চিলেকোঠার ভাঙ্গা ঘর পর্ব-০৫

0
564

#চিলেকোঠার_ভাঙ্গা_ঘর
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#পর্ব_৫
#ফিজা_সিদ্দিকী

শ্রেষ্ঠার উন্মুক্ত কোমরের উপর প্রবাহমান উত্তাল ঢেউ এর ন্যায় বিচরণ করছে আরাধ্যর হাত। প্রতিটা ঢেউ লোমহর্ষক, উত্তেজক। উত্তাল ঢেউগুলো টালমাটাল হয়ে আছড়ে পড়ছে যেন। শরীরের আদ্যোপান্ত জুড়ে বিচরণ করছে শিরশিরানি এক উন্মাদনা। কেউ যেনো বশ করে ফেলেছে শরীর। শুধুই কী শরীর? নাহ বরং দেহ, মন দুইই বশীভূত। প্রেমময় ছোঁয়া ছাড়া দেহ বশ্যতা স্বীকার করেনা এতো সহজে। লালসার খেলায় মোহ থাকেনা। না থাকে ভালোবাসা। যেটা থাকে তা হলো সর্বস্ব বিচরণের তীব্র আকাঙ্ক্ষা। ক্ষুধা নিবারণের চেষ্টা।

“আরাধ্য!”

শ্রেষ্ঠার কণ্ঠে ক্লেশ। গলা কাঁপছে খানিক। অনুভূতির শিওরে অবস্থান করা অবস্থায় তার এহেন কণ্ঠে কেঁপে উঠলো আরাধ্যও। চোখে মুখে স্পষ্ট হলো অপরাধবোধ। হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে ঘটাতে যাওয়া অঘটনের জন্য দোষারোপ করতে লাগলো নিজেকে। নিখুঁদভাবে উপলব্ধি হলো নিজের ভুল। অস্বস্তির কাঁটার মতো খচখচ করে বাঁধতে লাগলো পরিস্থিতি। শ্রেষ্ঠা কী তাকে ভুল বুঝলো? শরীরী খেলায় মেতে ওঠা এক পুরুষ ভাবলো আবারও? এবার কী তবে আগের চেয়েও দূরে ঠেলে দেবে তাকে? মনের যাতনা বাড়তে লাগলো ক্রমশ। ইতিমধ্যে শ্রেষ্ঠার কোমর হতে তার হাত নেমে এসেছে। নিজেকে খানিক চরিত্রহীন বলেও আখ্যায়িত করার চেষ্টা করলো সে।

আরাধ্যকে অবাক করে দিয়ে তার দুই গালে হাত রাখলো শ্রেষ্ঠা। অতঃপর ম্লান হেসে বললো,

“শারীরিক ক্ষুধা আর ভালোবাসার স্পর্শের মাঝে পার্থক্য বোঝার বয়সটা অনেক আগেই পেরিয়ে এসেছি।”

এই একটা কথা। একটা কথাই এতক্ষণের সমস্ত গ্লানি ধুয়ে মুছে একেকার করে দিলো যেনো। নিগুঢ় উত্তেজনায় আচমকা জড়িয়ে ধরলো শ্রেষ্ঠাকে। কোমর ধরে উঁচু করে মিশিয়ে নিলো তাকে বুকের সাথে। যেনো নরম এক টুকরো পেঁজা তুলো! অতঃপর কানের কাছে মুখ নিয়ে হিশহিশিয়ে বললো,

“তবে কী বাকি রাতটা কেউ আমাকে ভালোবাসার সুযোগ দিচ্ছে! এমনিতেই তো তাকে এই রূপে দেখে আমি অর্ধেক শেষ। বাকিটা শেষ করার দায়িত্ব কী সে নেবে?”

লজ্জায় রাঙ্গা শ্রেষ্ঠা মাথা গুঁজে দিলো আরাধ্যর বুকে। এমনটা নয় যে সে চাইছে আরাধ্যকে নিজের কাছাকাছি। এতোটা কাছাকাছি যেখানে একে অপরের নিঃশ্বাসের সাথে সাথে সাথে শরীরের গন্ধও মিলেমিশে একাকার হয়ে যাক। কিন্তু এভাবে আরাধ্যকে ফিরিয়ে দেওয়ার ক্ষমতাও তার নেই। প্রেম জিনিসটা তার জীবনে বহু কাঙ্ক্ষিত এক তপস্যার ফল। এই জীবনে কখনও প্রেমে পড়বে না বলেও সে পুরোদস্তুর আছড়ে পড়েছে আরাধ্যর প্রতি। আজ যদি আরাধ্য তার খুব কাছে আসে, আটকানোর সাধ্য নেই তার। তবে সে খুব করে চায় এতো তাড়াহুড়ো না করুক আরাধ্য। যখন মনটা স্বেচ্ছায় দিয়েছে, তবে শরীরটা পাওয়া তো খুব কঠিন নয়! অতঃপর আরাধ্যর কানের কাছে মুখ। ইয়ে গিয়ে ফিসফিস করে শ্রেষ্ঠা বললো,

“অপরাধবোধ থেকে যদি কারোর প্রতি ভালোবাসার অনুভূতি জেগে উঠতে পারে। তবে আমি তোমাকে ভালোবাসি। যতখানি গভীর ভরা পূর্ণিমায় উত্তাল সমুদ্রের ঢেউ, ততখানি গভীর আমার ভালোবাসা।”

১৫.

ব্যালকনির রেলিংয়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে শ্রেষ্ঠা ভাবছে আরাধ্যর কথা। আসার পর থেকে আরাধ্যর সাথে আর কোনো যোগাযোগ নেই তার। সে ইচ্ছে করেই কোন যোগাযোগ রাখেনি আরাধ্যর সাথে। দুজনের একসাথে কাটানো দিনগুলোর স্মৃতিচারণে অদ্ভুত এক উন্মাদনা ছড়িয়ে পড়ে তার আদ্যোপান্ত জুড়ে। শীতল হয় দেহ, মন। ভালোবাসলেই যে পেতে হবে, এমন তো কোনো নিশ্চয়তা নেই। ভালোবাসা ভালো থাকে অনুভবে। ভালো রাখে মনোহর স্মৃতিতে। অসময়ের স্মৃতিচারনে চোখ ভিজে ওঠার মতো টুকরো টুকরো স্মৃতি কুড়িয়েছে সে।

আজ তিনদিন হলো দেশে ফিরেছে শ্রেষ্ঠা। এয়ারপোর্টে ঢোকার আগের মুহূর্তেই তাকে আচমকা পিছু ডাকে আরাধ্য। অতঃপর বজ্রবেগে আছড়ে পড়ে তার বুকে। আবদ্ধ করে ফেলে বাহুবন্ধনের ঘেরাজালে। শ্রেষ্ঠা কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায় না। একেবারে নির্জীব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে শুধু। যেনো কোনো অনুভূতিই ছুঁয়ে দিতে পারছে না তাকে। এভাবে কতোটা সময় পার হয়েছে জানা নেই। তবে বাহুবন্ধনী আলগা হতেই ঘোর কাটে শ্রেষ্ঠার। করুন কণ্ঠে বলে ওঠে,

“আমাকে আর একটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরবেন? এতোটা শক্ত করে ধরবেন যেনো মিশে যেতে পারি একে অপরের সাথে। আপনার ঘামের গন্ধটুকুও যেনো লেপ্টে থাকে আমার শরীরে আজীবনের জন্য।”

আরাধ্য তাই করলো। দুই বাহু দ্বারা শক্ত করে চেপে ধরে রাখলো তাকে। দুজনের চোখের কোল ঘেঁষে বইছে অঝোর ধারা। শ্রেষ্ঠার বুক ভেঙে কান্না আসছে। কেনো যেনো মনে হচ্ছে এটাই তাদের শেষ দেখা। আর কখনো তারা একে অপরের এতটা কাছাকাছি আসতে পারবে না। পাশাপশি থাকলেও দুজনের মাঝে থাকবে যোজন যোজন দূরত্ব। যাওয়ার আগে শ্রেষ্ঠা একটা সাদা আনকোরা খাম ধরিয়ে দিয়ে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললো,

“প্লেন টেক অফ করার পরে চিঠিটা পড়বেন। এরপর কোনো রকম সিদ্ধান্তে পৌঁছাবেন। ভালোবাসলেই কাছে পেতে হবে এমনটা কোথাও লেখা নেই। স্মৃতির পাতায় জীবন্ত থাকুক প্রেমময় কিছুটা সময়।”

কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে শ্রেষ্ঠা ডুব দিল অতীতের নৃশংসতা ঘেরা এক অধ্যায়ে। এই অধ্যায় চাপা থাকার কথা ছিলো আজনম। যেখান রয়েছে দুঃখ ও দহনের যন্ত্রণা। নশ্বর পৃথিবীর কদাকার এক মূর্তির কাহিনী দাফন যেখানে। অন্ধকার ঘন জগৎ এর কুৎসিত এক রচনা। জরাজীর্ণ কিছু চরিত্রের বসবাসে এক দানবের ক্ষোভ নিঃসৃত ক্ষুদা।

পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন, কলেজের পাশেই ভাড়া বাড়িতে থাকে স্নিগ্ধা। সাদামাটা ছিমছাম স্বভাবের স্নিগ্ধার সবচেয়ে স্ট্রং পয়েন্ট তার পড়াশোনা। মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান হিসেবে আলাদা ভাড়া বাড়ি নিয়ে একা থাকার পথটা সহজ ছিল না তার জন্য। তবে মেধাবী হওয়ায় বেশ কিছু টিউশনির অফার আসে তার কাছে। সে সময়ে সবেমাত্র কলেজের শুরু। সেইসাথে নতুন জায়গা, নতুন দুনিয়া। চারিদিকের সবকিছু রঙচঙে। চোখের উপর যেনো রঙিন কোনো আস্তরণ। শ্রেষ্ঠার তখন সবেমাত্র দশম শ্রেণীর। তবে বয়সের তুলনায় একটু বেশিই পরিপক্ক সে। দুনিয়ার জটিলতা, কুটিলতা খুব সহজে ধরে নেওয়ার ক্ষমতা যেনো ঈশ্বরপ্রাপ্ত। অথচ তার চেয়ে চার বছরের বড়ো হয়েও স্নিগ্ধা এসব ব্যাপারে একেবারেই অজ্ঞাত। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলা বাকি মেয়েদের সাথে তার যায়না একদমই। তার বেশিরভাগ সময়টা কাটে পড়াশোনা নিয়েই। কখনও নিজের পড়াশোনা তো কখনো টিউশনির বাচ্চাদের। মাত্র দুটো টিউশনি নিয়েই নিজের খরচ ওঠানোর মতো টাকা জোগাড় হয়ে যেতো তার। তাই অতিরিক্ত টিউশনির বদলে সেই সময়টায় নিজের পড়াশোনার কাজে লাগিয়ে বরাবরের মতো সবার থেকে এগিয়েই থাকতো সে।

সময়ের গতিবিধির তাড়নায় নতুন শহর হয়ে উঠলো পুরোনো। জমে উঠলো একজোট হয়ে বন্ধুবান্ধবের আড্ডা। তাদের গ্রুপের সবচেয়ে নিষ্ক্রিয় সদস্য ছিলো স্নিগ্ধা। চুপচাপ, গম্ভীর, লাজুক। এই নিয়ে অনেকে অনেক সময় নানান ঠাট্টাও করতো তাকে নিয়ে। কিন্তু সেসব অগ্রাহ্য করে একজন সবসময় আগলে রাখতো তাকে। তার ছোটো ছোটো প্রয়োজনের দিকে খেয়াল রাখা সার্থক নামের ছেলেটা ছিলো তাদেরই গ্রুপের সদস্য। যাকে যে কোনো সময়, যে কোনো বিপদে আগে খুঁজে পেতো স্নিগ্ধা। সকলের ঠাট্টা তামাশা উপচে ছিলো যার ভরসার হাত।

রোজকার মতো আজও কলেজ থেকে ফিরে বইগুলো ওলোট পালোট করে চেক করলো স্নিগ্ধা। নির্দিষ্ট এক বইয়ের মাঝে থাকা ছোটো চিরকুট খানা দেখে আপনা আপনি ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে ওঠলো তার। বিগত দুই সপ্তাহ ধরে এমনটা প্রায়ই হচ্ছে। চিরকুটে খুব বেশি কিছু লেখা থাকে না। শুধু গোটা গোটা অক্ষরে লেখা থাকে কয়েকটা শব্দ। এটুকুতেই কম্পন শুরু হয় তার বুকে। থেমে থেমে আসে হৃদস্পন্দন। ওলোট পালোট হয়ে যায় অনুভূতির পসরা। তবে আজকের চিরকুটটার জন্য দীর্ঘ প্রতীক্ষা করেছে সে। গুনে গুনে চারটে দিন পরে চিরকুট দিয়েছে সে। আচ্ছা, মাঝের এই দিনগুলোতে সে কেনো চিরকুট দিলো না? সে কী অসুস্থ ছিলো? নাকি তাকে লেখা চিরকুটগুলো ছিলো কেবলই তার অবসর সময়ের নশ্বর এক কাজ? কী ভীষণ উৎকণ্ঠা নিয়ে বসে ছিলো সে, তা কী জানে সে? সে কী আদৌ জানে, কতোখানি অস্থিরতায় নিমগ্ন ছিলো তার দিনগুলো?

“অপেক্ষার প্রহর যদি প্রেমের তৃষ্ণা জাগায়, তবে এই অপেক্ষা আরও দীর্ঘ হোক। কেউ একজন তৃষ্ণার্ত চাতকের মতো চেয়ে থাকুক এই পথের পানে।”

স্নিগ্ধার বুক কাঁপছে। থরথর করে কাঁপছে সারা শরীর। অনুভূতিগুলো একসাথে জটলা পাকিয়ে বিবশ করে ফেলছে তার দেহ, মন। এই এতটুকু একখানি চিরকুট তাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেলো অন্য এক জগতে। যে জগতে নেই কোনো ছলনা। নেই কোনো মিথ্যা রাখঢাক। যা আছে তা হলো আবেগ ও মোহমায়ায় নিমজ্জিত কিছু রং বেরংয়ের চিরকুট, তাতে লেখা প্রেমময় শব্দ। চারপাশের অন্ধকার ছাপিয়ে উড়ে বেড়ানো এক ঝাঁক জোনাক পোকা। আর রং বেরং এর ডানা ঝাপটে উড়ে বেড়ানো কিছু প্রজাপতির দল।

#চলবে?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে