#গ্যাসবেলুন
#পর্ব_৮
লেখাঃ Nobonita Ferdows
.
অরূপ প্রতিদিন ছয়টা থেকে সাড়ে ছয়টার মধ্যেই অফিস থেকে ফিরে আসে। মাধূর্যকে বাড়িতে নিয়ে আসার পর থেকে সে প্রায় প্রতিদিনই বিকাল পাঁচটার মধ্যে অফিস থেকে ফিরার চেষ্টা করে। কিন্তু আজ সে ফিরলো রাত সাড়ে আটটায়৷ অফিসে একটা উটকো ঝামেলা হয়েছে। একসপ্তাহের মধ্যে চারজনের ফোন হারিয়েছে। প্রথম প্রথম ব্যাপারটাকে গুরুত্বে না নেয়া হলেও এখন বেশ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠেছে বিষয়টা। একদিন পরপর দুজনের ফোন টেবিল থেকে গায়েব হয়ে গিয়েছে।
তারপর আবার একদিন পর টানা দুদিনে দুজনের ফোন পকেট থেকেই হারিয়েছে। এদের সবারই ফোন হারিয়েছে অফিসে ঢোকার পর।
.
অরূপদের অফিসে প্রচন্ডরকম কড়া গার্ডের ব্যাবস্থা রয়েছে। অফিসের প্রতি ফ্লোরে ঢোকার দরজায় ফইস রিকগনিশন ব্যাবস্থা থাকায় অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ব্যতীত কেউ সহজে অফিসে প্রবেশ করতে পারেনা। এত কড়া ব্যবস্থা সত্ত্বেও যখন চুরী হচ্ছে, তার মানে অফিসের কেউ বা কেউকেউ এর সাথে জড়িত। চোর ধরার জন্য গোপন মিটিং করা হয়েছে। সকল কর্মকর্তাদেরকে সতর্কতার সাথে চলাফেরা করতে হচ্ছে৷ এইসব ঝামেলার কারণে অরূপের অফিস থেকে বেরোতে বেরোতেই আটটা পেরিয়ে গিয়েছে।
.
অরূপ বাসায় ফিরে কলিংবেল চাপতেই প্রতিদিনের মতোই অন্তু দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দিলো। অরূপ বাড়িতে ঢুকেই সিড়ির মাথায় খেয়াল করলো। অরূপ বড় ধরণের ধাক্কা খেলো। অরণী এবাড়িতে আসার দুমাস পেরিয়ে গিয়েছে৷ আর এই গত দুমাসে অরূপ প্রতিদিনই বাড়িতে ঢুকে সিড়ির মাথায় খেয়াল করেছে। সিড়ি দিয়ে উঠেই হাতের ডানের প্রথম ঘরটা অরণীর; এঘরের দরজায় সাদা ভারী পর্দা লাগানো। ঠিক এসময় করে সেই সাদা পর্দার আড়াল থেকে দুটো চোখ তার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে৷ এই দুইমাসে কোনোদিন এর ব্যতিক্রম হয়নি। যেদিন অরূপ অরণীকে অপমান করে তার ঘর থেকে বের করে দিয়েছিলো, তারপর দিনেও অরূপ খেয়াল করেছে, অরণী তাকে লুকিয়ে দেখেছে। অরূপের সামনপ না এলেও তার খোঁজ রেখেছে। আজ এমন কি হলে যে অরণী তার কলিংবেলের আওয়াজে ছুটে এলোনা? অরণী কি বাড়িতে নেই? নাকি তার আজ ফিরতে দেরী হলো বলে বুঝতেই পারেনি অরূপ এসেছে!
.
“উপরে তাকিয়ে কি দেখতিছো, ভাইয়া?”
.
“কই কি দেখতিছি? হাবলার মতো দাঁড়ায় আছির ক্যান তুই আমার সামনে? যা নিজের ঘরে যা।”
.
ধমক খেয়ে ভ্যাংচি কেটে উপরে চলে গেলো অন্তু।
.
অরূপের মন খারাপ হলো। কেনো হলো, সে নিজেও জানেনা। সিড়ি দিয়ে উঠে নিজের ঘরে এসে বাথরুমে ঢুকে গেলো সে। হেভি শাওয়ার নিয়ে বের হয়ে মাধূর্যের খোঁজে মায়ের ঘরের দিকে যেতে গিয়ে অরণীর ঘরের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়লো। অজানা কৌতুহল নিয়ে ঘরের মধ্যে উঁকি দিতেই দেখলো অরণী বিছানার ওপর দু’পা মেলে বসে আছে। দুই পায়ের ফাঁকে মাধূর্যকে বসিয়ে তার চুল বেঁধে দিচ্ছে।
.
“এই তো, আমার ছোট্ট মামনিটার চুল আমি বেঁধে দিয়েছি। আমার মামণিটাকে কেমন লাগছে দেখি!”
.
এতটুকু বলতেই মাধূর্য উঠে দাঁড়িয়ে অরণীর দিকে ঘুরতে গিয়ে আবার বিছানার ওপর ধপাস করে বসে পড়লো। অরণী হাসতে হাসতে মাধূর্যের হাত ধরে উঠে আবার দাঁড়া করিয়ে দিলো। মাধূর্য খিলখিল করে হেসে উঠলো। অরূপ স্বস্তির হালকা করে নিশ্বাস ফেললো। মুচকি হেসে ঘর থেকে বেড়িয়ে নিচে নেমে এলো। মা টেবিলে খাবার সাজিয়ে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে।
.
“আয় বাবা, খেতো বোস। আজকে দেরী হলো কেনো এতো, বাবা?”
.
“অফিসে কিছু সমস্যা হয়েছিলো?” চেয়ার টেনে নিয়ে বসতে বসতে বললো অরূপ।
.
অরূপের মা চোখ বড়বড় করে অস্থির হয়ে বললো, “কি সমস্যা, বাবা? তোকে নিয়ে কোনা সমস্যা? বড় কিছু হইছে বাবা?”
.
অরূপ চোখ সরু করে মায়ের দিকে তাকিয়ে বিরক্তি নিয়ে বললো, “আম্মা, তুমি তোমার সিনেমাটিক রিয়েকশন না দিয়ে আমার সাথে একটু কথা বলবা, প্লিজ?”
.
অরূপের মা ধপ করে নিভে যাওয়া আগুনের মতো ফ্যাকাসে চেহারায় তাকালেন। তারপর অরূপের প্লেটে ভাত তুলে দিতে দিতে কাঁদো কাঁদো স্বরে বললেন, “আমার কথা তোরা কেউ বুঝিসনা! মায়ের টেনশন তোরা কিভাবে বুঝবি?”
.
“আম্মা….” অরূপের ঝাঁঝানি শুনে চুপ করে বসে পড়লেন তিনি।
.
“আমি আর কোনো কথাই বলবোনা। খেয়ে নে চুপচাপ!”
.
অরূপ খেতে শুরু করার পরপরই তার চাচি এলেন খাওয়ার ঘরে।
.
“কিরে অরূপ, এতো দেরী কেনোরে তোর আজকে?”
.
“ওকে কিছু প্রশ্ন করিসনা রেনু। কিছু বললেই ঝাঁঝালো কণ্ঠে উত্তর দেয়!” বলে মুখ ঘুরিয়ে নিলো অরূপের মা।
.
ছোটচাচি হাসতে হাসতে বললেন, “আবার মা-বেটার ঝগড়া লাগছে?”
.
তারপর অরুপের পাশেই চেয়ার টেনে বসতে বসতে বললেন, “ভাবি, মাধূর্যকে যে সারাদিন অরুর কাছে ছেড়ে দিয়েছো; অরণী তো নিজেই একটা বাচ্চা, নিজেরই খেয়াল নিতে পারেনা; ও আবার ওইটুক বাচ্চা সামলাতে পারে?”
.
“আরে আমিই তো ভাবছিলাম, ও সামলাতে পারবেনা। এখন তো দেখতিছি সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ও একাই মাধূর্যকে সামলাচ্ছে!”
.
“ভার্সিটি বাদ দিয়ে যে সারাদিন বাড়িতে পরে আছে, ভাই কোনদিন যে আমার উপর রাগ হয়…”
.
“আমি তো ওকে বলেছিলাম, ভার্সিটি থেকে এসে নাহয় মাধূর্যকে দেখে রাখবে ও। কথা তো শুনেই না!”
.
অরূপ পানির গ্লাস হাতে নিয়ে বিড়বিড় করলো, “দুটো চড় বসায় দিলেই কথা শুনবে!”
.
অরূপের মা চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে বললো, “কি বললি?”
.
“কই কি? কিছুনা!”
.
“ভাবি, আমি বলি কি, অরুর কাছে সারাদিন এভাবে মাধূর্যকে রেখোনা। মাধূর্য তো এখন অরুকে ছাড়া কিছু বুঝেইনা। সেদিন দেখি অরুকেই মা মা বলছে। পরের বাড়ির মেয়ে; একদিন তো চলেই যাবে। তখন যদি মাধূর্য আর ওকে ছাড়া থাকতে না চায়?”
.
অরূপের মা গম্ভীরমুখে মাথা নাড়তে নাড়তে বললো, “কথাটা ঠিকই বলেছিস, রেনু!”
.
অরূপের খাওয়া শেষ। অরূপ কখনো প্লেটে হাত ধোয়না। উঠে গিয়ে বেসিনে হাত ধোয়। আজ অন্যমনস্ক হয়ে প্লেটেই হাত ধুয়ে ফেলে উঠতে উঠতে বললো, “মাধূর্য যদি ওনার কাছে থাকতে পছন্দ করে, তাহলে থাকুক।”
.
ছোটচাচি ঝাড়ি লাগিয়ে বললেন, “অরুর ভার্সিটির পড়া শেষ হলেই তো ও চলে যাবে। আর একটা সেমিস্টার হলেই তো শেষ। তারপর কি করবি?”
.
তারপরের কথা তারপর ভাবা যাবে চাচি।
.
.
অরূপ উপরে উঠে নিজের ঘরে দিকে যেতে গিয়ে অরণীর ঘরে গিয়ে ঢুকলো।
“আপনার ভার্সিটির ক্লাস হচ্ছেনা?”
.
অরূপের আওয়াজ শুনে মাধূর্য উঠে বিছানার চাদর দুহাতে খামচে ধরে আস্তে আস্তে নামলো বিছানা থেকে। তারপর ধপাধপ্ পায় ছুটে এসে “বাবাই… বাবাই…” করে দুহাতে জড়িয়ে ধরলো অরূপকে। অরূপ তাকে কোলে তুলে নিয়ে অরণীর দিকে তাকিয়ে বললো, আপনাকে কিছু প্রশ্ন করেছি।
.
অরণী চমকে উঠে তাকালো অরূপের দিকে। তারপর মাথা নিচু করে ধীরে ধীরে বললো, “জি। হচ্ছে!”
.
“তাহলে ভার্সিটি যান না কেনো?”
.
“এমনি!”
.
“এমনি মানে কি? কাল থেকে যেনো আপনাকে ভার্সিটিতে যেতে দেখি!”
.
অরণী চুপ করে থাকলো। এই ছেলেটার বারণের ওপর কথা বলার শক্তি তার নেই।
.
“কি হলো? কি বলেছি শুনেছেন?”
.
“জি!”
.
“গুড। ভার্সিটি শেষ হলে বাসায় এসে মধুকে নিয়ে থাকিয়েন। ওর জন্য পড়াশুনার ক্ষতি করিয়েন না। পরে তো আপনার বাবা আমাকে কথা শুনাবেন যে, আমার জন্য আপনার ক্ষতি হয়েছে।”
.
“জি আচ্ছা!”
.
“মধু মা… বাবাই চলে এসেছে। এখন আমরা বাবাইয়ের সাথে খেলবো। চলো মা। আন্টিকে বাই করে দাও!”
.
মাধূর্য বললো, “আন্নি খেলবেনা বাবাই?”
.
“না মা, আন্নি ঘুমাবে এখন। আন্নির বাবা বকুনি দেবে নাহলে। আমরা যাই?”
.
“আত্তা। তাতা আন্নি! তাতা! তুমি ঢুমাও।”
.
অরণী হাসলো। “টাটা, মা!”
.
.
অরণী পরদিন ভার্সিটিতে গেলো প্রায় একমাস পর। এই একমাস সে পড়াশুনো থেকে পুরোপুরি বিচ্ছেদ করেছিলো। এখন ভার্সিটিতে এসেই সে বিরাট বড় ধরণীর ধাক্কা খেলো। ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা ডেট দেয়া হয়েছে; রুটিন দেয়া হয়েছে। অথচ সে সিলেবাস পর্যন্ত জানেনা। হঠাত যেনো আকাশ ভেঙে পড়লো তার মাথার ওপর।
.
ফ্রেন্ডদের কাছে হেল্প নিয়ে সব নোটসগুলো জোগাড় করলো সে। পরীক্ষার আগের কয়দিন তাকে কোমর বেঁধে পড়াশুনা করতে হবে; নয়তো পাশ ঠেকানো সম্ভব হবেনা।
.
.
রাতে খেতে বসে অরূপ খেয়াল করলো, সবাই খেতে আসলেও, অরণী আসেনি। ছোটচাচিকে প্রশ্ন করতেই বললেন, অরণীর পরীক্ষা সামনে, পড়তে বসেছে। আমি খাবার দিয়ে আসছি ওর ঘরে!
.
অরূপ কিছু বললোনা। খেয়ে উঠে মাধূর্যকে নিয়ে অরণীর ঘরে গিয়ে দরজায় নক করলো। দরজা খোলাই ছিলো। অরণী বিছানায় হেলান দিয়ে বসে পড়তিছিলো। অরূপকে দেখেই ঠিক হয়ে বসে, ওড়না মেলে নিয়ে বললো, “জি! আসুন। কিছু বলবেন?”
.
“আপনার পরীক্ষা শুনলাম চাচির কাছে। কোনো দরকার হলে আমাকে বলিয়েন! এটাই বলতে এসেছিলাম! আর কয়দিন মাধূর্যকে দেখতে হবেনা আপনার। মা আর চাচি মিলে ওকে দেখে রাখতে পারবেন। আপনি পরীক্ষাটা ভালো করে দিয়েন!”
.
“শুনুন, আমি মাধূর্যের খেয়াল রাখি, আমার ভালো লাগে জন্য। এটা আমার ডিউটির মধ্যে পড়েনা যে আপনি বারণ করবেন।”
.
অরূপ মুচকি হাসলো। কিছু না বলে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলো।
.
.
.
চলবে……