চন্দ্র’মল্লিকা ১১ + ১২
লেখা : Azyah_সূচনা
দরজা পেটানোর আওয়াজে ত্যক্ত বিরক্ত রেহালা বেগম। কোমরের ব্যথার কারণে বিছানা থেকে মাটিতে পা ফেলতে চান না।সারাদিন শুয়ে বসে জং ফেলেছেন।গাধার খাটুনি খাটার জন্যতো চন্দ্র আছেই।ছোট বউটারও কোনো সাড়াশব্দ নেই।সারাদিন নিজের ঘরে তার প্রবাসী ছেলের সাথে ভিডিও কলে পড়ে থাকে।কোনো কাজকর্মে হাত দিলে হাত ক্ষয় হবে। সৌন্দর্য্য নষ্ট হবে।এটা মতামত তার।
“ছোটো বউ! ও ছোট বউ!দরজায় কে আসছে দেখবা না নাকি আমারই উঠন লাগবো?”
মৌ চেঁচায় নিজের ঘর থেকে।বলে, “আমি ব্যস্ত আছি আম্মা”
তপ্ত নিঃশ্বাস ফেললেন রেহালা।নিজেই ভারী দেহ নিয়ে এগিয়ে গেলেন দরজার দিকে।যেতে যেতে বলছেন, “কার মরা মরছে! এমনে দরজা ধাক্কাস যে?”
দরজা খুলতেই চোখের সামনে তিনচার জন মানুষ দেখে ভরকে উঠে।তার চেয়ে আশ্চর্য্যজনক তাদের পোশাক।সহজ ভাষায় পুলিশের পোশাক।দুজন মহিলা এবং বাকিরা পুরুষ।সকলেই পুলিশের পোশাকে।অবাক রেহালা বেগম প্রশ্ন করলেন,
“কি চাই?”
“আপনার নাম রেহালা সরোয়ার?”
“হ”
“মল্লিকা সরোয়ার আপনার কি হয়?”
“আমার মৃত পোলার বউ।”
রেদোয়ান বললো,
“আপনার নামে মামলা আছে। নির্যাতন মামলা।মল্লিকা সরোয়ার আর মিষ্টি সরোয়ার এর উপর অমানবিক অত্যাচার আর মারধর করার মামলা।”
চক্ষু কপালে উঠেছে রেহালার।বুকের ভেতরে ধ্বক করে উঠলো। ভয় বেগতিক। আত্মার পানি শুকানোর আগে কান্না জুড়ে দিলেন, “হায় আল্লাহ!এই মাইয়াডারে আমি নিজের মাইয়ার মতন পালছি।জামাই মরার পর ওর এই বাড়িতে রাইখা পালতাছি।ওই আমার এই পরিণাম করলো!”
কপালে হাত রেখে দরজায় বসে পড়লেন। মরা কান্না জুড়েছে।যেনো চন্দ্র নয় সে ভুক্তভুগী। অভিনয়ে মাস্টার ডিগ্রি অর্জিত নারীর দিকে চেয়ে হাসলো রেদোয়ান।
বললো, “খুব কষ্ট হচ্ছে আপনাকে দেখে।”
মুখ তুলে রেহালা বেগম বললেন, “আমারে অত্যাচার করছে ওই মাইয়া।আমার পোলারে অকালে খাইছে।আমারে খাওয়ন দিতে চায় না। কাম করায় হারাদিন।”
“ভুক্তভুগী আপনি অথচ আপনার বৌমার গায়ে আঘাতের চিহ্ন।কাজ করতে করতে হাত দুটো শুষ্ক।সঠিক পুষ্টির অভাব।”
রেহালা বেগম উঠে দাঁড়িয়েছে।এভাবে পুলিশের সাথে তার জোর চলবে না।চেচিয়ে ডাকলেন মৌকে।বললেন ছোট ছেলেকে কল করতে।সে সামনে এসে মূর্তির মতন দাড়িয়ে আছে।কোনোভাবেই কল করবে না স্বামীকে। শ্বাশুড়ি,মল্লিকা আর মিষ্টিকে ঘর ছাড়া করতে পারলেই বাঁচে সে।
“ওই আমার ছোট বউ।আপনারাই জিগান ওরে।”
মৌ এর পানে চেয়ে রেহালা বেগম বললেন, “ছোট বউ!এই সাহেবগোরে কও বড় বউ আমারে কি নির্যাতন করতো! কও”
মৌ একবার পুলিশ আরেকবার শাশুড়ির দিকে চায়।তার ভাবভঙ্গি আগের মতই।ঘরে পুলিশ এসেছে।তাতে তার কিছুই আসে যায়না।সে নির্দোষ।সেতো কিছুই করেনি।তাই তার ভয়ের কোনো কারণ নেই। মৌ বললো,
“আমি এসব জানি না।আমাকে টানবেন না।”
রেদোয়ান বললো, “আপনিতো এই বাড়িরই ছোট বউ।আর আপনি বলছেন আপনি কিছু জানেন না?”
“না”
“আমাদের সাথে দেমাগ দেখানো যাবে না।আপনার নামে কোনো কমপ্লেইন্ট নেই।আপনার জন্য মঙ্গল এটাই হবে সত্যি সত্যি বলে দিন এই ঘরে কি চলে”
যাও একটু চিন্তা হচ্ছিলো সেটাও নিমিষেই উধাও।বাঁচা গেলো। শাশুড়ি মা আশাভরা চোখে চেয়ে আছে ছোট বউয়ের দিকে।এখনই তার পক্ষ হয়ে কথা বলবে।তবে চোখ উল্টে নেয় মৌও।
বলে, “আপনারা যা শুনছেন ঠিকই শুনছেন। আম্মা ভাবীরে মারতো। ঘর থেকে বের করে দিতে চাইতো।”
ঘরের শত্রু বিভীষণ। অগ্নিদৃষ্টি মৌ এর দিকে।এবার তিনি নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মেরেই মৌ এর দিকে তেড়ে যান।চুলের মুঠি ধরে চড় দিতে চাইলে নারী কনস্টেবল এসে থামায় তাকে।
রেদোয়ান বললো, “কত সন চলে এটা জানেন?দুই হাজার।আগের দিনে বউ পেটানো অত্যাচার করার দিন শেষ।এখন আইন কঠোর।যোগ্য শাস্তি পাবেন এর।”
রেহালাকে থানায় নেওয়া হয়েছে।তার পক্ষে কিছু করার মতন কেউ নেই। মৌও কোনোদিন আসবে না।ছেলে বিদেশ। সর্বহারা হয়ে বিলাপ করতে করতে চলে গেলো।রেদোয়ান থানার ঝামেলা সেরে এসেছে হসপিটালে।মল্লিকার ঘুমের রেশ কাটেনি।মায়ের হাত ধরে বসে থাকা মিষ্টির দিকে একটা চকোলেট এগিয়ে দিয়ে বললো,
“মিষ্টি?আম্মু”
“জ্বি আংকেল”
“তুমি জানো তুমি একটা সাহসী মেয়ে?”
অবুঝের মতন চাইলো মিষ্টি রেদোয়ান এর দিকে।সাহসী বলছে?কিন্তু কেনো? চন্দ্রমল্লিকা তাদের কথার গুঞ্জনে হালকা চোখ মেলে। কানটাও সজাগ করলো।
রেদোয়ান উত্তর দেয়, “এইযে তুমি কি সুন্দর করে বললে তোমার দাদী পঁচা।তোমার মাকে কষ্ট দিয়েছে,ব্যথা দিয়েছে।আমি তাকে শাস্তি দিয়ে এসেছি।তাইতো তোমাকে সাহসী বলেছি।এই চকোলেট তোমার উপহার।”
ধীশক্তি জ্বলে উঠে মল্লিকার।যা শুনলো সেটার পরিণাম ভয়ঙ্কর।সম্পূর্ণ চোখ মেলে ডাকলো রেদোয়ানকে।বললো,
“দুলাভাই?কি বললেন?”
“কি খবর মল্লিকা?”
“দুলাভাই আপনি মাত্র কি বললেন?”
মাহরুর আসে।খাবার এনেছে নিজে রেধে। ক্যাবিনে প্রবেশ করে মল্লিকার ঘাবড়ে উঠা সরল মুখে নজর যায়। টিফিন ক্যারিয়ার পাশে রেখে এগিয়ে আসে।কপাল কুঁচকে দাড়ায় পাশে। রেদোয়ান মাহরুরকে লক্ষ করতে গিয়ে প্রশ্নের জবাব দিতে ভুলে গেছে।পূনরায় মুখ ফেরায় মল্লিকার দিকে।
বলে, “তোমার শ্বাশুড়িকে জেলে ভরেছি।ফাজিল একটা মহিলা!”
“কেনো দুলাভাই?কিসের ভিত্তিতে?” জোরেই বললো মল্লিকা।
“তোমাকে অত্যাচার করার ভিত্তিতে।”
“সে আমায় অত্যাচার করেনা।”
রেদোয়ান আজ খোচা দিল মাহরুরকেও।শুনিয়ে বললো, “তোমার ক্ষত অন্য কারো চোখে পড়ুক না পড়ুক।ডাক্তার আর পুলিশের চোখে ঠিকই পড়েছে।আর এই মিষ্টি মা আমাকে সাহায্য করেছে অপরাধীর বিরুদ্ধে তথ্য দিয়ে।তার একটা শাস্তি পাওয়া দরকার।”
কেদে ফেলে মল্লিকা।তার কান্না দেখে তৎক্ষনাৎ মাহরুরের হৃদয় মুষড়ে উঠলো। চন্দ্রের অজানা কান্না তাকেও মর্মবেদনা দিতে শুরু করলো।মল্লিকা বলে উঠে,
“আমাকে ঘরছাড়া করলেন দুলাভাই?”
তার কথা বিধলো দুজনের কাছেই কাটার মতন।অপরাধীকে শাস্তি দিতে গিয়ে পরবর্তী পরিস্থিতি কি করে ভুলে যায়?রেদোয়ান বলে,
“তোমার ঘর নেই?গ্রামে যাবে।রমজান চাচা তোমার বাবা এখনও বেচে আছে।”
“আমার বাবা কিভাবে নিজের পেট চালায় আমি জানি!তার কাধে আমি আর কোনো বোঝা দিতে চাই না।কেনো করলেন বলেন?আমি বলেছিলাম আপনাকে?”
মাহরুর আর রেদোয়ান একে অপরের দিকে চাইলো।রমজান সাহেব চেয়েছিলেন মেয়েকে নিয়ে আসতে।মেয়ে আসলে তবে না? মাহরুর ফোন বের করে।নাম নিতে না নিজেই রমজান সাহেবের কল।দ্রুত ধরে।অপরপাশে মেয়ের খবর পৌঁছে গেছে তার কানে।জানতে চাচ্ছেন তীব্রভাবে।কি অবস্থা তার।মল্লিকার দিকে ফোন এগিয়ে দিলো কথা বলার জন্য।
“মারে?তোর বাপের যা আছে তাই দিয়ে তোর আর তোর মেয়েরে দেখভাল করতাম।তুই আসলি না।”
“আব্বা এসব কথা কেনো বলো?আমি ভালো আছি”
কান্নারত রমজান সাহেব বলেন, “এতই ভালো আছিস যে আজ হাসপাতালে তুই। ফিরা আয় মা।আমার ছেলে আমার সংসারে কোনো কমতি রাখে নাই।”
বাবার কথায় অবাক হয় মল্লিকা।ছেলে কোথা থেকে আসলো?সেই উত্তর জানতেই প্রশ্ন করে মল্লিকা রমজান সাহেবকে।বলে, “ছেলে মানে?”
“আমার ভাতিজা।হীরার টুকরা ভাতিজা।প্রতি মাসে এই বুড়াবুড়ির জন্য খরচা পাঠায়।ভাবি মরার পরও এই চাচারে মনে রাখছে।…আর মা আমি জমিটা বেইচা দিছি।অর্ধেক টাকা মাহিরে দিয়া বাকি অর্ধেক রাখছি।তোর আর তোর মাইয়ার ভবিষ্যৎ দিব্যি হইয়া যাইবো এই টাকায়।তুই ফিরা আয়।ওই নরকে থাকিস না”
এত বছরে আরেকবার হয়তো চন্দ্রের প্রখর নজর দেখলো নিজের দিকে।চোখে চোখ মেলাতে পারলো না।নামিয়ে নিলো।বাবা মেয়ের কথা অজানা তার।লুকিয়ে রাখা কিছু কথা চন্দ্রমল্লিকার কাছে ফাঁস হয়েছে সেটা টের পায়নি।অজানা মাহরুর নিচে ফর্সের দিকে দৃষ্টিপাত করে।
____
“কি গো ভাইয়া?আমার বাড়ির দিকেতো ভুল করে তাকাও না। হঠাৎ কি হলো?দিনে রাতে সামনে আগমন ঘটছে তোমার এবাড়িতে?”
বোনের তীর্যকপূর্ণ কথা।অর্থ থেকে বিবশ নয় মাহরুর।লজ্জা হলো তার এমন কথায়। শিরীনও জানে মাহরুর কেনো আছে এখানে।চন্দ্র;তার চন্দ্রের জন্য।ভুলিয়ে ফুঁসলিয়ে চন্দ্র মল্লিকাকে এখানে এনে রেখেছে শিরীন। ও বাড়ির পথ ভুলে যাওয়ার কড়া আদেশ শিরীনের।ভুলে যেতে বলেছে তেতো বাক্যে যে কোনোদিন ওই বাড়ির বউ ছিলো সে।সম্পর্ক জুড়ে স্বামীর জন্য।যেখানে স্বামী নেই সেখানে আর কোনো সম্পৃক্তি নেই।আর অত্যাচারে অতিষ্ট হওয়ার পরতো আরো নয়।
রেদোয়ান বললো, “আহা শিরীন লজ্জা দিও না তোমার ভাইকে।দুর্বল হৃদয়ের মানুষ সে।তুমি গিয়ে মল্লিকাকে চা দিয়ে এসো”
শিরীন চলে গেলো।বেশি বেশি খাবার নিয়েছে প্লেটে।সব গিলাবে।না চাইলেও খাইয়ে ছাড়বে।নিজের উপর এত অনীহা এই মেয়ের?সেও বড়বোন।মুখে রাগের ছাপ নিয়ে গেলো মল্লিকার কাছে।বললো,
“এইযে ফল দেখছিস?এগুলো সব খাবি।আধ ঘন্টা পর চা আর পরোটা দিবো। সেগুলো বিনা বাক্যে খেয়ে উঠতে হবে”
অসহায় নেত্রপাত করে মল্লিকা।জানে শিরীনের স্বভাব।বেশি না তিন বছরের বড় বয়সে।অথচ ভাবসাব মায়েদের মতন।মল্লিকা ডেকে উঠে,
“বুবু?”
“কোনো কথা না চন্দ্র।খেয়ে ওঠ।আমি মিষ্টিকে খাইয়ে আসি।”
“এত খাবার কি করে খাবো বুবু?”
“মুখ দিয়ে খাবি।”
হাসতে চাইলো মল্লিকা।পারলো না।হাসি আসার মূল কারণ শিরীনের ভঙ্গি। ছোটবেলা থেকে দেখে আসছে।এমনি সে।বিয়ের পর গিন্নি হয়েছে।দুটো ফুটফুটে সন্তানের মা।তারপরও স্বভাব চরিত্রে কোনো পরিবর্তন নেই। দুর বসার ঘর থেকে আরো একটি কন্ঠস্বর ভেসে আসছে।চন্দ্রের মনের শান্তি আর অশান্তি।দুটোর মিশ্রণে তৈরি মানব।এখনও সর্বাঙ্গ কম্পিত করে তার কন্ঠস্বর।মন মস্তিষ্ক বেয়ে চলে পেছনের দিকে। স্মৃতিরা ফিরে আসতে চায়।কিন্তু জোর চালিয়ে থামায় চন্দ্রমল্লিকা।চেয়েছিলো তার স্বামীর মধ্যে খুঁজতে মাহরুরকে।লোকটা পেরে উঠেনি।রক্তের পরিচয় দিয়ে মায়ের মতই নির্মম,নির্দয় ছিলো সেও। তবে তার মৃত্যু? নড়বড়ে চন্দ্রকে পুরপুরি ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়।মাঝেমধ্যে নিজেকে প্রশ্ন করে সে।
“কেনো এই কপালে সুখ সইলো না”
ফলগুলোতে রুচি আসছে না।কিন্তু কঠোর আদেশ।খেতে হবে।ফিরে এসে ঠিক তদারকি করবে শিরীন। খুক খুক কাশির আওয়াজ শুনতে পেয়ে অন্যমনস্কতা কাটে। মাহরুর এসেছে। উপস্থিতি জানান দিলো অহেতুক কেশে।ভাবনায় মগ্ন ছিলো চন্দ্রমল্লিকা।
“আসবো?”
“জ্বি”
বড়ো একটা বিছানা।দুজন দুই কোণায় বসে।মল্লিকার গায়ে ওড়ানো কম্বলটা গুটিয়ে তার দিকে দেয় মাহরুর।মুখোমুখি বসে।একটাই আশা একটা পরিপূর্ণ কথোপকথন হোক তাদের মধ্যে।স্বাদ মিটে না যে।
“বাড়ি ফিরবি?টিকেট করবো?”
মাহরুরের দিকে না চেয়েই উত্তর দেয়, “ফিরতে চাই না।”
“তাহলে এখানে কোথায় থাকবি?”
“জানি না”
মায়ার অতলে ডুব দিচ্ছে চক্ষু।প্রিয় মানুষ হয়ে উঠেছে চন্দ্র।প্রেম জেগেছে ভুল সময়ে। মিথ্যে আশ্বাসে বক্ষ পিঞ্জিরায় বদ্ধ হৃদয়।হাত শূন্য। সবকিছুতো আগেই বিনষ্ট হয়েছে।ঠিক করার উপায় নেই।
“রেগে থাকিস না।”
“আমি রেগে নেই।আপনি আম্মাকে ছাড়ানোর ব্যবস্থা করুন।উনি বয়স্ক মানুষ”
শেষ কথাটি আবদারের সুরে বলেছে মল্লিকা।খানিক আদেশের আভাসও মিশ্রিত ছিলো।আর অন্যের প্রতি অগাধ মায়া। অপরাধীর জন্য মায়া যার সে কতটা মায়াবী হবে?
“করবো ব্যবস্থা।তার আগে আমার একটা শর্ত আছে।”
স্বভাবতঃই প্রশ্ন আসে, “কি শর্ত?”
“তুই বাড়ি ফিরবি আর আমি রেদোয়ানকে বলে মামলা তুলে নিবো।”
অবসাদে চাইলো মাহরুরের দিকে। বিচিত্র শর্তে চোরাবালিতে পতিত করার চেষ্টা।উত্তর আসলো,
“ওটা আমার সংসার।আপনি বুঝতে পারছেন না।”
“কিসের সংসার?”
“আমার স্বামীর সংসার।আমার সংসার।”
“তোর স্বামী কোথায়?”
মুখে উঁচিয়ে ছিলো। মাহরুরের পরবর্তী প্রশ্নের উত্তর দেবে বলে।তার আর উপায় রাখলো না। নেহাত চোখ নামায় মল্লিকা।
“যেখানে স্বামী নেই সেখানে সংসার নেই।আর যেখানে সম্মান নেই ওই সংসারে থাকার কোনো মানেই হয় না।ফিরে যাবি তুই।আমি টিকেট করবো”
“আপনারা যা ভালো মনে করেন।আমার জীবনতো অন্যের সিদ্ধান্তেই চলেছে সবসময়।”
দৃষ্টি শীতল করে মাহরুর। ভ্রূ জোড়া কাছাকাছি এসেছে চন্দ্রের কথায়।বলে উঠলো,
“অনেকটা বদলে গেছিস আবার কিছুটা আগের মতোই রয়ে গেছিস চন্দ্র।আমায় আর আগের মত পুরো নামে ডাকিস না।তুমি থেকে আপনিতে পদোন্নতি হয়েছে আমার।…..চিন্তা করিস না।তোর দোষ দিবো না।আমি জানি এই অপরাধের একমাত্র অপরাধী আমি।কোনোদিন ক্ষমা করিস না আমাকে।”
চলবে…..
চন্দ্র’মল্লিকা ১২
লেখা : Azyah_সূচনা
“বুবু?”
কায়ার ক্ষীণত্ব কাটিয়ে নিজ থেকে রান্না ঘরের দিকে এসে দাঁড়িয়েছে মল্লিকা। গতদিন পর্যন্ত পানির গ্লাস অব্দি ধরতে হাত কাঁপছিলো।হাসপাতালের বিছানার ছোঁয়া পেয়ে যেনো দুর্বলতা আরো ঘিরে ধরেছিল তাকে।রোগীদের মধ্যে থেকে রোগ বেড়েছিল।এখন সুস্থ মনে হচ্ছে।এসেছিল একই গান আওড়াতে।তাকে যেনো ওই বাড়িতে ফিরতে দেওয়া হয়। শিরীনের বিকট আওয়াজ আর চড় দেওয়ার ভয়ে আর কথাটি মুখ ফুটে বলা হলোনা।ভয় আছে তবে অনেক ভালোবাসাও আছে।তার এই তিক্ত মুখের আড়ালে লুকিয়ে থাকা নরম ব্যক্তিত্বটাকে সকলে চেনে।
“উঠে এসেছিস কেনো?কিছু লাগবে?”
অনেকদিন পর শাড়ি ছেড়ে সেলোয়ার কামিজ জড়িয়েছে চন্দ্র।শিরীন মুখ ফিরে চাইতেই দেখলো ওই ছোট্ট চন্দ্রকে।কিশোরী থেকে নারী হওয়ার পর মুখমণ্ডলে ভিন্নতা আসলেও ভিন্নতা আসেনি তার গড়নে।স্বাস্থ্যবতী হয়েছে মা হওয়ার পর তবে চোখে পড়ার মতন নয়।কে বলবে?পঁচিশ বছরের এক নারী সে?
ততক্ষনে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে মল্লিকা।বললো, “কিছু লাগবে না।একা ভালো লাগছিলো না।”
“দুপুরে কি খাবি বল?”
“এত কষ্ট করা লাগবে না আমার জন্য বুবু।”
“উফ চন্দ্র!তুইও মাহি ভাইয়ের মতন।”
ছ্যাঁত করে উঠে হৃদয়। সত্যিই সে মাহরুর ভাইয়ের মতন?একই ব্যক্তিত্ব তাদের?তাহলে কেনো মিলন হলো না?ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নিয়তি একে অপরের সামনে এনে দাড় করায়। অনুভূতি নিয়ে খেলা করে।
“হিরা ভাবি কোথায়?”
শিরীন আরচোখে তাকায়।হয়তো এমন প্রশ্ন আশা করেনি চন্দ্রমল্লিকার কাছে।শিরীনের দৃষ্টি দেখে মল্লিকা ততক্ষনাত বলে উঠে,
“না মানে!মাহি ভাই দুদিন পুরোটাই হাসপাতালে ছিলো।গতকাল অফিস করে এখানেই এসে থেকেছে। ভাবিকে দেখলাম না তার সাথে।তাই জিজ্ঞেস করেছি”
খুন্তি নাড়তে নাড়তে মলিন গলায় শিরীন বলতে লাগলো, “কি বলবো?জীবনটা ভালো চলছে না আমার ভাইয়ের। মৃত মানুষের নামে গীবত করা উচিত না।যদি সে নিজের মা হয় তাহলেতো আরো না।”
“কি হয়েছে বুবু?” জানতে চাইলো মল্লিকা।
“আমার ভাইও ঠিক তোর মতই।চোখে সুখের দেখা পেলো না।বিয়ের আগে অভাবের কষ্ট বিয়ের পর কষ্ট যেনো দ্বিগুণ হয়।তুইতো ততদিনে নিজের সংসারে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলি।এরপর ওই মহিলা!আমার মা যাকে ঘরের বউ করে এনেছিল?আমার ভাইটাকে শান্তি দিলো না।”
এক তরকারি রান্না শেষে আরেক চুলোয় ডিম ভাজতে ভাজতে শিরীন আবার বললো, “মানুষের শখ আহ্লাদ থাকে। পূরণ করতে চায়।কিন্তু ওই শখ আহ্লাদ যখন লোভে পরিণত হয় তখন মানুষ ধ্বংস হয়ে যায়রে চন্দ্র।সেই লোভটা ছিলো হিরা ভাবির।মা যখন মোতালেব চাচাকে বলেছে আমার ছেলে শিক্ষিত, ঢাকায় বিরাট চাকরি করে,নাম ডাক আছে তার সেখানে তখন অজান্তে তারাও লোভে পড়ে।তারপর কি হলো?ভাইয়া যখন তার সকল আবদার পূরণে ব্যর্থ হলো?মায়ের মিথ্যের দায় বহন করতে হয় মাহি ভাইকে।”
ফ্যালফ্যাল নয়নে তাকিয়ে আছে মল্লিকা। বিস্তারিত শুনছে মাহরুরের বৈবাহিক জীবনের।কিন্তু হিরা কোথায় এটা এখনও অজানা।মল্লিকা বললো,
“ভাবি এখন কোথায়?”
“আমার ভাইকে নিঃস্ব করে অন্যের ঘর আলোকিত করছে।মাসখানেক আগে তালাক নামায় সই নিয়ে নতুন জীবনসঙ্গীর সাথে প্রবাসে পাড়ি জমায়।”
শিরীনের কথার বিপরীতে কেমন প্রতিক্রীয়া দেওয়া উচিত?নিজের কানকে এখন অব্দি বিশ্বাস করাতে পারেনি।মল্লিকা কল্পনায় বেঁচেছে এতদিন।ভেবেছে নতুন সঙ্গিনীকে নিয়ে বেশ আয়েশেই জীবন চলছে মাহরুরের। কোনোদিনতো ভালোই বাসেনি মল্লিকাকে।যাও একটু মায়া ছিলো সেটাও বোধহয় স্ত্রীর মোহ ভুলিয়ে দিয়েছে।হিংসে হতো!তাদের একত্রে কল্পনা করে নিজে নিজেই জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়েছে।নিজের মনকে মানিয়েও নিয়েছে এক সময়। চেয়েছিলো নির্দয় পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব থেকে তার স্বামী ফারহানকে ফিরিয়ে আনতে।আরেকবার ভালোবাসার দুঃসাহস করেছিলো।জেদ চেপেছিলো।যে তাকে ভালোবাসেনি তার জন্য কিসের দরদ?
“ভাই তোর জন্য তার সাধ্যের মধ্যে লড়াই করেছে।কিন্তু কি জানিস?রক্তের কাছে আত্মার সম্পর্ক ফিকে পড়ে যায়।কোনোদিন বিয়ে করবে না এটাই জানিয়েছিল আম্মাকে।তবে মা জেদ ছাড়লো না।মৃত্যুর হুমকি দিয়ে……”
বলতে বলতে থেমে যায় শিরীন। অনুভূতি তারও আছে।গলায় তারও কথা দলা পাকিয়ে যায়।তবে নিজের চেয়ে বেশি অনুভূতির স্তব্ধ সাগরে ডুবিয়ে দিলো চন্দ্রকে। নির্বিকার চিত্তে শুনলো শিরীনের কথা।তবে কি মাহরুর ভাই চেষ্টা করেছিলো?
___
মিষ্টিকে বুকে জরিয়ে আছে মল্লিকা। সাথেই সুমাইয়া তার বাড়ির কাজ সারছে।সায়মন মিষ্টিকে একের পর এক প্রশ্ন করে যাচ্ছে।সবার সাথে মিশলেও মিষ্টি মায়ের মতোই বোকাসোকা মেয়ে।এখন পর্যন্ত স্কুলে ভর্তি করানো হয়নি তাকে।সেই ভাগ্যটাই হয়নি বলা চলে।অন্যদিকে সায়মন পড়ালেখায় পটু। এতশত কথা কিছুই মিষ্টির মাথায় ঢুকলো না।
সায়মন বললো, “খালামণি?মিষ্টি কথা বলেনা কেনো?ওকে আমি কবিতা বলতে বললাম তাও বলছে না।”
অসহায় মুখে সায়মনকে বললো, “ওতো কবিতা পারেনা বাবা”
“কেনো পারেনা খালামণি?”
সায়মন ছোট।বাচ্চা মনে কতইতো কৌতূহল। জানার ইচ্ছে।মল্লিকার খারাপ লাগলো।মেয়েকে কবিতা পর্যন্ত শেখাতে পারেনি।সায়মনের এতে কি দোষ?সুমাইয়া এর মাঝে বলে উঠে,
“মিষ্টি ছোট তাই কবিতা পারেনা।আমরা ওকে শেখাবো কেমন?”
সায়মনও সায় দিয়ে মাথা দোলায়।বলে, “ঠিক আছে আপু”
সুমাইয়া মিষ্টিকে নিজের সামনে বসায়।সায়মনের বই বের করে শিক্ষকতা শুরু করলো।মিষ্টিকে পড়াবে।মল্লিকার মুখে হাসি ফুটলো।সুমাইয়ার উদ্দেশ্যে বলল,
“আমার মায়ের কি বড় হয়ে শিক্ষক হওয়ার ইচ্ছে আছে নাকি?”
সুমাইয়া উত্তর দেয়, “হ্যা খালামণি।”
“আমার মামা একজন ভালো শিক্ষিকা হবে ইনশাল্লাহ!”
বলেই ঘরে প্রবেশ করলো মাহরুর।অবাধ্য হৃদয় বাঁধা মানে? বেহায়া হয়ে বারবার ছুটে আসে।কু-পুরুষের ন্যায় ছট্ফট করে কাঙ্ক্ষিত নারীর দিকে দৃষ্টিপাত করতে। লোকে বলবে স্ত্রী ত্যাগ করার সাথে সাথেই অন্য নারীতে আসক্ত?এই পুরুষের দোষ আছে নিশ্চয়ই।তারা কি জানে?এই নারী তার কতকাল পূর্বের মায়াবতী?একে অপরের সাথে মন বেধে বিচ্ছিন্ন হয়েছিলো দৈহিকভাবে।মনটা পড়ে আছে এখনও ওই গ্রামীণ মেঠো পথেই পড়ে আছে।দোষ একটাই।কিশোরী মনের প্রখরতা হেলাফেলা করেছে।পুরুষ হয়েও জোর খাটিয়ে নিজের করে নিতে পারেনি তাকে।
কাঁধের ব্যাগটা সোফায় রাখে মাহরুর।এলোমেলো চুলগুলো হাতের সাহায্যে আঁচড়ে পেছনে ঠেলে দিয়ে বসলো বাচ্চা ছানাদের মধ্যে এসে।মিষ্টি আর সায়মনকে একসাথে উরুতে বসিয়ে আদর ঢেলে দিচ্ছে।চুমু খাচ্ছে একের পর এক।আজকাল চন্দ্র তাকায় না মাহরুরের দিকে।সামনে পড়লেই চোখ নামিয়ে নেয়।হয়তো ঘৃণায়;আক্রোশে।
“আগামী কালকের টিকেট করেছি।”
“হুম?আমাকে বলছেন?”
“হ্যা। আগামীকাল গিয়ে দিয়ে আসবো।”
“আমি একাই যেতে পারতাম”
“বেশি সাহস দেখাস না চন্দ্র।এই সাহসটা নিজের শ্বাশুড়ীর সামনে দেখালে এই অবস্থা হতো না।”
চন্দ্রকে ধমকে দেওয়ার সুযোগ জীবনে কমই এসেছে।আদেশ অমান্য করার পাত্রী সে নয়।কোনো ‘টু’ শব্দ ছাড়াই মেনে নেওয়ার এক অদ্ভুত ক্ষমতা তার মধ্যে পরিলক্ষিত।তবে একেবারেই যে আসেনি তা নয়। মাহরুরের ক্ষেত্রে চন্দ্রের চরিত্র ভিন্ন।প্রেমে মত্ত হওয়া হৃদয় যেনো আরো বাধ্য ছিলো তার। মাঝেমধ্যে টুকটাক বিষয়ে কঠোর হতো মাহরুর।সেও ঠিক এমনি মলিন মুখ বানাতো কিন্তু মেনে নিত বিপরীতে কোনো প্রশ্ন উত্তর না করেই।যেমন এখন।
“এখন বাড়ি যাচ্ছি। কাল রেডি থাকিস। ও বাড়ি থেকে কাপড় আনা লাগবে না।তোর কাপড় বাহিরে রাখা আছে।দেখে নিস।আসি” বলে চলে গেলো মাহরুর।যাওয়ার একবার ফিরে তাকিয়েছে বটে।
__
বাসের বেগমমাত্রায় দেহ দুল্যমন। মাহরুরের বুকে নিঃশব্দ ঘুমিয়ে মিষ্টি। পুরোপুরি তার মধ্যেই লেপ্টে আছে।অতি নিকটে বসে আছে চন্দ্রও।তবে মধ্যিখানে একটা ব্যারিকেট টানা।পুরুষের দেহ চওড়া হয়।ছোট বাসের সিটে জায়গার কমতি।এরমধ্যে বড় ব্যাগটা অসস্তি দিচ্ছে তাকে।তাতে কি চন্দ্র তাদের সাথে চলতে থাকা আকাশের চন্দ্র দেখতে ব্যস্ত।ছোটবেলায় মনে হতো চাঁদটাও তাদের সাথে চলে।আজ বিচিত্রভাবে চন্দ্র তার সাথে।তার পাশের সিটে বসে পারি জমাচ্ছে চেনা পরিচিত নীরে।
বিগত একঘন্টা হলো তারা রওনা হয়েছে।এতটা চুপচাপ হলো কি করে এই মেয়েটা?একদম নিস্তব্ধ।নিঃশ্বাস ব্যতীত আর কোনো হেলদোল লক্ষ করা গেলো না। মাহরুরের হৃদয় ছটফট করে।যেমন আজ থেকে ঠিক ছয় বছর পূর্বে চন্দ্রের মন উতলা ছিলো তার জন্যে।সেই মৃদু চঞ্চলতা এসে থেমে যেনো মাহরুরের মুখোমুখি?
“কিছু খাবি চন্দ্র?”
“উহু”
“ক্ষিদে পেলে বলিস”
“ঠিক আছে।”
এড়ানো কথা। ভাবভঙ্গি থেকে পরিষ্কার কথা বলার কোনো ইচ্ছে নেই তার মধ্যে।তাও ব্যাকুলতা থামাবে কি করে? হৃদয়কে বললো আনমনে যখন তার জন্য কাতর হওয়ার সঠিক সময় ছিলো?তখন কেনো হলো না?
আবারও দূর্বশ মুখে বলে উঠে, “সেখানে গিয়ে কান্নাকাটি করবি না।চাচা,চাচী কষ্ট পাবে। হাসিখুশি থাকবি।তোর দিন ফিরছে।ভালো থাকার দিন।পিছনে যা ফেলে আসছিস ভুলে যাস কেমন? মেয়েটাকে নিয়ে একটা সুস্থ জীবন যাপন কর ”
মল্লিকা এখনও চেয়ে আকাশপানে।মনমরা ভঙ্গিতে উত্তর আসে, “আমি পেছনে ফেলে রেখে আসা বন্ধ ঘরে আবার ফিরে যাচ্ছি”
মাহরুর থমকায়। বিস্মিত হয়।অতিরিক্ত আগ্রহ দেখিয়ে জানতে চাইলো, “তাহলে কি তুই গ্রামে যেতে চাস না?”
“যাওয়া ছাড়া আরতো কোনো উপায় দেখি না”
আবেগ প্রবন হচ্ছে।গলা খাদে নামিয়ে মাহরুর বললো, “আমাকে ক্ষমা করবি চন্দ্র?আমি অনেক বড় একটা অপরাধী।তোকে আশা দিয়েছি।আবার ভঙ্গ করেছি।কিন্তু বিশ্বাস কর আমার হাতে কিছু ছিলো না।আমি তোর অনুভূতির সম্মান করেছি তখন।বিশ্বাস কর আমায়”
উত্তর দিলো না।হেয়ালি করলো সোজাসুজি মল্লিকা।রাগ নাকি কষ্ট?মুখ দেখারও উপায় নেই।কি করে বুঝবে মাহরুর? মিষ্টিকে সাবধানে কোলে রেখেই হাত জোড় করলো।বললো,
“আমাকে আর আমার মাকে ক্ষমা করে দে।কারো হৃদয়ভঙ্গ করার দায় নিয়ে মৃত্যুটা অনেক যন্ত্রণার হবে।”
“আমার কোনো রাগ নেই।যদি থেকেও থাকে?ক্ষমা করার চেষ্টা করবো মাহি ভাই।”
হতাশা নিয়ে প্রশ্ন করে, “শুধু মাহি?”
“হুম”
দীর্ঘ ছয় ঘণ্টার যাত্রা শেষ হয় মফস্বলে।বাস থেকে নেমেই পা জোড়া থমকায় দুজনার।অলিগলি পরিবর্তিত হয়েছে। মাহরুর- মল্লিকা উভয়ের এখানে আসাযাওয়া কম।এক সময় এই স্থানটি ছিলো কত আপন।ঠিক ছয় বছর আগে জোড়ায় জোড়ায় ত্যাগ করেছিল এই আধ পাকা রাস্তা।অভিমানে,কষ্টে।আজ ফিরেছে তবে আলাদা।মল্লিকা ফিরে চায়নি কোনোদিন।মায়ের মৃত্যুর আগে একবার এসেছিল মাহরুর।এরপর সেও বিমুখ হয়।
“চল” শব্দে মল্লিকার মস্তিষ্ক সচল হয়।অর্থাৎ আবার কিছু পথ হেঁটে নিজের বাড়ির দিকে এগিয়ে যেতে হবে। হাটতে হাটতে কল করে মাহরুর।রমজান মিয়াকে। জানাতে তারা এসে গেছে।পরপর রেদোয়ানকে কল করেও তাদের পৌঁছে যাওয়ার সংবাদ দিল।
“মা?আমার আম্মারে কত দিন পর দেখলাম!আমার নাতনি কই?”
মাহরুর ঘুমন্ত মিষ্টিকে এগিয়ে দেয় রমজান সাহেব এর কাছে। ফরিদা বেগম মেয়েকে জরিয়ে ধরে আছেন।নানার আদরে ফুটফুটে মেয়েটা চোখ পিটপিট করলো।চোখে আলো পড়তেই চোখ কচলে নেয়।শরীরের জোর কমেছে বয়সের জোরে।আজকাল হুটহাট কেদে ফেলেন রমজান সাহেব।যেমনটা এখন।কান্নায় ভেংগে পড়ছেন বাবা মা উভয়েই।কতদিনের তৃষ্ণা মিটলো।আদর ভালোবাসা
বিনিময়ের শেষ পর্যায়ে
মাহরুর বলে,
“আসি চাচা”
ফরিদা বেগম বললেন, “তুই কোথায় যাস? খাবি না?”
“না চাচী।বাড়ি যাবো।….অনেকদিন যাই না”
“খেয়ে যা অন্তত!”
“রাস্তায় খেয়েছি।একটু ঘুমাই গিয়ে।ক্ষিদে পেলে এসে খেয়ে নিবো। চাবিটা দিন”
রমজান সাহেব বললেন, “এখানেই বিশ্রাম করতি?”
“না চাচা। বাড়িই যাবো”
এক এক পদচারণ নড়বড়ে।যেনো কেউ পায়ে পাথর বেঁধেছে।বুকের অস্থিরতা বাড়ছে বাড়ির কাছাকাছি এসে।তারপরও এসে পৌঁছায়।যেখানে হাসি,কান্নার সমারোহ ছিলো। অতীত পুরোটা কেটেছে।আজ খাখা করছে আঙিনা।ভয়ঙ্কর শব্দহীনতা বিরাজমান।শুকনো ঢোক গিলে ভেতরে আসলো মাহরুর। উঠোনে ধুলা পড়া পুরোনো মোড়ায় বসে পড়লো ধপ করে।
অন্তরের গভীর থেকে ডাক আসলো, “আম্মা!”
ব্যাস!চোখ টলমলে হয়েছে নোনাজ্বলে।বক্ষ ভেদ করে হৃদয় বেরিয়ে আসবে আসবে ভাব।এদিক ওদিক চাইলো মাহরুর।মা নেই।তার শব্দ নেই।তার অস্তিত্ব নেই।চার বছর আগে কাধে করে রেখে এসেছে সেখানে। যেখান থেকে কেউ ফিরে আসেনা।
“আম্মা…আমার অপেক্ষা করো?অনেকদিন পর এসেছি।ক্লান্ত আমি,ক্ষিদে পেয়েছে।খাবার দিবে না?….আম্মা তোমার উপর আমার অভিমান ছিলো।কিন্তু তুমিতো আমার মা। রাগ থাকতে পারি আমি?….তুমি জেদটা না করলে আজ সব ঠিক থাকতো না আম্মা?আমাকে দেখো কি অবস্থা আমার? চন্দ্রকে দেখো?আমরা কেউ ভালো নেই।আম্মা আসবে একবার?……আসো আবার সব ঠিক করে নেই।ভুলগুলো শুধরে ফেলি আম্মা।”
চলবে….