চোরাবালি পর্ব-০৫

0
1003

#চোরাবালি
#পর্বঃ৫
#আহিয়া_আমান_অণু

১১
আলিফের সাথে গন্জে যাওয়ার জন্য বেরিয়েছি কিন্তু বাজারে এসে এভাবে আমান মির্জার মুখোমুখি হতে হবে কল্পনাও করিনি। উচু রাস্তাটায় কেমন থমকে দাড়িয়ে আছে।চোখ দুটো আমাতে আবদ্ধ; সেটা আমি একপলক দেখেই বুঝলাম।তাহিফ আলিফের কোলে।বাচ্চাটা নানান কথা বলছে ; এটা কি-ওটা কি প্রশ্ন করে আলিফের কানের পোকা নাড়িয়ে দিবে এমন অবস্থা।আলিফও দেখলাম ধৈর্য সহকারে সব প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে।ও আমানকে এখনও খেয়াল করেনি।মেইন রাস্তায় উঠতেই দেখলাম আমান সেই আমাকেই দেখে যাচ্ছে।আলিফও খেয়াল করলো আমানকে।নিচু স্বরে আমায় বলে,

“আপু, দুলাভাই তো দাড়িয়ে আছে?”

আমি উত্তর দিয়ে বললাম,

“গাড়িতে ডেকে গাড়িতে উঠবি; বেশি কথা বলবিনা।”

আলিফ আমার কথা অনুযায়ী তাই করলো।আমারও বেহায়া চোখ; এতদিন পর মানুষটাকে দেখে দেখার লোভ সামলাতে পারছেনা।আলিফ একটা অটোভ্যান ডাকলো।সেটা এগিয়ে আসতেই উঠে বসবো এমন সময় কানে ভেসে আসলো,

“আদ্রিজা আমান মির্জা!”

আমি চকিতে পিছনে তাকালাম।আমান মুখে হাসি টেনে দাড়িয়ে আছে।আমাকে সেই পুরোনো নামে ডাকায় খানিকটা রাগ হলো।যে পরিচয় আমার নয় সেই পরিচয়ে কেনো ডাকবে।আমি কান দিলাম না তাতে।ভ্যানে উঠে ভ্যানওয়ালাকে বললাম,

“চাচা ভ্যান ছেড়ে দেন।মানুষের অপেক্ষা করতে হবেনা।আমি বাকি ভাড়াটা দিয়ে দিবো।আপনি চলেন।”

ভ্যানওয়ালা সম্মতি দিলো তাতে।ভ্যান ছাড়বে এমন সময় আমান ভ্যানের সামনে এসে দাড়ায়।আমি তা দেখে বাজারে চারপাশে নজর বুলালাম।মানুষ তাকিয়ে তাকিয়ে তামাশা দেখে মজা নেওয়ার অপেক্ষায় আছে।আমি আলিফকে ইশারা করলাম কথা বলার জন্য। আলিফ সেজন্য বলে,

“আমান ভাইয়া পথ ছাড়ো।আমাদের যেতে হবে।”

“তোমার বোনকে কয়েকটা কথা কৈফিয়ত দিতে হবে আলিফ।এরপর আমি নিজেই সরে দাড়াবো।তোমার কিছু বলতে হবেনা।”

আমি আমানের কথা শুনে নিশ্চুপ বসে রইলাম।কথা বলতে মন চাচ্ছে না।আর যেটাতে মন সায় না দেয় সেই কাজ না করাই ভালো।আলিফ কি উত্তর দেবে; এটার জন্য আমার মুখপানে তাকিয়ে আছে।আমি ইশারা করলাম চুপ থাকতে। তাহিফকে আমার কোলে নিয়ে চেপে ধরে রাখলাম নিজের সাথে।শাড়ির উপর শাল চাদরটা দিয়ে বাচ্চাটাকে ঘিরে নিলাম।আমান আমার কোনো হেলদোল না পেয়ে গাড়িতে উঠে বসলো হুট করে।তারপর ভ্যানওয়ালাকে বললো,

“চাচা আপনি ভ্যান ছাড়েন। এরা যেখানে যাবে আমিও সেখানে যাবো।আপনি চলেন।”

