#চন্দ্রকুঠি
পর্ব দুই
#নুশরাত জাহান মিষ্টি
পরেরদিন সকালে,
পুলিশ স্টেশনে যাবো এই আশা তৈরি হচ্ছিলাম। এমন সময় বাবা দরজায় কড়া নাড়লো, ” আসবো মা?”
” হ্যাঁ বাবা এসো।”
বাবা ভিতরে আসতেই আমি প্রশ্ন করলাম,” কিছু বলবে?”
” কারাগারে যেও না। পুলিশ স্টেশন বা থানা নামে যে ভুল শব্দটি প্রয়োগ করি আমরা সেখানে।”
” ভুল শব্দ?”
” হ্যাঁ। ভুল শব্দ। তুমি নিশ্চয়ই থানা এবং কারাগারের মাঝে পার্থক্য জানো।”
” জানি। আসলে আপু পুলিশ স্টেশন বলে কারাগারে নিয়ে যাবে এটা বুঝতে পারি নি।”
কথাটি বলে মুন মনেমনে বললো, ” কে জানতো পুলিশ অফিসার বলে এক জেলের জেলারের সাথে প্রেম করে বেড়াচ্ছে ও?”
” যাই হোক। আমরা মাঝেমাঝে কারাগার এবং থানার মাঝে পার্থক্য গুলিয়ে ফেলি তাই তো সবসময় ভুল শব্দ প্রয়োগ করি।”
” হ্যাঁ বাবা।”
” তো যাই হোক তুমি কারাগারে যেও না প্লীজ।”
” আমি তো কলেজের জন্য তৈরি হচ্ছিলাম বাবা। কারাগারে কেন যাবো?” মিছে হাসি দিয়ে
” আমি জানি তুমি কলেজের নামে কারাগারে যাবে।”
” না বাবা আসলে…”
” আমি তোমাদের বাবা মুন। তোমাদের ভাবনা চিন্তা সবকিছু সম্পর্কে আমি খুব ভালোভাবে জানি।”
” বাবা আমি আসলে…”
” গন্তব্যহীন রাস্তায় মিছে ছুটে চলা উচিত নয় মা।”
” যদি গন্তব্যহীনই হবে তাহলে তুমি কাল রাতে ছাদে…”
বাবা আমাকে চুপ করিয়ে দিয়ে নিজেই বলতে লাগলেন, ” আমি জানি কাল রাতে তুমি আমাকে সিগারেট খেতে দেখেছো। সেই সাথে কিছু কথাও শুনেছো।”
” তুমি তো আমাকে দেখোনি তবে জানলে কিভাবে?”
” আমি তোমার বাবা। আমি তোমাদের উপস্থিতি অনুভব করতে পারি।”
” বাবা তাহলে আমাকে বলো কেন তুমি কালরাতে এমন আচরণ করলে?”
” কাল অফিস থেকে মুড খারাপ করে এসেছিলাম আমি। তাই ওমন ব্যবহার করেছি। এর সাথে কারাগারের কোন কানেকশন নেই। তুমি অহেতুক ভাবছো।”
” সত্যি আমি অহেতুক ভাবছি।”
” হ্যাঁ। আচ্ছা আমাকে বলো এখন তুমি কারাগারে গিয়ে কি খুঁজবে?”
” তা তো জানি না। তবে জানো বাবা ঐ কারাগার আমাকে খুব করে টানে। মনে হয় ওখানে আমার কিছু একটা আছে বা ছিলো।”
” এসব তোমার ভ্রান্ত ধারণা মুন। যেখানে কেউ যেতে চায় না সেই কারাগার তোমাকে টানছে। এসব নিছকই তোমার ভ্রম।”
” তাই হবে হয়তো। কিন্তু আমি সেখানে গেলে কি সমস্যা?”
” কোন সমস্যা নেই। আমি চাই পরিক্ষার আগে তুমি এসব নিয়ে ভাবা বন্ধ করো। পরিক্ষা সামনে এখন পড়ালেখা মন দেও। তারপর সব হবে।”
” পরিক্ষা পর তোমার কোন বাঁধা থাকবে না? শুধুমাত্র পড়ালেখার জন্যও যেতে বারণ করছো?”
” না থাকবে না। হ্যাঁ শুধু পড়ালেখার জন্য।”
” আচ্ছা তাহলে পরিক্ষার আগে এসব নিয়ে ভাববো না। তবে তারপর তুমি কিন্তু বাঁধা দিতে পারবে না।”
” আচ্ছা দেবো না।”
আরিফ সাহেব মুখে এই কথা বললেও মনেমনে ঠিক উল্টো ভাবনা ভেবে নিলেন, ” ততদিনে তোমার এই ভাবনাটা দূর হয়ে যাবে এই আশা রাখছি।”
_________
মাধুরি কলেজে গেটে পা রাখতে যাবে তখনি রাফি বাইক নিয়ে সামনে এলো৷ রাফিকে দেখে কালকের চাপা রাগটা আবার জেগে উঠলো। বেশ রাগ নিয়ে বললো, ” কি চাই?”
” তোমাকে?” বেশ আনন্দিত হয়ে
” আমাকে দিয়ে তোমার কি কাজ?”
” কেন জানো না বুঝি?”
” না তো৷ আমি তো জানতাম তোমার সব সময় নিজের ঐ চাকরির জন্যই রাখা।”
” কালকের জন্য সরি। প্লীজ ক্ষমা করে দেও। দেখো তুমি তো জানো আমাদের পেশায় রাত দিন নেই। যখনি ফোন আসবে কাজে নেবে পড়তে হবে।”
” কি এমন রাজকাজ্য করো তুমি তা তো ভালোই জানি। ঘুষ দিয়ে জেলের জেলার হয়েছো। তোমাদের আবার কাজ কি শুধু চেয়ারে বসে আরাম করা।”
” আমার যায়গায় থাকলে বুঝতে কি কাজ করি?”
” তো সেখানেই যাও না বারণ করছে কে?”
” সরি।” কান হালকা ধরে
” একটা শর্তে মাফ করতে পারি।”
” বলো কি শর্ত? আমি তোমার সব শর্তে রাজি।”
” আমার শর্তটা হলো, আজকে আমার ক্লাস শেষ না হওয়া অব্দি তুমি এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে। বলো রাজি?”
” হ্যাঁ রাজি। তোমার ক্লাস শেষ হওয়ার পর আমরা ঘুরতে যাবো।”
” দেখা যাবে।”
কথাটি বলে মাধুরি চলে গেলো। মুখে তার দুষ্টু হাসি। সে জানে রাফি সত্যি তার জন্য অপেক্ষা করবে এখানে। রাফি চাইলে ক্লাস শেষের আগে এসে কাজটি করতে পারে কিন্তু তাও সে করবে না। কারণ তার প্রিয় মানুষটির দেড়ি করে আশা, কথা না রাখার শাস্তিগুলো পালণ করতে তার ভালোই লাগে। আর প্রিয় মানুষটি মাধুরির কথায় সারাদিন কলেজ গেটে দাঁড়িয়ে থাকবে এটা ভাবতে মাধুরির খুব ভালো লাগে। এতে প্রমাণ হয় প্রিয় মানুষটি তাকে কতটা ভালোবাসে, যে তার এক কথায় সারাদিন রোদে দাঁড়িয়ে থাকবে। এতে অবশ্য রাফির আরো একটা লাভ হয় তাহলো ক্লান্ত বিকেলে কোন এক নির্জন যায়গায় বসে, সে তার প্রেয়সীর নরম হাতের ছোয়া দিয়ে গা থেকে ওড়নার কোনাটি নিয়ে ঘামগুলো মুছে দেওয়ার আনন্দ উপভোগ করে । ভালোবাসা এই ছোট ছোট আনন্দগুলো খুব মধুর হয়। এগুলো সত্যি ভালো লাগার।
অন্যদিকে,
মুন তার বাবাকে পড়ালেখায় মনোযোগী হওয়ার কথা দিয়ে থাকলেও কিছুতেই ভাবনা থেকে বেড়োতে পারছে না। বারবার মনে হচ্ছে কোন একটা রহস্য তাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। শেষমেশ থাকতে না পেরে চলে গেলো কারাগারে। সেখানে গিয়ে রহিমার সাথে দেখা। রহিমা নিজ থেকেই তার সাথে কথা বললো, ” তুমি সেই ডাক্তার মেয়েটির বোন না?”
” হ্যাঁ। তবে আপু এখনো পুরোপুরি ডাক্তার নয়।”
” সে যাই হোক একদিন তো হবে।”
” হ্যাঁ।”
” তা এখানে কিসের জন্য আসা?”
” কালকের সেই বাচ্চাটি আর তার মায়ের সাথে দেখা করা যাবে?”
” তুমি তাদের সাথে দেখা করতে চাইছো কেন?”
” এমনি। কাল অজ্ঞান হয়ে যাওয়ায় বাচ্চাটিকে দেখতে পায়নি তো তাই।”
” ওহ। এখন এসে ভালোই করেছো বিকেলের পর আসলে আর বাচ্চাটিকে দেখতে পেতে না।”
” কেন?”
” বিকেলে তাকে অনাথ আশ্রমে দিয়ে দেওয়া হবে।”
” অনাথ আশ্রমে কেন?”
” রেবেকার পরিবারে কেউ নেই, তাই বাচ্চাটিকে তুলে দেওয়ার মতো কাউকে পাওয়া যায়নি।”
” ওহ। তাহলে আমি কি দেখা করতে পারি?”
” হুম।”
রহিমা মুনকে রেবেকার কাছে নিয়ে গেলো। দ্রুত কথাবার্তা শেষ করতে বলে রহিমা চলে গেলো। মুন রেবেকার দিকে নজর দিলো। রেবেকা তার বাচ্চার সাথে খেলছে, তার সাথে নানা ধরনের কথা বলছিলো। বাচ্চাটি তার কাছ থেকে চলে গিয়ে যাতে কষ্ট না পায় তাই বোঝাচ্ছিলো। মুন কিছুক্ষন রেবোকার কান্ড দেখে তারপর খুব শান্তভাবে জিজ্ঞেস করলো, ” নাম কি রেখেছেন বাবুর?”
রেবেকা মুনের দিকে তাকালো। মুনের দিকে তাকিয়ে রেবেকা চমকে উঠলো। রেবেকার চমকানো মুখ দেখে মুন জিজ্ঞেস করলো, ” কি হলো আপনি এত অবাক হচ্ছেন কেন?”
” কি চাই তোর এখানে?”
” কিছু না। বাবুকে দেখতে এসেছি একটু।”
” নাম কি তোর?”
” মুনতাহা মাহযাবিন। আপনার?”
” মুন মানে চাঁদ মানে চন্দ্র।” এক নাগারে বললো
” হ্যাঁ মুন মানে তো চাঁদই।”
” তোর বাবা মা কে?”
” এসেছিলাম আপনার জীবন সম্পর্কে জানতে আর আপনি আমার সম্পর্কে জানার চেষ্টা করছেন। বেশ ভালো তো।”
” যা জিজ্ঞেস করছি তাই বলো। কিসে পড়ো?”
” এইতো সামনে এইচএসসি দিবো।”
” ওহ পরিক্ষা সামনেই তাই তো?”
” হ্যাঁ। এবার আপনি আপনার সম্পর্কেও কিছু বলুন?”
” বললে কি হবে? কি করবি তুই?”
” না মানে….”
” পরিক্ষার পর এখানে এসো। তারপর সব বললো সাথে তোমাকে দেখে চমকানোর কারণটাও বলবো।”
” পরিক্ষার পর বলবেন কেন? এখন বলতে কি সমস্যা?”
” কোন সমস্যা নেই। এখন বললে তুমি পড়ালেখায় মনোযোগী হতে পারবে না। যেহেতু পরিক্ষা সামনে সেহেতু পরিক্ষাটা দিয়েই নাহয় এসো।”
” আমি কি জানতে চাই আপনি সেটাই তো জানলেন না?”
” উহু জানতে হবে না। এখন যাও তো।”
” আচ্ছা। তাহলে আমি পরিক্ষার পর আসবো কিন্তু?”
” এসো।”
মুন চলে যাচ্ছিলো এমন সময় রেবেকা বলে উঠলো, ” তোমার চোখগুলো খুব সুন্দর মুন।”
মুন রেবেকার দিকে ঘুরে মুচকি হেঁসে বললো, ” ধন্যবাদ।”
” তোমার হাসিটাও খুব সুন্দর।”
মুন মুচকি হেঁসে চলে গেলো। এদিকে রেবেকা ভেবে চলেছে, ” একে আসতে বলে ভুল করলাম না তো। একে বললে কিছু কি হবে! মেয়েটি তো যথেষ্ট ছোট। একে আসতে বলাটা ঠিক হলো না বোধহয়।”
অন্যদিকে মুন কারাগার থেকে বের হবে এমন সময় কারো সাথে ধাক্কা খেলো। চোখ তুলে তাকিয়ে দেখলো একজন বেশ বয়স্ক মহিলা কর্মী। মহিলাটি মুনের দিকে তাকানোর সাথে সাথে বিদ্যুৎ চমকানোর মতো চমকে উঠলো। মহিলাটির মুখেও চমকানোর রেখা দেখতে পেয়ে মুন ভাবতে লাগলো, ” আজকে কি মুখটা ভালো দেখাচ্ছে না। নয়তো সবাই মুখের দিকে তাকিয়ে এত চমকাচ্ছে কেন!”
মুন ভাবনা থেকে বেরিয়ে মহিলাটিকে সরি বলতে যাবে। কিন্তু কই! মহিলাটি কই! মহিলাটি চমকানো নিয়েই মুনের সামনে থেকে চলে গেলো। মহিলাটির এই অভূত ব্যবহারের কোন মানে খুঁজে পেলো না মুন।
__________
সন্ধ্যাবেলা,
সব ভাবনাকে আপাতত পরিক্ষা অব্দি ছুটি দিয়ে মাধুরির সাথে পড়তে বসলো মুন। মাধুরির মুখ দেখে আজকে খুব খুশি খুশি লাগছে। রাফির সাথে যে ঝামেলা মিটে গেছে সেটা বুঝে গেলো মুন। হঠাৎ মাধুরির ফোনে একটি আননোন নাম্বার থেকে মেসেজ এলো, ” অন্ধকার। তোমার চারদিকে ঘোর অন্ধকার। অন্ধকার থেকে বের হতে হলে খুঁজে বের করে তোমার বাড়ি। তাড়াতাড়ি যাও সেখানে।”
চলবে,