#চিলেকোঠার_ভাঙ্গা_ঘর
#ফিজা_সিদ্দিকী
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#পর্ব_৪
“পুরনো কলিগ” কথাটা শুনেই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল আরাধ্য। কিছুক্ষণ আগে উদয় হওয়া ভালো লাগার উত্তাল ঢেউ মিলিয়ে গেল ভাটা রূপে। তোলপাড় করতে থাকা অনুভূতির রেশ পরিণত হলো চোরাবালিতে। অনুভূতি শুন্য চোখে বেশ কিছুক্ষণ তাকালো সে শ্রেষ্ঠার দিকে। অতঃপর হনহনিয়ে বেরিয়ে গেল রুম থেকে। রাগ হচ্ছে আরাধ্যর। ভীষণ পরিমাণের রাগ। এতগুলো দিন পরে হুট করেই এতখানি রাগ হওয়ার কোন কারণ খুঁজে পেল না সে। শুধু এটুকু জানে এই মুহূর্তে সবকিছু ভেঙ্গে চুরমার করে দেওয়ার মত রাগ হচ্ছে তার। বিষাক্ত লাগছে সবকিছু।
১৪.
অতিরিক্ত রাগের বসে কাল শ্রেষ্ঠাকে নিয়ে বাড়ি ফিরলেও হোটেল থেকে লাগেজগুলো নেওয়া হয়নি। রাগে জেদে একপ্রকার অন্ধের মতো ড্রাইভ করে বাড়ি ফিরেছে সে। ভয়ে তটস্থ হওয়া শ্রেষ্ঠার কাঁচুমাচু করা মুখটাও তার দৃষ্টিগোচর হয়নি। এতগুলো মাস, এতুগুলো দিন তো কোনো অপেক্ষা করেনি সে। বরং তার নাগালের বাইরে কিছু চেয়ে ফেলেছিলো, একথা ভেবেই নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিল। কিন্তু আজ এতটা কাছাকাছি থেকেও না থাকার বেদনা অসহনীয়। রাগে অন্ধের মতো লাগছে নিজেকে। বাড়ি ফিরে শ্রেষ্ঠাও আর কোনো কথা বলেনি। নিজের মতোই একেবারে চুপচাপ শুয়ে পড়েছিলো। বাকি রাত টুকু আরাধ্যর টি শার্ট আর ট্রাউজার পরে কাটাতে হয় তাকে। যদিও এ ব্যাপারে কিছুই আরাধ্য জানতো না। বাড়িতে ঢুকেই তার পাশের রুমটা খুলে দিয়ে পায়ে গট গট শব্দ তুলে নিজের রুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দেয় আরাধ্য। রুমের মধ্যে আরাধ্যর বেশ কয়েক জোড়া কাপড় রাখা দেখে, সেখান থেকেই একটা উঠিয়ে পরে নেয় শ্রেষ্ঠা। এরপর থেকে আর আরাধ্যর মুখোমুখি হওয়া হয়নি তার।
রাত গভীর হওয়ার সাথে সাথে খিদের মাত্রা বেড়েই যাচ্ছিলো শ্রেষ্ঠার। অগত্যা রুম থেকে বের হয়ে ডাইনিং রুমে যেতেই চোখ পড়ে টেবিলে ঢাকা দেওয়া খাবারের দিকে। হালকা হেসে খাবারটা শেষ করে শান্তির ঘুম দেয় সে।
সকালে ঘুম থেকে উঠে নাস্তা রেডি করে আরাধ্য। বেশ সকাল সকাল ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস তার আছে। নিজে নাস্তা করে বাকিটুকু চাপা দিয়ে আরাধ্য বেরিয়ে পড়ে অফিসের উদ্দেশ্যে। তখন ঘুমে বুঁদ শ্রেষ্ঠা। জেদ থেকে হোক বা ভালোবাসা, শ্রেষ্ঠাকে ঘুম থেকে ডেকে তোলার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে হয়নি আরাধ্যর। তাই রোজকার মতোই বেরিয়ে পড়ে অফিসের উদ্দেশ্যে।
“আমার জন্য একটা শাড়ী কিনে পাঠাতে পারবেন, প্লিজ!”
গোটা এক বছর পর চিরচেনা সেই নম্বর থেকে আসা মেসেজটা দেখে রাগের মাত্রা খানিকটা থিতিয়ে যায়। কিন্তু এতো সহজে গলে যাওয়ার ছেলে আরাধ্য নয়। তাই শ্রেষ্ঠার মেসেজের কোনোরূপ রিপ্লাই না করেই সাথে সাথে টেক্সট পাঠালো ইরাকে।
“একটা কালো রঙের কাতান শাড়ি মার্কেট থেকে কিনে আমার ফ্ল্যাটে দিতে এসো একটু। সাথে মেয়েলি যা যা লাগে সব।”
এমন অসময়ে আরাধ্যর মেসেজ পেয়ে খুশিতে আটখানা হয়ে ওঠে ইরা। খুশিতে বেডে শুয়ে গড়াগড়ি করে এরপর টেক্সটা ওপেন করতেই এতক্ষণের হাসিখুশি মুখটা চুপসে যায় বেলুনের মতো। চোখের কোণে জমা হয় জলরাশি। নিজেকে সামলানোর বৃথা চেষ্টা চালিয়ে রিপ্লাই করে,
“তোমার ফ্ল্যাটে মেয়ে?”
“হ্যা। ইন্ডিয়া থেকে একজন কলিগ এসেছে। পরিচিত আমার। আর সেই সাথে আমাদের কোম্পানির কাজেই এসেছে। তাই কিছুদিন থাকবে। ”
কথাটুকু শুনে সস্তির নিঃশ্বাস ফেললো শ্রেষ্ঠা। বুকের উপর থেকে বড়ো একটা পাথর যেনো নেমে গেলো। অতঃপর উৎফুল্লচিত্তে সাথে সাথে বের হয়ে গেলো মার্কেটের উদ্দেশ্যে। সুন্দর একটা শাড়ি, সেই সাথে ম্যাচিং ব্লাউস আরও কিছু জিনিসপত্র নিয়ে ফিরে এসে নক করলো আরাধ্যর ফ্ল্যাটের দরজায়। ইরাকে দেখে প্রথমে খানিকটা বিচলিত হলেও অপরিচিত দেশে আরাধ্যর পরিচিত একজনকে পেয়ে পরবর্তীতে অনেক খুশি হলো শ্রেষ্ঠা। কথায় কথায় তার আরও কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস কেনার বাহানায় দুজনের বের হলো মার্কেটে। মার্কেট ঘুরে বেশ কিছু জিনিস কিনে বিকালের মধ্যেই বাড়িতে ফিরে এলো দুজনে। কিন্তু ফেরার পথে তেমন একটা কথা হলোনা ইরার সাথে। মেয়েটাকে একেবারে অন্যরকম লাগছিলো। মন খারাপ নাকি কিছু ঘটেছে বুঝে উঠতে পারলো না শ্রেষ্ঠা। যেহেতু সেভাবে পরিচয় নেই, তাই আর জিজ্ঞাসা করার সাহসও পেলো না সে। অতঃপর ইরাকে বিদায় নিয়ে ঢুকে পড়লো ফ্ল্যাটে। কিন্তু ইরা তার বিদায়ের অপেক্ষা না করেই উল্টোপথে হেঁটে চলে গেলো নিজের ফ্ল্যাটে। বিষয়টাতে খারাপ লাগলেও পাত্তা দিলো না শ্রেষ্ঠা। অতঃপর লেগে পড়লো নিজের কাজে।
সময়টা সন্ধ্যার। অফিস থেকে বাড়ি ফিরছে আরাধ্য। সিগনালে আঁটকে পড়েছে গাড়ি। রাস্তার পাশে চোখ পড়তেই দেখতে পেলো সুন্দরী একজন মহিলা ফুল বিক্রি করছেন। হরেক রকম ফুলের বুকে থেকে শুরু করে নানা রঙের গোলাপ ও জানা অজানা বিভিন্ন ফুলের সমাহার সেখানে। হুট করেই কেনো যেনো ভীষণ লোভ হলো আরাধ্যর। গাড়ি সাইড করে নিজেও কিনে ফেললো কয়েকটা ফুল। যেটা সবচেয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে, সেটা হলো কালো রঙের গোলাপ। একপিস কালো গোলাপের সাথে কিছু টিউলিপ ফুলও নিলো সে। অতঃপর আবারো রওনা দিলো বাড়ির উদ্দেশ্যে। রাস্তায় যেতে যেতে ভাবতে লাগলো ফুলগুলো কী করবে সে! অনেক ভেবে চিনতে সিদ্ধান্ত নিলো ফ্লাওয়ার ভাসের আর্টিফিশিয়াল ফুলগুলো সরিয়ে টাটকা ফুলগুলো রেখে দিলে বেশ সুন্দর স্নিগ্ধ একটা পরিবেশ তৈরি হবে।
বেশ অনেকটা সময় ধরে কলিংবেল বাজানোর পরও কেউ দরজা খুলছে না। ইতিমধ্যে মনের মাঝে ভয়েরা উঁকি দিতে শুরু করেছে। চিন্তা হচ্ছে শ্রেষ্ঠার জন্য। অচেনা দেশে এসে কোথাও হারিয়ে গেলো না তো! নাকি খারাপ কিছু! না না আর ভাবতে পারছে না সে। গলা শুকিয়ে কাঠ। ভয়ের চোটে রীতিমত ঘামছে সে। হটাৎ দরজায় ধাক্কা দিতে গিয়ে তার খেয়াল হলো দরজা খোলা। ভয়ের মাত্রা এবার বাড়লো বৈ কমলো না। দ্রুত দরজা খুলে ভেতরটা একেবারে ঘুটঘুটে অন্ধকারে আচ্ছাদিত অবস্থায় পেয়ে বুকটা ছ্যাত করে উঠলো তার। অযাচিত চিন্তাগুলো তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়েই ক্রমাগত আঘাত করছে তাকে। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।
রুমের দরজা হালকা খোলা। ভেতর থেকে হালকা আলো ভেসে আসছে। তারাহুরো করে দরজা খুলতেই প্রথমেই চোখে পড়ে শ্রেষ্ঠাকে। উল্টোদিক ঘুরে দাঁড়িয়ে কিছু একটা করছে যেনো। আরাধ্য দৌড়ে গিয়ে জাপ্টে ধরে তাকে। আচমকা এহেন আক্রমনে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেও পরমুহুর্তে নিজেকে সামলে নিয়ে আরাধ্যর বুকে মাথা রাখে শ্রেষ্ঠা। তীব্রগতিতে ওঠানামা করা বুকের অবস্থা বুঝতে পেরে মাথা তুলে কিছু বলতে গেলে বামহাত দিয়ে তার মাথা আবারও বুকের সাথে চেপে ধরে আরাধ্য।
“একটু থাকো প্লিজ!”
শ্রেষ্ঠাও বাধ্য মেয়ের মতো চুপটি করে গুনতে থেকে তার হৃদস্পন্দন। প্রাণ ফিরে পেয়েছে যেনো আরাধ্য!
নিজের অবস্থান সম্পর্কে খেয়াল হতেই শ্রেষ্ঠাকে ছেড়ে দূরে সরে যায় আরাধ্য। মাথা নীচু করে আমতা আমতা করে বলে,
“সরি। আসলে দরজা খোলা আর এভাবে রুম অন্ধকার দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম অনেক। উত্তেজনায় কী থেকে কী করে ফেলেছি বুঝতে পারিনি। আই অ্যাম সরি।”
একবারের জন্যও চোখ তুলে তাকালে আরাধ্য বুঝতে পারতো শ্রেষ্ঠার ঠোঁটের কোণে প্রাপ্তির হাসি। কিন্তু এমন কিছুই হলোনা। বরং নত শিরে সে বের হয়ে যেতে গেলো রুম থেকে। আচমকা মুখের সামনে দরজা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় চমকে সামনে তাকায় আরাধ্য। দরজা বন্ধ করে তাতে পিঠ ঠেকিয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে শ্রেষ্ঠা। এতক্ষণে প্রথমবারের মতো তাকে খেয়াল করলো আরাধ্য। দেখে মনে হচ্ছে কিছুক্ষন আগে গোসল করেছে। চুলগুলো হালকা ভেজা। পরনে কালো শাড়ি, সাথে সাদা শরীরে লেপ্টে থাকা কালো ব্লাউজ। কী অসম্ভব রকম আকর্ষণীয় লাগছে তাকে, সে কী জানে? জানলে কী এভাবে তার সামনে আসতো? নাকি জেনে শুনেই এসেছে সে? ইচ্ছে করেই তাকে আকর্ষণ অনুভব করাতে চাইছে কি? শ্রেষ্ঠার চোখে চোখ পড়তেই আরও একবার হারিয়ে যেতে গিয়েও নিজেকে সামলে নেয় সে। পাশ কাটিয়ে বের হতে যেতে গেলে আচমকা সামনে থেকে জড়িয়ে ধরে শ্রেষ্ঠা। বুকে মাথা রেখে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলে ওঠে,
“কেনো ভালোবাসেন আমাকে?”
“জানা নেই।”
“অকারনে কিছু হয়না। অবশ্যই তার পিছনে কিছু কারন থাকে।”
“হয়তো আছে। তবে আমার জানা নেই। কারন সেই কারণগুলো কখনও খোঁজার চেষ্টা করিনি।”
“কেনো চেষ্টা করেননি?”
“প্রয়োজন মনে করিনি।”
“আমি এক বাচ্চার মা। এরপরও কারো অনুভূতি থাকতে পারে আমার প্রতি?”
“মা হওয়া খারাপ কিছু নাহ। ”
“আপনি চাইলে অনেক সুন্দরী মেয়েকে পছন্দ করতে পারতেন। যারা আমার মতো সেকেন্ড হ্যান্ড হতো না।”
“সেকেন্ড হ্যান্ড! ওয়াও! নিজেকে নিয়ে এতো দারুণ ব্যাখ্যা করার অধিকার কে দিয়েছে আপনাকে? আপনি কী জানেন আপনি মেন্টালি সিক? সাইকোলজিস্ট দেখান। আপনার মানসিক সমস্যা আছে।”
“জানি। ডক্টর দেখিয়েছিল। ডক্টর কী বললো জানেন?”
“নাহ”
“কেউ একজন আমার অভাবে দগ্ধ হচ্ছে প্রতিনিয়ত। আমিও পুড়ছি যন্ত্রণায়। দুটো মন দূরে, বহুদূরে, তবুও জ্বলছে তারা দুজনেই। এই রোগের ওষুধ শুধুই সে, যে এই রোগের কারন। তার শুন্য বুকে মাথা রাখলেই নাকি যন্ত্রণা কমে যাবে। হাহাকার গুলো নাম লেখাবে প্রাপ্তির খাতায়। নব্য অনুভূতিরা খেলা করবে মনের আঙিনায়। আমাকে সুস্থ হতে গেলে তার মাঝে আমার আমিকে জাগিয়ে রাখতে হবে।”
“তো আমাকে ছাড়ুন। একবার তার কাছে যান।”
“আমার সে, আমার খুব কাছেই আছে। তাইতো এতো সুস্থ। জানেন, হুট করেই পেয়ে গেছি তাকে। একেবারে অনাকাঙ্খিতভাবে। এই দেশ আমার জন্য এতখানি চমক নিয়ে অপেক্ষা করছে জানলে আগেই পাড়ি জমাতাম।”
ঠোঁট কামড়ে হাসলো আরাধ্য। শ্রেষ্ঠার ইঙ্গিত বেশ ভালোই বুঝতে পেরেছে সে। কিন্তু সরাসরি তার মুখ থেকে না শোনা পর্যন্ত নিস্তার নেই।
“যদি এতদিনে তার জীবনে নতুন করে কেউ এসে যায়? যন্ত্রণার একটা বছরে যদি সে নতুন এক আশ্রয় খুঁজে নেয় প্রশান্তির জন্য?”
হুট করেই অমাবস্যা নেমে এলো শ্রেষ্ঠার চোখে মুখে। হাতের বাঁধন আলগা হলোও সামান্য। অতঃপর কণ্ঠে খাদে ফেলে বললো,
“এলেও আসতে পারে। আসাটা খুব বেশি অস্বাভাবিক নয়। সেকেন্ড হ্যান্ড জিনিসের জন্য একটা বছর অপেক্ষা! ব্যাপারটা আসলেই বোকামি। হয়তো সে এতো বোকা নয়। শুধু সে কেনো, দুনিয়ার কেউই এমন বোকা নাহ। তবে সে নতুন আশ্রয় খুঁজে নিলে বরং আমি বেশি খুশি হবো। পুরানো জিনিস, ইউজড জিনিস, এগুলোর জন্য কেউ এতো মায়া দেখায় না। মায়া যতো সবতো নতুন জিনিসের।….”
শ্রেষ্ঠা পরবর্তীতে কিছু বলার আগেই দুইহাত দিয়ে তার কোমর পেঁচিয়ে ধরলো আরাধ্য। হিশহিশিয়ে বললো,
“এই মুহূর্তে আমার ঠোঁট দিয়ে আপনার ঠোঁট বন্ধ করাতে না চাইলে ওই ঠোঁট নিজে থেকেই বন্ধ করুন। নইলে তারা একে অপরের স্পর্শ পেতে কিন্তু বেশ উদগ্রীব।”
#চলবে!