#গোধূলি_রাঙা_দিগন্ত
#পর্বঃ৬
#লেখিকাঃফারিহা_খান_নোরা
ভীড়ের মাঝে অপ্রত্যাশিত ভাবে শরীরে পুরুষালী হাতের স্পর্শ পেয়ে চমকে উঠে আরিবা। দু চোখের কোঠর দিয়ে পানি উপচে পড়ার মত অবস্থা।ঘৃ’ণা ও রা’গে তার শরীর রি রি করছে। প্রণয়ের গুরুত্বপূর্ণ কল আসায় সে রিসিভ করতে একটু ফাঁকা জায়গা যায়।প্রেমাকে বলে আরিবাকে নিয়ে তাঁর পরিচিতি শপে যেতে। হঠাৎ করে প্রেমা কিছু না বলেই ভীড়ের মধ্যে উধাও হয়ে যায়। ততক্ষণে আরিবা ভীড়ের মাঝে অপ্রিতিকর পরিস্থিতিতে পড়ে। আরিবা জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো। তার এই বাজে পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার করে স্বয়ং প্রণয় শেখ নিজেই।কিছু না বলেই হঠাৎ করে আরিবার বাহু ধরে হেঁচকা টান দিয়ে নিজের বুকের একপাশে চেপে ধরে ভীড় ঠেলে চলতে থাকে।
আরিবা প্রণয়ের এতো কাছে এসে কেঁপে উঠে।কখনো কোনো পুরুষের এতো কাছে সে কোনো দিন আসে নি।প্রণয়ের বুক পর্যন্ত তার মাথা ঠেকেছে।প্রণয়ের বুকের বাম পাশের ধুকপুক শব্দ তার কানে এসে বাড়ি খায়।মনের ভিতর অদ্ভুত ভালো লাগা দোল খায় সাথে নিজের বুকের বা পাশের হৃৎপিণ্ড নামক যন্ত্রটি ক্রমান্বয়ে ধুকপুক ধুকপুক তরঙ্গ সৃষ্টি করতে থাকে।গম্ভীর পুরুষালী কন্ঠে প্রণয় বলে উঠে,
‘বড় বড় কবিরা বলে গেছেন সুন্দরী মেয়েরা বোকা হয়।আজ নিজের চোখে দেখলাম।’
______________________________
প্রণয় ও আরিবা শপে এসে দেখে প্রেমা নেই।প্রেমার ফোনে কল করে অসংখ্য বার তবুও পায় না।আরিবা ভেতরে রাখা সোফায় বসে প্রণয়ের করা সব অদ্ভুত আচরণ সম্পর্কে ভাবছে।প্রণয় পায়চারি করছে প্রেমার উপর খুব রা’গ লাগছে তার, এভাবে না বলে কোথায় চলে গেলো মেয়েটা? তার উপর টেনশন ও হচ্ছে প্রচুর কারণ এখন সময়টা খুব খারাপ।আধ ঘণ্টা হয়ে গেলো অধৈর্য হয়ে প্রণয় যখন প্রেমাকে খুঁজতে বের হবার ডিসিশন নিলো ঠিক তখনি হন্তদন্ত হয়ে প্রেমা ঢুকে পড়ে।প্রণয়কে দেখে চমকে উঠে।এতোটা লেট হবে সে বুঝতেই পারে নি।
প্রণয় প্রেমাকে এভাবে ঢুকতে দেখে রে’গে যায়। দাঁতে দাঁত পিষে প্রেমার দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে,
‘কোথায় গিয়েছিলি?’
আমতা আমতা করে প্রেমা উত্তর দেয়,
‘কেন এখানেই তো ছিলাম।’
‘এখানেই ছিলাম মানেটা কি? তোকে আমি এই শপটাতে আসতে বলেছি।আমরা আধঘন্টা হলো এখানে এসেছি তুই তো এখানে ছিলি না।’
ধরা পড়ে প্রেমার মুখ চুপসে যায় সে ভয়ে ঢোক গিলে।কিছুটা সাহস সঞ্চয় করে বড় ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে ভড়কে যায়।নিজেকে সামলিয়ে অপরাধীর সুরে বলে,
‘আসলে ভাইয়া আমি ভুলে এই শপে না এসে কসমেটিক সাইটে যাই।ভেবেছি তুমি ওখানেই যেতে বলেছ।সরি ভাইয়া আমার জন্য তোমাদের এতো অপেক্ষা করতে হলো।’
প্রণয় কিছুটা দমে গেল। তাচ্ছিল্য পূর্ণ কন্ঠে বলল,
‘থাক আর সরি বলতে হবে না।এক বলদ ভুলে উপরে যায় আরেক বলদ ভুলে নিচে থেকে যায়।’
শেষের কথাটা প্রণয় আস্তে ধীরে বলল।আরিবা কিছু না বুঝে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে।প্রণয়ের মাইন্ড চেঞ্জ দেখে আরিবা জেনো হাফ ছেড়ে বাঁচে।
প্রায় দেড় ঘন্টা ধরে তাঁরা লেহেঙ্গা দেখেই যাচ্ছে কিন্তু নেওয়ার নাম নেই।কখনো বলে এটা ভালো কখনো বলে ওটা ভালো নিজেরাই নিজেদের মনকে স্থির করতে পারছে না যে,এটাই ভালো এটা নিবো।হায়রে মেয়ে জাতি!
প্রণয় বিরক্ত! তার এখন মনে হচ্ছে এই কাপড় গুলোর মত পুরুষরাও যদি রঙ চঙ মানে লাল নীল বেগুনী হতো তাহলে মেয়েরা সঠিক বয়সে পাত্রই নির্ধারণ করতে পারত না।কখনো বলতো আমার লাল চাই কখনো বলতো না লাল নয় বেগুনী।এই যেমন তার বোন আর বউ ড্রেসের বেলায় করছে। যাক আল্লাহ্ বাচাইছে এটা হয় নি যে,শুকরিয়া!
অবশেষে প্রণয় ড্রেস দেখতে বসলেন। হালকা গোলাপি রঙের গোল্ডেন স্টোন ও সুতার কারুকাজ খচিত লেহেঙ্গা নিলো। সাথে লাল রঙের বেনারসি শাড়ি কারণ আরিবা বিয়েতে বেনারসী পড়তে পারে নি,তিনটা জামদানি শাড়ি নিয়ে দেয়।কিছু ড্রেস ও নিয়ে দেওয়া হয়। আধঘন্টার মধ্যে সব কিছু সম্পূর্ণ করে বেরিয়ে পড়ে রেস্টুরেন্টে এর উদ্দেশ্যে ।
________________________________
দেখতে দেখতে আরিবার এই বাড়িতে আসার ছয়দিন চলে গেছে আজ সাত দিন পড়ল।বিয়েটা যেহেতু অনাকাঙ্ক্ষিত আত্মীয় স্বজনরা কেউ বাড়িতে ছিলো না।তবে আজ সবাই বাড়িতে এসেছে।আসবে নাই বা কেন?আজ আরমান শেখের বড় পুত্রের রিসেপশন বলে কথা।বিয়েটা যেমনি সাদামাটা ভাবে হয়েছে রিসেপশন পার্টি ঠিক তেমনি জাঁকজমকপূর্ণ।প্রণয়ের সব বন্ধু বান্ধব ও তাদের বিজনেস পার্টনার আমন্ত্রিত এই অনুষ্ঠানে তবে আরিবা তার বন্ধু মহলকে জানায় নি। এই কয়দিনে নাসিমা শেখ তাকে ছোট বড় ব্যাপারে খোঁচা দিতে ভুলে নি। প্রথম প্রথম আরিবার খারাপ লাগলেও এখন আর এসব কানে তুলে না।কারণ সে জানে এখন এসব তার ভবিষ্যৎ,যা তার বাবা নিজের হাতে সূচনা করেছে।বাবার কথা মনে পড়তেই আরিবার মুখটা মলিন হয়ে গেলো।এতোদিনে বাড়ির কারো সাথে যোগাযোগ করে নি সে?কেন করবে তাঁরা আরিবার প্রতি অন্যায় করছে।এতো সব কিছু জেনোও তারা কিভাবে পারলো আরিবাকে প্রণয়ের সাথে বিয়ে দিতে।
‘ভাবি এদিকে তাকাও আর ভাইয়া তুমি ভাবির দিকে এগিয়ে এসো।কি দুজন দুই প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছো।এমন ভাব করছো জেনো তোমরা স্বামী স্ত্রী না, বরং পাড়া প্রতিবেশী।’
প্রেমার কথায় আরিবার ধ্যান ভাঙ্গল।প্রণয়ের দিকে তাকালে দেখতে পায় প্রণয় শক্ত চোখে প্রেমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে।বেচারি প্রেমা বুঝতে পেরে হেসে দেয়। ফটোগ্রাফার তাদের অসংখ্য ছবি ক্লিক করে।দেখতে দেখতে ও বাড়িতে যাওয়ার সময় হয়।যদিও আরিবা যেতে চায় না তবুও আরমান শেখের কথা ফেলতে পারে না। এতোক্ষণে আরিবা তার বাবা মা ও বোনের সাথে কোনো কথায় বলে নি।তারা চেষ্টা করছে তবুও ব্যার্থ। অবশেষে হাল ছেড়ে দেয় মেয়েটা তো বাড়িতে যাচ্ছে তখন না হয় সব ঠিক হবে।
_______________________________
রাস্তায় পুরোটা সময় আরিবা চুপচাপ বসে ছিলো।প্রণয় ড্রাইভিং সিটে তার পাশে আরিবা।পেছনের সিটে বাবা মা ও আরিবার বোন বসেছে।কেউ কারো সাথে কোনো কথা বলছে না।তবে মাঝে মাঝে প্রণয় ও হাসান সাহেব টুকটাক কথা বলছে। অবশেষে সাতদিন পর আরিবা নিজের বাড়িতে প্রবেশ করলো।নিজের বাড়ি বললে ভুল হবে এখন আর এটা নিজের বাড়ি নেই।আরিবা নিজের রুমে ঢুকেই বিছানায় শুয়ে পড়ে। চারিদিকে চোখ দিয়ে দেখে। আহ্ কতো আরাম কতোই না শান্তির জায়গা।এই সাত দিনে অই বাড়িতে এমন শান্তি পায় নি।তার অনুপস্থিতিতে ঘরটা ভালোভাবেই গুছিয়ে রেখেছে হয়তো মা নয়তো আপু।
আরশি রুমে ঢুকে আরিবার পাশে বসে মাথায় হাত দেয়। একমাত্র ছোট বোন তার। সে বাড়িতে থাকছে অথচ আরিবা এতো ছোট বয়সে শশুড়বাড়ি চলে গেল এটা মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে তার।
আরিবা শান্ত চোখে বড় বোনের দিকে তাকায়।আরিবার চোখে আজ তীব্র অভিমান দেখতে পারছে আরশি।সে দৃষ্টিতে আরশি কিছুক্ষণ ভড়কালো।তারপর কথা গুছিয়ে আরিবার উদ্দেশ্যে বলল,
‘কেমন আছিস? সব ঠিকঠাক আছে তো!’
আরিবা ধীর কন্ঠে আক্ষেপের সুরে বলল,
‘কেন সব ঠিকঠাক থাকার জন্যই তো তোমরা বিয়ে দিয়েছো।’
আরশি আবারও ভড়কালো অসহায় ভাবে বলল,
‘এভাবে বলছিস কেন?’
‘কিভাবে বলব আশা করছো? প্রণয়ের জীবণে অন্যকেউ ছিলো সব জেনে বুঝে তোমরা আমার সাথে কিভাবে এমনটা করতে পারলে?’
আরশি আরিবাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
‘আমি সত্যই জানতাম না পাখি আব্বু যে এমন একটা স্টেপ নিবে।যখন জানলাম তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে।আমি আর তোর দুলাভাই আব্বুর সাথে কথা বলেছি।আব্বুর সাথে তোর দুলাভাইয়ের কথা কাটাকাটি হয়েছে এমনকি আমারও।’
আরিবা তাচ্ছিল্য পূর্ণ কন্ঠে বলে ওঠে,
‘ওহ্ তাই নাকি? আমি জারিফ দুইজন দুইজনকে পছন্দ করতাম এটাও কি জানতে না তুমি?’
আরশি চুপ হয়ে গেল তার মুখ চুপসে যায়। কন্ঠনালী থেকে কোনো কথা বের হচ্ছে না।সে শুরু থেকেই জানতো আরিবা ও জারিফ দুজন দুজনকে পছন্দ করে।এতে আরশি ভীষণ খুশিও ছিলো।কারণ তার ছোট আর সে সারাজীবন তাহলে এক বাড়িতে থাকতে পারবে জা হয়ে অথচ কি থেকে কি হয়ে গেলো।
প্রণয় গাড়ি থেকে নেমে ও বাড়ি থেকে নিয়ে আসা গিফট গুলো শশুড় শাশুড়িকে বুঝিয়ে দেয়।হাসান ও রেবা ইতস্তত বোধ করে প্রণয়কে জানায়,
‘এসবের কি দরকার ছিল বাবা? এসব না নিয়ে আসলেই পারতে।’
প্রণয় একটু হেসে শান্ত কন্ঠে বলে,
‘তা কি করে হয় এসব আমার পক্ষ থেকে আপনাদের জন্য ছোট একটু ভালোবাসা।’
এই কথা শুনে হাসান ও রেবা মুগ্ধ হয়ে যায়।প্রণয়কে বিভিন্ন নাস্তা পানি দিলে সে শুধু লেবুর শরবত টুকু খেয়ে উঠে পড়ে।রেবা বেগম রেস্ট নেওয়ার জন্য আরিবার ঘর দেখিয়ে দেয়। প্রণয় আরিবার ঘরের সামনে এসে দুই বোনের কথপোকথন এর কিছু অংশ শুনতে পারে ভেতরে যাবে কিনা বুঝতে পারে না।তবে আরিবার বলা শেষের কথাটা শুনে প্রণয় স্তব্ধ হয়ে যায়।তার মনে একটা কথায় আসছে আরিবা জারিফকে পছন্দ করে।
‘কে এই জারিফ?’
।চলবে।