#গ্যাসবেলুন
#পর্ব_৭
লেখাঃ Nobonita Ferdows
.
অরূপের বাইকের সামনে মাধূর্য বসে আছে। অরূপ বাসার সামনে বাইক থামিয়ে নিজে নামলো। তারপর মাধূর্যকে কোলে নিয়ে বাড়ির ভিতরে ঢুকে গেলো। অরণী হতেম চোখে যতদূর হেলা যায়, ছাদের রেলিং ঘেষে হেলে দেখলো। কিছুক্ষণ সময় লাগলো না বুঝে উঠতে। তারপরই ছুটে ছাদ থেকে নিচতলায় নেমে এলো।
.
বসার ঘরের সোফার ওপর মাধূর্যকে বসিয়ে রেখে আন্টিকে ডেকে এনেছে অরূপ। আন্টি মাধূর্যকে দেখেই ছুটে গিয়ে কোলে নিয়ে আদর করতে শুরু করলো!
.
“বুবু, আমার ছোট্ট বুবু, তুমি এসেছো আমার কাছে? আমি তোমার জন্য কত্ত কান্না করেছি। তুমি তো ভুলেই গিয়েছো আমাকে!”
.
বাচ্চা মেয়েটা খিলখিল করে হাসছে। আন্টির গলার চেইনটা টেনে ধরে আধো আধো বুলিতে “বু.. বু… বু…” বলেই যাচ্ছে।
.
“মা, মাধূর্য এখন থেকে আমার কাছেই থাকবে!” অরূপ এতটুকু বলেই গলার টাই টেনে ঢিলা করতে করতে সিড়ি দিয়ে উপরে উঠে গেলো।
.
বাড়ির কেউ এই নিয়ে কোনো কথা বললোনা। ছোটফুপু আন্টির পাশে গিয়ে বসলো।
.
“ভালোই হলো ভাবি। অরূপটা কেমন নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলো। মাধূর্য এবাড়িতে থাকলে যদি একটু স্বাভাবিক হতে পারে।”
.
আন্টি নাতনীকে কোলে নিয়ে খেলা করতে করতে হাসছিলো। হঠাত হাসি থামিয়ে বিড়বিড় করলো, “রেনু, মাধূর্যকে সবসময় সামনে দেখলে পুরোনো কথা না ছেলেটার মনে পড়ে যায়!”
.
“আরে ভাবি, তুমি দুশ্চিন্তা কোরোনা। এখন মাধূর্য্যের জন্যেই দেখো অরূপ আবার বিয়ে করতে রাজি হবে।”
.
অরূপ সিড়ি দিয়ে নামতে নামতে বললো, “সেই আশায় থেকোনা ছোটচাচি। আমি আমার মেয়ের খেয়াল একাই রাখতে পারবো। মায়ের অভাব হবেনা ওর!”
.
অরূপ কথাগুলো অরণীর দিকে তাকিয়েই বললো। অরণী ব্যাপারটা খেয়াল করে যেনো বসার ঘর থেকে বের হয়ে নিজের ঘরে চলে গেলো।
.
অরূপ উৎফুল্ল মনে এসে মাধূর্যকে কোলে নিয়ে বললো, “আমার মায়ের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করো তো চাচি। তোমাদের কলকাতার সিরিয়াল টাইপ আলোচনা এখন বাদ দাও।”
.
“সিরিয়ালের কি পাইলি তুই এখানে?” মুখ কালো করে বললো চাচি।
.
“এই যে তোমাদের মাথায় সারাদিন বিয়ে বিয়ে ঘুরে। আম্মা তো এখন সিরিয়ালের মহিলাগুলার মতো কান্না শুরু করে দিবে।”
.
অরূপের কথাকে সত্যি করে অন্তুর মা সত্যি সত্যি মুখে আঁচল চেপে কান্না শুরু করলো।
“তোরা তো বুঝবিনা মায়ের কষ্ট। সব মায়ের কত শখ থাকে, ছেলের বউ নিয়ে সংসার করবে। এই বয়সে সংসারের হাল ছেড়ে নাতি নাতনিকে নিয়ে সময় কাটাবো; তা না, আমাকে এই বয়সেও একা এই সংসারের হাল টেনে যেতে হচ্ছে!”
.
অরূপ ঠাট্টার স্বরে বললো, “ছোটচাচি শোনো, তোমার ভাবি তোমাকে ইন্ডাইরেক্টলি কিভাবে অপমান করলো। তুমি নাকি সংসারের জন্য জন্য কিছু করোনা। ছি ছি ছি, চাচি, অপমান… অপমান….”
.
“তুই কিন্তু মার খাবি, অরূপ। মা কাঁদতিছে, আর তুই ফাজলামি করতিছিস?”
.
“আচ্ছা আচ্ছা, যাও তুমি খেতে দাও। আমি আম্মাকে নিয়ে যাচ্ছি।” হাসতে হাসতে বললো অরূপ।
.
“মধুমা, দেখোতো বুবু কাঁদতিছে। ভালো মেয়েরা কাঁদে বলো? যাও তো বুবুকে আদর করে দিয়ে আসো।”
অরূপ কোল থেকে নামিয়ে দিলো মাধূর্যকে। মাধূর্য গুটিগুটি পায়ে হেঁটে তার বুবুর কাছে গিয়ে ছোট্ট ছোট্ট হাতে বুবুর চোখ মুছে বললো, “তাঁদে না, বু..বু.. তাঁদেনা!”
.
অরূপ হেসে ফেললো মেয়ের কান্ড দেখে। অরণী দোতলার সিড়ির মাথায় রেলিং এর ওপর হাত রেখে নিচের সবাইকে দেখছে। এবাড়িতে আসার পর থেকে সে এই বাড়ির মানুষগুলোকে এত হাসিখুশি কখনো দেখেনি। মানুষগুলোর মধ্যে এতদিন যেনো প্রাণ ছিলোনা! সে সবচেয়ে বের অবাক হচ্ছে অরূপকে দেখে। এই মানুষটাও যে পরিবারের সবার সাথে এত হাসিখুশি থাকতে পারে তা তার ধারণার বাইরে ছিলো।
.
.
“আম্মাজান উঠেন এখন। সিরিয়ালি কান্না বন্ধ করে খাইতে আসেন!”
.
“তুই যা। খেয়ে নে। আমি মাধূর্যকে খাওয়ায় দেই আগে।”
.
অরূপ খেতে চলে গেলো। এই ভরদুপুরে বাসায় তেমন কেউ নেই। অরূপ একাই খেতে বসলো। অরণী বাড়িতেই ছিলো; ওর কথা যেনো সবাই ভুলেই গেলো।
.
.
পরদিন সকালে অরণীর ঘুম ভাঙলো সাড়ে দশটায়৷ নিচে নেমে দেখলো ডাইনিং রুমে, বসার ঘরে, রান্নাঘরে কোথাও কেউ নেই। অরণী ছোটফুপুকে খুঁজতে খুঁজতে পুরো একতলায় কাউকে না পয়ে দোতলায় উঠে এলো। অরূপের ঘর থেকে খিলখিল হাসির আওয়াজ আসছে। অরণী অরূপা ঘরের সামনে এসে কিছুটা ইতস্তত করে দরজায় ধাক্কা দিতেই ভেজানো দরজা খুলে গেলো। অরূপের ঘরের মেঝেতে আন্টি আর মাধূর্য বসে আছে। মেঝের ওপর নানান খেলনা পুতুলের, বলের ছড়াছড়ি। মাধূর্যের সাথে খেলতে খেলতে আন্টিও যেনো বাচ্চা হয়ে গিয়েছেন। অরণীকে খেয়াল করে আন্টি বললো, “ঘুম হলো, মা? বাসায় কেউ নেই আজ। সবাই সবার কাজে চলে গিয়েছে। আর রেনু গেলো পাসপোর্ট অফিসে; কি যেনো দরকার আছে ওর!”
.
“জি আন্টি, আমি নিচে কাউকে খুঁজে না পেয়ে এখানে এলাম।”
.
“নাতনি এসেছে তো মা, আর কোনোদিকে খেয়াল নেই। তুমি বসো একটু ওর কাছে, আমি তোমার নাস্তা এখানে নিয়ে আসছি।”
.
আন্টি উঠে দাঁড়াতেই মাধূর্য্য আন্টির শাড়ি টেনে ধরে ঠোঁট উল্টে ফেললো। এটা হলো কান্নার প্রস্তুতি।
“তোতায় যাও?”
“আমি একটু খেতে দেই এই আন্নিটাকে! তুমি আন্নির কাছে বসে থাকো। কান্না কোরোনা আবার!”
.
মাধূর্য গোলগোল চোখে মাথা তুলে অরণীর দিকে তাকিয়ে একবার দেখলো। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বুবুর হাত ধরে বললো, “আমিও যাবো তোমার সাতে!”
.
অরণী আধো আধো বুলি শুনে হেসে ফেললো। মাধূর্যের কাছেই মেঝের ওপর বসে বললো, “কেনো মা, আমাকে তোমার ভালো লাগেনি? তুমি খেলবেনা আমার সাথে?”
.
“না।” ডানে-বায়ে জোরে জোরে মাথা ঝাঁকিয়ে উত্তর দিলো সে।
.
