#চিলেকোঠার_ভাঙ্গা_ঘর
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#পর্ব_৬
#ফিজা_সিদ্দিকী
চিঠিখানা হাতে স্নিগ্ধা ঠিক কতোখানি সময় অবসন্নগ্রস্থ হয়ে বসে ছিলো তার ইয়াত্তা নেই। তবে শরীর কাঁপছিলো তার। নব্য ছন্দের তালে সুর মিলিয়ে প্রজাপতির মতো ডানা মেলেছে সুবিন্যস্ত আকাশে। আবার কখনও কখনও জোনাক পোকার মতো আলো ছড়িয়ে ঘুরে বেড়ায় শহরের অলিগলি। এ যেনো এক নব্য সুখময় অনুভূতি।
১৬.
পরের অপেক্ষাটা অবশ্য ক্রমশ দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়। দিন পেরিয়ে সপ্তাহ, সপ্তাহ পেরিয়ে মাসের অর্ধেক চলে যায়। স্নিগ্ধা ততদিনে পুরোপুরিভাবে ডুবে গেছে সেই অচেনা মানবে। ডুবেছে তার প্রেমে। গোটা গোটা অক্ষরে লেখা কঠিন কাব্যিক বাণীতে। প্রায় ছন্নছাড়া অবস্থা তার। সবার উপরে থাকা মেয়েটা দিনে দিনে পিছিয়ে পড়তে শুরু করেছে ক্রমে। নিজেকে যেনো গুটিয়ে নিচ্ছে সবকিছু থেকে। সারাটা সময় অপেক্ষায় থাকে কারোর। অদেখা, অজানা সেই মানুষটার নতুন কোনো বার্তার অপেক্ষায় কাটে তার দিন। এক এক মিনিট কাটে প্রহর সমান সময় নিয়ে। স্নিগ্ধা আদৌ জানেনা সেই মানুষটার কাছ থেকে আর কোনো চিঠি আসবে কিনা! জানেনা তাদের কোনোদিন দেখা হবে কিনা! শুধু জানে এই মানুষটাকে ছাড়া সে নিঃশ্বাস নিতে পারবে না। এইযে আজকাল কী এক শূন্যতায় যেনো মাঝরাতে ঘুম ভেংগে যায় তার। মনে হয় বুকটা যেনো ভীষণ ফাঁকা ফাঁকা। আচ্ছা এই শূন্যতা কিভাবে তৈরি হলো? সে তো মানুষটাকে কখনো দেখেনি। কখনও ছিলোও না তার জীবনে। যে কখনও ছিলো না, তার হারানোতে এতোখানি শূন্যস্থান তৈরি হয় কিভাবে? হাজারো প্রশ্নের শেষে উত্তর ওই একটাই। দীর্ঘশ্বাস।
লাইব্রেরীর একেবারে কর্নারের টেবিলে বসে আছে স্নিগ্ধা। লাইব্রেরী প্রায় ফাঁকা। কারন এই সময় ক্লাস চলছে। অথচ ক্লাসের সবচেয়ে পড়াকু, মনোযোগী মেয়েটা টেবিলে মাথা ঠেকিয়ে কী যেনো ভাবছে। এমন সময় হুট করে সেখানে উপস্থিত হলো সার্থক। পাশে কারোর উপস্থিতি টের পেয়ে আনমনে সেদিকে তাকায় স্নিগ্ধা। অতঃপর আবারো আগের মতো টেবিলে মাথা ঠেকিয়ে তাকিয়ে রইলো জানালার বাইরে। অদূরে কোথাও একটা। ক্ষীণ কণ্ঠে ডাকলো সার্থক,
“স্নিগ্ধা”
“হুম”
“আপসেট?”
“নাহ”
“টপার মেয়েটাকে আজকাল আর ক্লাস করতেই দেখা যায়না। আর তুই বলছিস কিছু হয়নি!”
“একা থাকতে চাই। প্লীজ।”
“এভাবে একা থাকলে কী তাকে খুঁজে পাবি? হতেও তো পারে সে তোর খুব কাছেই রয়েছে বেনামী ছায়া হয়ে।”
বিস্ফোরিত নয়নে চোখ তুলে তাকালো স্নিগ্ধা। এতক্ষণের নির্জীবতা কেটে গিয়ে তার চোখে মুখে ফুটে উঠেছে চরম বিস্ময়। সার্থক কিভাবে জানলো এইসব ঘটনা? সে তো কাউকেই শেয়ার করেনি এ ব্যাপারে। মনের ভুলেও কাওকে কিচ্ছু বলেনি সে। তবে কী সার্থক তাকে চেনে? এগুলো কী প্রী প্ল্যানড?
আচমকাই সার্থকের কলার চেপে ধরে স্নিগ্ধা। সার্থক চেয়ারে বসা অবস্থায় ছিল। স্নিগ্ধার কলার ধরতে সমস্যা হওয়ায় সার্থকের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পড়ে সে। স্নিগ্ধা সার্থকের কাঁধ সমান। তাই এই অবস্থায় সবচেয়ে পারফেক্টভাবে ধরতে পেরেছে সে।
“মশকরা করিস আমার সাথে?”
“নাহ তো।”
“সত্যি করে বল, কারা কারা মিলে এই প্ল্যান বানিয়েছিস?”
“আমি আর একজন। মোট দুইজন মিলে।”
“লজ্জা করছেনা তোর? এভাবে অকপটে নিজের ভুলগুলো নিয়ে গর্ব করে বলতে!”
“লজ্জা করার মতো কোনো কারণ দেখছি না।”
“কারন দেখছিস না? আসলেই দেখতে পাচ্ছিস না? এটা কোনো মজা করার মতো বিষয়? আমার ইমোশন তোর কাছে মজা করার জিনিস। এতোদিন ভাবতাম আর কেউ না বুঝুক অন্তত তুই আমাকে খানিকটা হলেও বুঝিস। অন্যরা যখন আমার সাদাসিদে চালচলন নিয়ে হাসাহাসি করার সুযোগ খোঁজে তুই অন্তত আমার পাশে থাকিস। কিন্তু আসলে মনে মনে এই চলছিল তোর? এভাবে, এভাবে আমাকে কষ্ট দিতে চেয়েছিলি তুই? বল কী চাইছিলি তুই? সবার সামনে আমার ইমোশন নিয়ে মজা লুটবি? আমাকে হেনস্থা করবি? বাহ সার্থক! বাহ! আমি তো এতদিন চিনতেই পারিনি তোকে।”
দীর্ঘসময় ধরে উচ্চশব্দে কথা বলে হাঁপাচ্ছে স্নিগ্ধা। থর থর করে কাঁপছে সারা শরীর। ফ্যানের তলায় থেকেও রাগের ফলে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে তার পুরো মুখে। খানিকটা সময়ের জন্য থামলো সে। অতঃপর জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করলো নিজেকে। লুকাতে চাইলো অনাকাঙ্খিতভাবে আগত অশ্রুকণাদের। আঁটকে দিতে চাইলো তাদের আঁখিপল্লব দিয়ে। কিন্তু তারা মানলো না সেসব বাঁধন। বাঁধহারা নদীর কূল কিনারা ছাপিয়ে আছড়ে পড়লো ঝর ঝর করে। সার্থক নির্বাক। হতবিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে স্নিগ্ধার দিকে। কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না সে।
ম্রিয়মাণ কণ্ঠে শ্রেষ্ঠা বললো, “মানুষ ঠিকই বলে। পিছন থেকে আঘাত করা মানুষগুলো কখনও দূরের হয়না। বরং তারা কাছে পিঠে থেকেই সুযোগের সন্ধান করে। বাইরের মানুষ আঘাত করলে তো সরাসরি চোখে চোখ রেখে সামনে থেকেই করে।”
শ্রেষ্ঠার বুক কাঁপছে। কান্নায় ভেঙে আসছে ঠোঁট। নিজেকে অনেক কষ্টে সামলে রেখেছে সে। পাশের চেয়ার থেকে ব্যাগ উঠিয়ে কাঁধে ঝুলিয়ে নেয় সে। অতঃপর পা বাড়ায় বের হওয়ার জন্য। আচমকা একজোড়া হাত বজ্রের বেজে এসে পেঁচিয়ে ধরে তার কোমর। অতঃপর টান দিয়ে বসিয়ে দেয় চেয়ারে। স্নিগ্ধা জোর করে উঠে যেতে গেলে তাদের মাঝের দূরত্ব ঘুঁচে যায় আরও খানিকটা।
একে অপরের মুখোমুখী বসে আছে সার্থক আর স্নিগ্ধা। সার্থক এই দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। স্নিগ্ধা অনেকটা সময় ছুটাছুটি করেও লাভ হয়নি। অগত্যা হার মেনে নিয়ে ঠাঁয় বসে আছে সেখানে। দুজনের কারোর মুখে রা টুকু নেই। যেটুকু শোনা যাচ্ছে তা হলো নিস্তব্দ পিনপতন নিরবতাযুক্ত লাইব্রেরির রুমে একে অপরের নিঃশ্বাসের শব্দ।
“তোমার নামে লিখেছি কতশত চিঠি। ওহে প্রিয়সী, দিও না গো এভাবে ফাঁকি।”
“সার্থক, এসব কী ধরনের ব্যবহার। মানছি তোরা এতদিন মজা করেছিস। কিন্তু আর নাহ।”
“কে বললো মজা করেছি? আমি বলেছি? এটাকে প্রেম করা বলে রে গাধী।”
“প্রেম?”
“হুম প্রেম। সেই প্রথমদিন থেকেই তোকে ভালো লেগে গিয়েছিলো। কিন্তু বাকিদের মতো আপডেটেড নাহ তুই। তাইতো এতটা সময় লেগে গেলো তোকে বোঝাতে।”
“দেখ, এসব মজা একদম ভালো লাগছে না।”
“হুস। বিশ্বাস হচ্ছে না? প্রমাণ লাগবে? ওয়েট।”
অতঃপর একজোড়া রুক্ষ অধরে সম্পৃক্ত হলো একজোড়া নরম ভেজা অধর। দীর্ঘ এক চুমু শেষে দাঁত বের করে হাসলো সার্থক। সবকিছু স্নিগ্ধার মাথার উপর দিয়ে গেলো। এতক্ষন ঘটে যাওয়া একের পর এক কাহিনীগুলো মেলানোর পূর্ন চেষ্টা করে। অতঃপর বিষয়টা বোধগম্য হতেই বিস্ফোরিত নয়নে তাকায় সে সার্থকের দিকে। ঠোঁট চেপে মিটিমিটি হাসছে সার্থক। এটুকুই যেনো আগুনে ঘি ঢালার মতো কাজ করলো। তেড়ে গিয়ে তার বুকে ইচ্ছেমতো কিল ঘুষি বসালো স্নিগ্ধা। একসময় নিজেই ক্লান্ত হয়ে থেমে গেলো সে। স্নিগ্ধাকে বুকের সাথে চেপে ধরে সার্থক বিড়বিড় করে বললো,
“ভালোবাসি আমার বোকাফুলকে।”
লাজুক হাসে স্নিগ্ধা। অতঃপর কোমল কণ্ঠে বলে,
“আমিও ভালোবাসি সীমাহীন।”
১৭.
পড়ন্ত বিকেল। লেকের পাশে একটা বেঞ্চে বসে আছে দুজনে। সার্থকের কাঁধে স্নিগ্ধার মাথা। তার দুই হাত সার্থকের হাতের মাঝে বাঁধা। নানা বিষয়ে টুকিটাকি গল্প করতে করতে সময়টা উপভোগ করছে তারা। আচমকা সার্থকের কাঁধ থেকে মাথা উঠিয়ে সিরিয়াস ভঙ্গিতে মুখোমুখি বসে স্নিগ্ধা। কৌতূহল কণ্ঠে প্রশ্ন করে,
“তুমি আমাকে চিঠি দিতে আগে বলোনি কেনো?”
“লুকিয়ে থাকতে মন চেয়েছিলো তাই।”
“এতোদিন এভাবে লুকিয়ে ছিলে কেনো?”
স্নিগ্ধার বোকা বোকা প্রশ্নে হাসে সার্থক। বলে,
“আমি যদি সরাসরি তোমাকে প্রেমের প্রস্তাব দিতাম রাজি হতে?”
স্নিগ্ধার সোজাসাপ্টা উত্তর,” নাহ”
“এজন্যই। ঠিক এই কারণেই সরাসরি বলিনি তোমাকে। এইযে প্রথম প্রথম চিঠি লিখতাম। তারপর লুকিয়ে লুকিয়ে তোমার ব্যাগে রেখে দিতাম। তুমি প্রথম কয়েকদিন ফেলে দিতে, মনে আছে?”
“হুম”
“কিন্তু কিছুদিন পর থেকে তোমার আগ্রহ বাড়লো। ফেলার নাম করে চারপাশে তাকিয়ে ঝট করে ঢুকিয়ে দিতে ব্যাগের মধ্যে। এরপর প্রথম প্রথম হয়তো ততটা গুরুত্ব দিয়ে পড়তে না। এরপর আস্তে আস্তে তোমার আগ্রহ বাড়লো। রোজ অপেক্ষা করলে সেই কাঙ্খিত সময়ের। সেই চিঠির। এরপর কিছুদিন আমি আর চিঠি দিলাম না। তোমার মন খারাপ হলো। কৌতূহল হলো। নিরাশ হলে। আগের চেয়ে বেশী উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করলে চিঠির জন্য। এরপর মাঝে মাঝে ইচ্ছে করেই চিঠি দিতে দেরি করলাম। এতে তোমার কৌতূহল আরও বাড়লো। সেই বাড়তে থাকা কৌতূহল অপেক্ষার সাথে মিলেমিশে ধীরে ধীরে রূপ নিলো নতুন এক অনুভূতির। যার নাম প্রেম।”
#চলবে!