
‘ কোনো ব্যাপার না।’
‘ ধন্যবাদ কাকু।’
আরিশের কপাল কুঁচকে আসে। এখনো বিয়েটা পর্যন্ত করল না, আর একটা মেয়ে নাকি তাকে বার বার কাকু ডাকছে। আরিশ নিজেকে শান্ত রেখেই বলল,’ আমাকে তোমার কোন এঙ্গেল থেকে কাকু মনে হয়?’
‘ নেমে আসুন।’
‘ নামব কেন?’
‘ আপনিইতো বললেন, আপনাকে কোন এঙ্গেল থেকে কাকু লাগে সেটা বলতে। নেমে আসুন, ভালো করে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে বলে দিচ্ছি।’
আরিশ কোনো কথা না বলে গাড়ি ফিরিয়ে নেয়। অহনা পেছন থেকে কাকু বলে কয়েকবার ডাকল। দাঁড়াল না আরিশ। অহনা বাড়ি ফিরে যায়।
রোস্তম ঘরে বসে ছিল। অহনাকে দেখে তার যেন প্রাণ ফিরে এলো। অহনা তাকে সব ঘটনা খুলে বলে। রোস্তমের তখন ঘৃ’ণা হতে থাকে। এক ছেলের সাথে বিয়ে ঠিক করেছে, আর তার আপন ভাই মেয়ের সর্ব’নাশ করতে যাচ্ছিল।
আরিশ বাড়ি গিয়েই মোড়লকে সব জানালো। মোড়লের সামনে হাজির করা হলো মতিকে। আরিশ কাঠ কাঠ গলায় বলে গেল,’ বাবা, আপনাকে সম্মান করি, তাই ভাইয়ের অপরাধের শাস্তি আমি নিজে দেইনি। আপনার কাছে এনেছি তাকে যথোপযুক্ত শাস্তি দেবেন। যেন আর কখনো অন্য কোনো মেয়ের সাথে এমনটা করতে না পারে।’
আরিশ সেখান থেকে চলে যায়।
মোড়ল প্রথমেই মতির দিকে তাকিয়ে বলল,’ তোমার শিক্ষায় কি ত্রুটি ছিল, একটু বলো আমায়?’
মতি বলল,’ বাবা মাপ করে দিন। আর কখনো এমন ভুল হবে না।’
‘ কাকে অপহরণ করেছিলে। আর কেন?’
‘ ভাইতো বলল।’
‘ আমি তোমার মুখ থেকে শুনতে চাই। নিজের অপরাধ স্বীকার করো।’
‘রোস্তম কাকুর মেয়ে।’
মোড়লের মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। হাতের লাঠিটা দিয়ে মাটিতে জোরে’শোরে আঘাত করেন তিনি,
‘ মাথা ঠিক আছে তোমার?’
‘ ভুল করে ফেলছি। কিন্তু আমি অহনাকে ভালোবাসি। বাবা, আপনি কিছু করুন। আমি ওকেই বিয়ে করতে চাই।’
মোড়ল রাগে নিজের হাতের লাঠিটা দিয়ে কয়েকটা বারি দিল মতিকে,
‘ কতবড় ভুল করেছো তুমি নিজেও জানো না। তোমার ভাইয়ের হবু বউকে অপহরণ করেছো। তুমি তো জানতে যে আরিশের সাথে আমি তার বিয়ে ঠিক করেছি।’
‘ আমি কি করব বাবা। আমি অহনাকে অনেক আগে থেকেই ভালোবাসি। যখন শুনলাম ভাইয়ের সাথে বিয়ে ঠিক করেছেন। আমি নিজেকে ঠিক রাখতে পারিনি। আমি জানি, আপনাকে এই কথাটা বললেও আপনি আমার কথা রাখতেন না। তাই বাধ্য হয়ে করতে হয়েছে আমাকে।’
মোড়ল থপ করে বসে পড়েন। একজন কর্মচারীকে বলল,’ পানি আনো।’
পানি আনতেই মোড়ল ঢকঢক করে পান করে বলে,
‘ ইচ্ছে করছে তোমাকে মে’রে মাটিতে পুঁ’তে দিই। যে মেয়ের চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলেছি, সেই মেয়ের কোনো দোষই ছিল না।’
‘ক্ষমা করুন বাবা। আর কখনো এমন ভুল হবে না। আমি বুঝে গেছি অহনা আমাকে ভালোবাসে না। আমিও আর চাইবো না।’
‘ ভুল করলে ক্ষমা করা যায়। কিন্তু তুমি ভুল নয়, অন্যায় করেছো। এই অন্যায়ের শা’স্তি না দিলে আমি লোকের কাছে ছোট হয়ে যাব।’
‘ বাবা, আমি আপনার ছেলে।’
‘এতদিন ছিলে, আজ থেকে আর নেই। আমার ছেলে কখনো এতো ঘৃ’ণিত কাজ করতে পারেনা।’
‘ না, আপনি এমন কিছু করতে পারেন না।’
মোড়ল পুলিশকে কল করে। দুই মাসের জন্য তাকে জেলে রাখার আদেশ দেওয়া হয়।
মোড়ল মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েন। কি করবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। ভীষণ অপরাধবোধ হতে থাকে তার।
রোস্তম মেয়েকে পেয়ে খুশি। কিন্তু তিনি বিচারের জন্য মোড়লের কাছে যাবেন বলে ঠিক করেন। এরই মাঝে অহনাকে বাড়িতে আসতে দেখে নিয়েছিল একজন মহিলা। ঘরে আড়ি পেতে আরো অনেক কথাই শুনে নিল। সেই মহিলা এলাকার সবার কানে এসব কথা ছড়িয়ে দিল। বিকেল হতে না হতেই যেন সবাই জেনে গেল। বাড়ি বয়ে লোকজন কথা শুনাতে আসতে শুরু করে। রোস্তম কার মুখ বন্ধ করবেন, বুঝতে পারেন না। কেউ বলছে,’ বড়জনরে ছেড়ে ছোট জনরে ভালো লাগলে বিয়েতে রাজি হলি কেন? কথায় আছে, অতি সুখ সহ্য হয় না।’
কেউ কেউ বলল,’ বেশি খেতে চাইলে এমনই অবস্থা হয়। বড়লোকের সব ছেলেকে একত্রে ফাঁসাতে চাইছিল।’
বাড়ি বয়ে এসে ঝ’গড়া করা মহিলাদের থেকে বাঁচার জন্য অহনা কপাট দেয়।
মাহতিম নাজের সাথে দেখা করার জন্য যেতেই দেখতে পেল আশিশ আসছে। মাহতিম আশিশের সাথে কথা বলতেই সে জানায়, সিক্রেট এজেন্টদের মধ্যে আরো দু’জনকে খু’ন করা হয়েছে। যদিও প্রমাণ বলে শ্বাসকষ্ট জনিত রোগের কারণে হয়েছে। কিন্তু একসাথে একই ঘরে দু’জনের শ্বাসকষ্ট হলো এটা মানতে পারল না মাহতিম। মাহতিম বলল,’ কোন দুজন?’
‘ অরোরা, অমৃতা।’
‘ কে এই কাজ করল?’
‘সেটাতো জানি না। তবে ওদের পুরো হিস্টোরি বের করেছি। অমৃতা খানমের বাড়ি গিয়েছিলাম। সেখান থেকে যা সূত্র পেলাম। তা অনুযায়ী তিনি মাদক সাপ্লাই করতেন। আর সব হিসেব তিনি তার ডায়রিতে লিখে রাখতেন। আমি ডায়রিটা সবার আড়ালে নিয়ে এসেছি। তবে একটা জিনিস বুঝতে পারছি না, গত কিছু মাসের কোনো লেখা নেই এখানে।’
মাহতিম ডায়রিটা হাতে নেয়। কিছুটা পড়ে বলল,’ আমি খুব ভালো করে বিষয়টা বুঝতে পেরেছি।’
আশিশ আগ্রহ নিয়ে বলল,’ কি বুঝলি?’
‘এটাই যে, তিনি মাদক সাপ্লাইয়ের পাশাপাশি আরও এটা কাজ করতেন। আর শেষে পদত্যাগ করায় কেউ তাকে মে’রে দিয়েছে।’
‘তুই সিউর?’
‘আমি একদম সিউর। আমাদের এখন অরোরার বাড়িতে যেতে হবে। নিশ্চয় কোনো ক্লু পাব।’
‘যাওয়া ঠিক হবে না। প্রোটেকশন আছে।’
‘তুই থাক। আমাকে কেউ দেখতে পাবে না। আমি যাব।’
মাহতিম চলে যায় অরোরা আরানের বাড়িতে। তার সমস্ত ফাইল খুজে দেখে। এক পর্যায়ে পেয়ে যায় একটা নথি। যেটা থেকে এটা স্পষ্ট যে, অরোরা কিছু তথ্য জমা রেখেছে এবং সে একজন মাদক ব্যবসায়ী। মাহতিমের মাথা ঘুরতে থাকে। যে মানুষগুলোকে এতো ভালো ভেবেছিল। তারাই শেষমেশ এমন সব কাজ করছে। মাহতিমের সবচেয়ে বিশ্বস্ত ছিল নিমো। মাহতিম সিদ্ধান্ত নেয় নিমোর বাড়িও খুঁজে দেখবে।
সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। মাহতিম নিমোর বাড়িতে যায়। অন্ধকার বাড়ি, তার পুরো পরিবার এখানে থেকে চলে গেছে। বাড়িটা পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে আছে। মাহতিম সমস্ত জায়গা খুঁজে দেখে। বেড রুমে গিয়েও তন্নতন্ন করে খুঁজে। খাট থেকে বালিশটাকে ছুঁড়ে ফেলে দিতেই তার নিচে একখানা চিঠি দেখতে পায়। আগ্রহ বসত মাহতিম দু ভাঁজ করা চিঠিটা খুলে নিজের চোখের সামনে মেলে ধরে….
চলবে…..