আমিও তবুও নিষ্প্রভ মলিন চাহনীতে তাকিয়ে থাকা ব্যতিত কোনো কথা বললাম না।ভ্যানওয়ালা ভ্ঢ়ান ছেড়ে দিলো।শনশনে ঠান্ডা বাতাস।শীতটা বেশিই লাগছে।ছেলেকে ভালোমতোন জড়িয়ে নিলাম নিজের সাথে।তাহিফ এরমাঝে বললো,

“মাম্মা, এত চেপে কেনো ধরেছো?দেখছোনা আমার চোখমুখ ঢেকে গেছে।”

“আমি খেয়াল করিনি বাবা; সরি।মাম্মা এখুনি সব ঠিক করে দিচ্ছি।”

“গলার স্বর তো মাশা-আল্লাহ আগের মতোয় আছে।তাহলে আমি ডাকছি উত্তর কেনো দিচ্ছেন না?”

তাহিফকে উত্তর দিতেই আমান কথাটা বলে। আমি আলিফের দিকে তাকালাম।ও ফোন বের করে কিছু একটা করছে।তাই আমি সেদিকে খেয়াল না দিয়ে তাহিফের দিকে মনোযোগ দিলাম।শালের কিছুটা অংশ নামিয়ে নিলাম তাহিফের মুখে উপর থেকে তাহিফ হাসলো আমার দিকে তাকিয়ে। জ্বরে বাচ্চাটার গা গরম হয়ে আছে তবুও বাচ্চাটার মুখে হাসি।মায়ের কষ্ট হয়তো বুঝে বিধায় হাসিখুশি থাকে।তাহিফের চোখে কান্না দেখলে আমিও কেঁদেকেটে অস্থির হয়ে যাই।এজন্য তাহিফ একটু বড় হতেই খেয়াল করেছি কান্নাকাটি কম করে।ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে এসব ভাবছি।কখনও নাক তো কখনও গাল টানছি।ভালো লাগে আমার ওর সাথে এমন খুনশুটি করতে।

“তোমার নাম কি বাবাই?”

আমান তাহিফের একটা হাতে নিজের হাতের আঙুল দিয়ে আটকে নিয়ে প্রশ্নটা করে।এতক্ষণ তাহিফের সাথে খুনশুটি করায় খেয়াল ছিলোনা আমার, যে বাচ্চাটার হাত শালের বাইরে গিয়েছে।তাহিফ একবার আমার দিকে তো একবার আমানের দিকে তাকাচ্ছে।আলিফও ফোন রেখে আমাদের তিনজনের দিকে তাকিয়ে আছে।তাহিফ আদো বুলিতে হঠাৎ উত্তর দিয়ে বললো,

“তাহিফ আহমেদ আদ্রিমান।”

আমি থমকে গেলাম;যে ছেলে আমার অপরিচিত কাউকে দেখলে কথা বলা দূরে থাক; পাশও ঘেষতে চায়না, সে ছেলে আমার অন্যের কথার উত্তর দিলো।রক্তের টান নাকি এটা! আমি তাহিফের দিকে তাকালাম। ও আমানের সাথে দুষ্টমিতে মেতে উঠেছে কোলে বসেই। কখনও আমানের হাতে চিমটি কাটছে তো আবার কোল থেকে নামার বায়না করছে। আমি তাহিফকে একটু ধমক দিলাম। আমি চাইনা ছেলেটা তার সংস্পর্শে যাক। ছেলেটা আমার ধমকে আগের মতো আমায় চেপে বসলো। আমান অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।হয়তো এভাবে ধমকানোতে নয়তো আদ্রিমান নামটা শুনে। কারণ আমার আর তার নাম মিলিয়ে নামটা রাখার কথা ছিলো আমাদের। নামটা ঠিকই রেখেছি; শুধু সে ব্যতিত আমি একা রেখেছি।আমান নিশ্চুপ হয়ে শুধু দেখেই যাচ্ছে আমাদের। আমি তাহিফের সাথে হড়হড়িয়ে কথা বলেই যাচ্ছি।তাহিফ একটার পর একটা কথা তুলছে এজন্য। ওর কথার উত্তর না পেলে রাগে খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে দেয় আমার ছেলে।

১২
প্রায় পঁচিশ মিনিটের মাথায় গন্জে এসে থামে ভ্যানটা।আলিফ আগে নেমে তাহিফকে কোলে নিলে আমি শাড়ির কুচি ধরে নেমে পড়ি।শাড়ি পড়ে থাকলেও আমি কখনো শাড়ি ঠিকমতো সামলানোর যে একটা ব্যাপার; সেটা আজও ঠিকমতো পারিনা।আলিফ ভাড়া মিটিয়ে দিলে আমি আর ও হাটা ধরি। আমানকে দেখলাম ভ্যান থেকে নেমে সিগারেট ধরাচ্ছে।সে পিছু পিছু আসলোনা আর। আলিফ নিজের ভার্সিটিতে যেতে রিকশার জন্য রাস্তার একপাশে দাড়াই।দাড়াতেই আলিফ একটা ডাক্তারের কার্ড হাতে দিয়ে বলে,

“আপু তুই এই ঠিকানায় চলে যা।আমি ভার্সিটিতে যাই।ক্লাসের সময় হয়ে আসছে।”

“তুই চিন্তা করিস না; রিকশা ধরে চলে যা তুই।”

আমার কথা শেষ হতেই একটা রিকশা পেয়ে যায় আলিফ।ও উঠে চলে যেতেই তাহিফ বলে,

“মাম্মা মামা গেলো কেনো?আমি মামার সাথে যাবো।তুমিও চলো।”

“তোমার মামা পড়তে গেছে বাবাই। তুমি বড় হও, তোমাকেও এভাবে পড়তে পাঠাবো।”

আমি উত্তর দিলাম তাহিফের কথায়।কার্ডের ঠিকানা অনুযায়ী একটা রিকশা ধরতে ঠায় দাড়িয়ে আছি আগের জায়গায়।

“মিসেস আদ্রিজা আমান মির্জা আপনার সাথে আমি কিছু কথা বলতে চাই।সুযোগটা কি দিবেন আমায়। ”

আবারও আমানের কন্ঠস্বর শুনে চকিতে পাশ ফিরে দাড়াই। রাস্তায় মানুষজন অনেক। সীন ক্রিয়েট করতে চাইলাম না। আমি মৃদু স্বরে উত্তর দিলাম,

“কোথাও গিয়ে বসা যাক।”

আমান সম্মতি দিলো। হাক ডেকে একটা রিকশা ধরে একটা রেস্টুরেন্টের নাম বললো।পনেরো মিনিটের মাথায় রেস্টুরেন্টে পৌছে যাই।রেস্টুরেন্টের একটা কেবিন বুক করে আমান।সেখানে নিয়ে বসিয়ে ওয়েটার ডেকে নিজেই আগ বাড়িয়ে খাবারের অর্ডার দিলো।আমি তা দেখে বললাম,

“আমি নিশ্চয় এখানে আপনার সাথে খেতে আসিনি।আপনি কি জন্য আমায় অযথা বিরক্ত করছেন এটা বলুন?”

“আমি ডাকলে এখন বিরক্ত লাগে আদ্রিজা আমান মির্জা!বাহ বেশ ভালো।”

“অনুগ্রহ করে আমায় আপনি মির্জা পরিবারের সাথে যুক্ত করে ডাকবেন না।আমি আদ্রিজা ইসলাম, সালাউদ্দিন ইসলামের মেয়ে।এটা বুঝেছেন আপনি? ”

“বিয়ে তো করেননি! তাহলে সবাইকে বলে কেনো বেড়াচ্ছেন বিয়ে করেছেন?”

“আমি বিয়ে করিনি কে বললো আপনাকে?”

“তাহলে আপনার স্বামী কোথায়?আর বিয়ে করবেন কিভাবে? আপনার সাথে তো আমার তালাক হয়নি; তাহলে দ্বিতীয় বিয়ের হুকুম কিভাবে পেলেন?”

“ওহহ তাহলে মনে আছে আপনার আমাদের তালাক হয়নি?”

আমার প্রশ্নের মাঝেই ওয়েটার এসে খাবার দিয়ে যায়।তাহিফ ফ্যালফ্যাল করে একবার আমাকে তো একবার আমানকে দেখছে।হয়তো ভাবছে এই লোকটা কে?যে তার মাম্মা এত কথা বলছে।ওয়েটার যেতেই আমান আমার প্রশ্নের উত্তরে বলে,

“তালাক হবে কিভাবে বলুন?যেদিন আপনার আর দুলাভাইয়ের সম্পর্কের কথা ধরা পড়লো সবার কাছে সেদিন ঢাকা থেকে এসে মাত্র বিচারের কথা তুলেছিলাম।কিন্তু আপনি তো পরদিন বিচার বসার আগেই গ্রাম থেকে উধাও হয়ে গিয়েছিলেন।উহাশীর কাছে আপনার নতুন বিয়ের খবর শুনে প্রথমে বিয়ে করেছেন মনে হয়েছিলো।পরে যখন মনে পড়লো আমার বৈধ স্ত্রী আছেন আপনি এখনও; সেখানে বিয়ে হারাম বৈকি বৈধ হবেনা।”

কথাগুলো বলতে বলতে আমান আমার প্রিয় বিরিয়ানি অর্ডার করেছিলো সেটা সার্ভ করে দেয়।আমি প্লেটটা ঠেলে তার সামনে দিয়ে বলি,

“বাহ খুব সুন্দর কথা বললেন, আমি খাবোনা, আপনি খেতে থাকুন।যাই হোক আপনার কথা শেষ? তবে আমি উঠতাম এখন।”

“এত তাড়াহুড়ো কেনো আপনার?যাই হোক আসল কথায় আসি, সেদিন কি হয়েছিলো মান অভিমান ভুলে আমায় বলবেন একটু?”

“এতদিনে আপনার সত্যি মিথ্যা যাচাইয়ের সময় আসলো আমান মির্জা?আপনার একবার অন্তত বুঝা উচিত ছিলো; যে মেয়েটা বরাবরই শান্ত সবার সাথে অথচ আপনার সাথে তার যত কথার ফুলঝুরি, সে কি বলে সেটা এট লিস্ট শুনি। কিন্তু না আপনি তো আপনার বাবা-বোনের কথায় আমায় সোজা দুশ্চরিত্রা,জাহান্নামের কীট বলে বিচার সভার আয়োজন করেছিলেন।সত্যিটা বলার প্রয়োজন মনে করছিনা।আশা করি আমায় বিরক্ত করবেন না আর।”

কথাটা বলেই আমানের উত্তরের অপেক্ষা না করে উঠে চলে আসি আমি।তাহিফ নিজেই কোল থেকে নেমে আমার হাতের আঙুল ধরে হাটতে ধরে।আমানকে একবার ফিরে দেখতে ইচ্ছে করলো; কিন্তু দেখলাম না।মা-ছেলে হেটে যাচ্ছে পাশাপাশি, এর থেকে সুন্দর সময় আমার কাছে কোনোটাই নয়।তাই এটাই উপভোগ করতে লাগলাম।রেস্টুরেন্টের বাইরে রিকশার জন্য দাড়াতেই তাহিফ ডেকে উঠে।আমি উত্তর দিয়ে বললাম,

“কিছু বলবে বাবাই?”

“লোকটা কে মাম্মা?”

তাহিফের প্রশ্ন শুনে থমকে গেলাম আমি। কি উত্তর দেবো।ততক্ষণে আমানও আমার পাশে এসে দাড়িয়েছে।আমি একবার আমানের দিকে তো একবার তাহিফের দিকে তাকাচ্ছ।

“কি হলো উত্তর দিন মিসেস আদ্রিজা!”

পাশ থেকে আমান কথাটা বলে উঠে।আমি তাহিফকে কোলে তুলে নিলাম।কোলে উঠতেই তাহিফ বলে,

“এটাই কি আমার বাবা মাম্মা?”

তাহিফের কথায় আমি চমকে তাকালাম ওর দিকে।আমানের মুখে প্রস্তর হাসি বিদ্যমান।সে ইশারায় বুঝাচ্ছে সত্যিটা বলতে।আল্লাহ আমি এখন করবো কি?শেষ পর্যন্ত ছেলেকে বাবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে হারিয়ে না ফেলি।

চলবে?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে