#চিলেকোঠার_ভাঙ্গা_ঘর
#ফিজা_সিদ্দিকী
#পর্ব_৬(মানুষ থেকে পশু হওয়ার জার্নির শুরুটা কোথায়!)
প্রতিদিনের নিউজপেপারে একই হেডলাইন দেখতে দেখতে বিরক্ত শ্রেষ্ঠা। শুধু রহস্যময় খুনের বিবরণ। অথচ যারা খুন হচ্ছে তারা কেউই কখনও ভালো মানুষ ছিলো না। এক্ষেত্রে পুলিশের উচিৎ তাকে বাহবা দেওয়া। যে আসামীগুলোকে উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে কিংবা উচ্চস্তরের পা চাঁটা লোকের সহযোগিতার ফলে বারবার জামিন দিয়ে দিতে হচ্ছে, তাদেরকে নির্মূলে শেষ করছে এই লোক। অথচ সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হল সমাজের ওই কীট গুলোকে মেরে ফেলা মানুষটাকে ধরতে উঠে পড়ে লেগেছে পুরো শহর। মন্ত্রী মিনিস্টার থেকে শুরু করে পুলিশ ফোর্স কেউ দুই দন্ড বসে থাকতে পারছে না। মানুষটাকে যেখানে দেখা যাবে সাথে সাথে গুলি করার অর্ডার আছে উপর মহল থেকে।
নির্ঝর একজন দায়িত্বশীল পুলিশ অফিসার। অথচ একথা আরাধ্য ছাড়া কেউ জানে না। ছোট থেকে পুলিশে জয়েন হওয়ার স্বপ্ন থাকলেও পরিবারের চাপে তাকে বিজনেস নিয়ে পড়াশোনা করতে হয়। তবে পুলিশ ফোর্স জয়েন হওয়ার সমস্ত ক্রেডিট নির্দ্বিধায় আরাধ্যকে দেওয়াই যায়। সম্ভ্রান্ত পরিবারে প্রভাবশালী বাবার একমাত্র সন্তান হওয়ায় বেশ উচ্চপদস্থ কিছু পরিবারে ছিল তার আনাগোনা। সঠিক সময় সেই পরিচিতি কাজে লাগিয়ে নির্ঝরকে পুলিশের কর্মকর্তা নিয়োগের জন্য ট্রেনিং এ পাঠিয়েছে সে। এই পুরোটা সময়টা বিদেশে থেকেও একান্তভাবে পাশে থেকেছে নির্ঝরের।
শ্রেষ্ঠাকে অফিস থেকে সোজা বাড়িতে ড্রপ করে দিতে চায় আরাধ্য। কিন্তু সে কিছুতেই ছুটি নিতে রাজি নয়। জয়েনিংয়ের অল্প কয়েকদিনের মাঝেই এভাবে ছুটি নেওয়া ব্যাপারটা ভীষণ দৃষ্টিকটু। সেই সাথে ম্যানেজার আরমানের সাথে ঘটে যাওয়া ধস্তাধস্তির কথা ততক্ষণে লোকমুখে রটে গেছে অনেকখানি। আর বরাবরের মতোই সব দোষ এসে পড়ে নারী জাতির উপর। এটাই আমাদের সমাজ। সমাজের গুটিকয়েক লোক টেনে হিঁচড়ে বিচার বসাবে মেয়েটার। কোনরূপ ভূমিকা পালন না করেও সমস্ত দোষারোপ জোর করে থুপে দেয়া হয় তার মুখে।
“দেখতে সুন্দর বলে নিশ্চয়ই সিডিউস করার চেষ্টা করেছে আরমানকে। নয়তো এভাবে মেয়ে দেখলে ঝাঁপিয়ে পড়ার ছেলে নাকি ও! বোঝোই তো উচ্চপদে রয়েছে কিনা!”
“আমরা তো এক জনম কাটিয়ে দিলাম এই অফিসে। আর এই মেয়ে আসতে না আসতেই নিজের রূপ দেখাতে শুরু করে দিয়েছে। লজ্জা শরম কোথায় বেচে এসেছে কে জানে!”
“কোথায় আর বেচবে! দেখো গিয়ে এমন কতো নিস্পাপ ছেলেকে ফাঁসিয়েছে। আরে ভাই, নিজে থেকে সম্মতি না দিলে কারোর সাহস আছে নাকি চোখ তুলে তাকানোর!”
“আমি তো প্রথম থেকেই বুঝেছিলাম মেয়েটার চরিত্রের সমস্যা আছে। রূপ আছে কিনা? রূপসী মেয়েগুলো সব এক এক টা জোস মাল হয়। রাত হলেই এদের পাব আর নাইট ক্লাবে দেখা যায় ভিড় করতে। বড়লোক ছেলেদের গলায় ঝুলে পড়ে। ওই তো কটা টাকা মাইনে পায়। ওই দিয়ে এসব রূপ ধরে রাখা যায় নাকি! মাসে মাসে পার্লারের বিল দিতে গেলে এমন কয়েকটা বড়লোকের ছেলেকে হাতে না রাখলে আবার হয় না।”
কেবিনে ক্লান্ত শরীর এলিয়ে বসে আছে শ্রেষ্ঠা। হঠাৎ কেবিনের দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করে একজন কর্মচারী। জরুরী কিছু ফাইল নিয়ে বের হওয়ার সময় ভুলবশত দরজা পুরোপুরি না আটকেই চলে যায়। ফলস্বরূপ খানিকটা দূরের ডেস্কে আলোচনায় মেতে থাকা ভদ্রমহিলা ও ভদ্রলোক গোছের লোকেদের প্রতিটা কথায় কানে আসে তার। নিজের সম্পর্কে এত এত খারাপ মন্তব্য শুনে ধক করে ওঠে শ্রেষ্ঠার বুক। হৃদস্পন্দনে ক্রমাগত উত্থান পতনের সাথে উঁকি দেয় অতীতের কিছু কাহিনী। জীবনের বীভৎসতা দেখতে দেখতে ক্লান্ত সে। সমাজের মাঝে ভদ্ররূপে বসবাস করা নিচু মানসিকতার মানুষগুলোর পায়ের তলায় থাকা ভাবনা গুলোতে সে রীতিমতো হতাশ। এখন আর ইচ্ছে করে না তাদের সাথে লড়াই করার। সব ক্ষমতা যেন হারিয়ে গেছে। অথচ একটা সময় পুরো দুনিয়ার সাথে চোখে চোখ রেখে লড়াই করেছে সে। ছোট শ্রেয়াকে নিয়ে পালিয়ে যায়নি কোথাও। বরং সমাজের মাঝে থেকে কানাঘুঁসো করা প্রতিটা কথাকে তুড়ি দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছে।
৮.
বিগত দুইদিন ধরে আরাধ্যর দেখা নেই। বরং তার পরিবর্তে আবির্ভাব ঘটেছে নির্ঝরের। শ্রেষ্ঠা বেশ কয়েকবার কৌশলে আরাধ্যর কথা জিজ্ঞাসা করলেও ব্যাপারটা খুব সূক্ষ্মভাবে এড়িয়ে যায় নির্ঝর। রাগ হয় শ্রেষ্ঠার। সেদিনের পর থেকে আরাধ্য নিজে থেকেই আড়ালে থেকেছে। তাই ইচ্ছাকৃত হোক কিংবা অনিচ্ছাকৃত, শ্রেষ্ঠাও আর কোনোরূপ যোগাযোগ করেনি।
হুট করেই শ্রেষ্ঠার মনে পড়ে আরাধ্যর শেষ কথাগুলো,
“খাঁন ইন্ডাস্ট্রির এমডি যে ছেলেটা আছেনা! আরে কী যেনো নাম! আজকাল তো শ্রেষ্ঠাকে দেখি তার সাথে চিপকে চিপকে থাকতে। নিশ্চয়ই একে ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করছে। এই সব মেয়েরা আবার প্রয়োজনে শরীর দেখিয়ে হলেও ছেলেদের কাবু করতে পারে। নাহলে কোম্পানির এমডি হয়ে ওই ছেলেটা কি আর এমনি এমনি পড়ে থাকে নাকি! দেখো গিয়ে ভেতরে কী কী সব চলে।”
অফিসের কর্মরত একজন ভদ্রমহিলার কথাগুলো একের পর এক নির্বিঘ্নে সহ্য করে গেলো আরাধ্য। একটা টু শব্দটুকুও করেনি। মহিলাটির ঠিক পিছনে বুকে হাত গুঁজে অপেক্ষামান সে। তার কথা শেষ হওয়া মাত্র পাল্টা প্রশ্ন করে আরাধ্য,
“আপনি এখানে কী করছেন বলুন তো! আপনাকে তো আমার বাড়িতে হওয়ার কথা। কারন আমার মাও আমাকে এতটা চেনেনা, যতটা আপনি চেনেন। আঃ! কী সৌভাগ্য আমার।”
পুরুষালী কণ্ঠের রুঢ় বাক্যে থতমত খেয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ান তিনি। মানুষটাকে ভালো ভাবে খেয়াল করে একদফা হাসে আরাধ্য। অতঃপর সেই চেয়ার টেনে বসে পড়ে নিজেই। এরপর নরম কণ্ঠে অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে বলে ওঠে,
“আপনার বয়স দেখে বোঝা যায় এই বয়সী একটা মেয়ে কিংবা ছেলে থাকার কথা। অথচ আজও আপনি পাড়ার পি এন পি সি করা কাকিমাদের বৈশিষ্ট্যটাই ছাড়তে পারলেন না। আচ্ছা, এইযে দামী একটা শাড়ী, বেশ পরিপাটি হয়ে সাজগোজ করা, গলায় কানে স্বর্ণের একটা হালকা মডার্ন সেট পরলেই তাকে ভদ্রমানুষ বলা যায়! তবে তো একটা গোরিলাকে এভাবে সাজিয়ে দিলে ঠিক আপনার মতোই লাগবে। তাইনা! একেবারে ডিটো কার্বন কপি। কারন, না তার আছে কোনো বিবেক-বুদ্ধি, মান-অপমান বোধ, সহবদ-ভদ্রতা, আর না আছে আপনাদের। হাঁটুর বয়সী ছেলেমেয়েদের নিয়ে এমন চিন্তা ভাবনা করতে গিয়ে রুচিতে বাঁধলো না একটুও! অন্যকে নীচে নামাতে নামাতে কখন যে নিজেকে একেবারে নিম্নস্তরে নিয়ে দাঁড় করিয়েছেন, দেখেছেন একবারও? আজ বরং আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে প্রশ্ন করবেন। মানুষ থেকে পশু হওয়ার জার্নির শুরুটা কোথায়!”
অল্পবয়সী এক ছেলের কাছ থেকে এতখানি অপমান ঠিক হজম হচ্ছেনা কারোরই। প্রত্যেকে নিজেদের ডেস্কে কাজে মনোযোগ দেওয়ার চেস্টা করলেও ভেতরে ভেতরে প্রতিশোধপরায়ন সাপের মতো ফুঁসছে।
নির্ঝরের ডাকে ধ্যানভঙ্গ হয় শ্রেষ্ঠার। অতীতের স্মৃতি থেকে বেরিয়ে আসে বাস্তব জগতে। অফিসের নির্দিষ্ট কিছু মানুষ তাকে দেখলেই বাঁকা চোখে তাকায়। তার বেশভূষা থেকে শুরু করে কাজ প্রতিটা ক্ষেত্রেই খুঁত ধরতে বিন্দুমাত্র ছাড় দেয়না।
প্রজেক্টের একটা কাজের জন্য নির্ঝরের সাথে সাইট ভিজিটিংয়ে এসেছে শ্রেষ্ঠা। চারিদিকে দাপটে বেড়ানো হাওয়ার তুমুল ঝাপটায় মাটিতে বসে পড়ে শ্রেষ্ঠা। সাথে রয়েছে একজন আর্কিটেকচার। কাজ সম্পর্কিত বিভিন্ন কিছু বুঝিয়ে দিচ্ছে সে তাকে। মাঝে মাঝে তুখোড় হাওয়ার দাপট এলেমেলো করে দিচ্ছে তার খোঁপায় বেঁধে রাখা চুল। নির্ঝর মুগ্ধ দৃষ্টিতে একনাগাড়ে তাকিয়ে আছে শ্রেষ্ঠার দিকে। যেনো চোখ ফেরালেই বিশেষ কিছু হারিয়ে ফেলবে।
বিগত পনেরো মিনিট ধরে গাড়িতে পাশাপাশি সিটে বসে আছে নির্ঝর আর শ্রেষ্ঠা। দুজনের মাঝে বিদ্যমান ঘোর নিস্তব্ধতাকে বিদায় জানিয়ে শ্রেষ্ঠা বলে,
“আপনাকে কিছু কথা বলবো। আরাধ্য স্যারকে বলে দিতে পারবেন?”
“অবশ্যই কেনো নয়!”
“বলবেন, আমার সাথে কাজ করতে যদি তার সমস্যা হয়, তবে এই প্রজেক্টের দায়িত্ত্ব অন্য কাউকে দেওয়া হবে। আমি আমার সমস্ত ডকুমেন্ট বুঝিয়ে দেবো তাকে। সমস্যা নিয়ে অযথা সহ্য করতে হবে না তাকে। আমি আজই এই প্রজেক্ট হস্তান্তর করে দেবো।”
#চলবে!