অরণী বাচ্চাদের মতো করে বললো, “তাহলে তো আমি কান্না করবো।।। ভ্যাএএএএএ… ভ্যাএএএ… মাধূর্য খেলেনা আমার সাথে… ভ্যাএএএ… ” দুহাতের আঙ্গুল মুটিয়ে চোখ ঘষতে ঘষতে কান্নার ভাব করলো অরণী।
.
অভিনয় কাজে দিলো। মাধুর্য বুবুর হাত ছেড়ে দিয়ে অরণীর কাছে গিয়ে বসে বললো, “তাদেনা, তাদেনা। আমি তেলবো তো। আমি তেলবো তোমার সাতে।”
.
অরণী চোখ থেকে হাত সরিয়ে হেসে ফেলে মাধূর্যকে টেনে কোলের ওপর বসালো।
.
আন্টি হাসলো। “মেয়ে সারারাত মায়ের জন্য কাঁদছে। নিজেও ঘুমায়নি আমাকেও ঘুমাতে দেয়নি। মা কোথায়, মা কোথায় করে অস্থির হয়ে গিয়েছিলো। পরে এটা ওটা বলে ঘুম পাড়িয়েছি।”
.
অরণী বললো, “ওর মা কি ওকে একেবারে দিয়ে দিয়েছেন? সেদিন মার্কেটে তো দেখলাম, উনার মেয়েকে নিয়ে বেশ দম্ভ ওনার। অরূপের কোলেও দিতে চাচ্ছিলেন না!”
কথাটা বলেই অরণী দাঁতে জিহ্বা কাটলো। অরূপের নাম ধরে বলায় আন্টি না আবার কি মনে করেন ভেবে আন্টির দিকে অস্বস্তি নিয়ে তাকালো।
.
আন্টি হয়তো সেভাবে খেয়াল করেননি। তিনি প্রশ্ন করলেন, “মার্কেটে শ্রেমার সাথে দেখা হয়েছিলো তোমাদের?”
.
“হ্যাঁ আন্টি!”
.
“থাক। যা হইছে ভালোই হইছে৷ বিয়ে করে সংসার করতিছে; মাঝখান থেকে আমার ছেলেটাকে কষ্ট দিয়ে গেলো শুধু শুধু।”
.
“উনি আবার বিয়ে করেছেন?”
.
“না। করবে। যার জন্য ডিভোর্স নিলো, সেই ছেলে নাকি এখন বাচ্চাসহ মেনে নিচ্ছেনা৷ তাই মেয়েকে দিয়ে দিছে।”
.
অরণী চমকে উঠে বললো, “একটা ছেলের জন্য নিজের সন্তানকে দিয়ে দিলো?”
.
“আজকালকার মেয়েরা মা, সম্পর্ক ভাঙ্গতে-গড়তে দ্বিধা করেনা। এদের কাছে নিজের মেয়েরও গুরুত্ব নাই! আমাদের সময় মেয়েরা স্বামীর অত্যাচারে থেকেও সংসার আঁকড়ে পড়ে থাকতো। আর আজকাল…”
আন্টি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।
.
অরণী চুপ করে মাধূর্যের দিকে তাকিয়ে থাকলো। কি নিষ্পাপ একটা মুখ। এখনও জীবনের এতসব জটিলতার কিছুই বোঝায় বয়স হয়নি, তাতেই তার জীবনে কতকিছু ঘটে যাচ্ছে।
.
“কিছু মনে করিওনা, মা। ছেলেটাকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকি সবসময়। কাউকে কিছু বলতেও পারিনা। তোমাকে নিজের মেয়ের মতোই দেখি। তাই কটা কথা বলে ফেললাম! থাকো তুমি বুবুর কাছে। আমি তোমার জন্য খাবার গরম করে আনি!”
.
অরণী মাধূর্যকে নিয়ে খেলতে শুরু করলো। কেবল জীবনের শুরুতেই মা থেকেও মাকে হারালো মেয়েটা। অরণী মাধূর্যের ডানহাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে ধীরে ধীরে বললো, “উনাকে নাহয় নাইবা পেলুম, তুই তো আমার মেয়ে হতে পারিস। আমায় মা ডাকবি?”
.
মাধূর্য কি বুঝলো কে জানে! ড্যাবড্যাব করে অরণীর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বললো, “তুমি জানো মা তোতায়?”
.
অরণী কি বলবে বুঝতে না পেরে বললো, “মা আছে তো। তোমার কাছেই আছে?”
.
“তোতায়? মা তোতায়?”
.
“আমি খুঁজে দেবো তোমার মা কে। চলো আমার পুতুল খেলি! মা চলে আসবে!”
.
মাধূর্য প্লাস্টিকের ছোট্ট চিরুনী দিয়ে পুতুলের চুল আঁচড়ানোয় মনোযোগ দিলো।
.
.
.
চলবে..