#গোধূলী_রাঙা_দিগন্ত
#পর্বঃ৭
#লেখিকাঃফারিহা_খান_নোরা
সময় বহমান!এ বাড়িতে আসার দুই দিন হয়ে গেলো অথচ ও বাড়ি থেকে এখন পর্যন্ত কেউ আরিবাকে নিতে আসেনি। প্রণয় আরিবাকে নিয়ে এসেছিলো কথা ছিলো তাঁরা দুইজন তিন দিন থেকে একসাথে চলে যাবে কিন্তু কপাল! কথায় আছে না জোর করে কোনো সম্পর্ক জোড়া লাগে না। প্রণয় সেই রাতেই চলে যায় রাত বারোটায় খবর আসে নাজমা শেখ নাকি প্রণয় প্রণয় করে কেঁদে কুটে সারাবাড়ি মাথায় তুলছে।প্রণয় না যাওয়া অবধি পানি পর্যন্ত স্পর্শ করবেন না। এসব শুনে মা ভক্ত প্রণয় সাত দিনের বিয়ে করা বউকে ফেলে সেই রাতে চলে যায় মায়ের কাছে তারপর থেকে ও বাড়ির সাথে আরিবার কোনো যোগাযোগ নেই।
ও বাড়ি থেকে আসার তৃতীয় দিন সকাল দশটায় আরিবার ঘুম ভাঙে। এ বাড়িতে এসে একের পর এক অবাক হচ্ছে আরিবা আগে যে মা কথায় কথায় বকতো সেই তিনি কিনা আরিবাকে কিছুই বলে না। এতো বেলা করে ঘুম থেকে উঠেছে অথচ তার মা কিছুই বলল না ,আগে হলে এতোক্ষণ কতো বকা খেতে হতো। অথচ এখন সামনে চা নাস্তা দিয়ে রেখেছে। খেতে খেতে ফোনে কল আসে।ফোন তুলে দেখে প্রেমা কল করেছে।
‘হ্যালো’
‘কি ব্যাপার ভাবি ও বাড়িতে যেয়ে আমাদের ভুলেই গেছো।’
‘না সেরকম কিছু না। তা তোমরা কেমন আছো?’
‘আলহামদুলিল্লাহ্। কিন্তু তুমি চলে যাওয়ার পর থেকে আর ভালো লাগছে না।এই এক সপ্তাহই কি মায়ায় ফেলেছ তুমি আমাকে।না জানি ভাইয়াকে কি করেছ?’
ওমনি ওপাশ থেকে পুরুষালী কাশির শব্দ পাওয়া যায়।আরিবা সচেতন কন্ঠে বলে,
‘পাশে তোমার ভাইয়া আছে নাকি?’
প্রেমা দাঁত বের করে প্রণয়ের দিকে তাকায়। প্রণয় রক্তচুক্ষ বের করে।প্রেমা বলে,
‘হ্যা শুরু থেকেই।’
আরোও কিছু বলতে যাবে তার আগেই প্রণয় ফোনটা প্রেমার থেকে নিয়ে কল কেটে দেয়।প্রেমা বুজতে পেরে দৌড় দেয়।
_____________________________
স্বন্ধ্যায় চায়ের আড্ডায় হাসান সাহেব ও রেবা বসে আছেন।আজ একটু তাড়াতাড়িই এসেছে।রেবা বেগম স্বামীকে চা দেয়।মেয়ে এসেছে বলে হাসান সাহেব বেজায় খুশি।
‘তোমাকে আজ খুশি খুশি লাগছে আরশির বাবা?’
‘মেয়েটা আমার কাছে থাকলে খুশি লাগে।এই যেমন এখন, কথা না হয় নাই বলল কাছে তো আছে। দেখলেই চোখ জুড়িয়ে যায়।’
‘মেয়ে বিয়ে দিয়েছ কাছে রাখার জন্য? প্রণয় সেদিন রাতেই আরিবাকে রেখে গেছে।তিন দিন হলো কোনো খোঁজ খবর নাই।প্রণয়ের সাথে আরিবার সম্পর্ক স্বাভাবিক না। ভুলে যেও না আরশির বাবা মেয়ে যখন বিয়ে দিয়েছ তখন পরের বাড়িতেই থাকতে হবে ওটাই তার আসল বাড়ি।’
রেবা বেগমের চিন্তিত কন্ঠস্বরে বলা কথায় হাসান সাহেবের হাসিখুশি মুখটা মলিন হয়ে গেল।রেবার কথা শুনে খারাপ লাগলেও রেবা কিন্তু ভুল কিছু বলে নি।
আরিবা দরজার আড়াল থেকে সব শুনে ফেলে।তার মনটা আরও খারাপ হয়ে যায়।বিয়ের পর মেয়েদের নিজের বলতে বুঝি কিছু থাকে না।চেনা পরিচিত পরিবার এক সময় যা নিজের বলে দাবি করতো সেই বাবার বাড়িও পর হয়ে গেলো? এই যেমন তার কাছে লাগছে।
__________________________
প্রণয় ড্রয়িং রুমে বসে আছে।সামনে তার মা ভাত নিয়ে ছোট বাচ্চাদের মত ঘ্যান ঘ্যান করছে।প্রণয় পড়ছে মহা ফ্যাসাদে,এই মাকে সে চিনে না।তার মা তিন দিন যাবৎ এমন বাচ্চামো করছে সে বিশ্বাসই করতে পারছে না।এই তিন দিন হলো প্রণয়কে তিনি ওয়াসরুম ব্যাতিত কোথাও যেতে দেন নি।এমনকি রাতে শোবার সময় ও বার বার এসে দেখে যায়।কি যন্ত্রনা! এদিকে আরিবাকে এই বাড়িতে নিয়ে আসার কথা উঠতেই ঘ্যান ঘ্যান শুরু হয়ে যায়।
আরমান শেখ স্ত্রীর এমন অভিনয় দেখে অতিষ্ঠ।সারাটা জীবন এমন অভিনয়ে সে অভ্যস্ত কিন্তু প্রেমের বিয়ে তাই তেমন কিছু করতেও পারেন। আরিবাকে ও বাড়ি থেকে নিয়ে আসতে হবে।না জানি ওনারা কি ভাবছে ।মান সম্মানের প্রশ্ন। না পেরে সিদ্ধান্ত নেয় তিনি নিজেই আরিবাকে নিয়ে আসবেন। নাসিমা যে,প্রণয়কে যেতে দিবে না সে নিশ্চিত।
__________________________
বিকাল বেলায় আরমান শেখ এ বাড়িতে আসলেন। হাসান সাহেবের সাথে ফোনেই কথা হয়েছিল তার।সে অনুযায়ী রেবা বেগম দুপুর থেকে বড় মেয়েকে নিয়ে রান্নার আয়োজন করেছেন।তার মনও খুব একটা ভালো নেই মাথার ভিতর একটাই প্রশ্ন প্রণয় কেন এলো না। নতুন জামাই এভাবে মেয়েকে জামাই ছাড়া যেতে হবে এটা মানতে পারছে না।
সবুজ রঙের জামদানি শাড়ি পড়ছে আরিবা।লম্বা চুল গুলো ছেড়ে দেওয়া। মুখে হালকা মেকাপ,চোখে গাড় কাজল আর ঠোঁটে ডার্ক রেড লিপস্টিক।হাতে কানে গলায় ছোট ব্যাবহারের অলংকার যা শশুড়বাড়ি থেকে পাওয়া। বসে থেকে জীবণের ছক কষছে সে।সব মেয়েদেরই নিতে আসে বর আর তাকে নিয়ে যেতে এসেছে তাঁর শশুড় অদ্ভুত না?
‘স্যার প্রণয় বাবা এলো না কেন?’
হাসানের প্রশ্নের উত্তর সাথে করেই নিয়ে এসেছে আরমান শেখ।তিনি হাসি মুখে বললেন,
‘ও কাজে আটকে পড়েছে।আর কি স্যার স্যার বলছো তখন থেকে শুনি? এখন আমাদের একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। আমারা এখন বেয়াই তাই স্যার স্যার বলা বন্ধ করো।’
হাসান সাহেব মুগ্ধ হলেন এমন ব্যাবহারে।আরিবা আসতে আসতে কথা গুলো শুনতে পায় সে জানে তার শশুড় মোটেও সত্য কথা বলছে না।কারণ প্রেমা তাকে ও বাড়ির কাহিনী বলেছে। প্রণয় কাছে আটকে পড়েনি বরং মায়ের পিছু পিছু মুরগীর বাচ্চার মত চ্যাও চ্যাও করছে।আরিবাকে দেখে আরমান শেখ হেঁসে বললেন,
‘এইতো আমার মা এসেছে।বাবার কাছে এসে বসো মা।’
আরিবা সালাম দিয়ে বসে পড়ে।মুখের সামনে তাঁর বাবার হাসি মুখের দিকে চোখ যায়। আরিবার ভিতর থেকে অস্থির হয়ে পড়ে।আসার পর থেকে বাবার সাথে সে কোনো কথাই বলেনি।মায়ের সাথে টুকটাক বলেছে।তবে বাবাকে পুরোপুরি ইগনোর করেছে।আজ সে শশুড়বাড়ি যাবে এ বাড়ির সবাইকে সে খুব মিস করবে।বাবা মাকে দেখে মনে হচ্ছে এখনি তাদের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে মনের তার অশান্তি দূর করুক কিন্তু না,এ অশান্তিতে তার বাবাই তাকে ফেলেছে।
রেবা বেগম ও আরশি রাতের খাবার পরিবেশন করছে। আরমান শেখ ও হাসান সাহবের মাঝের চেয়ারে বসেছে আরিবা মূলত আরমান শেখ নিজেই বসিয়েছে।রাতে খাবার পর্ব শেষে এখন ও বাড়িতে ফেরার পালা। হাসান সাহেব অসহায় ভাবে আরিবার দিকে তাকায়,আরিবা আর সহ্য করতে না পেরে বাবার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে কান্না শুরু করে দেয়।হাসান সাহেব আরিবার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
‘বাবা তোমার জন্য ভুল সিদ্ধান্ত নেয় নি মা আজ না বুঝলেও একদিন ঠিক বুজবে।’
আরিবা বাবার বুক থেকে মাথা তুলে বলে,
‘সে একদিন জেনো আমার জীবণে কখনো না আসে আর দোয়া করো এ বাড়িতে জেনো আর না আসতে হয়।’
মেয়ের এমন কথায় হাসান সাহেবের বুক হাহাকার করে উঠে।রেবা ও আরশি কান্না শুরু করে দেয়। আরমান শেখ আরিবাকে সময় দেওয়ার জন্য আগেই বিদায় নিয়ে গাড়িতে গিয়ে বসেছে।আরিবা এতো গুলো অসহায় চোখে দৃষ্টি পিছনে ফেলে চলে যায় নতুন গন্তব্যে।
__________________________
শেখ বাড়িতে কেউ জানে না আরমান শেখ আরিবাকে নিতে গেছে।আগে থেকে জানলে হয়তো নাসিমা শেখ নতুন ফন্দি আটতো সেজন্য কাউকে না বলেই চলে গেছে।
তখন রাত বাজে এগারোটা, ডিনার শেষে যে যার মতো রুমে অবস্থান করছে। প্রথম বারের মতো দ্বিতীয় বারও আরিবা শশুড়ের হাত ধরে শেখ বাড়িতে উপস্থিত হয়।বাড়ির পরিবেশ নিস্তব্ধ দেখে আরমান শেখ বললেন,
‘যাও মা ঘরে যাও!প্রণয় রুমেই আছে। প্রণয়কে নিয়ে তোমার মনে কি ধারণা জন্মাছে আমি বলতে পারবো না।তবে প্রণয় সত্যই ভালো মনের ছেলে তবে অতিরিক্ত মা ভক্ত।এই অতিরিক্ত ভক্তিটাই তোমার শাশুড়ি অন্যায় কাজে লাগায়।এখন তুমি এসেছ,আমার ছেলের চোখে ঠিক ভুল ধরিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব তোমার।শশুড় হয়ে বলছি না,বলছি তোমার বাবা হয়ে।’
আরিবা এতো কিছুর পরেও মনে মনে খুশি হয়।কথায় আছে না?
‘ জামাই আমার যেমন তেমন শাশুড়ি আমার মনের মত’
আরিবার ক্ষেত্রে হলো ঠিক উল্টো টা,
‘জামাই আমার যেমন তেমন শশুড় আমার মনের মতো ‘
কিন্তু কথা হলো তার বেলার সূত্র মিললো না কেন!
‘কেন কেন কেন?’
এতো গুলো কেনোর উত্তর এখন তাকে কে দিবে!
।চলবে।