#চিলেকোঠার_ভাঙ্গা_ঘর
#ফিজা_সিদ্দিকী
#পর্ব_৪(মেয়ে নাকি পরী!)
৫.
“রহস্যময় মৃত্যু! খুন নাকি আত্মহত্যা বোঝা দায়।”
সকাল সকাল পত্রিকা খুলতেই এমন কিছু চোখের সামনে পড়বে কল্পনাতীত ছিলো আরাধ্যর। তবে যেটা সবচেয়ে আশ্চর্য্যের তা হলো লোকটাকে সে চেনে। এক দেখায় যাকে বিকৃত মস্তিষ্কের মানুষ বলা যায়। এক পলক তাকিয়েই যাকে চরিত্রহীন লম্পট বলতেও দুইবার ভাবতে হয়না, লোকটা তেমনই একজন। শ্রেষ্ঠার সাথে অসভ্যতামি করা সেই বাসের লোকটার ছবি পত্রিকার প্রথম পেজেই বড়ো বড়ো ছাপা। পাশে সমবয়সী আরও একজনের লাশ পড়ে রয়েছে। হেডলাইনটা পড়ে যতটা না আক্ষেপ হয়েছিল, লোকটার চেহারা দেখে তা নিমেষেই গায়েব হয়ে যায় আরাধ্যর। তপ্ত দীর্ঘশ্বাসের সাথে মুখে তীক্ষ্ণ হাসি ফুটিয়ে পেপারটা এমনভাবে টেবিলে ফেলে যেনো সেটা একটা আবর্জনা। অতঃপর দুইহাত ঝেড়ে পকেটে ঢুকিয়ে গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে ঢুকে পড়ে ওয়াশরুমে।
খাঁন ইন্ডাস্ট্রির সাথে ডিল হওয়া নতুন প্রজেক্ট এর কাজের সম্পূর্ণ দায়িত্ব পড়ে শ্রেষ্ঠার উপর। কাল থেকে বিষয়টা নিয়ে চরম বিরক্ত সে। আরাধ্যর পিঞ্চ মেরে বলা কথাগুলো একেবারেই সহ্য করার মতো নয়। আবার কোম্পানির কথা ভেবে কিছু বলাও সম্ভব নয়। দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করা বিষয়টাও একেবারে যায় না তার সাথে।
নতুন কাজের মেয়েটার কাছে শ্রেয়াকে রেখে অফিসের জন্য রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়ে শ্রেষ্ঠা। বের হতে হতে ঘড়িতে সময় দেখে, আটটা ত্রিশ বাজে। বেশ কিছু আর্কিটেকচার এর সাথে মিটিং আছে তাদের আজ। যার মধ্যে থেকে দুইজনকে অ্যাপয়েন্ট করা হবে নতুন প্রজেক্ট এর জন্য। যেহেতু এই প্রজেক্টের মুখ্য পরিচালক শ্রেষ্ঠা, তাই শ্রেষ্ঠা আর আরাধ্য মিলে আজকের মিটিংটা দেখাশোনা করবে।
সময় নয়টা ত্রিশ বাজার আরও পনেরো মিনিট আগে থেকে মিটিং রুমে অপেক্ষা করছে বেশ কিছু নতুন পুরনো আর্কিটেকচাররা। ঘড়ির কাঁটা নয়টা ত্রিশ বাজতেই একসাথে রুমে প্রবেশ করে শ্রেষ্ঠা আর আরাধ্য। মোট পাঁচজন আর্কিটেকচারের মধ্যে চারজন ছেলে আর একজন মেয়ে। শ্রেষ্ঠাকে দেখে ছেলেরা সহ মেয়েটাও হা করে তাকায় সেদিকে। একেবারে নেপালিদের মত ধবধবে সাদা। খানিকটা লালচে আবার খানিকটা কালচে, কেমন যেন মদ্যজাতীয় পানীয় রঙের কোমর সমান চুল। কালো রঙের হাই নেক টি শার্টের মাঝে শরীরের ধবধবে সাদা রংটা দৃষ্টি আকর্ষণ করছে ভীষণভাবে।
“ড্যাম বিউটিফুল!”
“আসলেই জোশ ভাই!”
“ভাই এটা মেয়ে নাকি পরী!”
“হ্যাঁ, আপনাদের ইন্টারভিউ নেওয়ার জন্য আসমান থেকে নেমে এসেছেন উনি। পরীলোক থেকে স্পেশাল পারমিশন করিয়ে নিয়ে আসতে হয়েছে। ইন্টারভিউ নিয়ে আবার ফিরে যাবেন।”
হিশহিশিয়ে বলা আরাধ্যর কথা শুনে থতমত খেয়ে যায় পাশাপাশি বসে আলোচনা করতে থাকা ছেলে দুটো। মুখ কাঁচুমাচু করে, দৃষ্টি নত করে সোজা হয়ে বসে টেবিলে।
দীর্ঘ এক ঘন্টা মিটিং শেষে তাদেরকে ওয়েটিং রুমে বসতে বলে শ্রেষ্ঠা। অতঃপর নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে, চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার চেষ্টা করে তারা।
“ঈশানের প্ল্যানিং বেশ ভালো ছিল। আমি ওকে অ্যাপয়েন্ট করতে চাইছি, আপনার কি কোন আপত্তি আছে!”
“অবশ্যই আছে। ছেলেটাকে আমার পছন্দ নয়।”
“আসলেই!”
“হুম”
আরাধ্যর কথা শুনে শব্দ করে হেসে ওঠে শ্রেষ্ঠা। আরাধ্য আরও একবার মুগ্ধ হয় সেই হাসিতে। অথচ মুখে গাম্ভীর্য ভাব বজায় রেখে তাকায় শ্রেষ্ঠার দিকে।
“আপনি এখানে নিজের জন্য পাত্রী পছন্দ করতে আসেননি, মিস্টার! ওপস সরি! সে তো আবার পাত্র।”
“মানে কী?”
“বাই দা ওয়ে, আপনি কি আবার ওই টাইপের নাকি? মানে ছেলে ছেলে…”
“ছি! রুচি এতটাও নিচে নামেনি আমার এখনো। মেয়েদের প্রতি দারুণ লেভেলের ফিল আসে আমার।”
“হ্যাঁ সেটা তো দেখতেই পেলাম। মেয়ে হলে ফকফকা সাদা, আর ছেলে হলে তুম ফিদা।”
“এই! এই! কি দেখতে পেলে হ্যাঁ! উমমম, বিশ্বাস সেহেতু করছ না তাহলে একটা প্রমাণ তো দিতেই হয় তোমাকে। আর প্রমাণ চাওয়া মানুষটাকে দিয়েই প্রমাণ দিলে প্রমাণ আরও জোশ হয়।”
“মানে!”
“মানে হল তুমি একা, আমিও একা। বন্ধ রুম, এখন যদি কিছু মিছু করে বসি একটা! মানে ওই টাইপের কিছু!”
রাগী চোখে তাকায় শ্রেষ্ঠা, অতঃপর বিনা বাক্য ব্যয়ে হাতের ফাইলগুলো ঘাঁটতে শুরু করে সে। খানিকটা কাশির শব্দ করে শ্রেষ্ঠার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করে আরাধ্য। অতঃপর নরম কণ্ঠে বলে ওঠে,
“তোমাকে জোশ বলছিলো ছেলেটা।”
“ভুল তো কিছু বলেছি। একজনের চোখ খারাপ বলে পছন্দ হয়নি, তাই বলে কি সবাই চোখে অন্ধ হবে নাকি?”
“এই কমপ্লিমেন্টটা পছন্দ তোমার!”
“পছন্দ না হওয়ার মতো তো কিছু দেখছিনা। কেনো আপনার কি হিংসা হচ্ছে! আর ইউ ফিলিং জেলাস?”
“মে বি অর মে নট।”
°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°
নতুন কাজের মেয়েটা শ্রেয়াকে সাথে করে নিয়ে যায় পাশের ফ্ল্যাটে। আরোহী খাঁন বসে বসে টিভি দেখছিলেন। শ্রেয়াকে দেখে বেশ খুশি হন তিনি। কাজের মেয়ে সুমিকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারেন, পাশের ফ্ল্যাটে নতুন ভাড়াটিয়া উঠেছে। মেয়েটা সারাদিন অফিসে থাকে, তাই শ্রেয়ার স্কুল ছাড়া বাকি সময়টা দেখাশোনার জন্য সুমিকে বেশ কিছু টাকা দেবেন বলেছেন। শ্রেয়ার সাথে পুরোটা দিন বেশ ভালোই কাটে আরোহী খাঁনের। মূলত তিনি অপেক্ষা করছেন আরাধ্যর ফেরার। এর মাঝেই সুমিকে ডেকে বাড়িঘরটা পরিষ্কার করিয়ে ফেলেছেন। সুমি এই ফ্ল্যাটের প্রায় বেশিভাগ মানুষের হেল্পিং হ্যান্ড হিসেবে কাজ করে। প্রায় অনেক বছর ধরে এই কাজ করায়, সকলের কাছেই বেশ বিশ্বস্ত সে।
শ্রেয়ার সাথে টম অ্যান্ড জেরি দেখতে দেখতে আরোহী খাঁনও কখন যেনো তার মতোই বাচ্চা হয়ে গেছেন খেয়াল নেই। দুজনে মিলে টিভি দেখতে দেখতে চিপস খাচ্ছে, আর মাঝে মাঝে খিলখিল করে হেঁসে উঠছে। অফিস থেকে বাড়ি ফিরে বাড়ির মধ্যে এমন এক দৃশ্য দেখে বিস্মিত, অভিভূত আরাধ্য। যেনো ভূত দেখার মতো চমকে উঠেছে সে। আজ কতোগুলো বছর পর আবারও সে হাসতে দেখছে আরোহী খাঁনকে। বিগত পাঁচ বছরে যেনো তিনি হাসতেই ভুলে গেছিলেন। একটা দূর্ঘটনা তাদের জীবনের সবটুকু সুখ ধুয়ে মুছে নিয়ে চলে গেছে। সে কথা ভাবলেই বুক ভারী হয়ে ওঠে আরাধ্যর। দুজনের এতখানি সুখের মুহূর্ত কিছুতেই নষ্ট করতে চায় না আরাধ্য। এজন্যে চুপি চুপি পা টিপে টিপে পিছন থেকে চলে যায় নিজের রুমে। ফ্রেশ হয়ে এসে সামনে থেকে বাচ্চাটার মুখটা দেখে বিস্ময়ে কিংক্তব্যবিমূঢ় আরাধ্য। কিছু বলার ভাষা কেনো হারিয়ে ফেলেছে। ইতিমধ্যেই শ্রেয়া সোফা থেকে উঠে দৌড়ে গিয়ে কোমর জড়িয়ে ধরে আরাধ্যর। অতঃপর ঘাড় উঁচু করে কোমল কণ্ঠে বলে ওঠে,
“এইতো ভালো আঙ্কেল! তুমি এই আন্টির ঘরে কেনো? আন্টি কি তোমার কেউ হয়?”
“আগে বলো তুমি এখানে কিভাবে?”
“আমি তো আম্মুর সাথে ওইযে পাশের দরজা, ওখানে থাকি।”
” তাই নাকি! ইশ রে! আমি তো জানতামই নাহ। আর এই আন্টিটা হলো আমার আম্মু।”
“ওহ হো। আমার যেমন আম্মু আছে, তোমারও আছে তাইনা? এইযে এই আন্টি তোমার আম্মু তাইতো!”
“হুম একদম।”
“খালাম্মা, সব কাজ হয়ে গেছে। ওরে নিয়া যাই এখন। আপা এসে পড়বে এহনি।”
সুমির কথা শুনে মাথা নেড়ে সম্মতি দেন আরোহী খাঁন। অতঃপর শ্রেয়াকে খানিকটা আদর করে পাঠিয়ে দেন তার সাথে। সুমি চলে যেতেই মায়ের কোলে মাথা রাখে আরাধ্য। অতঃপর আসল ঘটনা কী জিজ্ঞাসা করতেই একে একে সব বলেন তিনি। এবার ব্যাপারটা পুরোপুরি পরিষ্কার হয় আরাধ্যর কাছে। সেই সাথে শ্রেয়ার সাথে ঘটা পূর্ব পরিচয়ের কথাও আরাধ্য জানায় মাকে।
৬.
“নিউজ দেখেছ!”
এতো রাতে আরাধ্যর মেসেজ দেখে বেশ খানিকটা বিরক্তবোধ করে শ্রেষ্ঠা। অতঃপর সিন করেও কোনো রিপ্লাই না দিয়ে ফোনটা রেখে দেয় বেডে। কিছুক্ষণ পর আবারো বেজে ওঠা মেসেজ টোনে ফোনের দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকায় সর শ্রেষ্ঠা।
“সেদিনের বাসের লোকটাকে কেউ খুন করেছে সম্ভবত। যদিও পুলিশ এখনও সিদ্ধান্ত জানাননি, তবুও আমার শতভাগ বিশ্বাস কেউ খুব চতুরতার সাথে খুন করেছে তাকে। তবে যে করেছে তাকে আমার ধন্যবাদ দিতে মন চাইছে। দেশ থেকে একটা আবর্জনা কমিয়ে দিলো।”
#চলবে!