#চিলেকোঠার_ভাঙ্গা_ঘর
#ফিজা_সিদ্দিকী
#সূচনা_পর্ব
১.
“এমন ফকফকা সাদা মেয়েকে বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।”
পাত্রী দেখতে এসে আরাধ্যর এহেন চড়া কণ্ঠের রুষ্ঠ বাক্যে হতবিহ্বল সকলে। হইহুল্লোড়ে ভরপুর পরিবেশ হুট করেই ছেয়ে গেল নিস্তব্ধতায়। বুকের মধ্যে দামামা বাজানোর মতো শব্দ হচ্ছে শ্রেষ্ঠার। তবুও সে নির্বাক। নতশিরে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে মেঝের দিকে। যেনো এই মূহুর্তে তার একমাত্র কাজ মেঝেতে পড়ে থাকা প্রতিটা অনু পরমাণু থেকে শুরু করে জীবাণুদের পর্যবেক্ষণ করা। দুই পরিবারের মাঝে ছোটোখাটো একটা যুদ্ধ লেগে যেতেই নিঃশব্দে বসার ঘর থেকে উঠে নিজের ঘরে চলে যায় শ্রেষ্ঠা। ভাবখানা এমন, যেনো এই মূহুর্তে তার পিছনে ফেলে আসা বসার ঘরটায় কিছুই হয়নি। সবটাই সরল, স্বাভাবিক।
“অভদ্রতামি করবিনা আরাধ্য। সেই কবে থেকে মেয়েটাকে পছন্দ আমাদের। শুধু তোর ফেরার অপেক্ষায় ছিলাম। এখন পুরো পাড়া জানাজানি হয়ে গেছে এই ব্যাপারে। এই মূহুর্তে তুই এই বিয়ে থেকে সরে আসতে পারিস না। এটা অন্যায়।”
“সিরিয়াসলি মা! এটা অন্যায়! পছন্দ না হলে জোর করে বিয়ে করে নেবো! তুমি আমাকে এমনটাই বলছো তবে!”
ফোঁস করে শ্বাস ছাড়েন আরোহী খাঁন। আরাধ্যর জেদ সম্পর্কে অবগত তিনি। কিন্তু মেয়েটার সাথে হওয়া অন্যায়ও মেনে নিতে পারছেন না। অতঃপর বিনয়ী ভঙ্গিতে তাকান সামনের সোফায় বসে থাকা শিমূল নিহারের দিকে। তৎক্ষনাৎ খ্যাক করে ওঠেন শিমূল নিহার। পাত্রপক্ষের মতিগতি বুঝতে তার আর বাকি নেই।
“না চাইলেও বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, আপনার ছেলের ভদ্রতার যথেষ্ট অভাব আছে। বিয়ে দেওয়ার চেয়ে তাকে সুশিক্ষা আর ভদ্রতা শেখানো উচিৎ আগে।”
রাগে কপাল কুঁচকে ফেলেন আরোহী খাঁন। আরাধ্যকে ভীষণ ভালোবাসেন তিনি। বাইরের কোনো মানুষের কাছ থেকে তার সম্পর্কে এহেন মন্তব্যে ক্ষুব্ধ হন তিনি। অতঃপর দাঁত কিড়মিড় করে বলে ওঠেন,
“একদম ফালতু কথা বলবেন নাহ। পাত্রপক্ষকে বাড়িতে ডেকে, যেচে অপমান করা মানুষদের পারিবারিক শিক্ষা কেমন হতে পারে বুঝতে আর বাকি নেই আমার। আমার ছেলে চাইলেও এই বিয়ে হতে দেবো না আমি আর।”
মুহুর্তের শীতল পরিবেশ আরও একবার গমগমে হয়ে উঠলো দুই নারীর কথা কাটাকাটিতে। বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে ফেলে আরাধ্য। অতঃপর কাউকে কিছু না বলে হুট করেই বসার ঘর থেকে উঠে যায় সে। বসার ঘর পেরিয়ে আরও দুটো রুম পার হয়ে তৃতীয় রুমের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। দরজা হালকা ভেজানো। আরাধ্য হালকা ধাক্কা দেয় দরজায়, অতঃপর রুমের মধ্যে ঢুকেই হুট করে লক করে দেয় ভেতরে থেকে। চোখ বড়ো বড়ো করে তাকায় শ্রেষ্ঠা। আচানক এহেন আক্রমণাত্মক পদক্ষেপের কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছে না সে। বিয়ের ব্যাপারটা মিটমাট করার জন্যই তো বসার ঘর ছেড়ে উঠে এসেছে সে! তবে সদ্য সাক্ষাৎ হওয়া এই ছেলে তার রুমে কেনো! আবার ভেতর থেকে লকই বা করলো কেনো!
“মিষ্টার আরাধ্য, যতদূর জানি আপনি একজন সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলে। অন্তত এতদিন পর্যন্ত সেই ধারনাই ছিলো। কিন্ত আজকের একের পর এক প্রত্যেকটা ব্যবহার প্রমাণ দিচ্ছে অন্যকিছুর। আশা করছি, নিজের সাথে সাথে পরিবারের মাথা হেঁট হওয়ার কারণ হতে চাইবেন না। ভদ্রভাবে বলছি, রুম থেকে বের হয়ে যান।”
“আপনাকে আমার সিগারেটের মতো লেগেছে। একেবারে নেশা নেশা। দুই ঠোঁটের মাঝে চেপে ধরে রাখতেই মন চায় যেনো। ঠোঁটের ভাঁজ থেকে উন্মুক্ত করবো শুধু ফু দেওয়ার জন্য। একটা শেষ হলে আর একটা, সেটা শেষ হলে আরও একখানা জ্বলন্ত সিগারেট ঠোঁটে চেপে ধরে রাখার মতো। ইশ কী যেন এক নেশায় বুঁদ আমি।”
আরাধ্যর কথায় বেকুব বনে যায় শ্রেষ্ঠা। কিছুক্ষন আগেই তো এই ছেলেটা তাকে বিয়ে করতে অস্বীকার করলো! মূহুর্তের মাঝে এমন পল্টিবাজ লোকের দর্শনটাও বোধহয় এবার হয়েই গেলো। ঠোঁটের কোণে তাচ্ছিল্যের হাঁসি ফুটে ওঠে শ্রেষ্ঠার।
“এমন কিছু বলবো আশা করছিলে নিশ্চয়ই! হাহ! মেয়ে জাতিটাই হলো এমন। ন্যাকামো করে কয়েকটা কথা বললেই গলে যায়। যেনো হাওয়াই মিঠাই! দুইদিনের প্রেমের দুই চারটে মিষ্টি কথায় নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে হোটেল পর্যন্ত চলে যায়। রেডিকিউলাস!”
এতক্ষন বহু কষ্টে নিজের রাগ সংবরণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল শ্রেষ্ঠা। কিন্তু আরাধ্যর শেষোক্ত কথায় রাগে শরীর কাঁপতে থাকে তার। চোখ বন্ধ করে ঠোঁট গোল করে জোরে জোরে নিঃশ্বাস টেনে নিজেকে ধাতস্থ করে সে। অতঃপর তীক্ষ্ণ চোখে সরাসরি তাকায় আরাধ্যর দিকে। তার চাহনিতে কী ছিল জানা নেই, তবে আরাধ্যর বুক কেঁপে ওঠে। চনমনে দৃষ্টিতে তাকায় এদিক সেদিক।
“মিস্টার আরাধ্য, আমি কিন্তু কারোর বেডরুমে যাইনি। এমনকি কারোর পারমিশন ছাড়া সেই রুমের দরজা লক করে একটা অভদ্র, আনকালচার, ইম্যাচিওর, তথাকথিত শিক্ষায় শিক্ষিত, মানুষের সাথে কথা বলার আদব জ্ঞ্যানহীন পুরুষের সাথে বার্তালাপ শুরু করিনি। এমনকি তারই বাড়িতে দাঁড়িয়ে তাকে অপদস্তও করিনি। এবার নিশ্চয়ই কে কাকে কিভাবে বিলিয়ে দিচ্ছে, হোটেলে নাকি একটা মেয়ের বেডরুমে, সেই সংজ্ঞাটা বুঝতে খুব একটা সমস্যা হয়নি!”
শ্রেষ্ঠার বলা প্রতিটা শব্দে ছিলো তীব্র অপমানের রেশ। প্রতিটা শব্দ যেনো খুব নিখুঁতভাবে তীরের ন্যায় ছুঁড়ে দেওয়া হয়েছে আরাধ্যর দিকে। রাগে শরীরের প্রতিটা রোমকূপ খাড়া হয়ে ওঠে তার। অথচ দাঁতে দাঁত চেপে তা নিঃসংকোচে গিলে ফেলে আরাধ্য। পরিবর্তে ঠোঁটের কোণে মিষ্টি হাসি ফুটিয়ে বলে ওঠে,
“চলুন বিয়েটা বরং সেরে ফেলি। দুইমাস ট্রায়াল দেওয়ার পর যদি পছন্দ না হয়, ডিভোর্স লেটার পেয়ে যাবেন। ওহ হ্যা, আপনার খরচের চিন্তা করতে হবেনা। প্রতি মাসে একটা মোটা অঙ্কের টাকা ঠিকই পেয়ে যাবেন।”
“আমার এতটাও দুর্দিন আসেনি, যে আপনার মতো একটা বিকৃত মস্তিষ্কের মানুষকে বিয়ে করতে যাবো। এই মূহুর্তে আমার রুম থেকে বেরিয়ে যান। নইলে এতক্ষন ধরে করা একের পর এক বেয়াদবির জবাব কড়ায় গন্ডায় মিটিয়ে নিতে এই শ্রেষ্ঠা তালুকদার খুব ভালো ভাবেই জানে।”
চারপাশ শুনশান, নিরবতায় আচ্ছন্ন। রাতের অন্তিমপ্রহর চলছে। অথচ নির্ঘুম আরাধ্য। আজকের ঘটে যাওয়া প্রতিটা ঘটনা কিছুতেই মাথা থেকে মুছে ফেলতে পারছে না সে। রাগে সাঁপের মতো ফোঁস ফোঁস করছে। কখনও এপাশ তো কখনো ওপাশ ফিরে ঘুমানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়ে অবশেষে উঠে বসে। রাগে হাতের বালিশটা ছুঁড়ে মারে দূরে। এতোখানি অপমান আজ পর্যন্ত কেউ তাকে করেনি। এমনকি বহু বিদেশিনী মেয়ে তার সাথে লিভইন রিলেশনে থাকার জন্য মরিয়া হয়ে থাকতো। অথচ মেয়েদের প্রতি তীব্র ঘৃণা আরাধ্যর। আরোহী খাঁন ছাড়া পৃথিবীর কোনো নারীকেই সহ্য হয়না তার। বিয়েতেও একমাত্র মায়ের জোরাজোরিতে রাজি হয়েছিলো সে।
২.
চাকরির ইন্টারভিউ এর জন্য রেডি হচ্ছে শ্রেষ্ঠা। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা নিস্পাপ ভাসা ভাসা একজোড়া চোখ পলকহীন তাকিয়ে আছে তার দিকে। হটাৎ আয়নায় চোখ পড়ে শ্রেষ্ঠার। শ্রেয়াকে এভাবে পলকহীন তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে শব্দ করে হেসে ফেলে সে। হাতের ঘড়ির বেল্টটা লাগাতে লাগাতে পিছন ফিরে কোলে তুলে নেয় শ্রেয়াকে। আদুরে গলায় বলে,
“মানিকে আজকে খুব পচা লাগছে বুঝি! শ্রেয়া মামনি এভাবে তাকিয়ে আছে যে!”
“এম্মা, মানি তো প্রিন্সেস। প্রিন্সেসকে কি কখনো খারাপ লাগে নাকি? আমিও বড়ো হয়ে তোমার মতো প্রিন্সেস হবো। কার্টুনের প্রিন্সেসের মতো মিত্তি মিত্তি লাগে তোমাকে।”
“একদম নাহ বাচ্চা। প্রিন্সেসদের জীবন অনেক ভয়াবহ হয়। তোকে সুন্দর হতে দেবো না আমি। একটুও সুন্দর হবি না তুই। এই দুনিয়ায় সৌন্দর্য্য নিয়ে জন্ম নেওয়া পাপ, মহাপাপ। আমার মতো ভয়ংকর জীবনে আমি তোকে কখনও ঠেলে দেবোনা। প্রয়োজনে কালি মাখিয়ে রাখবো তাও ভালো।”
“এইটুকু বাচ্চা একটা মেয়েকে কিসব শেখাচ্ছিস তুই শ্রেষ্ঠা। পাগল হলি নাকি!”
শিমূল নিহারের কণ্ঠস্বর শুনে শ্রেয়াকে ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় শ্রেষ্ঠা। পিছন ফিরে সন্তর্পনে মুছে ফেলে গড়িয়ে পড়া অশ্রুকনা। অতঃপর মুখে মেকি হাসি বজায় দেখে স্বাভাবিক কণ্ঠে বলে,
“তোমাদের পছন্দের পাত্রের কী খবর মা? শেষমেষ এই বিয়েটাও ক্যান্সেল তবে!”
“কথা ঘোরাচ্ছিস কেনো? আমি তোকে কিছু জিজ্ঞাসা করেছিলাম।”
“সেসব প্রশ্নের উত্তর বোধহয় আমার চেয়ে ভালো জানা তোমাদের। অহেতুক কেনো একই প্রশ্ন করো?”
“তাই বলে এই বাচ্চা মেয়েটাকে এসব বলবি তুই!”
“ও যে ওর মায়ের মতোই রূপসী হয়েছে মা! ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে যদি কপালটাও মায়ের মতোই হয়!”
“এমন একটা ভাব করিস যেনো শ্রেয়া তোরই মেয়ে। এভাবে নিজের জীবনটাকে নষ্ট করার কোনো মানে হয়না। আশপাশের মানুষজন ছিঃ ছিঃ করে, সেদিকে কি কোনো খেয়াল আছে?”
ব্যাগে ফাইলপত্র গোছাতে গোছাতে বাঁকা চোখে শিমুল নিহারের দিকে তাকায় শ্রেষ্ঠা। অতঃপর কণ্ঠে তাচ্ছিল্যভাব ফুটিয়ে তুলে বলে,
“আর কতকাল সমাজের জন্য আমাদের কাঠগড়ায় দাঁড় করাবে? অনেক তো হারালে! এবার অন্তত নিজের জন্য বাঁচো, আমাদের জন্য ভালো থাকো। কালকে তো তোমাদের পছন্দ করা ছেলেকে আমি শ্রেয়ার ব্যাপারে কিছু বলিনি। তাও তো বিয়েটা ভাঙলো। এবার নাহয় এই ভাঙ্গা গড়ার খেলা বন্ধ করো। আমি সত্যিই ক্লান্ত। শ্রেয়া আমার মেয়ে, ওকে আমি সেই পরিচয়েই বড়ো করবো, এতে কেউ আমার পাশে থাকুক বা না থাকুক।”
#চলবে!