চিলেকোঠার ভাঙ্গা ঘর ২ পর্ব-০২

0
606

#চিলেকোঠার_ভাঙ্গা_ঘর
#ফিজা_সিদ্দিকী
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#পর্ব_২

আরাধ্যর কোমর জড়িয়ে উষ্ণতা পাওয়ার আশায় আরও খানিকটা তার দিকে সরে এলো শ্রেষ্ঠা। একই বিছানায় পাশাপাশি দুটো দেহ। ঠিক পাশাপাশি নয় বরং ঘেঁষাঘেঁসি। একে অপরের শরীরের উষ্ণতা মাপার জন্য যথেষ্ট যে দূরত্ব, এতটাই দূরত্ব তাদের মাঝে। শরীর সারা দেয় মনের আগে। অথচ আরাধ্যর মন তো সেই কবেই সাড়া দিয়ে ফেলেছে! শ্রেষ্ঠার ঊষ্ণ নিঃশ্বাস আছড়ে পড়ছে তার বুকে। শিরশিরানি ধরে যাচ্ছে পুরো শরীরে। দুইচোখ বন্ধ করে গভীর নিঃশ্বাস ফেলে সে। অতঃপর নিজেকে নিয়ন্ত্রনে এনে সরে যায় বেডের কিনারার দিকে।
রাতের অন্ধকার ছাপিয়ে ক্ষীণ আলো দেখা দিয়েছে আকাশে। অথচ আরাধ্যর চোখে ঘুম নেই। এক হাত গালে ঠেকিয়ে ব্যাস্ত সে প্রেয়সীকে দেখতে। ভেজা চুলগুলো শুকিয়ে গিয়ে আছড়ে পড়ছে শ্রেষ্ঠার চোখে মুছে। ঘুমের মাঝেই নড়ে চড়ে ওঠে সে। আলতো হাতে শ্রেষ্ঠার চোখ মুখে পড়া ছয় চুলগুলো সরিয়ে দেয় আরাধ্য। এতোটা কাছ থেকে এই প্রথম দেখছে সে শ্রেষ্ঠাকে। মসৃণ ত্বক, গোলাপী ঠোঁট সবকিছুই যেনো বিশেষভাবে টানছে তাকে। অন্য এক ঘোরের মধ্যে চলে যায় আরাধ্য। বুড়ো আঙুলের ডগা দিয়ে স্লাইড করতে থাকে আরাধ্যর কোমল মসৃণ ত্বকে। ড্রিম লাইটের আলোতে তাকে কী ভীষণ রকম রূপসী লাগছে! সে কী আসলেই নজরকাড়া সুন্দরী নাকি শুধু তার এমন লাগে? দেখলেই ঘোর লেগে যায় যেনো! বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায়না সেদিকে। শ্রেষ্ঠার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই নিজের অজান্তে আরাধ্য ঠোঁট ছোঁয়ালো তার কপালে। গাঢ় এক চুম্বন এঁকে দিলো সেখানে। একে একে বেশ কয়েকটা চুমু খেলো তার চুলের ভাঁজেও। অতঃপর আগের মতোই এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ক্লান্তিতে ঘুম নেমে এলো তার চোখে।
রাতের ঘটনা ভাবতে ভাবতেই আরাধ্যর মনে পড়লো শ্রেষ্ঠার শরীরে লেগে থাকা রক্ত আর তার কাটা হাতের কথা। হাতের কব্জির কাছে বেশ অনেকখানি কেটে গিয়েছে। সচরাচর এমন জায়গায় কাটার কথা তো নয়। দেখে মনে হচ্ছিল যেনো আচমকা পিছন থেকে আক্রমন করেছে কেউ। কিন্তু কে করবে এমন? আর কেনোই বা করবে? আবার তার ধরনা ভুলও হতে পারে। হয়তো একটু বেশি বেশিই ভাবছে সে শ্রেষ্ঠাকে নিয়ে। কিন্তু আজকের পর থেকে যে তাকে নিয়ে ভাবার অনুমতি রইলো না আর! হুট করেই ধরা ছোঁয়ার বাইরে যেনো তার বসবাস!

১১.
সময়ের স্রোতে একটা বছর পেরিয়েছে। সেদিন এক কাপড়েই ফ্ল্যাট ছেড়েছিলো শ্রেষ্ঠা। দুপুরের মধ্যেই বাড়ি ফিরে গিয়ে নিজেকে করেছিলো রুম বন্দী। অফিস থেকে আসা লাগাতার কলগুলো শেষ পর্যন্ত যখন আর অগ্রাহ্য করা গেলো না, রুম থেকে বের হলো সে। একটা রোবটের মতোই বাড়ি থেকে অফিস আর অফিস থেকে বাড়ি, এভাবেই চলছিল জীবন। শিমূলের মেয়েকে নিয়ে দুশ্চিন্তার শেষ নেই। কিন্তু আদিল সাহেব বরাবরই শান্ত মেজাজের মানুষ। হুটহাট কিছু করে বসা ব্যাপারটা তার ধাঁচে নেই। তাই তিনি স্ত্রীকে বোঝান, যেনো শ্রেষ্ঠাকে সময় দেওয়া হয়। সহজে ভেঙে পড়ার মেয়ে সে নাহ। কিন্তু মায়ের মন মানতে নারাজ। হুট করে মেয়েটার মূর্ছা যাওয়া চেহারা তার বুকে গিয়ে বিঁধছে। শ্রেয়া বেশ অনেকটা সময় মায়ের সান্নিধ্য পায়নি। নানা নানুর কাছেই থাকতো। ধীরে ধীরে সময়ের সাথে স্বাভাবিক হতে শুরু করলো শ্রেষ্ঠা। আবারও আগের মতো পুরোদমে জীবন শুরু করতে গিয়ে বুঝতে পারলো অনেককিছুই ফেলে এসেছে আগের ফ্ল্যাটে। একবার ওখানে যাওয়া দরকার। আবার বাড়ি থেকে অফিস করতে অনেক সমস্যাও হচ্ছে। তাই সিদ্ধান্ত নিলো নতুন কোনো ফ্ল্যাটে উঠবে।
আরাধ্যর মুখোমুখি হওয়ার কোনরকম ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও গেটের চাবি ঘোরানোর সময় একবার সেদিকে তাকালো শ্রেষ্ঠা নিজের অজান্তেই। আরাধ্যর ফ্ল্যাটেও তালা দেওয়া। কিছুটা অবাক হলেও সেদিকে পাত্তা দিলো না সে। স্বভাবত এই সময়টা তার বাড়িতেই থাকার কথা। তবুও এসবে মাথা ঘামালো না সে।

এ পর্যন্ত সব ঠিকঠাক চললেও বিপত্তি ঘটলো এর কিছুক্ষণ পরে। কাজের মেয়েটা কোথা থেকে যেনো হুড়মুড় করে ঢুকলো ফ্ল্যাটে। হাসি হাসি মুখে তাকালো তার দিকে। অতঃপর ব্যাস্ত হাতে সাথে সাথে সাহায্য করতে শুরু করলো তাকে। আচমকা তাকে দেখে বেশ খানিকটা অবাক হলো শ্রেষ্ঠা। তবুও মুখে প্রকাশ করলো না। কারন তার বিশ্বাস মেয়েটা নিজেই সব বলা শুরু করবে গড়গড় করে কিছুক্ষনের মাঝে। ভীষণ সরল আর সাদাসিধে মনের কিনা! হলোও তাই। কিছুক্ষনের মাঝেই শুরু হয়ে গেলো তার একঝাঁক কথার পসরা।

“আপা, মেলা দিন পর দেখলুম আপনারে। কত্তোডি খারাপ হই গেছেন। খাওয়া দাওয়া করেন না নাহি?”

“আরে কী বলো! এই তো পনেরো দিন আগে গেলাম এখান থেকে। কিছুদিন পর দেখছো তো, তাই এমন মনে হচ্ছে। তুমি কেমন আছো বলো।”

“আর ভালা আপা। আমনেরা এলেন, ভাবলুম নতুন ভাড়াটিয়া আইছে কাম পামু। টাকাও পামু বেশি। ওমা আপনারাও দেহি চলি গেলেন, সেই সাথে সাহেবও চলি গেলো। দুইটা কাম গেলো। আর কেমনে ভালা থাহি বলেন!”

“সাহেব কে?”

“আরে ওই যে আমনের পাশের ফেলাটে যে থাকতো। হেব্বি করে দেখতে।”

“আরাধ্য!”

“হ্যা হ্যা। ওই সাহেব তো দেশের বাইরে চলি গেছে। যাওয়ার সময় আমার হাতে বকশিশ দিয়া গেছে কিন্তু! সাহেব মেলা ভালা মানুষ আছিলো।”

তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো শ্রেষ্ঠা। মেয়েটার মতো সেও তো ভালো ভেবেছিলো আরাধ্যকে। ভরসা করেছিলো। কিন্তু দিনশেষে তার ধারণা ভেঙেছে। কে জানে মেয়েটার ধারণা কখনও ভাঙবে কিনা!

“ও ভালা কথা আপা, আপনার শরীর কেমন আছিলো? হেইদিন রাইত্তে যেই জ্বরডা আছিলো! হের পরের দিনই তো আমনেরা চইলা গেলেন। জিগায়াম পারুম না।”

বেশ অনেকটা অবাক হলো শ্রেষ্ঠা। তার জ্বরের কথা মেয়েটা জানলো কিভাবে? তার তো জানার কথা নাহ! সেদিন রাতে তো আরাধ্য ছাড়া আর কেউ ছিল না তার কাছে! হিমোফোবিয়া আছে তার । সেদিন রাতে রক্তে মাখামাখি হাত দেখেই শরীর কাঁপিয়ে জ্বর এসে গেছিলো। আর সেভাবেই অজ্ঞান হওয়া। বিস্ময়ভরা কণ্ঠে শ্রেষ্ঠা জিজ্ঞাসা করলো,

“সেদিন রাতে আমার শরীর কাঁপতে জ্বর এসেছিল, তুমি জানলে কিভাবে?”

“আরে, কী বলেন আপা! আমনেরে ওয়াশরুমে নিয়া পুরো শরীর মুছায় দিছিলাম তো আমি। কাপড়ে রক্ত লাগি ছিলো। হেইটাও তো আমি খুলে দিয়ে অন্য কাপড় পরাই দিছিলাম।”

বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় শ্রেষ্ঠা। হাতে থাকা স্টিলের গ্লাসটা পড়ে গিয়ে ঝন ঝন শব্দের উৎপত্তি ঘটিয়েছে। তার শরীর কাঁপছে। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললো,

“তু তুমি করেছিলে ওগুলো?”

“হ আপা। সাহেব আমাকে ফোন দিয়া ঘুম থেইকা ডেকে আনাইছিলো। এমনে সাহেব আমারে টাকা বেশি দেয়, তাই তার কথা ফেলতি পারি নাই। হের উপর আবার হেই কামের লেইগা হাজার টাকা বকশিস দিছিলো গো আপা। সাহেব মেলা ভালা মানুষ।”

সেই ফ্ল্যাট আর ছাড়েনি শ্রেষ্ঠা। ভুল করে হলেও যদি কোনোদিন আরাধ্য তাকে খোঁজে, এই আশায়। তাকে খুঁজতে গিয়ে যদি এখানে না পায়! তবে তো আর কোনোদিনও দেখা হবে না তাদের! মনের মাঝের অনুশোচনা আর আরাধ্যর ফিরে আসার মনোবাসনা নিয়েই কেটে গেছে একটা বছর। আজও রোজ নিয়ম করে আরাধ্যর ফ্ল্যাটের দিকে তাকায় শ্রেষ্ঠা। হুট করেই যদি কোনোদিন দরজা খোলা পায়! এই আশায়।

১২.
বিগত এক বছরে সেই মিস্ট্রিম্যানের খুনের ব্যাপারটা প্রায় ধামাচাপা পড়ে গেছে। এখন আর তেমনভাবে কোনো খুনের খোঁজ পাওয়া যায়না। তার করা প্রতিটা খুনের মাঝে ছিলো একই রকম মিল। একইভাবে মার্ডার। কিন্তু হুট করেই যেনো কোথাও উধাও হয়ে গেছে সে। ডিপার্টমেন্ট থেকে কেসটা ক্লোজ করে দিলেও নির্ঝর প্রতিদিন স্টাডি করে এটা নিয়ে। প্রতিটা জিনিস খুঁটিতে খুঁটিতে দেখে। যদি কোনো ক্লু পেয়ে যায়, সেই আশায়। নিজের চাকরির সাথে আরো একটা কাজ সে বেশ ভালো করে করে। সেটা হলো শ্রেষ্ঠার উপর নজর রাখা। তাকে ফলো করা। তার আগেই তার বিপদ বুঝে ফেলে সেটা সরিয়ে ফেলা। তার অগোচরেই তার প্রেমে হাবুডুবু এক প্রেমিক পুরুষ। আজকাল নির্ঝরের আর দূরত্ব সহ্য হয়না। মাঝে মাঝে মন চায় তাকে সবটা জানিয়ে দিতে। কিন্তু মনের কোথাও যেনো ভয়েরা জটলা পাকিয়ে আছে। সেগুলো কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হলেই সরাসরি জানিয়ে দেবে তাকে। বাবা মাকে নিয়ে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবে শ্রেষ্ঠাদের বাড়িতে।

#চলবে!

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে