#চিলেকোঠার_ভাঙ্গা_ঘর
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#পর্ব_৮
#ফিজা_সিদ্দিকী
পরেরদিন ভোর হওয়ার আগেই কাওকে কিছু না জানিয়ে বাড়ি ফেরে শ্রেষ্ঠা। দমবন্ধ গিয়ে আসছিলো তার ওই বাড়িতে। অবচেতন মন বারবার টের পাচ্ছিলো কোথাও কিছু ভুল হচ্ছে। সার্থক ভালো ছেলে নয়। স্নিগ্ধা ঠকছে। খুব বাজে রকমভাবে ঠকছে। এই একটা বিষয় তাকে সারারাত ঘুমাতে দেয়নি। স্নিগ্ধার পাশে শুয়েই পুরোটা রাত নির্ঘুম কেটেছে তার। অসহনীয় রাতের প্রহরে বারবার মন চেয়েছে স্নিগ্ধাকে ডেকে সবকিছু সত্যি বলে দিতে। কিন্তু এতোকিছু বলার মতো সাহস তার ছিলো না। আর না পারছিলো সবকিছু মেনে নিতে। সার্থকের করা স্পর্শগুলো কাঁটার মতো ফুটছিলো তার সারা শরীরে। তাইতো ভোর হওয়ার আগেই কাউকে কিছু না জানিয়ে বের হয়ে গিয়েছিলো বাড়ী থেকে।
ঘুম থেকে উঠে পুরো বাড়ির কোথাও শ্রেষ্ঠাকে খুঁজে না পেয়ে ক্রমে অস্থির হয়ে পড়েছিলো স্নিগ্ধা। হটাৎ বালিশের তলায় রাখা ছোটো একটা চিরকুট পায় সে।
“হয়তো তোমার কাছে আমার আর কখনও আসা হবে না। আর বাহানা খুঁজবো না ছুটে আসার। তোমার ঐ শরুরে জীবনের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে না কেউ। তুমি আর আগের মতো নেই আপু। একটুও আগের মতো নেই। তোমার শরীরে সেই আগের মতো স্নিগ্ধ মা মা গন্ধ পাই না। বরং সেখানে…. থাক সেসব কথা।
আর আসবো না আমি। খুঁজবো না তোমায় এখানে সেখানে। আর ভালোবাসবো না। অকারণে বিরক্ত করবো না। তুমি কিভাবে এমন হলে আপু? আমি বিশ্বাসই করতে পারছি না। সেই সহজ সরল মেয়েটা, যাকে এই দুনিয়ায় সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতাম। যার মতো হওয়ার স্বপ্ন দেখতাম, সেই মানুষটার আর কোনো অস্তিত্ব নেই। শহরের হাওয়া বদলে দিয়েছে তাকে। বদলেছে তার শরীরকে। সেই সাথে শরীরি চাহিদাকে। এতটুকু বোঝার মতো বড়ো আমি হয়েছি। ওই বিছানায় আমার ঘুম আসবে না। যেখানে তুমি মেতেছ অন্য খেলায়, সেই বিছানা আমাকে কামড়ে ধরছে যেনো। ঘিনঘিন করছে শরীর। চাইলেও আটকাতে পারছি না, তোমার প্রতি আসন্ন ঘৃণাটুকু। তুমি কিভাবে পারলে? মা বাবার কথা ভাবলে না একটুও? আমি আর কখনও তোমার কাছে যাবো না আপু। কখনও না। সবশেষে বলবো, তুমি মানুষ চিনতে শেখোনি আপু।”
চিঠিটা পড়ার পর পুরোটা দিন থম মেরে বসে ছিল স্নিগ্ধা। ভেতরে ভেতরে অপরাধবোধে ভুগছিলো। শ্রেয়া তার চেয়ে বেশ কয়েক বছরের ছোটো। সার্থকের সাথে গড়ে ওঠা সম্পর্কের কথা এভাবে শ্রেয়ার সামনে খোলাসা হবে সে কখনো ভাবেনি। বরং এমন একটা সম্পর্ক সে নিজেও কখনো চায়নি। সে তো একটা সুস্থ স্বাভাবিক সম্পর্ক চেয়েছিলো। তবুও কিভাবে যেনো সেই সম্পর্ক ক্রমে হয়ে উঠলো শারীরিক সম্পর্ক। সার্থকের ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে গিয়েছিলো স্নিগ্ধা। তাইতো তাকে হারানোর ভয়ে হুট করেই নিজেকে সঁপে দেয় তার কাছে। কারন ছেলেরা নাকি মনের চেয়ে শরীর চেনে বেশি। সে তো এই অচেনা শহরে একটা চেনা মানুষ চেয়েছিলো। তাকে বোঝার মতো, ভালোবাসার মতো মানুষ। কিন্তু শ্রেয়া যে ভুল বুঝলো তাকে! শ্রেয়া কী সত্যিই আর কখনো আসবে না তার কাছে?
পুরোটা দিনে রুমবন্দী স্নিগ্ধাকে পঞ্চাশোর্ধ বার কল করেছে সার্থক। প্রতিবার একই ঘটনা ঘটছে। রিং হয়ে কল কেটে যাচ্ছে নিজের মতো করে। বারবার বাজতে বাজতে কেটে যাচ্ছে ফোন। স্নিগ্ধা শুনেও কিছু শুনছে না যেনো। এই মুহূর্তে কারোর সাথে কথা বলার ইচ্ছে নেই তার। একা থাকতে চায়, সম্পূর্ন একা। কিন্তু এই কথাটুকু বলার মতো শক্তিও যেনো অবশিষ্ট নেই তার মাঝে।
কিছুক্ষনের মধ্যেই সশব্দে বেজে ওঠা কলিং বেলের শব্দে চমকে ওঠে স্নিগ্ধা। ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও ক্লান্ত পায়ে এগিয়ে যায় গেট খোলার উদ্দেশ্যে। গেট খুলে সার্থককে দেখেও যেনো কোনো প্রতিক্রিয়া নেই তার মাঝে। উল্টো ঘুরে আগের মতোই ফিরে আসে রুমে। সার্থক নির্বাক। ফ্যালফ্যাল চাহনিতে চেয়ে থাকে শুধু তার দিকে। এতগুলো মাসে স্নিগ্ধাকে এতটা উদাসীন, এতো বেশি আনমনা আর কখনো দেখেনি সে।
১৯.
প্রায় দুই বছর পর ছুটিতে বাড়ি ফিরেছে স্নিগ্ধা। তাকে ঘিরে বাড়িতে তুমুল আয়োজন। শিমুল নিহার ব্যস্ত নানান বাহারী আয়োজনের হুল্লোড়ে। আজ কতোগুলো দিন পরে কলিজার টুকরো মেয়েকে দুই চোখ ভরে দেখছেন তিনি। আবেগে চোখ দুটো ভরে আসছে তার বারে বারে। শাড়ির আঁচল টেনে চোখের কোনের জলটুকু সন্তর্পনে মুছে ফেলেন তিনি। কিন্তু আবারও কিছুক্ষনের মাঝে ভরে আসে তার চোখ। ছলছল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন দূরে সোফায় বসে থাকা মেয়েটার দিকে। খুঁটিতে খুঁটিতে দেখতে থাকেন তার সবকিছু। আগের চেয়ে গায়ের রং বেশ উজ্জ্বল হয়েছে। দেখতে শুনতেও ভালো হয়েছে। শরীরে খানিক মেদ জমেছে। বাঙালি মেয়েদের শরীরে হালকা মেদ বেশ মানায়। সে কারণে স্নিগ্ধাকে দেখে একেবারে পরিণত নারী মনে হচ্ছে তার। শহরের ছোঁয়া পেলে বোধহয় মানুষ ঠিক এভাবেই বদলে যায়। সুন্দর হয় চেহারা। অজান্তেই নিজের মেয়ের প্রতি নজর দিয়ে ফেলছেন তিনি, ভেবেই জিভ কাটেন শিমূল নিহার।
খাওয়া- দাওয়া, আলাপ- আলোচনা কোনোটাতেই দেখা গেলো না শ্রেষ্ঠাকে। অসুস্থতার বাহানা দেখিয়ে পুরোটা দিন শুয়ে থাকলো রুমে। অথচ এইতো কয়েকমাস আগেও এই মানুষটাকে সে কতো ভালোবাসতো। ঠিক যেমন আলপিন ছুটে যায় চুম্বকের টানে! মানে না কোনো বাধা বিঘ্ন। সেভাবেই ছুটে যেতো সে। অথচ আজ সে সবকিছুই ম্লান। অনুভূতিরা নির্জীব।
সেদিন হুট করে বাড়ি ফেরায় অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছিল তাকে। তবুও সত্যিটা প্রকাশ করেনি সে। কিন্তু একলা রুমে কেঁদেছে প্রত্যহ। দহনে দহনে শেষ হয়েছে প্রতিটা মুহূর্তে। পুরো দুনিয়া ওলোট পালোট হয়ে গেছে তার। যন্ত্রণায় বুঁদ হয়ে কেটেছে প্রতিটা প্রহর। মাঝরাতে ঘুমের ঘোরেই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠেছে সে। বারবার মন চেয়েছে ছুটে যেতে মানুষটার কাছে। দ্বিধা, সংশয় ধুয়ে মুছে একাকার করে তার সাথে খোলাখোলি কথা বলতে। কিন্তু হয়নি। পেরে ওঠেনি মস্তিষ্ক আর মনের সাথে লড়াই করতে করতে। এক সময় হাঁপিয়ে যাওয়ার মতো হাল ছেড়ে দিয়েছে।
রাত তখন আটটা। শ্রেষ্ঠার রুমের দরজায় নক করে স্নিগ্ধা। শ্রেষ্ঠা জানে কে এসেছে এই মুহূর্তে।
“দরজা খোলা আছে।” -শ্রেষ্ঠা বলে।
স্নিগ্ধা নিঃশব্দে রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়। তাকায় রুমের এদিক ওদিক। কেমন যেনো এক অস্বস্তি লাগছে তার। অস্বস্তির কাঁটা খচখচ করে বিঁধছে যেনো তার বুকে। ক্ষণে ক্ষণে জিভ দিয়ে রুক্ষ ঠোঁট ভিজিয়ে কিছু বলার জন্য প্রস্তুত করছে নিজেকে। অবশেষে অবসন্ন কণ্ঠে বললো,
“কেমন আছিস?”
“ভালো।”
“পড়াশোনা কেমন চলছে?”
“ভালোই।”
“এক্সাম কবে তোর?”
“এইতো কয়েকমাস পরেই।”
এরপর বলার মতো আর কোনো কথা খুঁজে পেলো না স্নিগ্ধা। অনেক কিছু বলতে চেয়েও যেনো গুলিয়ে যাচ্ছে সবকিছু। কই আগে তো এমন হতো না? আগে তো এতো ভাবতে হতো না তাকে। তবে আজ কেনো এতো দ্বিধা তাদের মাঝে? দ্বিধা দ্বন্দরা মিলেমিশে এক অদৃশ্য দেয়াল তুলে দিয়েছে তাদের মাঝে। যাকে ডিঙিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না তাদের কারোর পক্ষেই। আচমকা স্নিগ্ধা উঠে দাঁড়ালো। বুঝতে পারলো তার অস্বস্তি হচ্ছে। দমবন্ধ লাগছে এই রুমে। বন্ধ করা দরজার পাল্লা হাট করে খুলে বের হতে গিয়ে শোনা গেলো একটা নিভু নিভু কণ্ঠ,
“সে আরও অনেককে এভাবে ঠকিয়েছে। ঠিক যেভাবে তোমাকে ঠকাচ্ছে। সব চকচকে জিনিস হীরে হয়না।”
২০.
“মানি, তুমি কাঁদছো?”
শ্রেয়ার ডাকে চমকে ওঠে শ্রেষ্ঠা। বিকাল গড়িয়ে কখন যে রাত নেমেছে ধরণীতে তার ইয়াত্তা নেই। কাপের কফিটা এতক্ষণে ঠাণ্ডা জল। চোখের কার্নিশ ছাপিয়ে উপচে পড়ছে জলের ধারা। নিঃশব্দ কান্না। অতীতের স্মৃতিচারণা নয়, বরং যেনো অতীতের মাঝে বাঁচছিলো সে এতক্ষন। কতোগুলো বছর কেটে গেলো। তবুও সেই দিনগুলো আজও গেঁথে আছে বুকে। প্রত্যহ নিয়ম করে পীড়া দেয় তাকে। র’ক্ত ঝরায় বুকের মাঝখানে। এ যেনো এমন এক ঘা, যা ভরতেই চায়না। বরং স্মৃতির পাতায় দগদগে ঘা হয়ে জ্বলজ্বল করে।
শ্রেয়াকে বুকে টেনে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে শ্রেষ্ঠা। এই একটাই শেষ আশ্রয়স্থল তার। যাকে ঘিরে দুনিয়া তার। শ্রেয়ার মাঝে খুঁজে পায় সে স্নিগ্ধাকে। বোনের উজাড় করা ভালোবাসার এক শতাংশ সে শ্রেয়াকে দিতে পারে কিনা জানা নেই। তবে নিজের সবটুকু দিয়ে ভালো রাখার চেষ্টা করে তাকে।
#চলবে!