গৃহযুদ্ধ পর্ব-১৮ এবং শেষ পর্ব

0
2709

#গৃহযুদ্ধ -শেষ পর্ব
____________________________
জীবনটা অনেক অদ্ভুত৷ অন্তত রফিক সাহেবকে দেখে সেটাই মনে হচ্ছে। চরিত্র হারালে মানুষের সবকিছু হারিয়ে যায়৷ রফিক সাহেব সেটার জলজ্যান্ত উদাহরণ।রফিক নামের কোনো লোকের অস্তিত্ব কোনো কালে ছিলো কিনা সেটা মানুষ আস্তে আস্তে ভুলে যাবে, এমনকি রফিক নিজেও।অপরদিকে সুপ্তি! সুপ্তিকে সাক্ষাৎ মৃত্যুও ভোলাতে পারবেনা আমার মন থেকে। মানসিক অসুস্থতা একটা রোগ মাত্র। বাকি সবকিছুই সুপ্তির পৃথিবীতে আগের মত আছে৷ ভালোবাসাময় আছে।
ভালোবাসা এজন্যই সুন্দর। ভালোবাসা এজন্যই স্বর্গীয়।
অপরাধের কালো জগতে বিচরণ স্বল্প সময়ের জন্য মানুষকে লাভবান করে তুললেও, শেষ পরিনতি কখনোই ভালো হয়না। তার জলজ্যান্ত উদাহরণ মিরাত।ভাড়াটে খুনী মিরাত নিজেরই কাছের এক ছোট ভাইয়ের হাতে নির্মমভাবে খুন হয়েছে।
বিনাদোষে যখন কাউকে খুন করা হয়,
তখন খুনীর একটু হলেও মন কাঁপে, হাত কাঁপে,মনের কোথাও একটা আফসোস হয়। কিন্তু অপরাধী লোকদের মারতে কারো হাত কাঁপে না,মায়া কাজ করে না।
আমি নিশ্চিত, মিরাতকে খুন করার সময় ওর খুনীর মনের কোথাও একটু আফসোস ছিলো না। ছিলো ঘৃণা ঘৃণা এবং ঘৃণা। পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে হলে,শিক্ষা গ্রহণ জরুরি। রেশমি এবং রফিকের পুরো গেমটার দিকে তাকালে মনে হয়, উইনার একজন। সে হলো কাব্য। রফিক সাহেবের রেশমিকে খুন করার পরিকল্পনা যখন ব্যর্থ হয়, কাব্য রেশমির সাথে যোগাযোগ করে।ইনিয়ে বিনিয়ে রফিক সাহেবের কথা বলে বেশ মোটা অংকের টাকা নিয়ে যায় রেশমির কাছ থেকে। আর বেচারা রফিক সাহেবের অবস্থা!
রেশমির বিয়েতে সবাই বেশ ফুরফুরে মেজাজে থাকলেও আমি মোটেও স্বাভাবিক ছিলাম না। রেশমি কারো সাথে ফোনে আমার ব্যপারে একটা কথা বলেছে ওটা মাথার ভেতরে ঘুরপাক খাচ্ছিলো বারবার।
আমি নিজে এমন কোন কাজ ই করিনি।
কিভাবে আমি মণিকা ভাবীর পেটের বাচ্চার বাবা হবো!
ধুর!
মনে কিছু একটা প্লান করতে করতে সুপ্তিকে বসে বসে সাজাচ্ছিলাম।
বিউটি ব্লেন্ডার দিয়ে যখন সুপ্তির মুখে প্রাইমার লাগিয়ে দিচ্ছিলাম ও বারবার নড়াচড়া করছিলো উঠে চলে যাচ্ছিলো।প্রাইমার লাগানো শেষে ওর মুখে ফাউন্ডেশন লাগিয়ে দিলাম,এরপর হালকা ফেস পাউডার দিয়ে বসলাম আই শ্যাডো নিয়ে।সুপ্তিকে যেহেতু নীল শাড়ি পড়াবো, তাই ঠিক করলাম ওর চোখের পাতার উপরে নীল রঙ এর শ্যাডো ব্যবহার করি।
নীল শ্যাডোর সাথে কম্বাইন্ড করে কালো আইলাইনার টেনে দিলাম ওর চোখে। সাজ শেষ না হতেই অদ্ভুত সুন্দর লাগছিলো সুপ্তিকে।
খেয়াল করে দেখলাম কোথাও যেন একটু কমতি লাগছে, পরে মনে পড়লো, ওহ মাশকারা লাগানো হয়নি। ওর বড় বড় পাঁপড়িতে সময় নিয়ে বসে বসে মাশকারা লাগালাম।
সব মায়াবি চোখের মেয়েরা নাকি কালো কাজল দিয়ে সাজে।
চোখের ওয়াটার লাইনে সুপ্তিকে আমি সাদা কাজল লাগিয়ে দিলাম।থাকনা কিছু বিষয় একটু আলাদা।
সাজানোর মূল কাজ শেষ, এরপর বাকি ছিলো কিছু টুকটাক কাজ,নাকের উপরে চিকন করে হাইলাইটার টেনে শেপ করে দেয়া,গালে হালকা করে ব্লাশ লাগানো ইত্যাদি ইত্যাদি।
লিপস্টিক চুজ করলো সুপ্তি নিজেই। গাঢ় খয়েরী রঙের লিপস্টিক।
সবকিছু শেষে ওকে নিজ হাতেই শাড়ি পড়িয়ে দিলাম।
আমি নিজে পড়লাম একটা খয়েরী রঙের কাবলি, সাথে জিন্স এবং পায়ে স্নিকারস।
আয়নার সামনে দুজনে পাশাপাশি হাত ধরে দাঁড়ালাম। মনে হলো পৃথিবীর সবথেকে পরিপূর্ণ, সুন্দর, সুখী দম্পতি পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে।
সুপ্তি একটু আগেও কেমন ছটফট, বাচ্চামি করছিলো। শাড়ি পড়ার পরে সে হুট করেই একদম চুপচাপ গম্ভীর হয়ে গেলো।
” শাড়ি পোশাকটা জাদুকরী পোশাক।
একজন মেয়ে যত চঞ্চল,দুষ্টু কিংবা বেয়ারাই হোক না কেনো! শাড়ি পরলে তার মাঝে গাম্ভীর্যতা চলে আসবেই।”
দুজনে গায়ে বডি স্প্রে মেখে, একদম পরিপাটি হয়ে বের হলাম। ছাদে গান- বাজনা চলছে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা হই হুল্লোড় করছে। রান্না নিয়ে ব্যস্ত আছেন মণিকা ভাবীও। তার পুরোনো কিছু বান্ধবীরা এসেছে। বর ও বউ বসবে ছাদের বৃষ্টিবিলার নামক ছোট্ট কুটিরের বিছানায়৷
ছাদের খোলা জায়গায় সামিয়ানা টানানো হয়েছে।চেয়ার টেবিলেরও ব্যবস্থা হয়েছে। রেশমির যে ছেলের সাথে বিয়ে হবে, সে পেশায় একজন সাধারণ চাকুরিজীবী।খোঁজ নিয়ে জেনেছিলাম ছেলেটা ভালোই।
ছাদে ওঠা মাত্রই ছোট বাচ্চা ছেলেমেয়েরা এসে সুপ্তিকে ঘিরে ধরলো। হাসতে হাসতে সুপ্তি আমাকে ছেড়ে ওদের মাঝে মিশে গেলো। আমি এক পাশে দাঁড়িয়ে রইলাম।
দূর থেকে সুপ্তির চাঁদের মত হাসি দেখে আমি বহুবার ওর প্রেমে পড়লাম।
মৃদু স্বরে মুখে গান চলে আসলো,
তোমার হাসির শ্রাবণ ঢলে,
স্বপ্ন নিয়ে ভাসতে চাই……
মণিকা ভাবী দূর থেকে আমাকে ও সুপ্তিকে দেখতে লাগলেন।
রান্নার পাত্রে খুন্তি নিয়ে জোরাজুরি দেখে বুঝলাম ঝড়টা ওনার মনেও চলছে খুব জোড়ে৷
মণিকা ভাবী যখন আমার দিকে তাকালো,
ওনাকে হাত দিয়ে ইশারা করে ডাকলাম।
সুপ্তি বাচ্চাদের সাথে খুনসুটিতে মেতে উঠেছে।
ভাবীকে বললাম নিচে,ওনার বাসায় আসতে।
ভাবী রান্নার দায়িত্ব ওনার সহযোগীর হাতে দিয়ে আমার সাথে নিচে আসলো। ওনার বাসায়৷
বারান্দার টেবিলটায়, মুখোমুখি হয়ে বসা আমি এবং মনিকা ভাবী।
ওনাকে হাসিমুখে বললাম,
ভাবী, আপনি আমার নামে গুজব কেনো ছড়াচ্ছেন?
– কি গুজব রোহান?
– আপনি প্রেগন্যান্ট?
– কিসব প্রশ্ন করছো তুমি?
– সরি ভুল হয়েছে, প্রশ্ন করা ঠিক হয়নি।
নিশ্চিত হয়েই বলছি, আপনি প্রেগন্যান্ট।
আপনি গাইনী ডাক্তার শারমিন আহমেদের কাছে গিয়েছিলেন। তার কাছ থেকেই নিশ্চিত হলাম।
কথাটা শুনেই লাফ দিয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন মণিকা ভাবী।
দাঁড়ানোর কারণও আছে যথেষ্ট। ডাঃ শারমিন আহমেদের কাছে গিয়ে ওনার স্বামীর নামের জায়গায় রোহান মাহমুদ লিখিয়েছেন তিনি।
মণিকা ভাবী আমাকে বললেন,
রোহান, এ বিষয়ে আমি আর কথা বলতে চাইনা।
– ব্যপারটি হাস্যকর ভাবী৷
– আমি জানি। আমি দুঃখিত, তোমার নাম ওখানে লেখানো উচিত হয়নি।
– রেশমিকেও আপনি আমার কথা বলেছেন? কিন্তু কেনো?
– এ বিষয়ে কোনো প্রশ্ন করোনা রোহান। আমি কথা দিচ্ছি, আমি আর তোমাকে কখনো কোন কিছুতে জড়াবো না। কিন্তু তুমি যদি এ বিষয়ে আমাকে আর একটি প্রশ্ন করো, আমি সুইসাইড করবো।
এবং এটাই সত্যি।
মণিকা ভাবীর চেহারার দিকে তাকানো যাচ্ছিলোনা। তার বয়সের ছাপ নিজের চেহারায় ফুটে উঠেছে আজ। হুট করেই একটা তরতাজা গোলাপ যেনো কেউ আগুনে পুড়িয়ে ফেললো, মণীকা ভাবীর চেহারা ঠিক ঝলসানো গোলাপের মত হয়্র গেছে।
তিনি উঠে চলে গেলেন। যখন দরজা থেকে বের হবেন, ঠিক তখনই বললাম, রবীন!!
মণিকা ভাবী আবারো আমার দিকে তাকালেন। তার চোখদুটো বিষ্ফোরিতো অবস্থায় আছে।
ঠান্ডা গলায় বললাম, ভয় নেই ভাবী।
আমি কাউকে বলবো না। কাউকে জানাবো না।
মণিকা ভাবী বললো, কি জানো তুমি রোহান?
আমার পেটে রবিনের বাচ্চা এটাই তো বলতে চাচ্ছো?
– তা তো বটেই।
তবে আমি আরো ভয়ানক কিছু জানি।
মণিকা ভাবীর কপাল থেকে ঘাম বেয়ে পড়ছে। অস্পষ্ট গলায় বললো, কি জানো তুমি?
একটা সিগারেট ধরালাম। বললাম এক-কাপ চা বানিয়ে আনুন, আজ আপনার সাথে গল্প করবো।
.
.
.
.
বাসায় কেউ নেই।
রেশমি পার্লারে গিয়েছে ব্রাইডাল সাজের জন্য।বাকি সবাই ছাদে, সুপ্তির জন্য চিন্তা হচ্ছে মাথায়। বেচারি উল্টাপাল্টা কিছু না করে ফেলে আবার! বাড়ি ভরা মেহমানের সামনে সুপ্তি যদি উল্টাপাল্টা কিছু করেও ফেলে, তাতে আমার আফসোস নেই,বউকে নিয়ে বিন্দুমাত্রও অপমান বোধ হবেনা। মানসিক অসুস্থতা রোগ মাত্র, কোনো অপরাধ না।
মণিকা ভাবী চা আনলো দু-কাপ।
এক কাপ ওনার নিজের জন্য আরেক কাপ আমার জন্য।
উনি পুনরায় আমার সামনে বসলেন। মাত্রাতিরিক্ত ঘামছেন।
ওনাকে বললাম আমি গল্প শুরু করলে আপনার চা খাওয়া আর হয়ে উঠবে না। এজন্য এক কাপ আনতে বলেছিলাম।
উনি আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন।
সিগারেটে টান দিয়ে পায়ের উপর পা উঠিয়ে বসলাম।
চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম,
আপনার চোখে কিছু একটা খেলা করছে। ভয় নাকি হিংস্রতা আমি বুঝছি না।
মণিকা ভাবী বললেন,
রোহান, তোমাকে যতটা বোকা আমি ভেবেছিলাম ততটা তুমি নও।
আমি হাসলাম।
“রবিনের লাশটা আধ-পচা অবস্থায় আমি কবর দিয়েছি ভাবি। আপনার বাসার পেছনেই, গর্ত করে৷ ”
মণিকা ভাবির মেরুদণ্ড বেয়ে যেনো শীতল একটা শিহরণ নিচে নেমে গেলো। তিনি এখন আর ঘামছেন না। ভয়ে জমে গেছেন।”
বলতে থাকলাম-
” আপনার এ পাঁচতলা বাড়িটিতে আপনি কেনো কোনো লোকজন ভাড়া দেন না, বিষয়টা নিয়ে আমার মাঝে বেশ কৌতূহল ছিলো। আমার মনে আরো কিছু প্রশ্ন আছে। আমি সেগুলো পরে আপনার কাছে উপস্থাপন করবো।
যাই হোক,
ফুলীর পোস্টমর্টেম রিপোর্ট আমি হাতে পেয়েছিলাম।
ওকে ধর্ষণ করা হয়নি। একটা মেয়েকে ধর্ষণ যদি না করা হয়, তবে তাকে উলঙ্গ করে খুন করার মানে হয়না। সুপ্তির যোনীতে একটা মদের বোতল ঢুকানো ছিলো।
হু…..
একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়লাম।
সিগারেট হাতে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম বারান্দায়।
ভাবি?
– জ্বী!
– আপনি ছেলেদের মাঝে বিশেষ একটা কিছু দেখে তাদেরকে আপনার বাড়ি ভাড়া দেন। তাইনা?
মণিকা ভাবি চুপচাপ রইলেন।
– আমি আসলে খুঁজছিলাম, রবিন আর আমার মাঝে কি মিল আছে? এবং আমি পেয়েও গেছি। আমাদের দুজনেরই জোড় ভ্রু! মানে আমাদের দুই ভ্রুর মাঝে কোনো ফাঁকা নেই৷ লোম উঠে জোড়া লেগে গেছে৷
মণিকা ভাবি এক আকাশ কনফিউশন নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন।
আমি আমার কথা চালিয়ে যেতে লাগলাম,
রবিন বাসা ভাড়া নেয়ার পরে আমি আমার পরিচিত বেশ কয়েকজন লোককে পাঠিয়েছি আপনার ফ্লাটে বাসা ভাড়া নেয়ার জন্য। অবশ্য আমি একটা বিষয় জানার জন্য এমনিতেই তাদের পাঠিয়েছিলাম।
কিন্তু আপনি তাদের বলেছেন রুম খালি নেই। অথচ খালি ছিলো।
আমি তখনই শিওর হই,যে আপনি আসলে নির্দিষ্ট কিছু মানুষকে আপনার ফ্লাটে ভাড়া দেন সবাইকে না।
এরপর আমি আমার এবং রবিনের মাঝে মিল খুঁজতে শুরু করি। দেখতে পাই, আমার ও রবিনের একটা বিষয় কমন, সেটা হলো আমাদের দুজনেরই জোড় ভ্রু।
প্লান অনুযায়ী আমি জোড় ভ্রু আছে এমন একজন লোককে খুঁজে বের করি এবং আপনার কাছে বাসা ভাড়া নিতে পাঠাই।
আপনি তাকে বাসা ভাড়া দিতে রাজি হন। আমার ধারণা সত্য হয়৷
যাই হোক,
এবার আসি ফুলী প্রসংগে।
ফুলীর ব্যপারে বলতে গেলে, ঘটনার আরো একটু গভীরে যেতে হবে।
আমি যখন আপনার বাসার ছাদে বৃষ্টি বিলাসে ছিলাম, রেশমির সাথে কথা বলছিলাম, পুরো বিষয়টি আপনি আপনার ফোনে ভিডিও করেন। আমার অগোচরেই।
তখন রেশমি আমাকে হঠাৎ জড়িয়ে ধরে। ওটাও রেকর্ড হয়। এবং আপনি সেই মুহূর্তের স্ক্রিনশট নিয়ে ফেক আইডি দিয়ে আমার স্ত্রীর কাছে প্রেরণ করেন। উদ্দেশ্য কি ছিলো সেটা আমি বুঝেছি। আমার এবং আমার স্ত্রীর সম্পর্কের মাঝে ফাঁটল তৈরি করা। আপনি চেয়েছিলেন আমার সাথে ঘনিষ্ঠ হতে।
আপনি হয়ত ভুলে গেছিলেন আপনি আমাকে আগেও টেক্সট মেসেজ পাঠিয়েছিলেন।
সুপ্তিকে ছবির সাথে যে লেখাগুলো পাঠিয়েছেন, সে লেখাগুলোর সাথে আমাকে মেসেজ পাঠানো লেখার টাইপিং স্টাইল হুবুহু মিলে যায়। এজন্য আমার বুঝতে কষ্ট হয়নি,কাজটা আপনার।
বারান্দায় থাকা একটা ক্যালাডিয়াম প্লান্ট এর চারা হাতে নিলাম।কাঁচের বোতলে শুধু পানিতেই বেড়ে উঠছে চারাটি। মাটির দরকার হচ্ছে না।
বোতলসহ চারা গাছটি এনে ভাবির সামনে রাখলাম।
মণিকা ভাবির চোখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম, ভাবি!
রবিনের সাথে নিজে টাকা খুইয়ে ঘুরেছেন,কেনাকাটা করেছেন, অবৈধ সম্পর্ক করেছেন,সেক্স করেছেন৷
তাহলে খুন কেনো?
ওকে খুন কেনো করলেন?
মণিকা ভাবি চিৎকার করে বলে,
“না আমি করিনি খুন ওকে। ”
-মিথ্যা বলে লাভ নেই ভাবি।
ক্যালাডিয়াম প্লান্ট এর চারা বোতল সহ হাতে তুলে নিলাম।
কাঁচের বোতলটির গায়ে লেখা- এবসুলুট ভদকা,
ফুলীর যোনীতে ঢুকানো ছিলো ঠিক এরকম ই একটি বোতল। এবসুলুট ভদকার বোতল মণিকা ভাবির বাসায় বেশ কয়েকটি দেখেছি আমি।
মণিকা ভাবিকে উদ্দেশ্য করে বলতে শুরু করলাম,
রবিনকে যে আপনি খুন করেছেন, এ সন্দেহ জাগার পেছনে অনেক কারণ আছে।
প্রথমত – আপনার বক্তব্য ছিলো আপনি চার ঘন্টা যাবৎ ফুলীকে পাচ্ছেন না। একটা মানুষ যে আপনার বাসায় কাজ করে সারাক্ষন চোখে চোখে থাকে সে চার ঘন্টা যাবৎ নেই আর আপনি চার ঘন্টা পরে হন্তদন্ত হয়ে খুঁজতে এসেছেন এ বিষয়টাই খটকা লেগেছিলো আমার। যখন ফুলীর লাশ দেখি, ওর নিম্নাংগে ঢুকানো বোতলটার মত একই রকম বোতল আমি শুধুমাত্র আপনার বাসাতেই দেখেছিলাম। যদিও এসবকিছুর উপর ভিত্তি করে আপনাকে সরাসরি খুনী বলা যায়না। তাই আমি সার্চ শুরু করি।
যদি আপনি রবিনকে খুন করেই থাকেন, তবে অবশ্যই বাসার এড়িয়ার মধ্যে কোথাও ওর লাশ রেখেছেন, এ চিন্তা থেকেই আমি সব জায়গায় তন্ন তন্ন করে খুঁজতে শুরু করি।
এবং পেয়েও যাই।রবিনের লাশ পাই আমি বাসার পেছনের সেফটি ট্যাংকের ভেতরে।
ততদিনে লাশ পঁচে গেছে। গা ধরলে মাংস খসে পড়ে এমন। তবুও আমি যেভাবে পেরেছি উঠিয়েছি। উঠিয়ে কবরের ব্যবস্থা করেছি। ভাবতেও গা শিউরে উঠছে, শুধু রবিন নয়, আপনি খুন করেছেন ফুলীকেও।
পুলিশ যাতে আপনাকে কোনো ভাবেই সন্দেহ না করে তাই আপনি নিজে আপনার টাকা-পয়সা গহনা সরিয়ে এমন ভাব নিলেন যেনো রবিন সব চুরি করে নিয়ে গেছে।
সুন্দর মুখশ্রীর আদলে আপনার পেছনে লুকিয়ে আছে এক জঘন্য পৈচাশিক সত্তা।
হয়ত, আপনার শিকার আমিও হয়ে যেতে পারতাম।
কিন্তু হইনি। এটা সুপ্তির ভালোবাসার জোড়।
ওর ভালোবাসার জোড়ে আমি বেঁচে আছি,বেঁচে গেছি।
এবার আপনার কাছে আমার প্রশ্ন, বলুন,রবিনকে কেনো হত্যা করেছেন?
মণিকা ভাবী বিমর্ষ দৃষ্টি নিয়ে বললো,
– রোহান, একাকিত্ব বিষয়টা খুব ভয়ানক। আমি একাকিত্বে ভুগি। খুব বেশি একাকিত্বে ভুগি।
আমার এমন কিছু কথা আছে, যা আমি কাউকে শেয়ার না করে পারিনা।
কিন্তু কেউ যদি জেনে যায় তারপর সেটা জানাজানি হয়ে যাওয়ার ভয়ে আমি তাকে সরিয়ে দেই পৃথিবী থেকেই।তুমি সবকিছু কিভাবে বুঝে গেলে আমি তা জানিনা,
তুমি খুব চালাক।
আমার যে ডায়েরিটা তোমাকে পড়তে দিয়েছিলাম, ওটাতে আমার গোপন একটা কথা লেখা আছে।
রবিন ডায়েরীটা শেষ করার আগে ওর সাথে আমি মিশেছি, সবটা দিয়ে মিশেছি। ও যা চেয়েছে দিয়েছি, টাকা পয়সা,যৌনসুখ.. সব।
কিন্তু আমার ডায়েরি যেদিন ও পড়া শেষ করলো, সেদিন ই ওকে চায়ের সাথে হাই পাওয়ারের ঘুমের ঔষধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেই। এরপর শ্বাসরোধ করে মেরে ফেলি৷ ফুলী পুরো ব্যাপারটা লুকিয়ে দেখে ফেলেছিলো। তাই ওকেও রেহাই দেইনি৷ আর সত্যি বলতে আমার এতে একটুও আফসোস নেই।
– আমাকেও কি রবিনের মত মেরে ফেলতেন?
– হ্যাঁ। তুমি ডায়েরীটার শেষ পাতা পডলেই তোমাকে মেরে ফেলতাম।
– কিন্তু আমি তো পড়ে ফেলেছি। আপনি হয়ত টের ও পাননি। লুকিয়ে লুকিয়েই আমি পড়েছি৷
মণিকা ভাবি আমার দিকে অশ্রুসজল নয়নে তাকিয়ে রইলেন। কিছু একটা বলতে চাচ্ছিলেন,
এর মধ্যেই ঘরে এসে ঢুকলো রেশমি। সাথে আরো কয়েকজন মহিলা। সবাই এসেই তোড়জোড় শুরু করে দিলো।রেশমি খুব খুশি। আজ তার বিয়ে খু্শি তো হবার ই কথা।
আমি বের হয়ে আসলাম।
সুপ্তির কাছে চলে এলাম। সে আমাকে দেখেই বাচ্চাদের মাঝ থেকে আমার পাশে এসে দাঁড়ালো। বরযাত্রী আসলো আরো অনেক্ষন পরে।
কাজী আসলো, বিয়ে পড়ালো, হৈ হুল্লোড় হলো।
খাওয়াদাওয়া পর্বের সময় হঠাৎ মণিকা ভাবী নিঁখোজ।
রেশমির বিয়েতে কারো খাওয়াদাওয়া হয়নি। মণিকা ভাবীর যত্ন নিয়ে রান্না করা স্বাদযুক্ত খাবার অবহেলায় নষ্ট হয়ে গেলো৷ কেউ ছুঁয়ে দেখার সাহস ও পায়নি। সবাই যখন খাওয়া-দাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো তখন আচমকাই শোনা গেলো বিকট এক আওয়াজ- চিৎকার, এরপরপিনপতন নিরবতা। মণিকা ভাবী ছাদ থেকে লাফ দিয়েছেন।
নিচে দেয়ালের উপরে লাগানো খাড়া খাড়া রডের উপরে উপুড় হয়ে পড়ে ছিলো ভাবীর নিথর দেহটি। সুঁচালো রডের মাথা তার পেটে ঢুকে পিঠ দিয়ে বের হয়ে গেছে। কি বীভৎস দৃশ্য।
সুপ্তিকে আমি কিছু দেখতে দেইনি।
ঘটনার পরে আমরা বাসা ছেড়ে দেই।
মণিকা ভাবির বিল্ডিং এ একটা পাপ চক্র শেষ হলো। শেষ হলো অনেক ধ্বংসের মাধ্যমে।
সব পাপচক্রই- শেষমেষ ধ্বংস কিংবা মৃত্যু দিয়ে শেষ হয়।
রেশমি দম্পতি নিজেরা একটা ফ্লাট কিনে উঠে পরে সেখানে। আমরা নতুন একটা জায়গায় বাসা ভাড়া নেই৷
সুপ্তি সুচিকিৎসায় আস্তে আস্তে ভালো হয়ে উঠতে শুরু করে। তবে হাই পাওয়ারের ঔষধের প্রভাবে ওর রাগ বেড়ে যায়৷
বাসায় ভাংচুর, অযথা ঝগড়া,এমনকি আমার গায়ে হাত তোলাও চলে।
তবে একটা কথা কি!
ভালোবাসার মানুষটা যখন খুব ভদ্র ছিলো তখনো ওকে আমি প্রচন্ড ভালোবেসেছি।
যখন পাগল ছিলো তখনো প্রচন্ড ভালোবেসেছি।
আর এখন এই রগচটা বউটাকেও প্রচন্ড ভালোবাসবো৷ ভালোবাসা পরিবর্তন হয়না। বরং বাড়ে। দিনে দিনে বাড়ে।
.
.
.
রেশমির অপারেশন সাকসেসফুল হয়েছে।
তার ব্রেস্ট ক্যান্সার হয়েছিলো।
ফলশ্রুতিতে তার বুকের স্তন দুটোই কেটে বাদ দিতে হয়েছে। তবুও ক্যান্সার থেকে মুক্তি মেলায়, সে বহু খুশি।
এদিকে খুশি আমিও কারণ রেশমির ব্রেস্ট ক্যান্সার হয়নি। ও সাধারণ বুকে ব্যাথার জন্য ডাক্তার দেখাতে গিয়েছিলো৷ পরে সেই ডাক্তারকে মোটা অংকের টাকা দিয়ে রেশমির রিপোর্টে ব্রেস্ট ক্যান্সারের জটিল অবস্থা দেখানো হয়েছে। ডাক্তার পরামর্শ দিয়েছে ওর স্তন কেটে ফেলার জন্য। রেশমি ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী নিজের স্তন কেটে ফেলতে সম্মতি জানায়৷
সুপ্তির উলঙ্গ ছবি তোলার জন্য এই শাস্তিটুকু ওর প্রাপ্য ছিলো৷ এখন একটুখানি অপূর্ণতায় সারাজীবন ডুবে থাকো রেশমি।
.
.
.
আমাদের ফ্লাটের পাশের ফ্লাটেই নতুন ভাড়াটিয়া এসেছে। ভদ্রলোকের স্ত্রী আমাদের
বাসায় এসে সেধে সেধে কথা বলে। একদিন সুপ্তি ওয়াশরুমে ছিলো, ভাবী এসে আমাকে বললো,
ভাইয়া আপনার বউ তো গান গাইতে পারেনা। আমি গান গাইতে পারি। শুনবেন?আপনার নাম্বার টা দেন।
মুচকি হেসে উঠে গেলাম। ভাবলাম আবার আমার জীবনে হয়ত আসতে চলেছে নতুন এক গৃহযুদ্ধ।
হাসতে হাসতেই পৃষ্ঠা উল্টালাম,
মণিকা ভাবীর ডায়েরির শেষ পাতা।
শেষ পাতার লেখাগুলোর মাঝে অতিপ্রাকৃত কিছু আছে হয়ত। নইলে আমি এতবার পড়ছি কেনো!
শুধুমাত্র এ লেখাটুকুর জন্য প্রাণ গেছে অনেকের। ফুলী রবিন সহ অনেকেই হয়ত মণিকা ভাবীর শিকার হয়েছেন। আমার ধারণা ভাবীর নিজের স্বামীও খুন হয়েছেন তার হাতেই।
সবশেষে একটা বিষয় মনে হলো। পৃথিবীতে দু-ধরণের মানুষ পৃথিবীতে টিকে থাকে,
এক- যারা কাব্যের মত সুবিধাবাদী এবং ধূর্ত।
দুই- যারা আমার মত মুখোশের আড়ালে থাকে।
#সমাপ্ত

#গৃহযুদ্ধ – শেষ পর্ব
__________________

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে