#চিলেকোঠার_ভাঙ্গা_ঘর
#ফিজা_সিদ্দিকী
#পর্ব_৫(চোরা অনুভূতি)
রাত বিরেতে আরাধ্যর মেসেজে বিরক্ত হলেও কৌতূহল চেপে রাখতে পারলো না শ্রেষ্ঠা। অতঃপর লিখে পাঠালো ছোট্টো একটা বার্তা।
“ইশ! কীভাবে মারা গেলেন?”
“খুব সম্ভবত মার্ডার।”
“যদিও লোকটা একদমই ভালো ছিল না। তাও এভাবে কাউকে মার্ডার করা ঠিক নয়। খবরটা শুনে খারাপ লাগলো বেশ।”
“হুম। কী করো?”
“আপনার মাথা চেবানো সহ্য করি।”
শ্রেষ্ঠার কাটকাট জবাবে বুকে চিনচিন ব্যথা অনুভূত হয় আরাধ্যর। খানিকটা সময় নিস্তব্ধ থেকে স্বল্প সময়ে টাইপ করে এক ক্ষুদে বার্তা।
“বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত।”
শ্রেষ্ঠা রিপ্লাই করলোনা। ফোনটা সাইড টেবিলে রেখে ঘুমন্ত শ্রেয়ার কপালে, গেলে চুমু দিয়ে শুয়ে পড়ে তাকে জড়িয়ে ধরে।
৭.
ব্যস্ত শহরের জ্যাম ঠেলে ভীড় বাসে গা ঘেষাঘষি করে আজ অফিসে আসতে হয়নি শ্রেষ্ঠাকে। প্রোজেক্টের কিছু কাজ পেন্ডিং ছিল, তাই আজ সকাল সাতটার মধ্যে অফিসে উপস্থিত হতে হয় তাকে। এসময় অফিস সম্পূর্ণ ফাঁকা থাকার কথা, তাই গলা থেকে ওড়না খুলে ডেস্কে রাখে শ্রেষ্ঠা। অতঃপর ব্যস্ত হয়ে পড়ে নিজের কাজে। হটাৎ লোডশেডিং এর ফলে ধ্যানভঙ্গ হতেই চারপাশে চোখ বুলিয়ে তাকায় শ্রেষ্ঠা। কেমন যেনো অনুভব হচ্ছে তার। যেনো সে ছাড়াও কেউ আছে এখানে। তার অগোচরে কেউ যেনো খুঁটিয়ে দেখছে তাকে।
ঘুটঘুটে অন্ধকার না হলেও বেশ অন্ধকারাচ্ছন্ন কেবিন। কেবিনের একপাশে কাঁচের থাই গ্লাস থাকায় দিনের আলো খানিকটা প্রবেশ করেছে ভেতরে। ফলস্বরূপ কিছুক্ষনের মাঝেই চোখ সয়ে যায় অন্ধকারে। আসেপাশের জিনিস বেশ খানিকটা দৃশ্যমান। আচমকা দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে অফিসের ম্যানেজার। একগাল হেসে অনুমতিবিহীন এসে বসে শ্রেষ্ঠার মুখোমুখি চেয়ারে।
“ম্যাডামের দর্শনা আজ এত সকালে যে!”
“সেই একই প্রশ্ন তো আমি আপনাকেও করতে পারি ম্যানেজার সাহেব!”
“হ্যাঁ হ্যাঁ সে পারেন। আপনার কাছ থেকে এমন পাল্টা প্রশ্ন পাওয়া অস্বাভাবিক কিছুই নয়।”
“জি, একদম। কিন্তু আপনি বোধহয় মাঝে মাঝে ভুলে যান শ্রেষ্ঠা অফিসের বাকি মেয়ে কলিগদের মতো নাহ। তাই তো আমাকেই বারবার মনে করিয়ে দিতে হয়।”
শ্রেষ্ঠার কথায় খানিকটা নড়েচড়ে বসে আরমান। হালকা কেশে গলা পরিষ্কার করে নির্ভীক কণ্ঠে বলে ওঠে,
“বড্ডো দেমাগ দেখছি তোমার। তা এতো দেমাগ আসে কোন নাগরের থেকে? শুনলাম সেই সংখ্যা নাকি একাধিক!”
“আমার নাগরগুলো যথেষ্ট ক্লাসি। যাকে তাকে আমি আবার চুজ করিনা। কিন্তু দুর্ভাগ্য আপনার, আপনি সেই ক্লাসে বিলং করেন না। বড্ডো লো ক্লাসের তো তাই!”
রাগে অপমানে চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে আরমানের। অফিসের প্রায় সকল মেয়ে কলিগকে বিছানায় পেয়েছে সে। কেউ স্বেচ্ছায় প্রমোশনের তাগিদে, আবার কাউকে প্রেমের জালে ফাঁসিয়ে বিছানায় ফুর্তি করেছে আরমান। সুদর্শন আর প্রভাবশালী হওয়ায় মেয়েরাও বেশ খানিকটা পাত্তা দিয়েই চলে তাকে। এমনকি অনেকে তো সরাসরি সামনে থেকে রাত কাটানোর প্রস্তাব দেয়। ইন্টারভিউ এর দিন থেকেই শ্রেষ্ঠার উপর নজর পড়ে আরমানের। নিকৃষ্ট আদিম খেলার অদম্য ইচ্ছের তাগিদে বার কয়েক শ্রেষ্ঠাকে উত্যক্ত করার চেষ্টাও করেছে সে। কিন্তু ফলাফল শুন্য। কাজ ব্যতীত শ্রেষ্ঠা একপলকের জন্য ঘুরেও তাকায় না তার দিকে। এভাবে দিনে দিনে আরো জেদ চেপে বসে আরমানকে। শক্তপোক্ত এই মানবীর অহংকার ভেঙে গুড়িয়ে দেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লাগে। শুধু সঠিক সময়ে সঠিক সুযোগের সন্ধানে ছিলো সে। আর আজকে সেই সুযোগটা পেয়ে গেছে আরমান। পুরো অফিসে সে আর শ্রেষ্ঠা ব্যতিত কেউ নেই। গেটের গার্ডকে কৌশলে কিছুটা সময়ের জন্য বেশ দূরে একটা কাজে পাঠিয়ে অফিসের মেইন সুইচ অফ করে দেয় আরমান।
“আমাকে চটালে রাস্তায় এসে যাবে কিন্তু! সাবধান!”
আরমানের কুটিল হাসি দেখে শব্দ করে হেসে ওঠে শ্রেষ্ঠা। নিস্তব্ধ রুমে এসে হাসির ঝঙ্কার একটু বেশীই কানে লাগে আরমানের। খানিক বিরক্তও হয় সে।
“যে নিজে রাস্তার মানুষ, সে আমাকে রাস্তায় নামবে বুঝি! আমি তো জানতাম রাস্তার কুকুরগুলো শুধু শব্দ করে ঘেউ ঘেউই করতে পারে। এর বেশি কিছু করার ক্ষমতা তাদের থাকেনা।”
সশব্দে চেয়ারে লাথি দিয়ে উঠে দাঁড়ায় আরমান। অতঃপর দাঁত কিড়মিড় করে এগিয়ে যায় শ্রেষ্ঠার দিকে। মুখে তার অসহ্যকর হাসি। অঙ্গভঙ্গি অশ্লীল। ছেলেটাকে দেখে গা গুলিয়ে উঠছে শ্রেষ্ঠার। যেনো কেনো ডাস্টবিন তার কাছাকাছি আসছে। যতো কাছে আসছে তার দুর্গন্ধ ততো তীব্র হচ্ছে। অসহ্যকর ঠেকছে নাকে। বিশ্রী রকম গন্ধ বের হচ্ছে সেখান থেকে।
“ছিঃ! দূরে সরুন বলছি। কেমন অসহ্যরকম বিশ্রী গন্ধ আসছে আপনার থেকে। নর্দমার কীট তো তাই! শুধু দামী পোশাক পরে ভদ্রলোকেদের মাঝে বসে গেলেই ভদ্র মানুষ হওয়া যায়না। চরিত্র মানুষের কদর্য মনের পরিচয় দেয়।”
“এই রূপ নিয়েই তোর এতো অহংকার তাইনা! আজকের পর থেকে এই মুখ নিয়ে বাইরে বের হতে ভয় পাবি। তোর রুপ, অহংকার সব ধুলোয় না মিশিয়ে পারলে আমার নামও আরমান নাহ।”
“আর কতো মেয়ের জীবন নষ্ট করবেন এভাবে!”
“আপাতত তোরটা করি। পরেরগুলো পরে দেখা যাবে।”
“এবার কিন্তু গার্ডকে ডাকতে বাধ্য হবো আমি। এমনিতেই অনেক সময় নষ্ট হয়ে গেছে। অনেক কাজ পেন্ডিং আছে আমার।”
“সুন্দরীরা বোকা হয় জানতাম। তবে আজ প্রমান পেলাম সচক্ষে। গার্ডকে বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে আসার মতো কাঁচা কাজ আমি করবো! ভাবা যায়!”
এতক্ষন বেশ জোর নিয়ে কথা বললেও এবার ভেতরে ভেতরে ভয় পেতে শুরু করে শ্রেষ্ঠা। যতোই হোক একজন পুরুষ মানুষের শক্তির কাছে পেরে ওঠা বেশ মুশকিল। তাই যথাসম্ভব নিরব থেকে নিজের কাজে মনোনিবেশ করলো সে। কিন্তু থেমে থাকলো না আরমান। চোখে মুখে স্পষ্ট তার উশৃঙ্খলতা। আড়চোখে আরমানকে নিজের কাছাকাছি আসতে দেখে ভয়ে হৃদস্পন্দন বেড়ে যায় শ্রেষ্ঠার। মনে মনে সৃষ্টিকর্তার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করে। ভেতরে ভয়ে ডগমগে অবস্থা হলেও কঠোর দৃষ্টিতে তাকায় আরমানের দিকে।
প্রজেক্টের ফাইল রাতে অফিসেই ফেলে এসেছিলো আরাধ্য। ফলস্বরূপ সকাল সকাল রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়ে সে। পথিমধ্যে বেশ কয়েকবার শ্রেষ্ঠাকে ফোন করতে গিয়েও করেনি। বারবার নম্বর ডায়াল করতে গিয়েও কোথাও একটা বাধা দিচ্ছে তাকে কল করতে। হয়তো কাল রাতে শ্রেষ্ঠার কথায় অপমানিত বোধ করেছে একটু বেশীই। মনে মনে প্রজেক্টের কাজটা দ্রুত শেষ করার সিদ্ধান্ত নিলো আরাধ্য। সেইসাথে কাজ ব্যতিত কোনোরূপ আলাপচারিতা না করার কথাও ভাবলো। শ্রেষ্ঠা তাকে পছন্দ করেনা, বিষয়টা বুঝতে আর কোনোভাবেই বাকি নেই তার। আর এভাবে কাউকে অকারণে বিরক্ত করা তার স্বভাবের সাথে যায়না। যেহেতু শ্রেষ্ঠা তার ব্যবহারে বিরক্ত হচ্ছে, তাই দূরত্ব বজায় রাখাই শ্রেয়।
গাড়ি পার্ক করে অফিসে ঢুকতে গিয়ে বেশ অবাক হলো আরাধ্য। গার্ড নেই। সচরাচর এমনটা হওয়ার কথা নয়। যেহেতু এটা তার কোম্পানি নয়, তাই এব্যাপারে বিশেষ খেয়াল দিলো না সে। কেবিন থেকে ফাইল নিয়ে বের হতে গিয়ে উপতলায় কিছু পড়ার শব্দে বেশ অবাক হয় আরাধ্য। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময় দেখে অবাকের রেশটা আরো গাঢ় হলো তার। অফিস আওয়ার শুরু হতে আরো এক ঘন্টা বাকি। তাই এ সময়ে অফিসে কারোর থাকার কথা নয়। তবে কিসের শব্দ হলো উপরে! নাকি সে ভুল শুনলো! উপরতলায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে দোটানায় ভোগে সে। তাৎক্ষণিক আবারও একসাথে বেশ কিছু জিনিস পড়ার শব্দ হয়। যেনো টেবিল থেকে অনেকগুলো জিনিস একসাথে নীচে ফেলে দিয়েছে কেউ। এবার আর এক মুহুর্ত না করে সিড়ি দিয়ে দ্রুতবেগে উপরে ওঠে আরাধ্য। শব্দের উৎস খেয়াল করে যেতে গিয়ে হৃদস্পন্দন থেমে যায় যেনো তার। শব্দটা শ্রেষ্ঠার কেবিন থেকে আসছে। যতো কাছাকাছি যাচ্ছে শব্দের তীব্রতা ততোই বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভয়ে বেশ কয়েকটা হার্ট বিট মিসও হয়ে গেলো বুঝি!
কেবিনের দরজা খুলতেই থমকে যায় আরাধ্য। শ্রেষ্ঠাকে টেবিলের সাথে চেপে ধরে জোরপূর্বক তাকে ছুঁয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে আরমান। দুজনের তুমুল ধস্তাধস্তিতে টেবিলের জিনিষপত্র এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে শব্দ সৃষ্টি করছে। এই অসময়ে আরাধ্যকে এখানে কোনোভাবেই আশা করেনি আরমান। তাই থতমত খেয়ে হাত ছেড়ে দেয় শ্রেষ্ঠার। ছাড়া পেয়ে সেখান থেকে দৌড়ে আরাধ্যর কাছে আসে শ্রেষ্ঠা। চোখ ভর্তি জল, কাঁদো কাঁদো মুখ, জোরে জোরে হাঁপিয়ে আরাধ্যর দিকে করুন দৃষ্টিতে তাকানো, সবকিছুতেই মুগ্ধতা খুঁজে পায় আরাধ্য। হাঁপাতে হাঁপাতে ধপ করে চেয়ারে বসে পড়ে শ্রেষ্ঠা। এমনিতেই সকাল থেকে কিছু খাওয়া হয়নি তার, তার উপর এতক্ষন ধস্তাধস্তি করে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে সে। কিছুক্ষণ আগে পর্যন্তও কতখানি জোর ছিলো তার মাঝে। অথচ যেই আরাধ্যকে দেখতে পেলো, দূর্বল হয়ে পড়ল কতখানি। এর কারণ শ্রেষ্ঠার জানা নেই। তবে সে মনেপ্রাণে চায় মানুষটা তাকে ভুল না বুঝুক।
শ্রেষ্ঠাকে অসুস্থ হয়ে পড়তে দেখে অস্থির হয়ে যায় আরাধ্য। টেবিল থেকে পানির গ্লাস এনে দ্রুত ধরে তার মুখের সামনে। ইতিমধ্যে সুযোগ পেয়ে পালিয়েছে আরমান। আরাধ্য এখন এসব নিয়ে ভাবতে চায়না। এখন সবার আগে শ্রেষ্ঠাকে সামলানো উচিৎ। ওই রাস্কেলকে তো পরেও খোঁজা যাবে।
“তুমি ঠিক আছো? শরীর কী খুব বেশি খারাপ লাগছে? ডক্টরকে কল করবো?”
ইশারায় মাথা নাড়ায় শ্রেষ্ঠা। যার অর্থ এসব কিছু করতে হবেনা। সে ঠিক আছে। তবুও আশ্বস্ত হতে পারছে না আরাধ্য। সমস্ত রাগ উপচে পড়তে চাইছে শ্রেষ্ঠার উপর।
“এভাবে ফাঁকা অফিসে কেউ একা আসে? আজ যদি আমি না আসতাম? কী হতো ভাবতে পারছো?”
“আপনি আছেন তো।”
#চলবে!