চিলেকোঠার_ভালোবাসা পর্ব-০৮ এবং শেষ পর্ব

0
1600

#চিলেকোঠার_ভালোবাসা
#পর্ব_৮ (শেষ)
#Adharer_Musafir (ছদ্দনাম)
(ফাহমিদা ইফ্ফাত ছিদ্দীকা)

আমার কথা শুনে নিলা অবাক হয়ে গেলো।
বোধহয় ভাবেনি এত সহজেই আমাকে কনভেন্স করতে পারবে।
নিলার মুখে বিজয়ের হাসি, যেনো আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছে।
চোখের পানি মুছে নিলা আমাকে বললো—

— সত্যিই তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছো ফায়াজ?
আমি জানতাম তুমি এখনও আমাকে অনেক ভালোবাসো, সেজন্যই তো আমি আসতেই তোমার মুখে হাসি ফুটে উঠেছে।

🍂

নিলাকে কথার পেছনে এনে দাঁড় করাতেই দেখি কথা মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে চোখের পানিটা খুব গোপনে মুছে ফেললো।
মুচকি হেসে নিলাকে ছেড়ে কথার হাত ধরে নিলার মুখোমুখি দাঁড় করালাম।
কথা খানিকটা অবাক হলেও নিজেকে সামলে নিয়ে আমাকে বললো–

— সবার সামনে এভাবে হুট হাট হাত ধরবেন না আমার।

যদিও কথার হাত ছেড়ে দিয়েছিলাম আমি, কিন্তু কথার এমন অভিমানি কণ্ঠে বলা কথায় আমি পুনরায় কথার হাতের পাঁচ আঙুলের ভেতর আমার হাত ঢুকিয়ে শক্ত করে ধরে উল্টো পিঠে চুমু খেলাম।
আমার এমন কান্ডে কথা এবং নিলা দু’জনই আমার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে।

কথার হাতের উল্টো পিঠে গভীর চুমু খেয়ে চওড়া একটা হাসি দিয়ে নিলার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললাম–

মিস নিলা অর মিসেস হোয়াটএভার, মিট মাই ওয়াইফ ওহ সরি; একচুয়েলি এখনও হয়নি।
এইতো কিছুদিনের মধ্যেই আমরা বিয়ে করছি।
বিয়ের প্রথম ইনভাইট আপনাকেই দিলাম, আমাদের বিয়েতে অবশ্যই আসতে হবে আপনাকে।

কথার হাতটা তখনও শক্ত করে বুকের মাঝে ঠেশে নিলাকে বললাম–

তুমি যদি ভেবে থাকো তোমাকে দেখানোর জন্য জেদ করে আমি প্রেম করছি কিংবা এসব বলছি তাহলে ভুল ভাবছো।
এই যে দেখছো এই মেয়েটাকে, ওর নাম কথা।
এই মেয়েটা তোমাকে চিরদিনের মতো ভুলে যেতে আমাকে একশত ভাগ সাহায্য করেছে।
আমি কখনই বলিনি কথাকে আমাকে সাহায্য করো, নিলাকে ভুলতে আমার তোমাকে প্রয়োজন।
নিজ থেকেই এসেছে, আর সব থেকে বড় কথা কি জানো?
আমি একটা ভাঙাচোরা মানুষ সেটা জানার পরও মেয়েটা আমাকে ভালোবেসেছে।
আমার ব্যক্তিত্বকে আপন করে নিয়েছে।
আর এটাই সত্যি যে, এই মেয়েটাকে এখন আমি নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসি।
তোমাকে যতটা ভালোবেসেছিলাম তার চেয়েও বেশি ভালোবাসি এখন কথাকে।
আমার জীবনে তোমার আর কোনো অস্তিত্বই নেই মিস নিলা।

আসলে কি বলোতো, তোমার জন্য আমার অভিশাপও এখন আর আসে না।
অভিশাপ দেয়ার জন্যও তো কাউকে মনে রাখা লাগে, তুমি তো আমার মনের কোনো খানেই নেই অভিশাপ কোথা থেকে আসবে বলো!

না না আমার কি মনেহয় জানো?
আমার তোমার প্রতি কৃতজ্ঞতা দেখানো উচিত।
তুমি আমার জীবন থেকে চলে না গেলে এই যে দেখছো কথাকে, এই মেয়েটার দেখাই পেতাম না।
কিন্তু তোমাকে আমি ধন্যবাদ বলবো না, কারন কি জানো?
নিয়তির লিখা বলে একটা কথা আছে, বিধাতা যাকে আমার জন্য নির্ধারন করে রেখেছে, তাঁর থেকে আমি যতোই মুখ ফিরিয়ে নেই না কেনো, সে আমার হবেই।
শুধু দেখার চোখটাই ভিন্ন, মেনে নেওয়াটা একান্তই নিজের।

বিয়েতে অবশ্যই আসবেন মিস নিলা।
চলো কথা, আজকে রিকশায় দু’জন মিলে সারা শহর ঘুরবো।

🍂

কথার হাত শক্ত করে ধরে সেখান থেকে চলে এলাম রাস্তায়।
এদিকে কথা যে আমার দিকে এখনও হা করে তাকিয়ে আছে তার তোয়াক্কাই করছিনা আমি, অবশ্য হাসি পাচ্ছে খুব।
রিকশায় উঠে বসে নিজে থেকেই রিকশার হুড উঠিয়ে দিলাম।
আজ আর কোনো সঙ্কোচতা নেই আমার।
আকাশটা আজও ভিষন মেঘলা, বোধহয় বৃষ্টি নামবে খুব শীঘ্রই।

বলছি যে এভাবে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলে কিন্তু আমার খুব লজ্জা লাগে।
চোখ না নামিয়ে নিলে, হয় তুমি প্রেমে পড়বে না হয় আমি।

— এসব কি হচ্ছে, কেনো এমন করছেন!

জানো কথা, যারা প্রকৃত প্রেম বোঝে তারা কখনো প্রেমিক হতে পারে না।
কারন ছলনার এই শহরে তারা সর্বদাই অবহেলিত।
ব্যতিক্রম মানুষ হিসেবে তাদের মূল্য বোঝার কেউ নাই।
তাই প্রেম আমি বোঝাতে পারবো না, প্রেম আমি করতেও চাইনা।
খুব দ্রুতই তোমাকে বিয়ে করবো আমি।

বলেই হাত ছেড়ে বাতাসে উড়তে থাকা কথার চুলগুলো কানের পেছনে নিয়ে রজনীগন্ধার স্টিক থেকে গোলাপটা কথার কানে গুজে দিলাম।
আমার হাত এক ঝটকায় সরিয়ে দিয়ে কথা বললো–

— কি বলতে চান আপনি, আমি প্রেমিকা নই?

বলেই কথা চুপ হয়ে গেলো।
বোকা মেয়ে, রাগের মাথায় কি থেকে কি বলে ফেলেছে বলে চুপষে গেছে।
শব্দ করে হেসে বললাম–

তুমি প্রেম বোঝো?
বুঝলে এতদিন আমার সাথে অভিমান করে থাকতে পারতে না।
কথার হাতটা আবার আলতো করে ধরতেই সে আমার দিকে তাকালো।
বললাম-

আমি না খুব অলস, উত্তরের ঐ জানালাটা খুলতে একদমই মনে থাকেনা আমার।
তুমিই না হয় ঐ জানালাটা প্রতিদিন খুলে দেয়ার দায়িত্ব নাও।
কথা দিচ্ছি, রোজ দু’জনে জানালার ধারে বসে এক কাপ চায়ে আড্ডা দেবো।
তুমি কথা বলবে আর আমি শ্রোতা হয়ে শুনবো।

কথা চোখ সরিয়ে নিলো।
গোলাপটা কথার চুল আর কানের মাঝে খুব মানিয়েছে।
বোধহয় মেয়েটা একটু লজ্জা পাচ্ছে ।
বললাম–
বিয়েতে কিন্তু আমি তোমার হাতে মেহেদী একদম দেখতে চাইনা।
তোমার হাত একেবারে খালি থাকবে, মেহেদীর গন্ধটা আমি একদমই নিতে পারিনা।

আমার এমন উদ্ভট কথায় মেয়েটা ফিক করে হেসে দিলো।
আমি নিরবে তাকিয়ে দেখছি ঐ হাসি, কি মিষ্টি হাসি।
ইচ্ছে করছে টুপ করে নিয়ে খেয়ে ফেলি, পাগল আমি’ মানুষের হাসি আবার খাওয়া যায় নাকি?

আমার এমন ভাবনার বিচ্ছেদ ঘটলো কথার চিৎকারে।
হঠাৎই পেছন থেকে একটা গাড়ি এসে আমাদের রিকশায় ধাক্কা দেয়।
খুব বেশি জোড়ে ধাক্কা খায়নি অবশ্য, রিকশাওয়ালা দ্রুত ব্রেক করায় আর তেমন কিছু হয়নি।
পেছনটা একটু মুচড়ে গিয়েছে শুধু।
কথার দিকে তাকাতেই দেখি, কপাল কেটে হালকা রক্ত বের হচ্ছে।
রিকশার সাইডের লোহার রডের সাথে কপালে ধাক্কা লেগে এই অবস্থা হয়েছে।
দ্রুত কথাকে রিকশা থেকে নামিয়ে পাশের একটা ফার্মেসিতে নিয়ে কপালটা ড্রেসিং করিয়ে দিলাম।
ভাগ্যিস ধারে কাছেই ফার্মেসি ছিলো।

কপালে ওয়ানটাইম লাগিয়ে রাখায় কথাকে দেখতে কেনো জানিনা আরো কিউট লাগছে।
কে জানে আমার এসব উৎপটাং ফিলিংস কোথা থেকে আসে।
এখন কথাকে দেখে আমার আফসোস করা উচিত, কথার কষ্টে কষ্ট পাওয়া উচিত সেখানে তাকে দেখে আমার কিউট লাগার ব্যপারটা একটু বেশিই অদ্ভুত লাগছে নিজের কাছে।
সে যাই হোক, কথাকে দেখতে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে।
খুব বেশিই কি ব্যাথা পাচ্ছে নাকি বুঝতে পারছি না।
হাঁটতে হাঁটতে বললাম– ফুচকা খাবে!

আমার কথায় কথা বড় বড় চোখ করে তাকালো।
মনে হচ্ছে এই প্রশ্নের অপেক্ষাতেই ছিলো মেয়েটা।
মুচকি হেসে কথার হাত ধরে রাস্তার উপারে নিয়ে গেলাম।

একের পর এক ফুচকা মুখে পুরে নিচ্ছে কথা।
অবশ্য এক প্লেট খাওয়া শেষ হয়েছে কিছুক্ষন হলো।
এক প্লেট শেষ করে কথা আমার দিকে তাকাতেই আমি স্বশব্দে হেসে আরো এক প্লেট ফুচকা দিতে বললাম।
ওপরওয়ালা বোধহয় মেয়েদের এই একটা খাবার, গপাগপ গিলে ফেলার অসীম ক্ষমতা দিয়ে দিয়েছেন।
কি করে এরা এভাবে অমৃতের মতো ফুচকা খায় কে জানে।
আমি তাকিয়ে আছি কথার দিকে, মেয়েটার আর কোনো দিকে হুশ নেই; একের পর এক বাটি থেকে ফুচকা তুলে খেয়েই যাচ্ছে।
বোতল থেকে পানি নিয়ে হাত ধুতে ধুতে কথাকে বললাম–

আজ বিকেলে ছাঁদে থেকো, অনেকদিন বিকেলে গল্প করা হয়না।

— কেনো, আপনার সাথে গল্প করবো কেনো?
আমি কি আপনার কেউ হই!

মুচকি হেসে বললাম- চশমা ছাড়াই এসো, তোমাকে চশমা ছাড়াই বেশ লাগে।

🍂
🍂
🍂

বাসায় পৌছেই তানভিরের ফোন পেয়ে বেশ হকচকিয়ে গেলাম আমি।
নিলা, আমি আর তানভির একটু বেশিই ক্লোজ্ড ছিলাম বটে, তবে নিলার সাথে সম্পর্ক শেষ হবার পর থেকে ভার্সিটির প্রায় সবাইকেই ইগনোর করে চলতাম।
হঠাৎ আজ তানভিরের ফোন, কোনো সমস্যা হয়নি তো?
রিসিভ করে ফোন কানে নিতেই তানভির প্রায় হাঁপাতে হাঁপাতে যা বললো তাতে আমার মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে উঠলো।
এমন সংবাদে হাসি আসাটা খুবই জঘন্য একটা ব্যাপার তবে ঐ যে নিয়তির বিচার।
তার উপর বিশ্বাস করে সব কিছু ছেড়ে দিয়েছিলাম আমি।
না, প্রকৃতি ঠিকই প্রতিশোধ নিয়েই ছাড়ে।
তাই কিছু কিছু জিনিস মানুষকে প্রকৃতির হাতেই ছেড়ে দিতে হয়।

নিলা এখন হসপিটালের বেডে শুয়ে হয়তো মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে।
নিলার পেটে অবৈধ সন্তান বেড়ে উঠছিলো কিনা।
আমার সাথে থাকলে তো আর আমাকে তোমার বেড পার্টনার বানাতে পারতে না।
তাই অযোগ্য ক্ষেত নামক ট্যাগ দিয়ে সম্পর্ক শেষ করে চলে গিয়েছিলে।
নতুন সম্পর্কে জড়িয়ে তোমার চাহিদা মেটানোর মেশিনকে খুশি করতে গিয়ে অবৈধ কাজে লিপ্ত হয়েছো, পেটে বাচ্চা আসার পর সে ফিরিয়ে দেয়াতেই বোধহয় আজ আমার কাছে ফিরে আসার ভিক্ষে চাইছিলে তুমি?
যেই দেখলে আমিও মেনে নেইনি, ওমনি সুইসাইড করতে বসে গেলে!
সরি টু স্যে নিলা, কিন্তু তোমার জন্য আমার নূন্যতম আফসোসটুকুও হচ্ছেনা।
আমি অতটা ভালো মানুষও নই, বদলে গেছি।
আমাকে বদলে দিয়েছে নতুন কেউ একজন।
অবশ্য আমি ভাবছি তুমি যে তোমার পেটের অবৈধ বাচ্চাটাকে আমার বলে চালিয়ে দাওনি এটাই বা কম কি।

কিন্তু আমি চাইনা তুমি মরে যাও।
এত সহজে মরে গিয়ে বেঁচে যাবে তুমি?
নাহ, তোমাকে বাঁচতে হবে, দেখতে হবে আমি কতটা সুখে আছি।
তোমার দেয়া অবহেলার আগাছা উপড়ে ফেলে আমি কিভাবে মাথা উঁচু করে বেঁচে আছি তোমাকে সেসব দেখতে হবে।

কল কেটে দিতেই আবার ফোন বেজে উঠলো।
আননোন নাম্বার থেকে ফোন এসেছে।
রিসিভ করতেই দ্বিতীয়বারের মতো মুখে হাসি ফুটে উঠলো আমার।
তবে এবার তাচ্ছিল্যের নয়, আনন্দের হাসি।
ইন্টারভিউর জন্য আমাকে আসতে বলেছে।
ভাবতেই কেমন লাগছে, সেই কবে থেকে এখানে সেখানে চাকরির এপ্লাই করছি।
আজ দিনটাই খুব অন্য রকম।
ধীর পায়ে গিয়ে উত্তরের জানালাটা খুলে দিলাম।
আকাশটা এখনও খুব মেঘলা।
তখন বৃষ্টি এলো এলো করেও আসেনি।
সত্যিই, মেয়েটা কি করে বোঝে এতকিছু।
খোলা জানালার সামনে দাঁড়িয়ে ঠান্ডা বাতাসে মনটা মুহূর্তেই ভালো হয়ে গেলো আমার।
আচ্ছা এখন কি মাস?
কে জানে, বাংলা মাসের প্রতি বরাবরই বেখায়ালি আমি।

🍂

বিকেলে ছাঁদে পা রাখতেই দেখি কথা আমার আগেই ছাঁদে এসে উপস্থিত।
এক দিন বৃষ্টি থামার পরে কালো শাড়ি কালো টিপ কালো চুরি পরে এসো মেঘ ভেবে প্রেমে পরে যাবো।
বজ্রপাতের শব্দ শুনে কেপে উঠো নিয়ম ভেঙ্গে প্রেমে পরে যাবো।
আবার বৃষ্টি নামলে দুই হাত মেলে আকাশ এর দিকে চেয়ে থেকো আমার দুই হাতে তোমায় জড়িয়ে কানে কানে বলবে ও মেঘ তুমি হাজার বারন করলে আজ আমি তোমার প্রেমে পরে যাবো।

কালো শাড়ি কালো চুরি আর কালো টিপে কথাকে কেমন লাগছে তা ভাষায় প্রকাশ করা আমার সাধ্যের বাইরে।
ঐ যে দ্বীপান্বিতা, কালো শাড়ি পড়ে কাশফুলের বাগানে দৌড়ানোর মুহূর্তের কথাটা কেনো জানিনা হুট করেই মনে পড়ে গেলো।
তবে না, আজ আমি কথার সৌন্দর্যের কোনো উপমা দিবো না, এই সৌন্দর্যের কোনো উপমা হয়না।
সে স্বয়ং নিজেই একটা উপমা, তার উপমা আর কি দেবো আমি।

ছাঁদে প্রচন্ড বাতাস, বোধহয় ঝড় আসবে একটু পরই।
কোইন্সিডেন্সলি হলেও সত্যি আজ আমিও কালো পাঞ্জাবীতেই দাঁড়িয়ে আছি।
কথা লাফিয়ে লাফিয়ে বাতাসের মজা নিচ্ছে।
হাত প্রশারিত করে বাতাস আকরে ধরার হাস্যকর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
আমার হাসির শব্দে মেয়েটা আমার দিকে তাকালো, মুহূর্তেই লজ্জা পেয়ে ছাঁদের কার্নিশ ঘেষে দাঁড়ালো।
আমি চিলেকোঠা পেড়িয়ে কাথার পাশে এসে দাঁড়াতেই কথা বললো–

— কেনো ডেকেছেন আমাকে!

এমনি, কারন ছাড়াই।
আমি কিন্তু আমার উত্তর এখনও পাইনি।

— কিসের উত্তর?

কথা ভ্রুকুটি করে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো।
মেয়েটার চোখে দুষ্টুমির বড্ড ক্ষিধে।
চোখ বন্ধ করে খানিকটা হেসে নিলাম আমি।

— হাসছেন কেনো? আর আমাকে ছাঁদেই বা আসতে বলেছেন কেনো!
কিসের উত্তর চান আপনি?

বিয়ে করবে আমাকে?

কথা লজ্জায় হা করে তাকিয়ে রইল আমার দিকে।
এদিকে আমি যে লজ্জা শরমের মাথা সব খেয়ে বসে আছি সে খেয়াল কি কথার আছে?

হাতটা দাও!

— কি?

শুনতে পাওনা? মেঘের গর্জন কি খুব বেশিই জোড়ে হচ্ছে? হাতটা সামনে আনো।

কথা হাত সামনে বাড়িয়ে দিতেই আমি পাঞ্জাবীর পকেট থেকে কাঁঠগোলাপের লম্বা মালাটা কথার হাতে তিন ভাজে পড়িয়ে দিলাম।
কথা অবাক চোখে আমার কান্ড দেখছে।
মেয়েটা ইদানিং খুব বেশিই অবাক হয়।
এত অবাক হওয়ার কি আছে!
প্রেমে পড়েছি আমি, এসব তো সহ্য করারই ছিলো!

ফায়াজ..

কথা আমাকে কিছু বলার আগেই আমি হাতের ইশারায় কথাকে চুপ করিয়ে দিলাম।
কথার দু’হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে হাঁটুগেড়ে বসে পড়লাম।
কথা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।
আকাশে মেঘের তীব্র গর্জন জানিয়ে দিচ্ছে এখনই বৃষ্টি নামবে।

একদিন নিঃশব্দে” স্বপ্নবিহীন”আমার কাছে এসো!
তোমাকে নতুন করে স্বপ্ন দেখানোর ভীষণ ইচ্ছে আমার।
শুধু সেই ইচ্ছের সাথে তোমার সম্মতি মেশানোর সময় টুকু আমায় দিও!
আমি না হয় কিছু নব স্বপ্ন নিয়ে তোমার আসার অপেক্ষা করবো!
লাল গোলাপ কিংবা কৃষ্ণচূড়া ফুলে আমি বিশ্বাসী নই!
কাঁঠগোলাপের কথা ভিন্ন।
সময়ের টানাপোড়নে শুকিয়ে যাওয়ার বেদনা আমি সইতে পারবো না!
তুমি বরঞ্চ ‘এক চিলতে রোদ হয়ে এসো’ আমি না হয় একখণ্ড জমাট বাঁধা মেঘ হয়ে তোমাকে ভিজিয়ে দেবো!
তবুও স্বপ্নচারিনী হয়ে এসো না!
নৈঃশব্দের বারান্দায় ক্লান্ত হয়ে বসে থাকার ধৈর্য আমার নেই! আমি ভীষন অধৈর্য” তোমাকে পাওয়ার নেশায়”ভীষন অধৈর্য! আমার দেয়া স্বপ্ন গুলো খুব যতনে রেখো।স্বপ্নগুলো দুঃস্বপ্ন হয়ে কোন রাতে তোমার ঘুম ভাঙ্গাবে না, এত টুকু বিশ্বাস না হয় করলে!
এক জীবনে না হয় একটু কষ্ট পেলে, তবে কথা দিলাম, তোমায় ঠকাবো না।
বাকি রইল ভুলে যাওয়ার কথা; তোমাকে ভুলে যাওয়ার ক্ষমতা আমার নেই! সে ক্ষেত্রে আমি ক্ষমতাহীন।
তোমাকে চাওয়া টা হয়তো অসাধ্য অথবা সাধ্যের বাহিরে”তবে সেই অসাধ্যকে স্বাধন করার জন্য আমি উঠে পড়ে লেগেছি।
আমাকে ভালোবাসো সে খবর” কোন এক নীল খামে ভরে আমাকে পাঠিও না!
কারণ আমাকে ভালোবাসো কিংবা বাসোনা সে খবর জানার মাঝামাঝি সময় টুকু আমার জন্য অনেক বেদনাদায়ক হবে!
হঠাৎ করেই এসো।
তোমাকে ভীষণভাবে পাবার অসুখ এখন আমার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে!
আর এই অভ্যাসটা” বদঅভ্যাসে পরিবর্তন হোক”এটা আমি মানতে পারব না।
জানি” পিঞ্জিরায় বন্দী পাখি হওয়ার ইচ্ছা তোমার নেই!
তুমি খোলা আকাশেই থেকো”আমি না হয় কোন পাকা” শিকারির প্রেম মাখা”তীর হয়ে তোমার হৃদয়ে বিধবো!
আমায় কোথায় পাবে?
আমায় পাবে বহু মানুষের সমালোচনার ভিড়ে!
সেখানে আমি তোমার অপেক্ষায় থাকার দায়ে সমালোচিত!
যেখানে আমি অনন্ত কাল ধরে তোমার অপেক্ষায় অপেক্ষাকৃত।

কথা এখনও আমার দিকে বিষ্ফোরিত চোখে তাকিয়ে আছে।
আমার বলা শেষ হতেই আকাশ থেকে এক ফোটা পানি কথার হাতের উল্টো পিঠে এসে পড়লো, তারপর আরেক ফোটা।
মুহূর্তেই ঝুম বৃষ্টির আনাগোনা।
কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই দু’জন বাজে ভাবে ভিজতে শুরু করলাম।
কথার হাত শক্ত করে ধরে দৌড়ে চিলেকোঠার বদ্ধ রুমটায় চলে এলাম দু’জন।
দ্রুত শ্বাস নিতে নিতে আমায় বললো–

— এটা কি হলো!

কি?

— বৃষ্টিটা কি একটু দেরিতে এলে পারতো না?

মানে?

— কিছুনা।

কথা শাড়ির এদিক সেদিক ঝাড়তে ঝাড়তে মুখে বিরক্তির ছাপ এনে দেয়াল ঘেষে দাঁড়িয়ে রইল।
আমিও চুপচাপ কথার পাশে দেয়াল ঘেষে দাঁড়িয়ে বললাম–

তো?

— কি তো?

মানে, না কিছুনা।

তারপর আবার কিছুক্ষণ নিরবতা।
আমি টুপ করে কথার হাত ধরলাম।
কথা একবার আমার দিকে তাকিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিলো।
ওপাশ ফিরে বোধহয় মুচকি হাসলো, আমিও যা বোঝার বুঝে নিয়েছি।
মেয়ে বলে কথা, এত সহজে ভালোবাসি তো আর বলবেনা।
আমাদের হুট করে হয়ে যাওয়া ভালোবাসাটা চিলেকোঠার এই বদ্ধ রুমে আটকে রইলো।
কোথায় ভাবলাম খোলা আকাশের নিচে কথার মুখ থেকে ভালোবাসি শুনবো।

— বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাচ্ছেন কবে?

কথার প্রশ্নে আমি ভেবাচেকা খেয়ে গেলাম।
আমি এদিকে কথার মুখ থেকে ভালোবাসি শোনার জন্য আকুল হয়ে যাচ্ছি আর মেয়ে বলে কিনা বিয়ের প্রস্তাব কবে দিবেন?
এতো দেখি সব দিক থেকে এক ধাপ এগিয়ে।
মুচকি হেসে কথার হাতে পাঁচ আঙুল ঢুবিয়ে বুকের মধ্যে শক্ত করে ধরে বললাম–

আমাকে তোমার পরিবার মেনে নেবে?
মানে বেকার ছেলে…

কথা এক ঝটকায় আমার হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো আমার দিকে।
কর্কশ ভাষায় আমাকে বললো–

আপনি টিউবলাইটই থেকে যাবেন আজীবন।
আপনার আর আমার কথা বাসার সবাই জানে।
আপনি কি ভাবেন আমি কিছুই বলিনা কাউকে?
আমার পেটে কথা থাকেনা, সিগারেট থেকে শুরু করে আপনার ছ্যাঁকা খেয়ে ব্যাকা হয়ে যাবার কথাও সবাই জানে।

কি?

আপনার কি মনেহয় ফায়াজ?
আমার বাবা আমাকে আরো মাস খানিক কিংবা আরো দুই তিনটা বছর পালতে পারবে না?
পাপ কুড়ানোর চেয়ে কি বিয়ে করাটা ভালো না?
খুব বেশি হলে কি হবে!
পাশাপাশিই তো থাকবো আমরা দু’জন।
একদিন আপনি আমার কাছে থাকবেন একদিন আমি আপনার কাছে থাকবো।
মাসে মাসে তো আর জামা কাপড় চাইবো না, আবার বাবার দেয়া যথেষ্ট আছে সেসব।
মাঝে মাঝে আপনি নাহয় আমাকে ঘুরতে নিয়ে যাবেন, যেমনটা আজকে ফুচকা খাইয়েছেন ঠিক তেমনই।
আপনার চাকরি হতে হতে তো আর আপনি বুড়ো হয়ে যাচ্ছেন না।
আজ বাদে কাল তো চাকরি হয়েই যাবে।
তাছাড়া আপনার টিউশন তো আছেই।
এখন এমন হাবলার মতো মুখ করে আছেন কেনো, ধ্যাৎ ভালো লাগছে না কিছুই।

এই মেয়েকে কিছু বলা নিতান্তই বোকামি।
আমি যেখানে সম্পর্কের শুরুর কথা টানছি সেখানে এই মেয়ে বিয়ের পরের চিন্তা ভাবনা করে বসে আছে!
ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করছি, কি যে হবে কে জানে।
পেটে কোনো কথাই থাকেনা, সবাইকে বলে বেড়িয়েছে এতদিনের সব কথা।
ছিঃ ছিঃ ছিঃ ভাবতেই আমার কেমন লজ্জা লাগছে।
কি আর করা, মুচকি হেসে কথার হাত আলতো করে ধরে বললাম–

আর একবার “ভালো লাগছে না” বলেই দেখো!
তোমার ঠোঁটের বারান্দায় এক কাপ কড়া লিকারের চা, বিকেলের দাবীতে আমরন অনশনে বসবে আমার চিলেকোঠার ক্ষ্যাপাটে দুপুর।

(সমাপ্ত)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে