গোলকধাঁধা পর্ব-১১

0
455

#গোলকধাঁধা
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১১

সিরাত নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে
ভাবলো এই লোকটা পাগল; জীবনেও শোধরানোর নয়। সেইসাথে প্রচন্ড হাসিও পেলো ওর। লোকটা
এত অদ্ভুত কথা বলে মাঝেমধ্যে যে ও দ্বিধায়
পড়ে যায়। কখনো ভয়ও হয়! ও হাসার প্রচেষ্টা
করে বলল,
‘এসব আবার কেমন প্রতিজ্ঞা আপনার? এরকম
কেউ বলে?’
‘আমি বলি। কারণ আমার লক্ষ্য তো এটাই, তোমার জীবন উলটপালট করে দেওয়া। কেন,
তুমি বুঝি জানতে না?’
সিরাত আলতো হেসে বলল,
‘মানে? বুঝিনি কি বলতে চাচ্ছেন।’
প্রত্যয় গমগমে কন্ঠে বলল,
‘সিরাত, ইদানীং বুদ্ধিসুদ্ধি লোপ পেয়েছে তোমার। ব্যাপারটা কী?’
‘কিছু না। আসলে আমি কনফিউজড হয়ে গেছি
একেক সময় একেক কথা বলছেন।’
প্রত্যয় ওর গাল টেনে ধরলো,
‘প্রেমে পড়ে গেছেন মিসেস?’
সিরাত লাল হলো। নতমুখে আওড়ালো,
‘এটাই কি স্বাভাবিক নয়? ভালোবাসা আসবে এটা
তো হওয়ারই।’
প্রত্যয় ওকে ছেড়ে দিলো৷ এরপর অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ওকে ঘাবড়ে দিতে হো হো
করে হেসে বলল,
‘আমি তোমাকে সত্যিই সবার থেকে আলাদা ভেবেছিলাম সিরাত। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে তুমিও সব মেয়েদের মতো।’
সিরাত ভীষণ বিস্মিত হলো,
‘আমি বুঝতে পারছি না আপনি এত অবাক
হচ্ছেন কেন? এতদিন ধরে স্বামী-স্ত্রী হিসেবে আমরা আছি। অন্য সবার মতো স্বাভাবিক ভাবেই আমাদের সম্পর্ক এগিয়ে গেছে। এখন আপনি বলছেন আমি অন্য সবার মতো? মানে কি?’
প্রত্যয় শব্দ করে নিঃশ্বাস ফেললো। গা এলিয়ে দিলো হেডবোর্ডে। একটু সময় চুপ থেকে এরপর ভ্রু
সোজা করে বলল,
‘তোমাকে আজ কিছু বলি, হুঁ! রাজনীতি করা আমার স্বপ্ন ছিলো। কত ঝড় ঝাপটা পেরিয়ে ক্যারিয়ারটা গুছিয়েছি সেটা তুমি চিন্তাও করতে পারবে না। অথচ সেটা তোমার জন্য নষ্ট হতে বসেছিলো। আমার জীবনে তোমার জন্য সবচেয়ে বেশি সমস্যা হয়েছে সেটা কি জানো তুমি? এত এত সমস্যা যে, একটা সময় আমার মনে হতো তোমার লা’শ ফেলে দিই।’
সিরাত আঁৎকে ওঠলো। নির্বাক হয়ে তাকিয়ে রইলো ওর দিকে। ভালোই তো এতক্ষণ কথা বলছিলো দু’জন। তাহলে এখন এসব উদ্ভট কথা বলছে কেন লোকটা?
প্রত্যয় কপালে হাত ঘষে আবারও বলল,
‘তবে সেটা করিনি। নেহাৎই তুমি মেয়েমানুষ, তাই।
কিন্তু ব্যাপারটা একসময় এত এত বাড়াবাড়ি পর্যায়ে নিয়ে গেলে যে তোমাকে চরম একটা শিক্ষা না দেওয়া অবধি শান্তি পাচ্ছিলাম না। একটা কথা কি জানো, তোমাকে হাতে মেরে কাপুরুষের তকমা পেতে চাইনি। সেজন্য সহজভাবে এগিয়েছি। তোমাকে দুর্বল জায়গায় আঘাতটা করতে চেয়েছি। আই মিন পরিবার, বিয়ে,স্বামী, ভালোবাসা এসব জিনিসকেই অস্ত্র
হিসেবে নিয়েছি। শারীরিক ভাবে নয় আমি তোমাকে মানসিকভাবে ভাঙতে চেয়েছি। আর দেখো এটা কিন্তু ম্যাজিকের মতো কাজ করেছে।’
প্রত্যয় এটুকু বলে থামলো। সিরাতের চোখ জ্বলজ্বল করছে। কি হলো এটা? প্রত্যয় প্রথম প্রথম ওকে কষ্ট দেওয়ার চেষ্টা করলেও একটা পর্যায়ে নিজের ভুলগুলো শুধরে নিয়েছিলো। তাহলে এতদিন কি ও অভিনয় করে গেছে? আর অপেক্ষা করেছে সিরাত কবে দুর্বল হবে ওর ওপর? এটাই ওর ইচ্ছে ছিলো। আজ যেই মনের কথাটা সাহস করে বলে দিলো তখনি সিরাতের অনুভূতিকে মিথ্যে প্রমাণ করে দিতে চাইছে? ওর মাথা যেন ভার হয়ে এলো। মস্তিষ্ক ফাঁকা লাগছে।
সময় নিলো একটু। অভিনয় নাকি বাস্তব বোঝা কঠিন। তবুও ও আড়ষ্ট হেসে বলল,
‘সত্যিই আপনি আমাকে ভেতর থেকে ভেঙে
দিয়েছেন।’
প্রত্যয় চোখমুখ শক্ত করে বসে রইলো। কেমন অদ্ভুত লাগছে এসব স্বীকার করে। বলল,
‘অবশেষে নিজের কার্যে সফল হয়েছি
তাহলে?’
সিরাত নির্লিপ্ত কন্ঠে বলল,
‘অবশ্যই মিস্টার প্রত্যয়। তবে আমারও কিছু বলার আছে।’
প্রত্যয় ক্ষীণ স্বরে বলল,
‘শুনছি।’
‘আসলে আমি ভেবেছিলাম যেমনই হোক আপনি তো আমার স্বামী। কোনো বিপদ হোক বা খারাপ কিছু ঘটুক তা চাইনি। সবসময় যাতে ভালো কাজ করেন, ভালো থাকতে পারেন তাই চেয়েছি। আমি আপনার সাথে সুখী হতে চেয়েছিলাম। এর বেশিকিছু নয়।’
প্রত্যয় চোখেমুখে অনুশোচনার রেশ ফুটে ওঠলো।
ছোট গলায় সে বলল,
‘এত সহজে? আমি তো শত্রু ছিলাম।’
সিরাত মলিন হাসলো। এরপর বলল,
‘এগুলো তো সম্পূর্ণই মনের ব্যাপার। মন যখন-তখন প্রেমে পড়ে যেতে পারে। হোক সে শত্রু বা মিত্র! কিন্তু
চমকপ্রদ ব্যাপারটা কি জানেন? আপনি আমাকে মেরে কাপুরুষের তকমা পেতে চান নি। কিন্তু যা করেছেন তা কাপুরুষের থেকেও অধম! আমি সবকিছু ভুলে যাকে আপন করতে চাইলাম সে-ই আমায় পর করে দেবে ভাবিনি। মন ভাঙার কষ্টটা তবে আমি সামলে নিতে পারবো আশা করি। কিন্তু আর কখনোই বিশ্বাস
করবো না।’

সিরাত ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। প্রত্যয় ভেতরে ভেতরে চমকালো। সিরাত এত ঠান্ডা আচরণ করবে সে ভাবেনি। ধারণা করেছিলো ও বেশ হুলস্থুল করবে, চেঁচামেচি করে বাড়ি মাথায় করে সিনক্রিয়েট করবে। কিন্তু না! মেয়েটা এত শান্তভাবে কথাগুলো বলে
দিলো যে এখন ওর নিজেরই অস্বস্তি হচ্ছে।
প্রত্যয় বিমূর্ত ভঙ্গিতে বিছানায় বসে ছটফট করতে লাগলো। নিজেকে কেমন ছোট মনের মনে হচ্ছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো দেড়টা বাজে। সিরাত এখনো ঘরে আসেনি। ওর তো আরও কিছু বলার আছে, সেগুলো শুনবে না সিরাত? আচ্ছা, রাগ করে আবার বেরিয়ে গেছে নাকি বাড়ি থেকে? আশঙ্কা বাড়লো ওর। হতচকিত হয়ে ছুটে গেলো। সারাবাড়ি ঘুমে ডুবে আছে, কোথাও কেউ নেই। গেলো কোথায় মেয়েটা? হন্তদন্ত হয়ে দারোয়ানকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানতে পারলো সিরাত বাইরে যায়নি। প্রত্যয় ভালো করে খোঁজ নিয়ে
দেখলো সিরাত প্রত্যাশার ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে।
ও মুখভার করে দাঁড়িয়ে থাকলো বাইরে। এতগুলো দিন একসাথে থেকেও কখনো একে-অপরকে বলা হয়নি ভালোবাসি। কিন্তু প্রত্যয় জানে এতদিনে সে নিজেও সিরাতের প্রতি দুর্বল এবং নির্ভরশীল। ওকে ছাড়া ওর রাতে ঘুম হয় না, অস্থির লাগে, জীবন দুর্বিষহ মনে হয়। এগুলো যে ভালোবাসার অন্য রুপ সেটা সে জানে। ধরা দিতে চায় না সিরাতকে। কিন্তু আজ তো ভালো মনেই ও নিজের কুরুচিপূর্ণ দিকটা তুলে ধরেছিলো সিরাতকে, যাতে নিজের মনের ভার কমে যায়। কিন্তু ভার কমার বদলে দূরত্ব বাড়িয়ে দেবে তা তো ভাবেনি। প্রত্যয়ের ইচ্ছে করলো ট্রেনের নিচে মাথা দিয়ে ম’রে যেতে। সবসময় সব সত্যি জানাতে নেই।

