#গোধূলি_রাঙা_দিগন্ত
#পর্বঃ৮
#ফারিহা_খান_নোরা
আকস্মিক পেছন থেকে হঠাৎ করে কেউ জড়িয়ে ধরতে চমকে গেল আরিবা। না দেখলেও বুঝতে পারছে হাত দুটোর অধিকারী কোনো পুরুষ মানুষ। প্রণয় তার সাথে এমন কাজ করবে না। এ কয়দিনে যতটুকু চিনেছে আর যাইহোক প্রণয় একটা মেয়েকে সম্মান দিতে জানে।এই বাড়িতে পুরুষ মানুষ বলতে প্রণয় তার শশুর ও দেবর প্রীতম আছে।প্রথম দু’জন তার নিকট অত্যন্ত সম্মানের ব্যাক্তি আর প্রীতম তার সাথে আরিবা তেমন পরিচিতি নয় যার জন্য বলতে পারছে না।আরিবা প্রচন্ড বেগে পেছনে ফিরে, না দেখেই সামনের ব্যাক্তিকে জো’রে ধা’ক্কা দিয়ে বসে। লোকটি কিছুটা দূরে সরে যায়,মুখ তুলে তাকাতেই আরিবা সামনের ব্যাক্তিটিকে দেখে বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। তাঁর হাত পা ক্রমাগত কাঁপতে থাকে সাথে ঠোঁট তিরতির করে কাঁপছে।এ কি করে হতে পারে ও কি সত্যি দেখছে নাকি স্বপ্ন!
‘এভাবে কেউ ধাক্কা দেয়? আরেকটু হলেই তো পড়ে যেতাম। বাহ্ এই কয়দিনে দেখছি তুমি ভালোই শক্তি সঞ্চয় করেছো জানেমান।’
আরিবা অবাক হয়ে যায়। অনবরত তিরতির করা কাঁপা ঠোঁট দিয়ে অতি কষ্টে একটা শব্দই বেরিয়ে আসে।
‘জারিফ!’
জারিফ হেঁসে দেয়।আরিবার কাছে এসে প্রফুল্ল চিত্তে বলে,
‘হ্যা জারিফ! তোমার জারিফ জানেমান। প্রথমে তোমায় এখানে দেখে আমি অবাক হয়ে যাই পরবর্তীতে তোমাকেও একটু অবাক করবো বলে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরি কিন্তু তুমি যে এতোটা ভয় পাবে তা আমি বুঝতে পারি নি।’
আরিবা নিজেকে কিছুতেই সামলাতে পারছে না। সে এতোদিন ভেবে এসেছে কি করে জারিফের সম্মুখীন হবে। একদিন না একদিন তো তাকে জারিফের সামনে দাঁড়াতেই হবে কিন্তু সেই দিন যে এতো তাড়াতাড়ি আসবে সে কল্পনায়ও ভাবতে পারে নি।মনের মধ্যে প্রশ্ন জাগে জারিফ এখানে কেন?
আরিবা লক্ষ করে তারা ঠিক প্রণয়ের রুমের দরজার সামনে অবস্থানরত। যে কোনো মুহূর্তে প্রণয় আসতে পারে।আরিবা জারিফের থেকে নিজের দূরত্ব বাড়িয়ে ফেলে এতে করে জারিফের ভ্রু কুঁচকে যায়।আজ আরিবার ব্যাবহার তার কাছে অদ্ভুত ঠেকছে। তার মুখ দেখে মনে হচ্ছে আরিবা তার থেকে কিছু একটা লুকাতে চাইছে।এই আরিবাকে তাঁর কেমন জানি অচেনা লাগছে।ঠিক তখনি প্রণয় বেরিয়ে এসে আরিবাকে দেখে অবাক হয়ে যায়। এতো রাতে আরিবাকে সে এখানে আশা করে নি।
‘আরে প্রণয় ভাই! আপনি দেখছি বিয়ে করে আগের থেকেও বেশি হ্যান্ডসাম হয়ে গেছেন। এসবের ক্রেডিট কি আমাদের নতুন ভাবির নাকি?’
প্রণয় এতোক্ষণে সামনের ব্যাক্তিটিকে লক্ষ্য করে।ছেলেটি আর কেউ নয় প্রীতমের ছোট বেলার বন্ধু। ছেলেটির শেষের কথায় অস্বস্তিতে পড়ে আড়চোখে আরিবাকে একবার দেখে নেয় মেয়েটি কেমন জড়সড় হয়ে চুপসে আছে।প্রণয়ের কপালে ভাঁজ পড়ে। নিজেকে স্বাভাবিক করে বলে,
‘জাহিন তুমি এখানে! প্রীতমের রুমে গিয়েছিলে?’
জারিফ একটু হেসে আরিবার দিকে তাকিয়ে বলে,
‘প্রীতমের রুমেই যেতে নেয় মাঝপথে এই ম্যাডামের সাথে দেখা সেজন্য দাঁড়িয়ে পড়লাম। প্রণয় ভাই নতুন বিয়ে করেছেন ভাবিকে সময় না দিয়ে আপনি এখানে আমাদের সাথে সময় নষ্ট করছেন এটা কিন্তু ঠিক হচ্ছে না। আপনি বরং রুমের ভিতরে যেয়ে আমাদের সুন্দরী ভাবিকে সময় দেন।’
জারিফের এমন কথায় আরিবার চুপসানো মুখ ফুঁস হয়ে যায় অপরদিকে প্রণয়ের চোখে বিস্ময়। প্রণয় প্রশ্ন ছুঁড়ে,
‘তুমি আরিবাকে আগে থেকে চিনো?
জারিফ একটু লজ্জা পায় বন্ধুর বড় ভাইয়ের সামনে তো আর বলা যায় না,আরিবা তার গার্লফ্রেন্ড।জারিফ কিছু একটা ভেবে বলে,
‘আমাদের ভার্সিটির জুনিয়র আরিবা। কিন্তু আরিবা এখানে কেন? প্রণয় ভাই এমন না তো আরিবা আপনার শালী? ভাবির সাথে এসেছে বুঝি!’
আরিবার হাঁসফাঁস হচ্ছে কি একটা পরিস্থিতিতে পড়ল সে। নিজেকে ফাঁ’সি’র আসামির মতো লাগছে।এই জারিফটার ও মাথায় কি বুদ্ধিসুদ্ধি নেই কি সব বলে যাচ্ছে ননস্টপ।বউ কে বানাচ্ছে শালী ভাবা যায়!
প্রণয় কটমট করে একবার আরিবার দিকে তাকায় ও একবার জারিফের দিকে তাকায়। আরিবার দিকে আঙুল উঁচিয়ে ধরে কন্ঠে কঠোরতা আরোপ করে বলে,
‘ও আমার শালী নয়, ও আমার বউ।তোমাদের ভাবি বুঝলে জাহিন?’
কথা শেষ করে আরিবাকে আদেশ করে,
‘রুমে এসো।’
______________________
নিস্তব্ধ রাত! এই রাতে কেউ হাজার স্বপ্ন বুনে, কারো স্বপ্ন আবার ভঙ্গ হয়। জারিফ প্রতীমের ছোট বেলার বন্ধু।স্কুল কলেজে তার নাম জাহিন ইসলাম।সবাই জাহিন নামেই চেনে তাকে একমাত্র বাড়িতে জারিফ নামে পরিচিত।ছেলেটা সব সময় মজার ছলে থাকে সেজন্যই তো আরিবাকে এ বাড়িতে দেখে ব্যাপারটা মজার ছলেই নিয়েছে কিন্তু সে কি জানতো তার জন্য কি অপেক্ষা করছে? আরিবা তার সাথে এসব করতে পারলো কি করে! সে বন্ধুদের সাথে ট্যুরে গিয়েছিলো,ফিরে এসে যে,সে এতো বড় সারপ্রাইজ পাবে কোনো কালেই ভাবে নি।জারিফের বুকের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে।এতো বড় প্রতারণা!
আরিবা গুটিগুটি পায়ে রুমে ঢুকতেই প্রণয় প্রশ্নবিদ্ধ করে,
‘তুমি এখানে?’
‘কেন আশা করেন নি বুঝি?’
আরিবার কন্ঠে তাচ্ছিল্য।প্রণয় নিজেকে সামলিয়ে স্বাভাবিক ভাবে বলে,
‘বলতে পারো।এতো রাতে তোমাকে আশা করি নি।’
‘বাবা এনেছে।’
প্রণয় আর কোনো কথা বলেননি।আরিবা স্বস্থি খুঁজে পেল কারণ প্রণয় জারিফকে নিয়ে আর একটা প্রশ্নও করে নি।প্রণয় জানে জাহিন ফানি টাইপ,মজা করতে পছন্দ করে যার জন্য ওর প্রসঙ্গ টেনে এনে সময় নষ্ট করতে চায় নি।প্রণয় কি আর জানতো এই জাহিন তার লাইফের সবচেয়ে বড় গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গের সাথে জড়িয়ে আছে?
____________________
সকালবেলা আরিবাকে দেখে রা’গে ফেটে পড়ে নাসিমা শেখ।মনে মনে গা’লি দিতে থাকে। রা’গে গজগজ করতে করতে আরিবাকে বেশ কয়েটা কথা শুনিয়ে দেয়।
‘তোমার কি লা’জ লজ্জা বলতে কিছুই নেই? বিয়ের এক সপ্তাহ পেরোতো না পেরোতেই নিজের লজ্জাও খেয়ে ফেলেছো। যেখানে আমার ছেলে তোমাকে চায় না, রেখে এসেছে বাপের বাড়িতে সেখানে নিজেই ধেই ধেই করে একা একা চলে এসেছো। লজ্জা শরম হীন মেয়ে মানুষ কোথাকার।’
আরিবার মনটা এমনিই বিক্ষিপ্ত ছিলো তার মধ্যে নাসিমা শেখের এমন কথায় ভেতরটা ভে’ঙে চুড়ে যাচ্ছে। এর মধ্যেই আরমান শেখ এসে উচ্চস্বরে বলে,
‘নাসিমা তুমি কিন্তু বড্ড বেড়েছ। যা জানো না তা নিয়ে কথা বলো কেন? নাকি আরিবাকে অপমান করার একটা কারণ ও ছাড়ো না। আরিবা একা একা আসে নি আমি নিজে যেয়ে ওকে নিয়ে এসেছি। আমার মনে হয় কি জানো আত্মসম্মান আরিবার ঠিক আছে কিন্তু তোমার নেই তা না হলে নিজেকে কেউ অন্যের চোখে এতো নিচে নামায়?’
আরমান শেখ আরিবার মাথায় হাত রেখে বলে,
‘যাও মা রুমে যাও। এবাড়িতে কোনো কাজ তোমায় করতে হবে না। তুমি আমার মেয়ে, তুমি তোমার মতো করে চলবে।আর এই মহিলার থেকে সাবধানে থেকো।’
শেষের কথাটা নাসিমা শেখ কে দেখিয়ে দিয়ে বললেন। নাসিমা শেষ রা’গে ফেটে পড়েন স্বামীর কাজে।স্বামী তো নয় যেনো মির’জাফর!
আরিবা নিঃশব্দে যেতে নেয়। পিছন থেকে আরমান শেখ বলে উঠে,
‘নরম মনের হলে চলবে না মা।মনে রাখবে তুমি রিনা খানের মতো শাশুড়ি পেয়েছ।যেখানে রিনা খানের মতো শাশুড়ি আছে সেখানে নিজেকে বাংলার বউ ভাবতে হবে।’
শেষের কথাটা মজার ছলেই বলল আরমান শেখ। আরিবা বুঝতে পারছে তাকে হাঁসাতে কথা গুলো বলা তবুও তার মুখে হাঁসি নেই।জীবণটা তার কেমন যেনো হয়ে গেলো। রুমে আসতে নেয় তার আগেই কেউ হেঁচকা টান দিয়ে ফাঁকা রুমে নিয়ে যায়। তাকিয়ে দেখে জারিফ করুন চোখে তার দিকে আগে থেকেই চেয়ে আছে।আরিবা নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করে।এতে করে জারিফ আরও শক্ত করে ধরে করুন কন্ঠে বলে,
‘তুমি এখানে ভালো নেই আরিবা। আমি সব বুঝতে পারছি তুমি ইচ্ছার বিরুদ্ধে এই বিয়ে করেছো তাই না? তুমি ডিভোর্স দিয়ে আমার কাছে চলে আসো। আমি তোমাকে অনেক সুখে রাখবো।আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি আরবি।’
দরজার সামনে ফুলদানি পড়ার শব্দে আরিবা ও জারিফ উভয়ই চমকে যায়। পেছনে তাকিয়ে দেখতে পারে……
।চলবে।