গল্প:#চেয়েছিলাম_তো_তোমাকেই
লেখিকা:#সুরভী_আক্তার
#পর্ব:০২ + ০৩
বাড়িতে আসার পর আম্মু শপিং এ যাওয়ার জন্য রেডি হতে বললো কিন্তু আম্মুকে আমি কিভাবে বলি যে যাদের জন্য তাদের এত আয়োজন তারাই একে অপরের প্রতি সন্তুষ্ট না।
“আম্মু”
“কি হয়েছে?আর বসে আছিস কেন যাবি না নাকি?
“বলছি যে…একটা কথা রাখবে?”
“কি কথা?”
“এই বিয়েটা না করলে হয় না?”
আমার কথা আম্মু যেন বিশ্বাসই করল না।হেসে বললো”এটা কি মজা করার সময়?আর যে মেয়ে বিয়েতে খুশি থাকে সে আবার বিয়েতে না করবে কেন?”
“আমি সিরিয়াস আম্মু!”
“আজব!তোর তো বিয়েতে কোন সমস্যা ছিল না।মতও আছে বলেছিলি তাহলে এখন এটা বলার মানে কি?”
“আমার এখনো মত আছে!
কিন্তু যার সাথে বিয়ে দিতে চাচ্ছ সেই রাজি না”
“রাজি না মানে? নিরবের কথা বলছিস?নিরব রাজি না?কেন?সে তো সবার সামনে মত দিয়েছিল”
“দিয়েছিল,কিন্তু সেটা শুধুমাত্র আন্টির মন রাখার জন্য।সে অন্য কাউকে ভালোবাসে।আর সে যদি আমাকে শুধুমাত্র অপছন্দ করত তাহলে বিষয়টা মানা যেত কিন্তু সে অন্য কাউকে চায় আর সেটা আমাকে বলেছে।
আমি যদি এখন কিছু না করি তাহলে সারাজীবন ও আমাকে দোষারোপ করবে আর এভাবে কি পথ চলা যায়? যেখানে অন্য কারো বসবাস।”
“হুম সব বুঝলাম, কিন্তু অন্য কাউকে পছন্দ হলে হেনাকে (নিরব ভাইয়ার আম্মু) বলতে পারত”
“সে তার মায়ের কাছে”না”বলতে পারবে না তাই বলছে না। তোমরা আমাকে বেকার ছেলের সাথে বিয়ে দিচ্ছ কিন্তু নিরব ভাইয়া যাকে ভালোবাসে তার বাবা মা তো এভাবে বিয়ে দিবে না তাই ভাইয়া ভেবেছিল একটা চাকরি পেলেই আন্টিকে বলে দিবে কিন্তু তা আর হলো কই?
অবশ্য চাকরি পেলে হয়ত বিয়ে করেই বাড়ি ফিরত একদম।
এখন তুমিই কিছু করতে পারো, ভাইয়ার জন্য না অন্তত আমার জন্য করো।
বিয়েটা হয়ে গেলে সে আমাকে শান্তিতে থাকতে দিবে না।
এমনও হতে পারে সে আমাকে রেখে অন্য জায়গায় চলে গেছে,সে কিছুই করতে পারে!তার আগে তুমি কিছু করো”
আমার কথা শুনে আম্মুর কপালে চিন্তার ভাঁজ দেখা দিল। আম্মু কিছুক্ষণ চিন্তা করে আমার দিকে তাকিয়ে বলল”তোর খারাপ লাগবে না?”
এই কথা শুনে আমি মাথা নিচু করে ফেললাম। কারণ এর যে কোন উত্তর আমার কাছে নেই!
“হ্যাঁ”আমি বলতে চাই না আর “না” আমি বলতে পারবো না। মিথ্যা কথা বললেই যে আমি ধরা খাই সবসময়।আমার কিছু না বলা দেখে আম্মু পাশে এসে বললো”কি করা যায় আমি দেখছি তবে নিজেকে সামলে চলিস। নিরবের অন্য কারো সাথে বিয়ে হলেও তোকে সামনে থেকে দেখতে হবে”
আম্মু চলে গেল। আমিও আমার রুমে চুপচাপ চলে আসলাম।
কত সহজেই না বলে দিলাম আমি ম্যনেজ করে নিব।করেও দিলাম।
আম্মু হয়ত ভাবছে আমার বিয়ে ভেঙে যাবে আর যার সাথে বিয়ে ভেঙে যাবে তারই বিয়ে আমাকে সামনে থেকে দেখতে হবে তাই আমার কাছে কোন উত্তর নেই। কিন্তু আম্মু তো আর জানে না এর ভিতরের জিনিসটা আমার কাছে কত গভীর!
এক বছর আগে যতটা না খুশি হয়ে ছিলাম এখন সেই খুশি দ্বিগুণ দুঃখ দিচ্ছে মনে।
সব খুশি গুলো দুঃখের নিচে চাঁপা পড়ে যাচ্ছে।
তবে এর পরের দিনগুলো আমার জন্য কেমন হবে তা আমার জানা নেই।
___________
সেই দিন বিকালেই আন্টি আমাদের বাসায় আসল।আমি ছাদে মনমরা হয়ে বসে ছিলাম তখন।
আম্মু ডাক দিয়ে বলল আন্টি নাকি এসেছে।আমি জানি এখন আন্টি আমাকে নানা প্রশ্ন করবে।
জানতে চাইবে সত্যটা। আমাকে সাজিয়ে গুছিয়ে আন্টিকে সবটা বোঝাতে হবে।
নিজেকে যথাসম্ভব শক্ত রাখতে হবে।
নিচে গিয়ে দেখলাম আন্টি একপাশে চিন্তায় ডুবে আছে।হয়ত ভাবছে তার ছেলের মধ্যে এমন কি খামতি আছে যে আমি তাকে বিয়ে করতে না করেছি!
আমি গিয়ে স্বাভাবিকভাবেই আন্টির পাশে বসে বললাম”কি খবর আন্টি? হঠাৎ এসময়?”
আন্টি যেন ভুত দেখার মত আমার দিকে তাকালো। তিনি হয়ত ভাবছেন আমি এত স্বাভাবিক আছি কি করে?
আন্টি নিজেকে সংযত রেখে বলল”নিরবকে কি তোর ভালো লাগে না?”
যা মনে করেছিলাম ঠিক তাই!আন্টি সেসব বিষয় নিয়েই আমার সাথে কথা বলতে এসেছে।
আমি বললাম”ভালো না লাগার কি আছে? তোমার ছেলে তো হাজারে একটার মত!তা হঠাৎ এগুলো কেন জিজ্ঞেস করছ?”
“কথা কাটাচ্ছিস?”
“ম..মানে?”
“তুই আমাকে সরাসরি বল সমস্যা টা কি?সবাই তো রাজি ছিলি তাহলে হঠাৎ এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার মানে কি?”
আমি অসহায় চোখে আম্মুর দিকে তাকালাম। আম্মু আমাকে চোখ দিয়ে আস্বস্ত করে সব সত্য বলতে বলল।
আমি মনে সাহস জুগিয়ে বলা শুরু করলাম”তুমি চাও না তোমার ছেলে ভালো থাকুক?”
“তার ভালো থাকা এখানে আসছে কেন?”
“তুমি শুধু আমার প্রশ্নের উত্তর দাও তাহলেই সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবে”
আন্টি বিরক্ত চোখে বললো”সে আমার ছেলে। আমার সন্তান।তার ভালো থাকা আমি চাইব না কেন?
আর চাই বলেই তো তোর সাথে বিয়ে দিতে চাচ্ছি যাতে করে সে তার জীবনে আরো সুখী হতে পারে।”
“তুমি কি একবারও তার বিয়েতে মত জানতে চেয়েছ?”
“তোদের সামনেই তো মত দিল”
“সেটা শুধুমাত্র তোমার মন রাখার জন্য।সে অন্য কাউকে চায়। সেটা সে তোমার মুখের উপর বলতে পারবে না কারণ তুমি আমি সবাই জানি সে তার পছন্দের মেয়ের চেয়ে তোমায় বেশি ভালোবাসে।
আর আমাকে যে সে পছন্দ করে না সেটা সে তার ব্যবহারের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত প্রকাশ করে যাচ্ছে।
তোমার কথায় হয়ত সে বিয়ে করে নিবে কিন্তু সুখি হতে পারবে না।তাই বলছি একবার তোমার ছেলের কথা ভাবো!
তার পছন্দকে একবার দেখ।”
“কিন্তু…”
“কোন কিন্তু না। তুমি এই বিয়েটা ভেঙে দাও! ভাগ্য থাকলে তো সেটা তুমি আমি রোধ করতে পারব না তাই না?
তাহলে হয়ত নিয়তি চায় না বিয়েটা হোক।আর যদি কোনদিন নিরব ভাইয়া চায় আমাকে মন থেকে বিয়ে করতে তাহলে সেদিন আমি আর দ্বিতীয়বার ভাববো না।”
“এটাই কি তাহলে তোর শেষ কথা?”
“ধরে নাও এটাই আমার তোমার কাছে শেষ আবদার।”
“তাহলে তাই হোক।”
“আন্টি?”
“হুম”
“আরেকটা কথা। বিয়ে নিয়ে বাসায় তুমি আর কথা উঠাবা না। কোন কথা উঠাবা না। তাকে নিজের মত থাকতে দাও।যদি সে নিজ থেকে কিছু জিজ্ঞেস করে তাহলে শুধু ছোট্ট করে উত্তর দিও।”
“জানিনা ভাগ্য কি আছে। আল্লাহ করে যেন নিরব সময় থাকতে সব বুঝতে পারে।
তোর জায়গায় অন্য কেউ থাকলে হয়ত এরকম ত্যাগ দিত না।যাই হোক খেয়াল রাখিস আর বিয়ে ভেঙেছে বলে আমাদের বাড়ি আসা বন্ধ করবি না যেন”
“তুমি কি মনে করেছ?এই হালকা একটা কারণে আমি আমাদের সম্পর্ক নষ্ট হতে দিব?”
আন্টি হালকা হাসলো, আমিও সৌজন্য মূলক একটা হাসি দিলাম। তবে এই হাসির পিছনের দুঃখটা কেউ ই দেখল না।আর আমার জন্য এটা মোটেও ছোট বা হালকা কোন ব্যাপার না!
___________
বিয়ে যেহেতু হচ্ছে না তাই আমি আমার পড়াশোনা কনটিনিউ করলাম।
ভেবেছিলাম বিয়ের পর আর পড়ব না। কারণ নিজের বাসায় পড়া আর অন্যর বাসায় পড়া,থাকা একই ব্যপার না।
তারা যতই আমাকে ভালোবাসুক আমার পড়াশোনা নিয়ে তাদের সমস্যা না থাকলেও পাড়া পড়শি ঠিকই বিষয়টাকে ভালো চোখে দেখবে না আর নানা কথা আন্টিকে লাগাবে।তখন আমাদের সম্পর্কটা আগের মত স্বাভাবিক থাকবে না।
পড়াশোনা করতে গেলেও নিরব ভাইয়ার চেহারা চোখের সামনে ভেসে উঠে।
ছোটবেলা থেকে চেয়ে এসেছি, জীবনে এমন কেউ আসবে যে আমাকে তার চোখের মনির মত রাখবে, ভালোবাসবে।নিরব ভাইয়াকে দেখে আমার এমনই মনে হয়েছিল। তাকে সবসময় চাইতাম কিন্তু ভাগ্য বলেও যে কিছু হয় সেটা হয়ত ভুলে গিয়েছিলাম। ভাগ্য হয়ত চায় না আমার আর তার মিলন হোক।
.
.
.
.
এই দুইদিন অনেক টেনশনে পার হয়েছে নিরবের।নাহারকে হারিয়ে ফেলার ভয় তাকে কুড়ে কুড়ে খেয়েছে।
রাতে শান্তিতে ঘুমাতে পারেনি। সারারাত গেছে চিন্তা করতে করতে আর শেষ রাতের দিকে ঘুমিয়েছে।
কিন্তু অবাক করার বিষয় হলো এই দুইদিনে মা একবারো বিয়ে নিয়ে একটি কথাও বলেন নি।
নিরবও আগ বাড়িয়ে কিছু জিজ্ঞেস করেনি।তবে আজই যদি বিয়ে হয়?
তাই খাওয়ার টেবিলে বসে কৌতুহল দমিয়ে রাখতে না পেরে নিরব জিজ্ঞেস করেই ফেলল”মা বিয়ের কি খবর?”
মা একবার নিরবের দিকে তাকিয়ে প্লেটে ভাজি উঠাতে উঠাতে বললেন”কার বিয়ে?”
নিরব মায়ের ব্যবহার দেখে অবাক হলো।যিনি বিয়ে নিয়ে সবচেয়ে খুশি ছিলেন তিনি জিজ্ঞেস করছেন কার বিয়ে?
এখানে কি অন্য কারোও বিয়ে নাকি?
“আমার বিয়ে”
“ওমা, তোর বিয়ে তো এখনো ঠিক করি নি বাবা।যখন তোর কাউকে পছন্দ হবে তখন বলিস। আগে একটা চাকরি তো নে!”
“কেন?অথৈ এর সাথে বিয়েটা হচ্ছে না?”অবাক হয়ে বলল নিরব
নিরবের কথা শুনে তিনি নিরবের দিকে এক নজর তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন”তোর তো তাকে পছন্দ নয় তাইনা?তাই তোর ভালোর কথা ভেবে সে বিয়েটা ভাঙিয়ে দিয়েছে।আশা করি বুঝতে পেরেছিস।
এবার জলদি খাওয়া শেষ কর।এখন ৮টা বাজে ১০ টার দিকে তো আবার তোর ইন্টারভিউ আছে”
মায়ের কথা শুনে নিরবের মনে পড়ল তার ইন্টারভিউ আছে।এই ৩-৪ দিনের টেনশনের মধ্যে তার কিছু মনেই ছিল না আর না কিছু পড়েছে। তাই সে বলল”না আম্মু আজকের ইন্টারভিউ টা দিব না এর পরের সপ্তাহে কোন ভালো কম্পানিতে জবের জন্য ট্রাই করব”
“তোর যেরকম ইচ্ছা”
নিরবের খারাপ লাগলো তার মাকে মনমরা দেখে।
অথৈকে মায়ের পছন্দ তাই হয়ত মায়ের খারাপ লাগছে কিন্তু নাহারও তো ভালো মেয়ে,মায়ের নিশ্চয়ই পছন্দ হবে তাকে। শুধু একটা চাকরি পাই।
নেক্সট উইক এ কোন ভালো জায়গায় ইন্টারভিউ দিব। তাড়াতাড়ি একটা চাকরির খোঁজ করতে হবে।আমি নাহয় আমার বিয়েটা আটকে ফেলেছি দুই দিন পর যদি নাহারের বিয়ে হয়ে যায়?
না এটা হতে দেওয়া যাবে না।
চলবে…
গল্প:#চেয়েছিলাম_তো_তোমাকেই
লেখিকা:#সুরভী_আক্তার
#পর্ব:০৩
কেটে গেছে আরো দুই দিন।
আজ শুক্রবার।তাই বান্ধবী প্রমাকে কল দিয়ে আসতে বলেছি বাড়ির কিছুটা দূরে।
জায়গাটা অনেকটা গাছে ভরা, নিরিবিলি পরিবেশও বলা যায়।
মানুষের যাতায়াত কম।পাশ দিয়ে একটা নদীও আছে।
__________
রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলেছি আমি আর প্রমা।মনটা অনেক প্রফুল্ল লাগছে এখন।
“এই?”
হঠাৎ প্রমার ডাকে তার দিকে তাকিয়ে বললাম”কি হয়েছে?”
“ওইটা নিরব ভাইয়া না?”
তার দৃষ্টি অনুসরণ করে আমি সামনের দিকে তাকিয়ে দেখলাম নিরব ভাইয়া গাছে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আর তার সামনেই আরেকটা গাছে হেলান দিয়ে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
তার পিছন টাই দেখতে পাচ্ছি শুধু।তবে তার লম্বা চুল দেখে চিনতে অসুবিধা হলো না যে এইটা নাহার আপু।তাই প্রমাকে বললাম”আমার আর ভালো লাগছে না চল না বাসায় ফিরে যাই?”
“খুব বেশি খারাপ লাগছে?না মানে নিরব ভাইয়ের সাথে দেখা সাক্ষাৎ হয় না তো দেখা করেই যাই?”
“তোর ইচ্ছে হলে যা, আমাদের তো প্রায়ই দেখা হয়”
“আচ্ছা বাদ দে। তুই যাবি না তাহলে আমি একা গিয়ে কি করবো?চল আমিও বাসায় যাই”
পিছন ফিরতেই আমি টাস্কি খেলাম। পিছন থেকে নিরব ভাইয়ের আব্বু সাদ আঙ্কেল আসছে।আজ শুক্রবার হাট বাজারের দিন।তাই হয়ত সকাল সকাল আঙ্কেলের দেখা পাওয়া গেল।
আন্টি হলে তবুও কোন কিছু হত না। আঙ্কেল যদি একবার নিরব ভাইয়াকে অন্য মেয়ের সাথে দেখেছে!
আমি জলদি প্রমার হাত ধরে আবারো নিরব ভাইয়াদের দিকে যেতে লাগলাম।
তখন প্রমা বলল”কিরে ওইদিকে কই যাস আবার? তোর না খারাপ লাগছে?”
“তুই তো বললি নিরব ভাইয়ের সাথে দেখা করবি তাহলে দেখা করেই যা”
“কিন্তু..”
“এখন চুপচাপ দেখা কর পরে সবটা বলছি”
আমার কথা শুনে প্রমাও আর কিছু বলল না।
আমি নিরব ভাইয়া দের সামনে যেতেই তারা অপ্রস্তুত হয়ে গেল।
হঠাৎ আমাদের এখানে তারা আশা করে নি।
আমি নাহার আপুর দিকে তাকিয়ে বললাম”আপু! তুমি একটু দূরে যাও,নিরব ভাইয়ার আব্বু আসছে!”
আমাকে দেখে নাহার আপু হয়ত কটাক্ষ করে কিছু বলত কিন্তু আমার মুখে এই কথা শুনে কিছু বলল না। কিন্তু পিছনে ফিরে যাওয়ার সময় আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল”নিরব কিন্তু আমারই থাকবে”
আঙ্কেলের কথা বলাতে যে ভয়ের রেখা ভাইয়ার মুখে ফুটে উঠেছিল সেটাই এখন নাহার আপুর কথায় খুশিতে পরিণত হয়েছে তবে কথাটা আমার মনে দাগ কেটে গেল।
প্রমা বুঝল না কিছুই। কারণ এসব কিছুই শুধুমাত্র নিরব ভাইয়া আর আমার পরিবারের মাঝেই ছিল কিন্তু নিরব ভাইয়াই হয়ত নাহার আপুকে বলেছে কারণ সে কোন কিছুই ওর থেকে লুকায় না।
এরই মাঝে আঙ্কেলও আমাদের পাশে এসে গেছে।আমরা কিছু সৌজন্যে মূলক কথা বলেই আঙ্কেলকে বিদায় দিলাম।প্রমাও নিরব ভাইকে কিছু সাধারণ কথাবার্তা জিজ্ঞেস করল।
তারপর আমরা বিদায় নিতে গেলেই নিরব ভাইয়াও বলল সেও এখন বাসায় যাবে তাই আমরা একসাথেই হাঁটতে থাকলাম।
প্রমা মধ্যখানে আর আমরা দুইজন দুপাশে।আমি তার পাশে দাঁড়াতে পারি নি কারণ”সংকোচ”আর সে দাঁড়ায় নি কারণ আমি সরে এসেছি বলে।
চুপচাপ হাঁটতে হাঁটতেই হঠাৎ প্রমা বলে উঠল”আচ্ছা নাহার আপুর তখনকার কথাটার মানে কি?”
ওর এই প্রশ্ন শুনে আমি আর নিরব ভাইয়া দুজনেই দাঁড়িয়ে গেলাম।
আমাদের দাঁড়াতে দেখে প্রমাও দাঁড়িয়ে বলল”কি হলো দাঁড়িয়ে গেলি কেন?”
তখন আমরা আবারো হাঁটতে শুরু করলাম।আর বললাম”তুই তো জানিসই নাহার আপু নিরব ভাইকে কত ভালোবাসে আর আমি আর নিরব ভাইতো অনেক ক্লোজ তাই হয়ত ভুল বুঝে বলেছে”
আমার কথা প্রমার বিশ্বাস হলো বলেই মনে হয়।পরের রাস্তায় আমি সংকোচে পড়লাম কারণ এতক্ষণ প্রমা সাথে ছিল কিন্তু তার বাড়ি ডান দিকেই আর আমাদের এখন একা যেতে হবে।
আমি কিছু না বলেই চুপচাপ হাঁটতে থাকলাম।এমনি দিন হলে হয়ত বকবক করে মাথা খেয়ে ফেলতাম তার,তবে আজ নিজেকে নিজের কাছেই তুচ্ছ মনে হচ্ছে।
“নাহারকে সব বলেছি আমি,এত সংকোচের কিছু নেই”
“জানি আমি”
“জানিস মানে?”
“তার থেকে তো তুমি কিছু লুকিয়ে রাখো না তাই জানি”
“তাহলে এত সংকোচ কিসের?”
“একটা মেয়ের পছন্দের মানুষের সাথে বিয়ে ঠিক হওয়ার পর বিয়ে ভাঙলে সে নিশ্চয়ই আনন্দে আত্মহারা হয়ে থাকবে না।
না পাওয়ার চেয়ে পেয়ে হারানোর দুঃখ টা বেশি লাগে।
তবে সেই শোকে যে তোমার বিয়েতে আসব না সেটা কিন্তু মনে করো না, অবশ্যই আসব আর নিজ হাতে সবটা করব”
আমার কথার বিপরীতে নিরব ভাইয়া আর কিছু বলল না।
.
.
.
বাড়ি ফিরেই গোসল করলাম।নিরব ভাইয়া আর আমার বিয়ের খুশিতে যে পেন্টিংটা করছিলাম সেটাও বাকি থেকে গেছে।
তো কি হয়েছে? বিয়ে না হোক! সেটা তো আমি কমপ্লিট করেই ছাড়ব।
তাই সমস্ত সরঞ্জাম নিয়ে বেলকনিতে এসে বসলাম। আম্মু এখানে সাধারণত আসে না তাই এটা শেষ হলে এখানেই রেখে দিব।
মন খারাপ হলেও এখানে এসে এটা দেখব, হুম!
অন্যদিকে,
নিরব মন দিয়ে প্রিপারেশন নিচ্ছে।তার চাচা একটা ভালো জায়গায় ইন্টারভিউ দেওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছে।
যদিও জব সাইট গুলো থেকে সে প্রতিনিয়ত এগুলো খবর নিতেই থাকে।
তার মন মত সরকারি চাকরির পরিক্ষা এটা। একবার টিকে গেলেই নাহারকে প্রথমে জানাব তারপর সে কত খুশি হবে!
২৫-২৬ বারের মত নিরবকে ফোন দিয়েও নাহার পাচ্ছে না।
মেজাজ গরম হয়ে গেছে তার একেবারে।
নিরবের সাথে একবার দেখা করা উচিত নাহলে পরে ঝামেলা করবে।
কিন্তু ফোন দিয়ে কি নিরবকে পাওয়া যায়?
সে একদম মন দিয়ে পড়তে ব্যাস্ত।যদিও নাহার ছাড়া তেমন কেউ নিরবকে ফোন দেয় না তবুও সে ঠিক করেছে চাকরি হয়ে গেলেই নাহারের সাথে মন খুলে কথা বলবে সে।
তার মন বলছে চাকরিটা এবার হয়েই যাবে।
পরদিন সব কাগজপত্র গুছিয়ে মাকে সালাম করে নিরব বেরিয়ে গেল।
এর আগে কয়েকটা ইন্টারভিউ সে দিয়েছে তাই তেমন একটা নার্ভাসনেস তার মধ্যে কাজ করছে না।
প্রিপারেশনও ঠিক ঠাক আছে। শুধু কনফিডেন্ট থাকতে হবে।
পাঁচ মিনিট পর অফিসে এসে পৌঁছালো সে। সরকারি অফিস গুলো বুঝি এমনই বড় হয় প্রত্যেকটা?
তাই হবে!নয়ত কি সরকারি কর্মচারীদের বাড়ি এমনিই বড় বড় হয়?
রিকশা ভাড়া মিটিয়ে ইন্টারভিউ রুমের দিকে এগুলো সে।সবাই প্রায় নার্ভস। কেউ বা বইয়ে মুখ গুঁজে আছে। আচ্ছা এরা কি জানে না পরিক্ষার আধা ঘন্টা আগে থেকে ব্রেনকে রেস্ট দিতে হয়।
পড়াগুলো মাথায় সব ইনপুট হয়।জানবেই বা কিভাবে এরা তো ফার্স্টবেঞ্চার ছিল। সারাক্ষণ শুধু বইয়ে কিভাবে যে ঢুকে থাকে! একটুও ক্লান্তি বা বিরক্তি লাগে না?
দেখতে দেখতে নিরবের ডাক পড়ল।নিরব সব প্রশ্নের উত্তর সহজেই দিয়ে দিল।
তার কনফিডেন্স দেখে তারাও নিরবকে জব দিয়ে দিতে দিল আর দুয়েক দিনের মধ্যেই জয়েন হতে বলল।
নিরব “Thank you sir” বলে বেরিয়ে এলো ঠিকই কিন্তু তার নাচতে ইচ্ছে করছে এখন।
ইন্টারভিউ রুম থেকে বেরিয়ে সে তার পকেট থেকে ফোন বের করে সুইচ অন করেই দেখতে পেল নাহারের অনেকগুলো কল। দেখেই সে মুচকি হাসলো তারপর নাহারকে কল করল সে।
ওইদিকে নাহার নিরবের কল পেয়েই নিজের রুমে গিয়ে রিসিভ করল। বাসায় অনেক মানুষ তো!কেউ কিছু শুনে ফেললে তো সমস্যা!
“হ্যালো নাহার, বলছি যে এখনি আমার সাথে দেখা করতে পারবা?”
নাহারেরও যেহেতু নিরবের সাথে দেখা করার প্রয়োজন ছিল তাই সেও দ্বিমত পোষণ করল না। শুধু বলল”কোথায় দেখা করতে হবে?”
“***এখানে চলে আসো, তোমার বাসারও পাশে হবে”
পৌঁছাতেই নিরব বলল”তোমার জন্য সারপ্রাইজ আছে!”
“কিন্তু তোমার আর ফালতু সারপ্রাইজ আমার দরকার নেই”
এর আগেও সারপ্রাইজ বললে নিরব শুধু গিফট দিত কিন্তু এইবার যে সত্যি বড় একটা সারপ্রাইজ আছে তা নাহার শুনল না।ওর মনে হল নিরব হয়ত কোন ফালতু গিফট ই এনেছে।
“এভাবে বলছ কেন? আচ্ছা ফোন অফ ছিল তাই? আচ্ছা রাগ করো না আমার গিফট এই তোমার সব রাগ ঠান্ডা হয়ে যাবে”
“বললাম তো তোমার কোন ফালতু গিফট আমার দরকার নেই”
“এভাবে বলছ কেন?আর কারন কি?”
“কারণ আমি এই রিলেশন টা আর কনটিনিউ করতে পারছি না”
“কথাটা শুনে নিরবের কি বলা উচিৎ সে বুঝল না তবুও কোনরকম বললো”কারণটা কি জানতে পারি?”
“অবশ্যই, তার জন্যাই তো কাল থেকে ফোন করেও তোমাকে পাই না
সে যাই হোক, আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। ছেলে সরকারি চাকরি করে আর সেখানে তো তুমি একটা বেকার আর এরকম রিলেশনের কোন ভবিষ্যৎ নেই”
“কিন্তু তুমি তো অথৈকে কালকেই বললে আমি শুধু তোমারই থাকবো তাহলে তুমি অন্য কারো হয়ে যাচ্ছ কেন?”
“কারণ তখন আমি বুঝি নি”
“আচ্ছা বিয়েটা তুমি ভাঙার চেষ্টা করো নি?”
“পাগল হয়েছি আমি?এত ভালো একটা ছেলেকে আমার ফ্যামিলি হাতছাড়া করবে নাকি?
সেটা তো বোকামি হবে!”
“তাহলে আমাদের ভালোবাসা?”
“কিসের ভালোবাসার কথা বলছ?যেটা কখনো ছিলই না? শোন,আমি একমাত্র সাজিদকেই ভালোবাসি।যার সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে।
সময় পেলে একদিন দেখা করিয়ে দিব।আর দাওয়াত দিতে ভুলব না চিন্তা কইরো না
আর বিয়েতে কোনপ্রকার ব্যঘাত ঘটানোর চেষ্টা করো না।”
“আচ্ছা করব না”
নাহার ঘুরে চলে যাচ্ছে আর নিরবের চিৎকার করে বলতে মন চাইছে”আমিও চাকরি পেয়েছি, চাকরির দোহাই দিয়ে হলেও আমার হয়ে থেকো।”
কিন্তু সে বলবে না কারণ সে নাহারের আসল চেহারা টা দেখে ফেলেছে যা শুধু টাকাকেই ভালোবাসে।
এখন যদি নাহার ওকে বিয়ে করতে রাজিও হয় তবুও তাকে নয় কিংবা তার জন্য নয় তার টাকার জন্য করবে।
এখন অথৈ এর বলা প্রত্যেকটা কথা তার মনে পড়ছে।
সে নাহারের বিরুদ্ধে বলেছিল বলে তাকে এই নিজ হাতে চড় মেরেছি।
আমার খারাপ হবে ভেবে সে নাহারকে দূরে করার চেষ্টা করছিল কিন্তু আমি?
অথৈকে প্রত্যখান করেছি আমি। তার ভালোবাসা তার ফিলিংস আমার জন্য সত্য ছিল সেগুলোকে প্রত্যখান করেছি আমি।
হিরাকে কাঁচ ভেবে ভুল করেছি আমি।মাকে কি জবাব দিব আমি?
এত এত ভুলের মাঝে কার কাছ থেকে ক্ষমা পাব আমি?
এগুলোর একটাই সমাধান।হ্যাঁ!সেটাই করব আমি।
আরেকটা রিকশা ডেকে বাড়ির পথে রওনা হলো নিরব।
.
.
.
কলিং বেল বাজতেই নীলিমা জাহান গিয়ে দরজা খুলে দিলেন।এসময় নিরবকে দেখে তিনি অবাকই হলেন। তবুও বললেন”এসময় নিরব? কোন কাজ ছিল নাকি?”
“অথৈ কোথায়?”
“হঠাৎ অথৈ এর কথা”(অবাক হয়ে)
আন্টি প্লিজ বলো!
ও তো ছাদে আছে
আচ্ছা
বলেই নিরব ছাদের দিকে গেল। নীলিমা শুধু নিরবের কার্যকলাপ দেখলেন।চোখ মুখ কেমন বিধ্বস্ত লাগছে তার। তাহলে কি সে নিজের ভুল বুঝতে পারল?
ভেবেই মুচকি হাসলেন নীলিমা।
ছাদে বসে দুরের পানে চেয়ে ছিলাম আমি। ঘরের চার দেয়ালে বন্দী থাকার চেয়ে ছাদে খোলা আকাশের নিচে মৃদু বাতাসও ঢের ভালো।
হঠাৎই পায়ের আওয়াজে পিছন ফিরেই নিরব ভাইকে দেখে অবাক হলাম।সে অনেক তাড়াতাড়ি আমার কাছে এসে বললো”অথৈ?একটা প্রশ্নের উত্তর দিবি?”
হঠাৎ এসেই প্রশ্ন শুনে কেমন যেন লাগছে। তবুও বললাম”বলো”
“আমার যে চাকরি নাই তবুও তুই কেন বিয়ে করতে রাজি হলি?”
“চাকরি তো হাতের মোয়া না যে চাইলেই পাওয়া যাবে আর এমনও না যে তুমি কোনদিন চাকরি পাবা না আর আমি কি ষাড় যে সব খেয়ে ফেলব?”
“আর আমি?”
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম”সেটা তো জানোই”
“অথৈ!আমি তোর কাছে কিছু চাইলে দিবি?”
“তোমার জন্য তো আমি নিজেকেই বিলিয়ে দিতে রাজি সেখানে কিছু চাইলে দিতে পারব না?বলো কি চাও”
“তোকে বিয়ে করতে চাই”
চলবে….