এরপর সিরাত কেমন পাল্টে গেলো। প্রত্যয়কে এড়িয়ে চলতে শুরু করলো। ওর কোনো কাজ গোছগাছ করে দিতো না, কোনোভাবেই ওর সামনে পড়তে চাইতো না। নির্বাচনের কাজে ব্যস্ত প্রত্যয় সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে বাড়ি এসে দেখতো সিরাত আগেভাগেই খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে নিজের মতো করে। অথচ মেয়েটা এতদিন ওকে একা করে কখনোই খেতো না। এরমধ্যে মাস দেড়েক কেটে গেলো। বাড়ি ফিরে অন্যদিনের মতোই আচরণ পেলো সিরাতের থেকে। প্রত্যয় এতদিন সব মেনে নিলেও আজ কেন যেন ব্যাপারগুলো হজম করতে পারলো না। কোমড়ে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো বহুক্ষণ। এরপর সিরাতকে টেনে এনে বুকে জড়িয়ে শুয়ে পড়লো। ঘুম ভেঙে গেলো সিরাতের। ধরফড়িয়ে ওঠে বসে অগ্নিময় চোখে তাকালো। প্রত্যয় কথা বলার চেষ্টা করলেও সিরাত দূরে সরে গেলো। বিরক্তি নিয়ে দু-হাত জড়ো করে বলল,
‘সব প্রতিশোধ নেওয়া হয়ে গেলে আপনি অতি শ্রীঘ্রই তালাকের ব্যবস্থা করুন। এক খাটে কোনো কাপুরুষের সাথে ঘুমাতে হয় ভাবলেই আমার বমি পাচ্ছে। সরুন তো।’
চোখমুখ কুঁচকে দৌড়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো সিরাত। এরপর বের হয়ে ওড়নায় হাতমুখ মুছেই বালিশ নিয়ে ডিভানে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। প্রত্যয় হতভম্ব হয়ে বসে থাকলো। নিজের মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে। কপাল দোষে আজ তার এই দশা। কেন সে ওসব স্বীকার করতে গেছিলো? এমনিতেই তো ভালো
ছিলো সবকিছু!

________________________

নতুন দিনের সূচনা। রাতে বোধহয় বৃষ্টি নেমেছিলো। চারদিকে কেমন উদাসী ঠান্ডা হাওয়া বইছে। রোদ নেই। ফোনের শব্দে ঘুম ভাঙলো প্রত্যয়ের। বিরক্তি নিয়ে রিসিভ করে সব বুঝিয়ে দিলো ওপাশের ব্যক্তিটিকে। ফোন রেখে ঘাড় ফেরাতেই সিরাতকে ডিভানে বসে থাকতে দেখলো। ভাবলেশহীন ভাবে চা খাচ্ছে। মুখ দেখে মনে হচ্ছে পৃথিবীর কোথাও অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু ঘটতে চলেছে। প্রত্যয় ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো। এরপর দু’বার ডাকলো ওকে, সাড়া পেলো না। সিরাত বেরিয়ে গেলো। হতাশ প্রত্যয় ওঠে ফ্রেশ হয়ে নিলো। পাঞ্জাবি বের করে রেডি হতে হতে ভাবলো কিভাবে, কি করলে মহারানীর মন পাবে সে! আর তো এই বিরহ সহ্য করা যাচ্ছে না। বউয়ের মন জয় করার চেয়ে নির্বাচনে জয় পাওয়া সহজ।

বাইরে হালকা বৃষ্টি নেমেছে। প্রত্যয় ড্রাইভারকে তাড়া দিলো গাড়ি বের করতে। একেবারে রেডি হয়ে দোতলা থেকে নামার সময় সে দেখলো সিরাত ছাড়া বাড়ির সকলে ডাইনিং এ অপেক্ষা করছে ওর জন্য। সবার মুখ জ্বলজ্বল করছে। মুশফিকা চৌধুরী ছেলেকে দেখে আহ্লদে ফেটে পড়ে বললেন,
‘আব্বা, আমার আব্বা এদিকে আসো।’
প্রত্যয় বুঝলো না কিছুই। আমির সাহেব গমগমে স্বরে হেসে ওঠলেন,
‘এসো এসো, মিষ্টিমুখ করো।’
প্রত্যাশার চেহারাও খুশি খুশি। যেটা সচরাচর থাকে না। প্রত্যয়ের চোখ এতক্ষণে টেবিলের দিকে পড়লো। নানা পদের মিষ্টান্ন রাখা ওখানে, যেন দোকান বসেছে। কাজের লোকগুলো পর্যন্ত খুশি। কিন্তু কোথাও সিরাতের টিকিটিও নেই। প্রত্যয় কিছুই ধরতে পারছে না। ভ্রু কুঁচকে মা’কে সে জিজ্ঞেস করলো,
‘ব্যাপার কি? নির্বাচন তো আরও সাতদিন পরে। এখনও তো জয়লাভ করি নি, তাহলে এত আনন্দ-উৎসব কোন হিসেবে?’
আমির সাহেব উচ্চস্বরে হেসে ওঠলেন,
‘আমার গাধা ছেলে কি বলে শুনলে?’
মুশফিকা চৌধুরী হাসতে লাগলেন। পুত্রকে দ্বিধান্বিত দেখে তিনি বেশ মজা পাচ্ছেন। প্রত্যাশা ঢুস করে ভাইয়ের মুখে মিষ্টি ঠেসে দিয়ে হাসিমুখে বলল,
‘তুমি বাবা হতে চলেছো ভাইয়া। এই নাও মিষ্টি খাও!’
প্রত্যয়ের গলায় মিষ্টি আটকে গেলো বোনের কথা শুনে। চোখ কপালে ওঠলো ওর। সবাই কি মজা করছে ওর সাথে? কাশতে থাকলো সে। মুশফিকা চৌধুরী হন্তদন্ত হয়ে পুত্রকে পানি খাইয়ে দিলেন। প্রত্যয়ের গলা দিয়ে আওয়াজ বেরুচ্ছে না উত্তেজনায়। কোনোমতে মুশফিকা চৌধুরীকে জিজ্ঞেস করলো,
‘মা আমার বউ কই?’

[ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আশা করি।]

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে