#চিলেকোঠার_ভাঙ্গা_ঘর
#ফিজা_সিদ্দিকী
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#পর্ব_১
কড়া পারফিউমের স্মেল নাকে আসতেই ঘুম ভেঙে যায় শ্রেষ্ঠার। আলতো করে চোখ খুলতেই চোখের সামনে আবিষ্কার করে আরাধ্যকে। বেডে হেলান দিয়ে খানিকটা তার দিকে ঝুঁকে শুয়ে আছে সে। দুইজনের শরীর একে অপরের সাথে লেপ্টে না থাকলেও দূরত্বের সীমা ছাড়িয়ে প্রায় ঘেঁষাঘেঁষি অবস্থা। বিষয়টা বোধগম্য হতেই আঁতকে ওঠে শ্রেষ্ঠা। দুচোখের পাতায় তন্দ্রাচ্ছন্নতা কেটে গিয়ে ততক্ষনে বিস্ময় ভাব ঠাঁই পেয়েছে। আচমকা বেখেয়ালিতে নিজের শরীরের দিকে নজর যেতেই আরেকদফা আঁতকে ওঠে সে। শরীরে অন্য এক পোশাক আর একই বেডে আরাধ্যর অবস্থান দেখে কল্পনায় ভেসে ওঠে বিশ্রী কিছু দৃশ্য। লোমহর্ষক, কল্পনাতীত কিছু মুহূর্ত। ঘটনক্রমে ছিটকে দূরে সরে যেতে গিয়ে আচমকা বেড থেকে নিচে পড়ে যায় শ্রেষ্ঠা।
কিছু পড়ার শব্দ শুনে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে আরাধ্য। ভোরের দিকে হুট করেই চোখ লেগে গিয়েছিল তার। শব্দের উৎস খুঁজতে গিয়ে শ্রেষ্ঠাকে নীচে মেঝেতে বসে থাকতে দেখে দ্রুতকদমে এগিয়ে যায় সেদিকে। ব্যাথাতুর কণ্ঠে বলে,
“পড়ে গিয়ে এভাবে বসে আছো কেনো? শরীর কী খুব বেশি খারাপ লাগছে? শরীরে ব্যথা করছে?”
অবিশ্বাস্য অথচ ফ্যালফ্যাল চাহনী শ্রেষ্ঠার। ব্যথা! কিসের ব্যথার কথা বলছে আরাধ্য? তবে কী তার ধারনাই সঠিক! গভীর রাতে কী তাদের মধ্যে ব্যাথা পাওয়ার মতো সম্পর্ক হয়েছে? ভাবনার মাঝেই গলা ধরে আসে শ্রেষ্ঠার। মাথা ফাঁকা ফাঁকা লাগে। সে তো বিশ্বাস করেছিলো আরাধ্যকে! কান্নারা দলা পাকিয়ে জমাট বাঁধে বুকের কাছে। শ্রেষ্ঠার ব্যাথাতুর দৃষ্টি দেখে তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে আরাধ্য। চিন্তিত ভঙ্গিতে পায়ে হাত দিয়ে ব্যথা পাওয়া স্থান শনাক্ত করতে গেলে, পায়ে ব্যথা নিয়েই পিছিয়ে যায় শ্রেষ্ঠা। ঠিক যেভাবে আগুনের সংস্পর্শে আসা অঙ্গ দ্রুতবেগে পিছিয়ে নেয় মানুষ! সেভাবেই পিছিয়ে গেলো শ্রেষ্ঠা। দুরুদুরু বুকে কাঁপা কণ্ঠে উচ্চারণ করলো কয়েকটা শব্দ,
“বিশ্বাসঘাতক! এ জীবনে এই মুখ আর দেখতে চাইনা।”
আহত দৃষ্টিতে তাকালো আরাধ্য। এই কয়েকটা শব্দ যেনো শব্দ নয়, একেকটা ক্ষেপণাস্ত্র ছিলো তার কাছে। কথা বলতে গিয়ে খেয়াল করলো তার ঠোঁট কাঁপছে। অনেককিছু বলতে চেয়েও কিছুই বলতে পারছে না। গভীর এক দীর্ঘশ্বাসের সাথে ঠোঁট দিয়ে জীভ ভিজিয়ে আরাধ্য বললো,
“তুমি ভুল ভাবছো শ্রেষ্ঠা। আমাদের মাঝে……”
” বেরিয়ে যান। এই মুহূর্তে বেরিয়ে যান আমার রুম থেকে। আমার সহ্য হচ্ছেনা আপনাকে। আমার ত্রিসীমানায়ও যদি আর কখনো আপনাকে দেখি, তবে….!”
কথার মাঝেই থেমে গেলো শ্রেষ্ঠা। তবে তার প্রতিটা কথা ছিলো ভয়ংকর। কণ্ঠে কী যেনো একটা ছিলো। তবুও বেশ খানিকটা সময় ব্যাথাতুর দৃষ্টিতে অপলক তাকিয়ে রইলো আরাধ্য। শ্রেষ্ঠা মনের ভুলে একবারের জন্যও তাকালো না তার দিকে। তবুও বেহায়া মন বারবার চাইছে সে তাকাক একটু। একবার তাকাক তার চোখের দিকে। চোখ তো মিথ্যা বলেনা। সে কী পারবে না, তার চোখের ভাষা বুঝে নিতে? পারবে না মিথ্যার বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে সত্যিটা জানতে?
আরাধ্য বেরিয়ে যেতেই হাঁটু মুড়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে শ্রেষ্ঠা। একহাতে বিছানার চাদর টেনে ছুঁড়ে মারে দূরে। দুইহাতে মুখ ঢেকে পাগলের মতো কান্না করতে থাকে সে। মনে মনে ভাবে, বিশ্বাসঘাতকদের দেখতে হুবহু মানুষের মতো কেনো হয়? কেনো বিশ্বাসঘাতকদের জন্য আলাদা কোনো চেহারা বানাননি সৃষ্টিকর্তা? কেনো করলো আরাধ্য তার সাথে এমন? সে তো একজন ভালো বন্ধু হিসেবে চিনতো আরাধ্যকে। আচ্ছা, শুধুই কী বন্ধু? হয়তো নাহ। হয়তো তার ভালোও লাগতো আরাধ্যকে। খানিকটা পছন্দ করতো কি? অথচ আজ এক লহমায় সেই ভালোলাগার স্থানে জমা হলো একরাশ বিতৃষ্ণা।
ক্লান্ত, বিধ্বস্ত পায়ে নিজের ফ্ল্যাটে ঢোকে আরাধ্য। রুমে যেতেই চোখ পড়ে বেডের মধ্যিখানে গুটিশুটি হয়ে শুয়ে থাকা শ্রেয়ার দিকে। বেডের কাছে গিয়ে ঘুমন্ত শ্রেয়াকে বুকে টেনে নেয় সে। হয়তো এরপর আর কখনো দেখা হবেনা তাদের। তবে অল্পদিনেই অতিরিক্ত মায়া জন্মে গেছে তার এই মেয়েটার প্রতি। অজানা এক টান অনুভব করেছে সেই প্রথমদিন থেকে। চোখ জ্বলছে তার। ঠোঁট নামিয়ে চুমু খেলো ঘুমন্ত শ্রেয়ার কপালে। দুইহাত মুঠোয় ভরে চুমু খেলো সেখানেও। শ্রেষ্ঠার ঘুম ভেংগে গেলো। ঘুম ঘুম চোখে সেও গলা জড়িয়ে ধরলো আরাধ্যর।
“গুড মর্নিং আঙ্কেল।”
“গুড মর্নিং মামনি। মানি তোমাকে খুঁজছে তো! যাও মানির কাছে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও।”
শ্রেয়া বাধ্য মেয়ের মতো বেরিয়ে গেলো আরাধ্যর ফ্ল্যাট থেকে। পাশাপাশি দুটো ফ্ল্যাট। দরজা খোলা থাকায় সহজেই ঢুকে গেলো সে। শ্রেষ্ঠাকে মেঝেতে বসে কাঁদতে দেখে ছোটো ছোট দুইহাতে চোখ মুছিয়ে দেয় শ্রেয়া। অতঃপর কোলে বসে কোমল কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করে,
“তোমার খারাপ লাগছে মানি? অনেক বেশি অসুস্থ লাগছে? ডক্টর ডাকবো?”
মেয়ের চিন্তিত মুখ দেখে ফিকে হাসে শ্রেষ্ঠা। কপালে ছড়িয়ে থাকা চুলগুলো সরিয়ে চুমু খায় সারামুখে। বলে,
“তুমি ডাক্তার চেনো? তাহলে ডাকবে কিভাবে?”
“আমি তো চিনি না। কিন্তু ভালো আঙ্কেল চেনে। ভালো আঙ্কেলকে বললে ঠিক ডেকে দেবেন।”
“শ্রেয়া, ওনাকে আমরা চিনিনা। আমাদের পরিচিত নন উনি। এভাবে কয়কেদিনের পরিচয়ে কাউকে বন্ধু মনে করতে নেই। বন্ধু আর বিশ্বাসঘাতক সবার চেহারা একই রকম হয়। ফার্দার যেনো আর ওনার সাথে কথা বলতে না দেখি আমি।”
মায়ের কড়া কণ্ঠের বাক্যে শ্রেয়া কী বুঝলো কে জানে? শুধু মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। যার অর্থ সে কথা বলবে না।
আরাধ্য নিশ্চুপে শুয়ে আছে দীর্ঘক্ষণ ধরে। এভাবে কতক্ষন কেটে গেছে জানা নেই তার। রাতের ঘটনাগুলো একে একে পালাক্রমে ঘুরে চলেছে তার মস্তিষ্কে। কোথা থেকে কী হয়ে গেলো কিছুই মাথায় আসছে না। অভিমান পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে তরতর করে। রাতের ঘটনাগুলো তাকে যতোখানি শীতলতা দিয়েছে, সকালটা হয়েছে ততখানি তিক্ততার। সে কোনোভাবেই বোঝাতে পারবে না শ্রেষ্ঠাকে। ভালোবাসার কথাটা মুখে বলার আগেই এভাবে ছন্নছাড়া হয়ে যাবে কল্পনায় ভাবেনি।
শ্রেয়ার ডাকে ছুটে গিয়ে অন্ধকার ওয়াশরুমের ফ্লোরে আবিষ্কার করে শ্রেষ্ঠাকে। থরথর করে কাঁপছে সে। কান্নার সাথে গোঙানিগুলো মিলেমিশে অন্যরকম এক ভয়ানক শব্দের সৃষ্টি করেছে যেনো! আরাধ্য এগিয়ে গেলো। খানিকটা আড়ষ্ঠতা নিয়েই হাত ধরলো শ্রেষ্ঠার। শরীর অত্যধিক গরম। অতঃপর কপালে, গলায় হাত দিতেই চমকে গেলো। জ্বরে সারা শরীর পুড়ে যাচ্ছে। আলতো হাতে শ্রেষ্ঠাকে ডাক দেয় আরাধ্য। বেহুশের মতো গুঙ্গিয়ে যাচ্ছে শুধু সে। বাধ্য হয়ে তাকে কোলে তুলে বেডে নিয়ে আসে আরাধ্য। বেশিক্ষণ ওয়াশরুমের ঠাণ্ডা ফ্লোরে থাকলে শরীর আরও বেশি খারাপ করবে, এজন্য বেডে শুইয়ে দেয়। শ্রেষ্ঠার এমন অবস্থা দেখে শ্রেয়া আরো জোরে জোরে কান্না করে দেয়।
“শ্রেয়া, তোমার মানি এমনিতেই অসুস্থ। মেডিসিন নিয়ে ঘুমাতে হবে তাকে। এভাবে কান্না করলে তার অসুবিধা হবে তো!”
“কিন্তু আমার তো কান্না পাচ্ছে খুব।”
“আচ্ছা, তুমি এক কাজ করো, আমার রুমে গিয়ে বসো। ঘুম পেলে ওখানেই ঘুমিয়ে পড়বে কেমন?”
হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে চলে যায় শ্রেয়া। পুরোটা রাত শ্রেষ্ঠার মাথার কাছে বসে জলপট্টি দেয় আরাধ্য। মাঝে মাঝে মাথায় পানি ঢেলে জ্বর কমানোর চেষ্টা করে। অথচ রাত বাড়ার সাথে সাথে জ্বরের মাত্রাও বেড়ে চলেছে ক্রমাগত। ঘুমন্ত শ্রেষ্ঠাকে মেডিসিন খাইয়ে ভোররাত পর্যন্ত জলপট্টি দেয় আরাধ্য। ভোরের দিকে জ্বরের মাত্রা খানিকটা কমেছে। শরীর ঠাণ্ডা হয়েছে দেখে সস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সে।
আচমকা আরাধ্যর কোমর জড়িয়ে ধরে আলতো করে তার দিকে সরে আসে শ্রেষ্ঠা। অতিরিক্ত গরম শরীর হটাৎ করে ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়ায় উষ্ণতার খোঁজে জড়িয়ে ধরেছে তাকে। আরাধ্য ছুটানোর চেষ্টা করে কয়েকবার। কিন্তু লাভ হয়না। অতঃপর ঘুমন্ত শ্রেষ্ঠার দিকে চোখ পড়তেই আরাধ্য মুগ্ধ নয়নে চেয়ে থাকে সেদিকে। যেনো কতো জনমের চোখের তৃষ্ণা মেটাচ্ছে আজ সে। চোখে মুখে ছড়িয়ে পড়া অবাধ্য চুলগুলো ফু দিয়ে সরিয়ে দেয় আরাধ্য। নড়েচড়ে ওঠে শ্রেষ্ঠা।
#চলবে!