চিলেকোঠার ভাঙ্গা ঘর পর্ব-০৩

0
616

#চিলেকোঠার_ভাঙ্গা_ঘর
#ফিজা_সিদ্দিকী
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#পর্ব_৩

“হেই বেবস! এতো মনমরা কেনো আজকের দিনে? চলো ক্লাবে যাই।”

“ইরা, তোমাকে কতোবার বলেছি এসব নামে ডাকবে না আমাকে। আমার একটা নাম আছে। একান্তই নাম নিতে ইচ্ছে না করলে বাকিদের মতো এরাদ বলবে।”

“কাম অন, এক বছর হয়ে গেলো আমাদের ফ্রেন্ডশীপের। অথচ তুমি সেই আগের মতোই টিপিক্যাল বিহেভ করো। হুয়াই?”

“ইরা, আমার ভালো লাগছে না। আজকের দিনে একা থাকতে চাই।”

“হুয়াট রাবিশ! এসব টিপিক্যাল বাঙালি নাম আমার ভালো লাগে না তুমি জানো। অ্যারাস নাম আমার।”

“ভুলে যেওনা তুমি নিজেও একজন বাঙালি। বাবা মায়ের ভালোবাসার দেওয়া নাম ইরা। বাঙালির রক্ত তোমার শরীরে। এসব ক্লাব, পার্টি করে উড়নচণ্ডীর মতো ঘুরে বেড়ানো, এসব বাঙালি কালচার নয়। আর আমি তোমাকে ইরা নামেই ডাকবো। পছন্দ না হলে দরজাটা ওদিকে আছে।”

চুপসে গেলো ইরা। ছেলেটাকে মনে মনে ভালোবাসে সে। কিন্তু মুখে প্রকাশ করতে পারেনি আজও। সবসময় রুড বিহেভ করা মানুষটার উপরেই কিভাবে যেনো সে ঝুঁকে পড়লো নিজের অজান্তেই। অথচ মানুষটা একবারের জন্যও তার সাথে মিষ্টিমুখে কথা পর্যন্ত বলেনি। মাঝে মাঝে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে খুঁটিতে খুঁটিতে দেখে ইরা। চোখ ধাঁধানো সুন্দরী সে। সাদা মসৃণ ত্বকের কোথাও সামান্যতম দাগ নেই। যাকে এক দেখায় পছন্দ হয়ে যাবে যে কোনো ছেলের। অথচ এই একটা মানুষের সামনে তার সমস্ত রূপ সৌন্দর্য্য ফিকে লাগে। কারন সে তো ঘুরেও তাকায়না তার দিকে।

কানাডার বিলাসবহুল ফ্ল্যাটের বেলকনিতে দাঁড়িয়ে কফির মগে চুমুক দিচ্ছে আরাধ্য। আজকের এই দিনটা ভীষণ পোড়াচ্ছে তাকে। বাকি দিনগুলো যে স্বাভাবিকভাবে কাটে এমনটা নয়। কিন্তু আজকে দিনটা একটু বেশিই বিষন্ন লাগছে। বিষাক্ত লাগছে সবকিছু। ভালবাসার সাথে অভিমানগুলোও আজও জীবন্ত। বরং দিনে দিনে সময়ের কালক্ষেপে আরও বেড়েছে। শ্রেষ্ঠাকে সে ভুলতে পারেনি আজও। তার আত্মার সাথে যেনো মিশে গেছে সে। সেদিন রাতের এতো কাছাকাছি আসা, শ্রেষ্ঠাকে এতো কাছ থেকে দেখা, তার প্রথম চুম্বন, প্রথম বারের মতো ছুঁয়ে দেওয়া, সবকিছুই কী ভীষণ রকম জীবন্ত। একটা বছর কেটে গেছে। ব্যস্ততায় পুরোটা দিন বুঁদ থাকে আরাধ্য। তবুও মস্তিষ্কে একটা মানুষ থেকেই গেছে। যাকে দেখার অনুমতি না থাকলেও ভালোবাসায় কোনো বাধা নিষেধ নেই।

সেদিনের ঘটনার এক সপ্তাহের মাথায় দেশ ছেড়ে আবারও বিদেশে পাড়ি জমিয়েছিলো আরাধ্য। যে মেয়েটাকে বিয়ে করার জন্য বাধ্য হয়ে নিজের দেশে ফিরতে হয়েছিলো তাকে, আজ তারই বিরহে দেশ ছাড়লো সে। জীবন কী ভীষণ রকম অদ্ভুত।

১৩.
ইন্ডিয়া থেকে বেশ কিছু মানুষ আজ কানাডায় এসেছে। মূলত অফিসিয়াল কিছু চুক্তিপত্রের কাজেই পাঠানো হয়েছে তাদের। তাদের হোটেল বুক করা থেকে শুরু করে মিটিং ম্যানেজ সবকিছুর দায়িত্ত্ব পড়েছে মিষ্টার হেনরির উপর। ইন্ডিয়ান কোম্পানি শুনেই আরাধ্যর চোখের সামনে ভেসে উঠলো শ্রেষ্ঠার মুখবয়ব। কিন্তু আদৌ কী তা সম্ভব? শ্রেষ্ঠার দেখা কী সে এজনমে পাবে? হয়তো নাহ। আবার হয়তো পেলেও পেতে পারে। শুনেছে দুনিয়াটা গোল। তাই কোনো এক ক্ষণে আবার দেখা হলেও হতে পারে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের মতো কাজে ব্যস্ত হয়ে গেলো আরাধ্য। ইতিমধ্যে কেবিনের দরজায় নক করছে কেউ।

“স্যার মিটিংরুমে আপনাকে ডাকছেন। ”

“আমাকে কেনো? আজকে তো ইন্ডিয়ান ক্লায়েন্টদের সাথে মিটিং ছিলো। মিস্টার হেনরি আসেননি?”

“না না স্যার। আসলে আপনি নিজেও তো ইন্ডিয়ান। তাই স্যার আপনাকেও মিটিংয়ে জয়েন করার জন্য বললেন। ”

বিরক্ত হয় আরাধ্য। নিজেকে কেমন যেনো শো পিস লাগে। তাকে যেখানে ডাকবে যেতে হবে নাকি? চোখে মুখে হাজারও বিরক্তি নিয়েই মিটিং রুমে প্রবেশ করলো সে। মুখে লম্বা একটা হাসির রেখা টেনে সামনে তাকাতেই বড়ো রকমের ধাক্কা খেলো। চমকের তীব্রতা এতটা বেশি ছিলো যে কয়েক কদম পিছিয়েও গেলো সে। শ্বাস প্রশ্বাস ওঠানামা করছে তীব্র গতিতে। আচমকা আরাধ্যর এমন পরিবর্তনে মিটিং রুমের সবার দৃষ্টি তার দিকেই। এভাবে সকলের তাকানো দেখে খানিকটা অস্বস্তিতে পড়লো সে। অতঃপর নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে একটা চেয়ার টেনে বসে পড়লো। পুরো একটা বছর পর আবারও দেখছে সে শ্রেষ্ঠাকে। একই দিনে আবারো তাদের দেখা। বুকের ভিতর তীব্র জ্বালাপোড়া টের পাচ্ছে। ভেতরে কেউ যেনো আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। দাউদাউ করে জ্বলছে।

সাদা ঠাই গ্লাসের এপার ওপার স্পষ্ট। ছয়তলার উপর থেকে নিচের দিকে তাকালে মানুষগুলোকে অনেক ছোটো ছোটো দেখাচ্ছে। যেনো ইঁদুর ছানার মতো বিচরণ করছে কোলাহল মুক্ত, সুষ্ঠ পরিমার্জিত রাস্তায়। আরাধ্যর ডানহাতে কফির কাপ। বামহাত পকেটের মধ্যে বন্দী। গভীর কিছু চিন্তায় মগ্ন হয়ে মাঝে মাঝে চুমুক দিচ্ছে গরম ধোঁয়া ওঠা কফির কাপে। দৃষ্টি নীচে রাস্তার দিকে নিমগ্ন হলেও মস্তিষ্কে চলছে অন্যকিছু। আচমকা পিছন থেকে একজোড়া হাতের জাপ্টে ধরার আভাসে হকচকিয়ে যায় আরাধ্য। বিদেশে এগুলো স্বাভাবিক হলেও অফিসের সবাই জানে আরাধ্যর এসব একদমই অপছন্দের। তাই তার সাথে ভুলেও কেউ এমন ধরনের কিছু করার সাহস পায়না। বিরক্তির সাথে সাথে রাগটাও দপদপ করে বাড়তে লাগলো তার। মেয়েটার দুইহাত তার বুকের উপর রাখা। আচমকা কফির কাপটা পাশের টেবিলে রেখে হাত ধরে টান দিয়ে সামনের ঠাই গ্লাসের সাথে চেপে ধরে তাকে। হকচকিয়ে যায় মেয়েটা। সাথে উচ্চারিত হয় ব্যাথাতুর কিছু শব্দ। আরাধ্যর ডান হাত তার গলায় বেড় দিয়ে ধরা। যেনো আর একটু হলেই গলা চেপে ধরবে।

শ্রেষ্ঠা! শ্রেষ্ঠা তাকে এভাবে ছুঁয়েছে! ভাবতেই উত্তেজনায় সারা শরীরে কাঁটা দিয়ে ওঠে আরাধ্যর। হাতটা আপনাআপনি গলা থেকে সরে যায়। চোখে মুখে ছড়িয়ে পড়া চুলগুলো কানের পিছে গুঁজে দিতে গিয়েও সরিয়ে নেয় হাত। শুধু এক ধ্যানে তাকিয়ে থাকে শ্রেষ্ঠার দিকে। আগের উজ্জ্বলতা আর নেই। চোখের নীচে জমা হয়েছে অনেক নির্ঘুম রাতের নিদর্শন। চেহারায় মলিনত্বের ছাপ। আরাধ্যকে নিশ্চুপ ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে শ্রেষ্ঠা প্রশ্ন করে,

“মে আই?”

সম্মতি ফিরলো আরাধ্যর। শ্রেষ্ঠা হয়তো চেয়ারে বসার জন্য অনুমতি নিচ্ছে। একথা ভেবে মাথা নাড়ায় আরাধ্য। কিন্তু পরক্ষনেই আরাধ্যকে অবাক করে দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে ওঠে শ্রেষ্ঠা। হকচকিয়ে যায় আরাধ্য। এমন কিছু হতে পারে সে কল্পনায়ও ভাবেনি। তবে কল্পনাতীত কিছু পাওয়াতে যে এতো সুখ, তা আজ বেশ অনুভব করছে। এতদিনের জমা হওয়া অভিমানের পাহাড় ধুয়ে মুছে যাচ্ছে কারো চোখের জলে।

“শ্রেষ্ঠা, কী হয়েছে? এমন পাগলামী করছো কেনো? শরীর খারাপ লাগছে?”

“উহু। এতোদিন খারাপ ছিলো। আজ তো ভালো হওয়ার পালা।”

“তুমি অসুস্থ ছিলে এতোদিন?”

“হুম। মানসিক অসুস্থতায় চুবিয়ে রেখে এসেছিলো কেউ। কেউ একজন ইচ্ছে করে অনুতাপের আগুনে ঝলসে যাওয়ার জন্য রেখে এসেছিলো।”

“ঝলসে গেছো?”

“শুধু ঝলসে যাইনি, অনুতাপের তীব্রতা তাকে আমার মনে ঠাঁই দিয়ে ফেলেছে।”

“মানে?”

“কিছুনা”

“শ্রেষ্ঠা বলো!”

“নাহ”

আরাধ্য শ্রেষ্ঠার থুতনি ধরে মুখটা উঁচু করলো। বুড়ো আঙুলের ডগা দিয়ে মুছিয়ে দিলো গালে লেপ্টে থাকা অস্রুকনা। অতঃপর তৃষ্ণার্ত পথিকের ন্যায় কোমল অথচ অসহায় গলায় বলে উঠলো,

“একটা বছর। সময়টা অনেক বেশি। তাও নিজেকে সামলে নিয়েছি। তোমাদের থেকে অনেক দূরে চলে এসেছি। সেদিনের পর থেকে আর কখনো মুখোমুখি হইনি তোমার। অথচ আমার ভেতরটা কতখানি পুড়েছে, তার সাক্ষী আমার নির্ঘুম রাত। একলা রাতের আকাশ। অনেক তো হলো অপেক্ষা। এবার কী অবসান হতে পারেনা সবকিছুর? এতো কাছে পেয়েও তোমাকে না পেলে এই আক্ষেপ যে আমাকে বাঁচতে দেবে না। একবার অনেক কষ্টে নিজেকে সামলেছি। পরেরবার কিন্তু পারবো না। মরেই যাবো আমি।”

কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে আরাধ্যর থেকে দূরে সরে যায় শ্রেষ্ঠা। অতঃপর চেয়ারে বসতে বসতে বলে,

“অচেনা শহরে পুরোনো কলিগ থাকতে কষ্ট করে হোটেলে উঠতে যাবো কেনো? কাজ শেষ করে জলদি বাড়িতে চলো। যাওয়ার সময় হোটেল থেকে লাগেজগুলো পিক আপ করে নেবো।”

“মানে?”

“এখানে এতো মানে মানে করার কী আছে? কয়েকদিনের জন্য এসেছি কানাডা ঘুরে দেখাবে। তোমার বাড়িতে রেখে আদর আপ্যায়ন করবে ব্যাস। এটুকু অতিথী সেবা তো করাই যায়। আফটার অল পুরোনো কলিগ বলে কথা।”

#চলবে!

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে