#চাঁদের_আলোয়_জোছনা_ভাঙ্গে
পর্ব ৬৬
লেখা আশিকা জামান
পরিষ্কার ঝকঝকে আকাশ দেখে মনে হচ্ছেনা একটু আগেই কেমন ঝুম বৃষ্টি নেমেছিল। ল্যাম্পপোস্টের মৃদু আলোয় পিচ ঢালা ভেজা রাস্তাটা চিক চিক করছে। চারপাশে হিমশীতল বাতাস উপেক্ষা করে নির্দয় ভাবে এগিয়ে চলেছে গাড়ি।
চারপাশ’টা হুট করে কেমন গুমোট লাগছে অনন্যার হয়তো তার মনের গুমোট ভাবটাই ছাড়ে নি। কিছুক্ষন থেমে নিয়ে অনন্যা বলল, ” একবার বলতে পারতে যে আসবে!”
” তোমাকে সুন্দর লাগছে!” অঙ্কন অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল।
” তোমাকেও সুন্দর লাগছে। অবশ্য প্রতিদিনই লাগে। তবে প্রশ্নটা অন্যকিছু করেছিলাম।”
অঙ্কন উত্তর দিলো না। অনন্যার বুকের মধ্যেখানে যেন কেউ হাতুড়িপেটা করছে। দমবন্ধ অস্থির লাগছে। অধৈর্য্য গলায় বলল,
” তুমি কী এখনো আমার উপর রেগে থাকবে।” কথাটা বলতেই কেমন গলা ধরে এলো। খুব কান্না পাচ্ছে। কিন্তু সে কাঁদবে না। তাকে শক্ত হতে হবে৷ অনেক অনেক শক্ত।
” তোমায় কে বলল আমি রেগে আছি। আচ্ছা কী করলে বুঝবে আমি রেগে নেই। আমি তোমার উপর রাগ করতে পারি না।”
” সেটা তোমার চোখ মুখ দেখেই বুঝতে পারছি। চলে যাওয়ার আগে এই বিয়ের কথা সামনে আনার কোন যুক্তিযুক্ত কারণ আমাকে দেখাতে পারবে! অযথা সবাই কষ্ট পাবে এর থেকে বেশি কিছু তো হবে না। তাহলে কেন অবুঝের মতো বিহেভ করছো। বিয়ের কথা বললেই কী সেদিন বাবা তোমার সাথে আমাকে যেতে দিত। যেতে দিত না। তাছাড়া আমি তো কয়েকদিন পরেই চলে আসছি। এতো দিন অপেক্ষা করেছো এই কয়েকটা দিনের জন্য এতো অধৈর্য্য কেন হচ্ছো।”
” অনন্যা নামো! তোমার বাসার সামনে এসে পড়েছি।”
অনন্যা ঘাড় ঘুরিয়ে সামনে তাকায়। ভালো সময় এত দ্রুত কেন শেষ হয়ে যায়। হুট করেই মনে প্রশ্ন জাগে আদৌ কী এটা ভালো সময়!
এত মান অভিমান সে নিতে পারছেনা। জাস্ট নিতে পারছেনা।
★★★★★★★
আকাশ জুড়ে অগণিত তারা মাঝখানে নিঃসঙ্গ চাঁদ। মৃদুমন্দ বাতাস আর ভরা জোছনায় শরীর এলিয়ে দিয়ে অন্বেষা চলে গেছে বাস্তব আর কল্পনার মিশেলে কোন এক রঙ্গিন দুনিয়ায়। সেই দুনিয়ার রঙচঙে মধুমাখা আলোয় কেবল তারা দু’জন। প্রথম ভালোলাগা , প্রথম প্রেম, স্পর্শ এইসব কী আদৌ ভুলার মতো!
হৃদয়ের গহীন ঘরে আজীবল অমলিন করে রাখার মতন।
উত্তাল ভালোবাসার জোয়ার সেই সাথে তুমুল বর্ষন অন্বেষার মনে হচ্ছিলো সে কোণ এক স্বপ্নরাজ্যের রাজরানী। আর সেই সিংহাসনের মালিক কেবল অনিক। ভেসে যেতে চেয়েছিলো ভালোবাসার মোহানায় আরও কিছুক্ষণ। কিছুটা মুহুর্ত একান্ত আপন হয়ে।
কিন্তু হুট করেই অনিক বলে উঠলো,
” চল, গাড়িতে উঠি। তোমাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসি।”
অন্বেষা লজ্জা ভেঙে গোঁ ধরে বলেছিলো সে আরও কিছুক্ষণ ভিজতে চায়।
অনিক চোখে চোখে বলেছে,
” হুয়াইট অর অন্য যেকোন লাইট কালার বাদ দিয়ে ড্রেসাপ পরে এসো তখন সারাদিন ভিজা যাবে। ”
” বৃষ্টিতে ভিজার সাথে ড্রেসের কালারের কী সম্পর্ক! ” অন্বেষা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে বলল।
” সরি, আমি এতকিছু বলতে পারছি না। তবে এটুকু জেনে রাখ আমি অতোটাও উদার নই যে, জনসম্মুখে নিজের গার্লফ্রেন্ডের শরীর প্রদর্শনী করতে উদ্ধুদ্ধ করব।”
অন্বেষা অাৎকে উঠে নিজের শরীরের দিকে তাকায়। ভিজে চপচপে সাদা শাড়ি গায়ের সাথে লেপ্টে শরীরের কিয়দংশ দৃশ্যমান হয়ে পড়েছে। লজ্জায় অস্থির হয়ে এক দৌড়ে অনিককে ফেলে গাড়ির কাছে এসে পড়ে।
পেছন পেছন হাত দিয়ে চুল ঝাড়তে ঝাড়তে অনিক এসে গাড়ির সামনের দরজা খুলে দেয়।
এরপর আর অনিকের দিকে তাকানোর সাহস হয়নি। যতক্ষণ ছিলো লজ্জাবনত মুখটা নিচু করেই রেখেছিলো। অনিক মৃদু হেসেছিলো আর কিছু বলেনি।
অন্বেষার ফোন বেজে উঠায় তার ভাবন ঘরে দরজায় শক্ত করে তালা ঝুলাতে হয়। অনিক ফোন করেছে। দুরু দুরু করে বুক কাঁপছে, কাঁপছে গলা সাথে মুঠোয় ভরা হাত।
” হ্যাঁলো, অন্বেষা, কথা বলছ না কেন! কী করছিলে!”
” তারা গুণছি। ছাদে এসেছি।”
” মিথ্যে বলছো কেন, তুমি আমায় ভাবছিলে, এম আই রাইট!”
অন্বেষা হোঁচট খাওয়া গলায় বলল, ” কী করে বুঝলে!”
” সিম্পল, প্রেমে পড়লে মানুষ ভালোবাসার মানুষের কথাই ভাবে, তারা গুণে না। এটা বুঝার জন্য ফিমেইল সাইকোলজিরর উপর পি এইচ ডি করতে হয় না।
তা কী ভাবছিলে! বলা যায়?”
অন্বেষা চুপ করে থাকে কেবল নিঃশ্বাসের উঠানামা শোনা যায়।
” কী হলো, লজ্জাবতী কী এখনো লজ্জা পাচ্ছে! হ্যাঁলো মিস, আমি আপনার সামনে নেই। চাইলেই কিছু দেখতে পাবো না। নিসঙ্কোচে বলুন।”
অন্বেষা লজ্জায় আবার লাল হয়ে উঠে। দাঁতে দাঁত চেপে চুপ করে থাকে।
” ওহ্, বুঝেছি তুমি নিশ্চয় বৃষ্টিতে ভেজার মুহূর্তের কথা ভাবছিলে!”
অন্বেষা ধরা পড়ে যায়। চোখে মুখে মেকি রাগ ফুটে উঠে৷
” তো কী হয়েছে! বৃষ্টি ভেজার কথা ভাবছিলাম তাতে কী হয়েছে! আমি না হয় সে কথা ভাবছিলাম আর তুমি তখন কী করছিলে ! আমি দেখেছি তুমি আমার দিকে ঠিক কেমন করে যেন অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছিলে। দৃষ্টিটা স্বাভাবিক ছিলোনা।”
অনিক বিস্মিত হয়ে বলল, ” স্বাভাবিক ছিল না!”
” না ছিল না। আমি তো বুঝিই নাই এই অবস্থা আর তুমি না জানি কতক্ষণ এভাবে তাকিয়ে ছিলে। ”
” আমি আবার বেশিক্ষন কোথায় তাকালাম! আমার নজর এত খারাপ না বুঝছেন। একটু তাকিয়েই তো চোখ সরিয়ে নিলাম। কেবল…!”
অনিক কথাটা শেষ করতে পারে না। অন্বেষা উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো,” কেবল কী! অ্যাই কী দেখেছো তুমি!”
” তোমার নাভীর ডানপাশের তিলটা খুব সুন্দর।” অন্বেষার কান গরম হয়ে উঠলো। কম্পমান গলায় সুর তুলে কোনরকমে বলল, ” অসভ্য।” এরপর দুম করে ফোন কেটে দেয়।
অনিক কতক্ষন থম ধরে বসে থাকলো। এটা কী হলো। দুম করে ফোন কেটে দিল। এটা কোন কথা হলো।
ব্যপারটা হজম হলো না। তাই ভাবলো এক চক্কর ছাদে ঘুরে আসা যাক।
★★★★★★
ছাদের এক মাথায় বিষন্ন মুখে অনন্যা বসে আছে। তার চরম জেদ চেপে গেছে। হয় এস্পার নয় ওস্পার। আজ ইচ্ছেমতো কয়েকটা কথা অঙ্কনকে শুনাবে, না হলে শান্তি পাবে না৷ গোটা কয়েকবার ফোন দেয়ার পর যখন অঙ্কন রিসিভ করেনা তখন তার রাগে দুঃখে চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করে।
এর ঠিক কয়েক সেকেন্ড অতিবাহিত হওয়ার পর অঙ্কন যখন কলব্যাক করে তখন রাগ কিছুটা কমে। কিন্তু অঙ্কন যখন সুর করে টেনে টেনে বলে,
” সুইটহার্ট, আ’ম সোউউউউউউউ বিজি। ডোন্ট মাইন্ড।” অনন্যার ইচ্ছে হয় কয়েক গালি শুনিয়ে দিতে। কিন্তু অঙ্কন নিজেই ফোন কেটে দিয়েছে।
সমস্ত রাগটাই ফোনের উপর ঝারতে চায়। সেই সুযোগটা পায় না অনিকের অনাকাঙ্ক্ষিত আগমনে।
” অনন্যা, কী হয়েছে। এতোটা উত্তেজিত হচ্ছিস কেন!”
” ভাইয়া, আমি ওই উল্লুকটার সাথে ব্রেকাপ করব। হি কান’ট ডিজার্ভ মি! হি কান্’ট….” অনন্যা আর কিছু বলতে পারলো না। চোখের পানি নাকের পানি এক করে ফেললো।
অনিক মৃদু হাসলো। এরপর সঙ্গোপনে হাসি লুকিয়ে একটা দুঃখী দুঃখী ভাব এনে বলল,
” হোয়াট’স রং উইথ য়্যু! ডোন্ট ক্রাই অনন্যা।”
অনন্যা থামলো না অনিক আবার বলল,
” এতোটা হাইপার হতে নেই। তাহলে বিবেক বুদ্ধি লুপ পায়। আর আজ তুমি উত্তেজিত হয়ে যা বলছ কাল কিন্তু তা নাও বলতে পারো। সো যাই বলো না কেন ভেবেচিন্তে বলতে হয়। রাগ হলো আর দুম করে কিছু বলে দিলাম! এরকম মেন্টালটি তো তোমার আগে ছিলো না!”
অনন্যা তীর্যকভাবে তাকায়। ভ্রুঁ কুঁচকে বলল,
” তুই আমার সামনে থেকে যাবি ভাইয়া! আমার কাউকেই ভাল্লাগছে না। না হয় আমিও যাচ্ছি।”
অনিক হতভম্ব অনন্যার এই হঠাৎ ফুঁস করে উঠায়।
অনন্যা তোয়াক্কা না করে গটগট করে সিড়ি বেয়ে নেমে যায়।
” যাহ্ বাবা, কিছু বললামই না দুম করে চলে গেল। ধুর সব মেয়েরাই এক!” অনিক পাগলের মতো একাই হোঁ হোঁ করে হাসলো।
চলবে…