#চিলেকোঠার_ভাঙ্গা_ঘর
#ফিজা_সিদ্দিকী
#পর্ব_৭(প্রণয়াবেগ উৎসর্গ)
#প্রথম_পরিচ্ছেদ(সমাপ্ত)
“সূচনার রেশ পরিসংহারে হারিয়ে যায়।”
নির্লিপ্ত ভঙ্গিমায় আকাশপানে তাকিয়ে দুইতলা বাড়ীর ছাদের কার্নিশে বসে পা দোলাচ্ছে আরাধ্য। শ্রেষ্ঠার কথায় ঘাড় ঘুরিয়ে সরাসরি তাকালো তার দিকে। অতঃপর ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসির রেশ বসায় রেখে বললো,
“মুগ্ধতা খুঁজে পেয়েছি তোমার মাঝে। প্রতি মূহুর্তে প্রতিটা ক্ষণে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়েছি অনিমেষ।”
শ্রেষ্ঠা স্থির। যেনো কাঠের পুতুলকে জোর করে বসিয়ে রাখা। অথচ দৃষ্টি শূন্য, এলোমেলো। তবুও কণ্ঠের মাঝে রয়েছে অসম্ভব আত্মবিশ্বাস।
“সময়ের ফেরে মুগ্ধতার বাণী ছেয়ে যায় তিক্ততায়।”
“তবে প্রেম!””
“হৃদয়ে লুকায়িত প্রেমের কুঠুরি হতে নির্গত হয় দীর্ঘশ্বাস। ঝলসে যায় সাজানো গুছানো সংসার।”
“এতো তিক্ততা আর দীর্ঘশ্বাস বয়ে বেড়ানো যায়না। আমাদের সবারই জীবনে হয়তো এক অধ্যায় থাকে, যা হয় একান্ত ব্যাক্তিগত। পুরো দুনিয়া থেকে লুকিয়ে যাকে আমরা পুষে রাখি বুকের মাঝে আজীবন। কিন্তু বেঁচে তো থাকতে হয়! যদি বাঁচতেই হয় তবে ভালো থাকা কেনো হবে না?”
অনেকটা সময় কাটলো নিরবতায়। হয়তো কারো আবেগী মনের উন্মত্ততা লুকানোর চেষ্টা নয়তো অতীতের ঝলসে যাওয়া পাতাগুলো জীবন্ত হওয়ার ব্যাথায় বার কয়েক তপ্ত দীর্ঘশ্বাস ব্যতীত কিছুই শোনা গেলো না। শাোঁ শাোঁ শব্দে প্রবাহমান বাতাসের সাথে শ্রেষ্ঠা নিঃশ্বাসের গতিবেগ বাড়লো। ঠোঁট দুটো গোল করে বিষাক্ত কিছু বাতাস ঝেড়ে ফেলে দিলো ভেতর থেকে। আরাধ্য দেখলো। সবটাই বেশ ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলো। একেবারে যাকে বলে খুঁটিতে খুঁটিতে দেখা। শ্বেতাভ চামড়ার মাঝে ভেসে ওঠা লালচে তিল, লালাভ ঠোঁটের দাঁত দ্বারা আঁকড়ে ধরা, কখনও বা জিহ্বা দ্বারা শুষ্ক ঠোঁটের আদ্রতা প্রদান, সবটাই যেনো মুখস্ত করে ফেললো। সেই সাথে আরও খানিকটা ঝুঁকে পড়লো শ্রেষ্ঠার প্রতি। টকটকে রক্তবর্ণ ঠোঁটের গা ঘেসে বেড়ে ওঠা লালচে তিল। আফিমের চেয়েও অধিক মাদকতার সুরে হাতছানি দিচ্ছে যেনো! এই আগুন সুন্দরী মেয়েকে বিয়ে করতে না করেছিলো সে! সেদিন কেনো এত রূপ, মাধুর্য্য তার চোখে আঁটকালো না? এই চোখ ধাঁধানো রুপ সুন্দরী মেয়েটাকে সে নিজে রিজেক্ট করেছিলো, ভাবতেই হাসি পাচ্ছে আজ। সেদিন এমনটা না করলে হয়তো আজ দুজনের জীবন ভিন্ন হতো। আরোহী খাঁন যেভাবে তার বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিল, হয়তো এতদিনে তাদের জায়গা হতো এক ছাদের নীচে। একই কুঠুরির একে অন্যের পোশাকের ন্যায় কাটতো কোনো এক রাত। বিনিদ্র মধুরতায় ছেয়ে যেতো কোনো এক রাত।
শ্রেষ্ঠা মুখ তুলে তাকায়। আরাধ্যর বিমোহিত দৃষ্টিতে দৃষ্টিপাত হতেই চোখ সরিয়ে ফেলে দুজনে। অস্বস্তিকর একটা পরিস্থিতি থেকে বের হতে তাৎক্ষণিক আরাধ্যর জিজ্ঞাস্য,
“কিন্ডার গার্ডেন স্কুলে তোমার আনাগোনা কেনো? জানামতে তোমাদের পরিবারের একমাত্র মেয়ে তুমি। ”
“সবকিছুই যে আপনার জানার মাপকাঠির মধ্যে পড়বে, এমনটা নাও হতে পারে। আমার ব্যক্তিগত বিষয়গুলোতে কারো নাক গলানো একেবারেই অপছন্দের।”
কণ্ঠের মাঝে রাগের আভাস। মুহুর্তেই মূর্ছা পড়া মেয়েটা যেনো দৈবশক্তি পেয়েছে। তেজ এসে ভর করেছে তার মাঝে। ঘাড় বাঁকিয়ে তাকালো আরাধ্য। দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো শ্রেষ্ঠার যাওয়ার পানে। আচমকা জোরালো কণ্ঠে বলে উঠলো,
“মনের ভুলে কিংবা মন খারাপের কবলে, ধরা দিও এ ভুবনে। সাঁঝের বেলা, ছোটাছুটি করে নাইবা পেলে দেখা, ছুটে এসো এই নিবাসে সব বেলা।”
৯.
আজ অনেকগুলো দিন পর শ্রেয়া দেখা পেল আরাধ্যর। ভূবন ভোলানো হাসি মুখে দৌড়ে এসে জাপ্টে ধরতে গিয়ে হোঁচট খাওয়ার উপক্রম। আরাধ্য খুব সাবধানে দৌড়ে গিয়ে কোলে তুলে নিলো তাকে। এতে যেনো তার হাসির পরিমাণ আরও বাড়লো। চওড়া হলো ঠোঁটের দুইপাশের বহর। খিলখিল শব্দে মুখরিত চারিপাশ। আরাধ্যও মেতে উঠলো তার শিশুসুলভ আচরণে। মেয়েটা যেনো আস্ত এক ভালোবাসার ডিব্বা। যেখানে শুধু ভালোবাসা জমা রাখতে ইচ্ছে করে। ঠিক যেভাবে প্রতিদিন ভাঙতি টাকাগুলো জমানো হয় ভান্ডারে, সেভাবেই খুচরো ভালোবাসাগুলো উজাড় করে রেখে দিতে মন চায় তার কাছে। এতো এতো বেশি আদুরে, যেনো ছোট্টো এক বিড়ালছানা। শ্রেয়ার ফ্যামিলির সাথে কোনোদিন দেখা হয়নি আরাধ্যর। তবে তাদের সম্পর্কে বেশ খানিকটা ধারণা জন্মেছে তার। দৃষ্টিপটে অপরূপা এক মাতৃত্বের প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে বারেবারে তার মস্তিষ্কে। শ্রেষ্ঠার মা একজন সিঙ্গেল মাদার। বাবাকে সে কখনো দেখেনি। এমনকী আদৌ তার মায়ের বিয়ে হয়েছে কিনা সে বিষয়েও নিশ্চিত নাহ আরাধ্য। তবে জানার পন্থা থাকলেও কখনও সে বিষয়ে খোঁজ নেওয়ার বিন্দুমাত্র আগ্রহ প্রকাশ করেনি সে। কী প্রয়োজন একজন মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে প্রবেশের! সে তো শ্রেয়াকে ভালোবাসে। এইতো মাঝে মাঝেই তায়েফ দেখা হয় স্কুলে, বেশ অনেকটা সময় কাটে অগোছালো ছন্নছাড়া গল্পগুজবে। এইতো বেশ। সম্ভবত শ্রেয়ার মায়েরও তাদের কথোপকথনে কোনো আপত্তি নেই। নইলে এতদিনে হয়তো শ্রেয়া খানিকটা দূরে সরে যেত তার থেকে। কিন্তু এমনটা যখন ঘটেনি তখন ধরে নেওয়াই যায়, শ্রেয়ার মতো তার মাও অসাধারণ ব্যাক্তিত্বের অধিকারী এক মহিলা। এই মানুষটার কথা ভাবলেই শ্রদ্ধা আর সম্মানে ভরে ওঠে আরাধ্যর বুক। আজকাল এমন মানুষ আসলেই বিরল। বরং নিজেদের সুখের কথা ভেবে সন্তানের ভবিষ্যৎ জলাঞ্জলি দেওয়া মানুষের সংখ্যাই অধিক। অথচ এই যুগের মানুষ হয়েও নিজের চেয়ে বেশি সন্তানের কথা ভেবেছেন তিনি। সমাজের চক্ষুশূল হয়েও সন্তানকে আঁকড়ে ধরে কাটিয়ে দিচ্ছেন দিনের পর দিন। হয়তো রাস্তার কিছু কুকুররুপী মানুষদের টিটকারীও শুনতে হয় প্রতি মূহুর্তে।
১০.
লাশের সংখ্যা দিনে দিনে বাড়তেই থাকছে। প্রতিটা খুনই হচ্ছে অবিকল একই ভাবে। পোস্টমর্টেম রিপোর্টে ধরা পড়েছে প্রতিটা লাশের শরীরে উপস্থিত চেতনানাশক ঔষধি। হাতের শিরার মধ্যে অতিরিক্ত পরিমাণের বায়ু একইসঙ্গে প্রবেশ করানোর ফলে মৃত্যু ঘটছে সকলের। কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্য্যের বিষয় হলো, ইনজেকশনের সিরিঞ্জ এ মৃত ব্যাক্তির ফিঙ্গাপ্রিন্ট ছাড়া আর কিছুর অস্তিত্ব নেই। প্রতিটা লাশের পাশেই পড়ে আছে একটা করে খালি সিরিঞ্চ। যেটা মৃত ব্যাক্তি নিজেই নিজের শরীরে প্রবেশ করাচ্ছে।
এতো এতো সমীকরণ মেলাতে গিয়ে আরও বেশি জটিল হয়ে পড়ছে কেসটা। নির্ঝর মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে কেবিনে। এই একটা কেস পুরো পুলিশ ডিপার্টমেন্টকে নাড়িয়ে রেখে দিয়েছে। উপরমহল থেকে চাপ, তা না হলে কখনোই এই বিষয়ে মাথা ঘামাতো না সে। কারন ইনভেস্টিগেশনে দেখা গেছে খুন হওয়া প্রতিটা মানুষের অতীতই কালো। অনেকে ড্রাগ পাচারকারি কিংবা নারী পাচারকারি চক্রেও জড়িত। অনেকে কয়েকবছর হাজতবাস কাটিয়েও গেছে। বেশিরভাগ মানুষের ফাইল খুঁজে পাওয়া গেছে আসামীদের রেকর্ডের লিষ্টে। অনেকে উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে হাজতবাস করেনি আবার অনেকে হাজতবাস থেকে ছাড়া পেয়েছে। কিন্তু মানুষের স্বভাব পরিবর্তন হওয়ার নয়। তাই জেল থেকে বের হয়ে তারা আবারো যুক্ত হয়েছে সেই সব কাজের সাথে।
মাঝরাত। হুট করেই ঘুম ভেংগে যায় শ্রেয়ার। পাশ ফিরে মাকে জড়িয়ে ধরার উদ্দেশ্যে হাত বাড়িয়ে হাতড়ায় বেশ অনেকটা সময়। কিন্তু কিছুতেই নাগাল পায়না শ্রেষ্ঠার। ঘুম ঘুম চোখে উঠে বসে শ্রেয়া। ঘুমের রেশ ছাড়াতে দুই চোখ হাত দিয়ে কচলে পাশে তাকায়। শ্রেষ্ঠা নেই। ভীতু চোখে আশপাশের সব জায়গায় তাকিয়েও শ্রেষ্ঠাকে কোথাও খুঁজে না পেয়ে কান্না পায় শ্রেয়ার। কিন্তু মায়ের শেখানো কথায় কান্না চেয়ে রেখে বেড থেকে নেমে পড়ে সে। একে একে রান্নাঘর থেকে শুরু করে সবজায়গায় দেখে ফেলে সে। অবশেষে বাথরুমের দরজা খুলে শ্রেষ্ঠাকে দেখতে পেয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে চায় তার বুকে। কিন্তু কয়েকটা বাড়াতেই থমকে যায় সে। শ্রেষ্ঠা কাঁদছে। হাঁটুতে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। ভয় পেয়ে ছুটে দরজা খুলে বাইরে চলে যায় শ্রেয়া। আচমকা তার মনে পড়ে আরাধ্যর কথা। তাদের পাশের রুমটাই আরাধ্যর। ভয় থেকে বাঁচতে মাঝরাতে জোরে জোরে ধাক্কা দেয় আরাধ্যর রুমের দরজা।
বেশ অনেকটা সময় ধরে কেমন এক খট খট হচ্ছে দরজায়। ঘুমের মাঝেই হুট করে সজাগ হয় আরাধ্যর মস্তিষ্ক। ঘুম ছুটে গিয়ে কৌতূহল চেপে বসে মনে। ভারী এক লাঠি ডান হাতে উঠিয়ে পা টিপে টিপে এগিয়ে আসে দরজার কাছে। খুব সাবধানে লক খুলে দরজা টানতেই শ্রেয়ার কান্নারত নিস্পাপ মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে ছ্যাত করে ওঠে তার বুক। হাতের লাঠিটা ফেলে দৌড়ে দরজার বাইরে থেকে তুলে আনে শ্রেয়াকে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করছে শ্রেয়া। হয়তো কোনো কিছুতে ভয় পেয়েছে অনেকটা, এমনটা ভেবে তাকে শান্ত করার চেষ্টায় লেগে পড়ে আরাধ্য।
গুনগুনিয়ে করা শ্রেষ্ঠার কান্না দেখে প্রাথমিকভাবে আরাধ্য নিজেও ভড়কায়। বেশ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে অনেকটা সময় কান্না করার পর যেনো আর বেগ পাচ্ছেনা। গলা ভেঙে গেছে। শ্রেষ্ঠাকে এ অবস্থায় দেখে বুকের মাঝে মোচড় দিয়ে ওঠে আরাধ্যর। তৎক্ষণাৎ দৌড়ে গিয়ে বুকে টেনে নেয় শ্রেষ্ঠাকে। একজোড়া ভরসার হাত পেয়ে শ্রেষ্ঠাও অবচেতন মনে আঁকড়ে ধরে তাকে আস্টেপৃষ্টে। আরাধ্য একহাত শ্রেষ্ঠার মাথায় রেখে আদুরে কণ্ঠে বলে ওঠে,
“কিচ্ছু হবে না। আমি আছি তো!”
#সমাপ্ত।